ফ্রিহ্যান্ড লস এঞ্জেলস হোটেলের বারে একা বসে মানুষজনের কর্মকান্ড দেখছিলাম। আমার পাশে চাইনিজ চেহারার এক মহিলা এসে বেশ আয়েশ করে বসলেন। তারপর গ্লাসভর্তি লাল রঙের পানীয় নিয়ে চুমুক দিতে লাগলেন। আমি মুগ্ধ দৃষ্টিতে তার মদ খাওয়া দেখছি। বয়স কত হতে পারে? খুব বেশি হলে ত্রিশ! এর বেশিও হতে পারে, আমি আবার মানুষের বয়স সহজে অনুমান করতে পারি না।
আমার দিকে তাকিয়ে চাইনিজ বলে উঠলেন, ‘হেই গোলমুখওয়ালী, কি খবর?’
সম্বিৎ ফিরে পেয়ে আমি বলি, ‘ভালো, তোমার কি খবর?’
-হ্যাঁ ভালোই। তুমি ড্রিংক করছ?
-না, করছি না।
-ওহ, তাই তো দেখছি। কারো জন্য অপেক্ষা করছ?
-না তাও নয়।
চাইনিজ চেহারা হাসি দিয়ে বলল, ড্রিংক করছ না, কারো অপেক্ষাতেও নেই, তো কি করছ তুমি?
আমি কিছুটা লজ্জা পেলাম। তবুও পাল্টা হাসি দিয়ে জানাই, আমি আসলে মানুষ দেখছি। মুভিতে আমেরিকান পাব আর বারের দৃশ্য অনেক দেখেছি। আজ স্বচক্ষে দেখছি, এই যা।
-ওহ, ঘটনা এটাই। বুঝেছি আমি। কোন দেশ থেকে? ইন্ডিয়া?
-না না, আমি ইন্ডিয়ান নই, বাংলাদেশি। বাংলাদেশ চেনো না?
-কেন নয়? আমরা তো বাংলাদেশের কাছের দেশ। থাইল্যান্ড। তোমাদের চেহারা ভারতীয়দের মত, আর এখানে তো ভারতীয়দের বেশি দেখা যায়, তাই তোমাকেও আমি ভারতীয় মনে করেছি। ভারতীয় বলায় খুব রিয়েকশন দেখিয়েছ, আঘাত পেলে নাকি?
আমি হেসে বলি, নাহ, ব্যপার না। এই দেখো আমিও তোমাকে চেহারার কারণে চীনা মনে করেছিলাম।
আমার হাসিতে থাই মহিলাও যোগ দিলেন। হাসি থামিয়ে বলল, ঠিক আছে, মানুষ দেখো। তবে একটা ড্রিংক নিয়ে মানুষ দেখো। এতে মজাটা বেশি পাবে।
-নাহ প্রিয়, আমি আসলে এলকোহলে অভ্যস্ত নই।
-আহা বাংলাদেশি, মদই খেতে হবে কে বলল? একটা সফট ড্রিংক ট্রাই করে দেখো।
-এখানে সফট ড্রিংক আছে?
থাই নারী হাসিতে মুখর হয়ে উঠে, সফট ড্রিংক থাকবে না কেন? মনে হয় লোকটাকে তুমি সফট ড্রিংকের কথা জিজ্ঞেস করেও দেখনি।
আমি লজ্জিত কণ্ঠে বলি, আসলে এই বারে ড্রিংকের যত বোতল দেখছি সবই তো মদের বোতল মনে হচ্ছে। তাই আমি ভেবেছিলাম সফট ড্রিংক থাকবে না।
বারটেন্ডারকে ডেকে থাই নিজেই সফট ড্রিংক নিয়ে নিল। সফট ড্রিংক মানে পেপসি। প্রথম চুমুক দিয়ে মনে হল- আরে, এই পেপসি তো আমাদের দেশের পেপসির চেয়ে বেশি মজা! তবে পরের চুমুকে আর বেশি মজা মনে হল না। একই তো জিনিস।
থাই বলল, ও বাংলাদেশি। তোমার নাম এখনো বলনি। কি নাম তোমার?
