somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

এপিটাফ

২৮ শে জুলাই, ২০১৮ বিকাল ৪:০৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আমার দিদার মৃত্যুবার্ষিকী কখনো আনুষ্ঠানিকভাবে পালন করা হয়নি। এবার টাইমিংটা ভালো ছিল, দিদার মৃত্যুর তারিখটা পড়ল ছুটির দিনে। বাবা মায়ের হাতে অবসর থাকায় তাই দিদার মৃত্যুবার্ষিকী পালন করতে আমরা গ্রামের বাড়ি গেলাম।
দিদা মানে আমার বাবার আম্মা। বাবার মাকে দিদা বলে- এই কথাটি পাঠকদের শিখিয়ে দিতে হবে না আমি জানি। কথাটি উল্লেখ করেছি অন্য কারণে। আমার পরিচিত জনদের মাঝে বাবার মাকে দিদা ডাকতে আমি কাউকে দেখিনি। সবাই দাদু বা দাদি বলে ডেকে থাকে। আমাদের পরিবারে ‘দিদা’ শব্দটি কিভাবে ঢুকেছে কে জানে। সেই ডাকে আমি অভ্যস্ত। বাবা মায়ের পর আমার সবচেয়ে আপনজন ছিলেন দিদা। আমার বাবা মা রুটিন অনুযায়ী প্রতিদিন সকালে কাজে চলে যেতেন, মা কখনো দুপুরে ফিরতেন, কখনো ফিরতেন বিকেল বেলায়। সারাদিন আমার একমাত্র সাথী ছিলেন দিদা। দিদার সাথে একা কত দিন যাপন করেছি, আশ্চর্যের ব্যপার হল সেই দিনগুলোর স্মৃতি অত ভালো করে মনে পড়ে না। তবে দিদার সাথে শেষদিন চোখাচোখি হবার স্মৃতিটি খুব ভালো করে মনে আছে।

আমার দিদা অসুস্থ, হাসপাতালে এক সপ্তাহ যাবত পড়ে আছেন। একদিন মা বাসায় এসে বললেন, চল তোর দিদাকে দেখতে যাবো। আমি তো মহাখুশি, মায়ের সাথে হাসপাতালে যাবো। মা তো আমাকে নিয়ে কোথাও যেতে পারেন না, আজ নিয়ে যাবেন। মায়ের সাথে খুশিমনে নাচতে নাচতে চলে গেলাম।
হাসপাতালের একটা কেবিনে সাদা বিছানার উপর দিদা চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছেন। মনে হচ্ছিল যেন তিনি গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। মাঝেমাঝে বড় বড় করে শ্বাস নিচ্ছেন। কেবিনের একপাশে বসে মা আর আন্টি (বাবার বড় বোন) নিচুস্বরে কথা বলছিলেন। অচিরেই আমার বিরক্তি এসে গেল। ভেবেছিলাম এখানে দিদা, আন্টি আর মা একসাথে বসে গল্প করবেন, আমি মাঝখানে বসে উনাদের আলাপ সালাপ দেখবো। কিন্তু এখানে এই একঘেয়ে পরিবেশ দেখে মন খারাপ হয়ে গেলো। চুপচাপ দিদার পাশে বসে রইলাম। মনে মনে অপেক্ষা করছি মা কখন বলবেন, চল যাই। অমনি আমি একলাফে এই রুম থেকে বের হয়ে বাসায় চলে যাবো। কিন্তু মা যেভাবে আন্টির পাশে গ্যাঁট হয়ে বসেছে, আজ তো মনে হয় সহজে ফেরা হবে না। মন খারাপ করে চুপচাপ ঘুমন্ত দিদার পাশে বসে রইলাম। কিছুক্ষণ পর দিদার গলার গোঙানির আওয়াজ শুনে দিদার দিকে তাকাই। দিদার এই আওয়াজ আমার পরিচিত, ঘুম থেকে জেগে উঠার আগে দিদার গলায় এরকম আওয়াজ হতে অনেক শুনেছি। সুস্থ থাকা অবস্থায় আমি যখন দিদার পাশে শুয়ে বা বসে থাকতাম তখন এই আওয়াজ শুনে বুঝতাম দিদার ঘুম শেষ হয়ে এসেছে, এখনি তিনি জেগে উঠবেন। স্বাভাবিকভাবে সেদিনও ভাবলাম দিদা এখন উঠবেন। কিন্তু না, তিনি উঠছেন না। আমি ডাক দিলাম, ‘দিদা’। দিদা তখনই চোখ মেলে আমার দিকে তাকালেন। ঘোলাটে চোখে আমার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন, তবে খুব অল্প সময়ের জন্য, হয়ত কয়েক সেকেন্ড হবে, তারপর আবার খুব স্বাভাবিকভাবে চোখ বন্ধ করে ফেললেন।
মা আর আন্টি কাছে এসে আমাকে ইশারা করলেন যেন কথা না বলি। আমি ভয় পেয়ে চুপ হয়ে গেলাম।
দিদার সাথে জীবনে আমার কত মাখামাখি ছিল, কতগুলো দিন ঘুম থেকে জেগেছি উনার মুখ দেখে, ঘুমিয়েছি তাঁর মুখ দেখে দেখে, সেই স্মৃতিগুলো মনে নেই । মনে আছে শুধু হাসপাতালে কয়েক সেকেন্ডের চোখ মেলে তাকানোর দৃশ্যটা । কি আশ্চর্য!
হাসপাতাল থেকে ফেরার পথে মায়ের কাছে জানতে চাইলাম দিদাকে কখন ফেরত আনা হবে। মা বলেছিলেন দিদা সেরে উঠলেই উনাকে আবার আমরা বাসায় নিয়ে আসবো । সুস্থ আর হননি, দুই দিন পর দিদা মারা গেলেন। আমার দিদা আর বাসায় ফিরেননি। দিদার বডি সোজা নিয়ে যাওয়া হয়েছিল আমাদের গ্রামের বাড়িতে, যেখানে তিনি এখনো আছেন। এবার তাঁর মৃত্যুর দিনটিতে আমরা সেখানে গেলাম।