-হৃদি। তুমি হৃদি বলতে পারো।
-সুন্দর নাম তো। আমি সিরিকিত দাউ। দাউ বলে পরিচিত হই সবার কাছে।
কি খটমটে নাম। তবুও সৌজন্য দেখিয়ে বললাম, তোমার নাম খুব চমৎকার।
দাউ বলল, তোমার কি বয়ফ্রেন্ড আছে?
কি আশ্চর্য! শুরুতেই এই কথা বলে ফেলে কেউ? আমি লজ্জা কাটিয়ে বলি, হ্যাঁ আছে। জিশান তার নাম। তবে আমাদের দেশের বয়ফ্রেন্ড আর আমেরিকা ইউরোপের বয়ফ্রেন্ড এক রকম নয়। আমাদের দেশে আমরা মেয়েরা কোন ছেলেকে বিয়ের জন্য পছন্দ করলে তাকে বয়ফ্রেন্ড মনে করতে পারি। বয়ফ্রেন্ডের সাথে বাংলাদেশি মেয়েরা সব ধরনের সম্পর্ক রাখে, তবে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনের জন্য বিয়ে হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। আমরা এ ব্যপারে একটু রক্ষণশীল।
থাই নারী দাউ মুচকি হেসে বলল, জানি আমি। মালয় মেয়েরাও এরকম। তোমার বয়ফ্রেন্ডের ছবি দেখাতে পারবে?
-হ্যাঁ অবশ্যই। আমি মোবাইলে জিশানের ছবি বের করে দাউকে দেখাই। দাউ প্রসন্ন চোখে বলল, ওয়াও, খুব স্মার্ট ছেলে! আমার মনে হয় সে ভালো কোন পেশাতে আছে!
আমি হেসে বলি, তোমার ধারণা মন্দ নয়। সে ট্যাক্স ক্যাডার।
-ট্যাক্স ক্যাডার ব্যপারটা বুঝিনি।
ওহ নো। এই মহিলাকে আমি এখন কিভাবে বুঝাই ট্যাক্স ক্যাডার জিনিসটা কি রকম। মুচকি হেসে বললাম, আমাদের দেশে ট্যাক্স এর সাথে রিলেটেড একটা বড় সরকারী ডিপার্টমেন্ট আছে। জিশান, মানে আমার বয়ফ্রেন্ড, সেই ডিপার্টমেন্টে যোগ দিয়েছে। এখন সেটাই তার পেশা। এটা লোভনীয় একটা পদবী বলতে পারো।
-বুঝেছি। তো বাংলাদেশি, শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনের জন্য আর কতদিন অপেক্ষা করবে? বুঝতে পারছো কি বলেছি।
আমি হেসে উত্তর দিই, আমি বুঝেছি। বাংলাদেশে ওর একটা ট্রেনিং চলছে সেটা শেষ হলেই আমাদের বিয়ে হতে পারে। বেশিদিন লাগবে না, বড়জোর চার মাস। দেশে ফিরে গেলেই বিয়ে হয়ে যেতে পারে।
-ওহ আচ্ছা। মানে তুমি কয়েক মাসের জন্য এখানে বেড়াতে এসেছো?
-ঠিক। আমি আমার ভাইয়ের কাছে এলাম। বেড়ানো শেষ হলে আমার ভাই, ভাইর স্ত্রী এবং তাদের বাচ্চাদের নিয়ে বাংলাদেশ ফিরে যাবো। আমার ভাই ভাবি বিয়ের অনুষ্ঠানে থাকবেন, এরকম প্ল্যান আছে। আচ্ছা আমার সম্পর্কে অনেক কিছু জানলে, তোমার কিছু বলবে না? তোমার বয়ফ্রেন্ড আছে?
-আমি বয়ফ্রেন্ড দিয়ে কি করবো? আমি তো বিবাহিতা নারী। আমার স্বামী আছে।
-ওহ দুঃখিত। তুমি বিবাহিতা জেনে ভালো লাগলো। তোমার স্বামী কি করে?
-এখন সে তার বাবার শস্য খামারে চাষবাস করে। আগে আমেরিকান সেনাবাহিনীতে মেজর ছিল।
-ওয়াও, সেই মেজরকে তুমি বাগে আনলে কিভাবে বল তো।
-আমি ওকে বাগে আনিনি, সে নিজেই আমাকে বাগিয়ে নিয়েছিল। এসব শুনে তোমার ভালো লাগবে না। অন্য প্রসঙ্গে কথা বলি।
-না, দয়া করে মেজরের কথাই বল, আমি এটা শুনতে খুব আগ্রহী।
-তুমি কি লম্বা কাহিনী শুনতে চাও?
-হ্যাঁ অবশ্যই। আমার ভালো লাগবে।
দাউ আমার গ্লাসের দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি কি ড্রিংক উপভোগ করতে পারছ না? এতো ছোট চুমুক দিয়ে পান করছ মনে হচ্ছে যেন খুব গরম কফি খাচ্ছ। এই গ্লাস শেষ হতে তো এতো সময় লাগার নয়।
-আমি সত্যিই উপভোগ করছি। আসলে ছোট চুমুক দিয়ে খাচ্ছি কারণ আমার কোন তাড়া নেই। আমার হাতে তোমার গল্প শোনার মত যথেষ্ট সময় আছে। দয়া করে বল আমাকে।
দাউ আরেক গ্লাস লাল পানি নিল। ওর ভাবসাব দেখে মনে হচ্ছে সে আমাকে লম্বা একটা সময় দিতে প্রস্তুতি নিচ্ছে। লাল পানিয়ের গ্লাসে এক চুমুক দিয়ে দাউ বলল, আমি থাইল্যান্ডে খুব অল্প বয়স হতেই টাকা কামানো শুরু করেছিলাম। চিয়ার লিডার হিসেবে আমার জীবন শুরু হয়। চিয়ার লিডার বালিকারা কৌশলে অনেক টাকা আয় করতে পারে। আমিও অনেক করেছি। কিন্তু টাকা কখনো জমিয়ে রাখতে পারিনি। কোন না কোনভাবে আমার টাকা খরচ হয়ে যেত।
দাউ তার গ্লাসে দ্বিতীয় চুমুক দিল। গলা ভিজিয়ে নিয়ে আবার শুরু করল, আমি কত কাজ করেছি, কত পেশা নিয়েছি জানো? ব্যাংককের এক নামকরা হোটেলে স্পা এর কাজও করেছি। যখন যা সুবিধা মনে হত তাই করতাম। স্পা এর কাজেই একদিন আমেরিকান মেজরের সাথে পরিচয় ঘটেছিল। সে তখন মেজর ছিল না, ক্যাপ্টেন ছিল। তার নাম রবার্ট লিসন। থাই-আমেরিকান সেনাবাহিনীর যৌথ মহড়ার কাজে ব্যাংকক যায়। একদিন সে স্পা নিতে আসে, আর তার সাথে দেখা হয়ে যায় আমার। লিসন আমাকে দেখে পছন্দ করেছিল। শুধু স্পা নিয়েই সে তৃপ্ত হল না। আমার আরও অনেক সেবা নিল সে। আমার আর তার ভালো সম্পর্ক গড়ে ওঠে। বেশিদিন লিসন ব্যাংকক ছিল না। আমার সাথে দেখা করার জন্য আসা যাওয়া করার সুযোগও বেশি ছিল না তার। তবে যখনি সুযোগ পেত চলে যেত আমার কাছে। ব্যাংককের কাজ শেষে লিসন আমেরিকা ফিরে আসে। চলে আসার পরেও আমার সাথে সে নিয়মিত যোগাযোগ রাখত। আমিও তার সাথে যোগাযোগ ধরে রাখতে আগ্রহী ছিলাম, একজন আমেরিকান খদ্দের কে হারাতে চায় বল। এরপর খবর পেলাম লিসন পদোন্নতি লাভ করে মেজর হল। ২০০৪ সালে সে ইরাক যায়। পরের বছরেই জঙ্গিদের সাথে এনকাউন্টারে ডান পা হারিয়েছে। পঙ্গু মেজর লি আমেরিকায় ফিরে সরকার থেকে মেডেল অব অনার পায়। আমি সব জানতাম। মাঝে মাঝে লম্বা বিরতি থাকলেও আমার আর লির যোগাযোগ অব্যাহত ছিল। পঙ্গু হয়ে ঘরে পড়ে থাকার মত লোক নয় লি। তার বাবার বড় র্যানশ আছে। সেখানে গিয়ে ভুট্টা চাষ শুরু করে। একদিন ফেসবুকে লি আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। আমি তো মহাখুশি। একজন আমেরিকান ভেটেরানের স্ত্রী হব। আমেরিকার নাগরিক হব। এ তো আমার জীবনের বড় প্রাপ্তি। সবকিছু ছাপিয়ে, অন্য লোকদের অপবিত্র কামুক দেহ ঘষাঘষি করতে হবে না আমাকে। আমি লির প্রস্তাবে অনতিবিলম্বে রাজি হয়ে যাই। চলে এলাম আমেরিকা। লির সাথে বসবাস শুরু করি। তারপর প্রায় ছয় মাস পর বিয়ে হল আমাদের।