সারাদিন দিদার বিদেহী আত্মার মাগফেরাতের জন্য অনেক কিছু করা হল। আমাদের বাড়িতে অনেক মানুষ এসেছিলো। সবাই মিলে খতম পড়ানো, দোয়া-কলমা, খাওয়া-দাওয়া অনেক কিছু হল।
দিনশেষে আবার আমাদের বাড়িটা নির্জন হয়ে গেলো।

মা বললেন চল তোর দিদার কবর দেখে আসি। মায়ের সাথে কবরস্থানের দিকে রওয়ানা হলাম। বৃষ্টিভেজা পিচ্ছিল পথ, সাবধানে মা মেয়ে দিদার কবরের কাছে হেঁটে গেলাম। দিদা এখানে অবশ্য একা নন, তাঁর পাশেই দাদাসহ আরও কয়েকজনের কবর আছে।
এতক্ষণ যা বললাম সব ছিল ভূমিকা। এবার আসল কথায় আসি, দিদার কবরের কাছে দাঁড়িয়ে আমার কেমন অনুভূতি হয়েছিল আজ সেটাই বলব।
দিদার কবরের উপর রূপালি পাতের একটি এপিটাফ আছে। আমি এপিটাফ পড়ছিলাম, এখানে শায়িত আছেন শ্রদ্ধ্যেয়....
আর পড়তে পারলাম না, দুচোখ ঝাপসা হয়ে এলো। চোখ মুছে আবার সেই রূপালি এপিটাফে তাকালাম, এপিটাফ আবার চোখের জলে ডুবে যায়।

দিদা আমাকে অনেক গল্প বলতেন। সেই গল্পের বেশিরভাগ ছিল ধর্মীয় গল্প। একদিন দিদা ইসরাফিল নামক এক বড় ফেরেশতার গল্প বলেছিলেন। সেই ফেরেশতার হাতে বিরাট এক বিউগল আছে। পৃথিবীর যেদিন আয়ু শেষ হয়ে যাবে আল্লাহ ইসরাফিলকে সেই বিউগল বাজাতে নির্দেশ দিবেন। ফেরেশতা তিনবার ফুঁ দিয়ে বাজাবেন। বিউগলের প্রথম সুরে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে। আর শেষবার যখন বাজবে তখন সব মানুষ পুনর্জীবন লাভ করবে। যে যেখানে শায়িত আছে সেখান হতে সোজা উঠে দাঁড়াবে। তারপর মানুষের বিচার হবে, বিচার শেষে সব ভালো মানুষ বেহেস্তে যাবে। মজার ব্যপার হল বেহেস্তে সবার বয়স হবে সমান। দিদা এবং তাঁর নাতনী দুজনেই যুবতী হয়ে যাবে। কারণ সেখানে তো কেউ আগে কেউ পরে জন্মাবে না, সবাই ইসরাফিলের বিউগলের সুর শুনে একই সময়ে নতুন জীবন শুরু করবে। বিউগলের সুর শুনে একই সময়ে আমি আর দিদা উঠে দাঁড়াবো, আমরাও সমবয়সী হয়ে যাবো। একদম বান্ধবীর মত! মজার ব্যপার, এই জীবনে যত না বলা কথা আছে আমি আর দিদা তখন সব বলতে পারবো। বয়সের কোন বাঁধা থাকবে না। কিন্তু সেই দিনটা কখন আসবে? মানুষ লাখো বছর ধরে মরছে, লাখো বছর তারা ইসরাফিলের সেই সুরের অপেক্ষায় কবরে শুয়ে আছে। মিশর, গ্রিস আর পারস্যের কত রাজা প্রজার চিহ্নিত কবর আজ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। আমার দিদার কবরের উপর যে এপিটাফ আমাদের ভালোবাসা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তা কত বছর থাকবে? পঞ্চাশ বছর? একশো বছর? ভাবতেই গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে, আমি নিজে কোথায় থাকবো একশো বছর পর?

মা পাশ থেকে বলে উঠেন, বৃষ্টি আসবে মনে হয়, যাওয়া উচিৎ।
মাকে বললাম, তুমি যাও, আমি একটু পরে আসছি ।

মা গেলেন না। তিনি আমার পাশে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন। হয়তো আমাকে এই নির্জন জায়গাতে একা রেখে যেতে তাঁর সাহস হচ্ছে না। আজ আমি বেঁচে আছি বলে মা আমাকে রেখে ফিরে যেতে চাইছেন না। যদি দিদার মত মরে যেতাম তখন ঠিকই এখানে রেখে চলে যেতেন। আমার উপর বৃষ্টি, রোদ, চাঁদের আলো সব পড়ত। আমার মাথার কাছে একটি এপিটাফে হয়তো লেখা থাকতো, এখানে শায়িত আছে স্নেহের...
আর ভাবতে পারি না, নিজের কবরের এপিটাফে কি লেখা থাকবে তা তো আমি দেখতে পাবো না। আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে সেটা দেখতে কেমন হবে। আমার চোখে যেন অশ্রুর বান ডাকে। ভেজা চোখে মায়ের দিকে তাকালাম। হঠাৎ মনে হয় যেন সামনে দাঁড়ানো আমার মা হলেন সেই না দেখা এপিটাফ। মায়ের কাঁধে কপাল ঠেকিয়ে দাঁড়াই, শ্রাবণের ধারার মত অশ্রুতে ভিজতে থাকে শুভ্র এপিটাফ।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৮ রাত ১০:৩০
১৫টি মন্তব্য ১৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আজকের ব্লগার ভাবনা: ব্লগাররা বিষয়টি কোন দৃষ্টিকোন থেকে দেখছেন?

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৯ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৪১


ছবি- আমার তুলা।
বেলা ১২ টার দিকে ঘর থেক বের হলাম। রাস্তায় খুব বেশি যে জ্যাম তা নয়। যে রোডে ড্রাইভ করছিলাম সেটি অনেকটা ফাঁকা। কিন্তু গাড়ির সংখ্যা খুব কম।... ...বাকিটুকু পড়ুন

সাপ, ইদুর ও প্রণোদনার গল্প

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ০৯ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৪৪

বৃটিশ আমলের ঘটনা। দিল্লীতে একবার ব্যাপকভাবে গোখরা সাপের উৎপাত বেড়ে যায়। বৃটিশরা বিষধর এই সাপকে খুব ভয় পেতো। তখনকার দিনে চিকিৎসা ছিলনা। কামড়ালেই নির্ঘাৎ মৃত্যূ। বৃটিশ সরকার এই বিষধর সাপ... ...বাকিটুকু পড়ুন

একাত্তরের সংগ্রামী জনতার স্লুইস গেট আক্রমণ

লিখেছেন প্রামানিক, ০৯ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৩:২১


(ছবির লাল দাগ দেয়া জায়গাটিতে গর্ত করা হয়েছিল)

শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

২৩শে এপ্রিল পাক সেনারা ফুলছড়ি থানা দখল করে। পাক সেনা এলাকায় প্রবেশ করায় মানুষের মধ্যে ভীতিভাব চলে আসে। কারণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাড়ির কাছে আরশিনগর

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ০৯ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৩:৫০


বাড়ির কাছে আরশিনগর
শিল্পকলা একাডেমির আশেপাশেই হবে চ্যানেলটার অফিস। কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজি করল মৃণাল। কিন্তু খুঁজে পাচ্ছে না সে। এক-দু'জনকে জিগ্যেসও করল বটে, কিন্তু কেউ কিছু বলতে পারছে না।

কিছুদূর এগোনোর পর... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি ভালো আছি

লিখেছেন জানা, ০৯ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৪৯



প্রিয় ব্লগার,

আপনাদের সবাইকে জানাই অশেষ কৃতঞ্গতা, শুভেচ্ছা এবং আন্তরিক ভালোবাসা। আপনাদের সবার দোয়া, সহমর্মিতা এবং ভালোবাসা সবসময়ই আমাকে কঠিন পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে শক্তি এবং সাহস যুগিয়েছে। আমি সবসময়ই অনুভব... ...বাকিটুকু পড়ুন

×