লম্বা কাহিনী বলে দাউ আবার তার থাই ঠোঁট লাল তরলে ডুবিয়ে নেয়। আমি বুঝতে পারছি দাউ আরও কিছু বলবে। প্রায় ত্রিশ সেকেন্ড বিরতি দেবার পর দাউ শুরু করল, এটাই কিন্তু শেষ নয়। আমি অচিরেই দেখতে পেলাম আরও অনেক আমেরিকান পঙ্গু সেনা থাই মেয়েদের বিয়ে করেছে। প্রকৃতপক্ষে, ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় থেকে আমেরিকান সেনাদের মাঝে এই ট্র্যাডিশন চালু হয়েছে। যে আমেরিকান সেনারা থাইল্যান্ড হয়ে ভিয়েতনাম আসা যাওয়া করতো তারা সুযোগ বুঝে কোন এক থাই প্রস্টিটিউটের সাথে ভাব জমিয়ে নিত। তারপর আমেরিকান সেনা শেষ বয়সের কাছাকাছি এলেই পরিচিত সেই থাই হোরকে বিয়ের প্রস্তাব দিত। থাই মেয়েগুলো খুশি হয়ে রাজি হয়ে যায়, রাজি কেন হবে না বল, সামনে তাদের আমেরিকান উন্নত জীবনের হাতছানি। তাই মাতৃভুমি ছেড়ে বৃদ্ধ কিংবা পঙ্গু আমেরিকানের সাথে এদেশে চলে আসে। আমিও এরকম এক নারী।
দাউ তার ঠোঁট আবার রেড ওয়াইন দিয়ে ভেজালো। তার ফর্সা মুখ লাল হয়ে গেছে, বুঝলাম না, লাল ওয়াইন কি তার চেহারাও লাল করে দিতে পারে?
দাউ আবার বলল, তুমি জানো? থাই মেয়েরা স্বামীভক্ত হয়। থাই মেয়েদের এই দুর্বল চিত্তটিকে আমেরিকান বুড়োরা কাজে লাগাচ্ছে। তারা শেষ বয়সে একটা স্থায়ী সেবিকা পাবার আশায় থাই মেয়েদের শিকার করে নেয়। আমিও একজন সেবিকা। আমার সাথে লির বয়সের ব্যবধান মাত্র বারো বছর, ভাবতে পারো? জীবন শুরু করেছিলাম চিয়ারলিডার হিসেবে, আমার মনে হয় যেন আমার একটুও উন্নতি হয়নি, আমি এখনো চিয়ারলিডার রয়ে গেছি।
[এই গল্প সম্পুর্ন কাল্পনিক, জীবিত বা মৃত কোন ব্যক্তির সাথে এই গল্পের কোন বাস্তব সম্পর্ক নেই। ব্লগার ভুয়া মফিজ ভাইয়া আমাকে লস এঞ্জেলস শহর নিয়ে একটা কাল্পনিক ভ্রমণকাহিনী লিখতে বলেছিলেন। আমি তাঁর চ্যালেঞ্জ নিয়ে বলেছিলাম ভ্রমণকাহিনী লিখব। দুঃখিত জনাব ভুয়া ভাইয়া, পারলাম না। এরকম ভ্রমণকাহিনী লিখতে অনেক কিছু জানতে হয়, অনেক ভাবতে হয়। আমি পারলাম না। তবে একদম ছেড়ে দিতেও মন চাইলো না। তাই এই কাল্পনিক গল্পটি লিখেছি। ভাষাগত এবং তথ্যগত কোন ত্রুটি পেলে পাঠকগণ ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন, আশা করি।]
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৮ রাত ৯:০৩