মুক্তমনায় গত ২৯ আগস্ট ব্লগার নি:সঙ্গ বায়সের “প্রসঙ্গ আদিবাসী: কিছু প্রশ্নের উত্তর খোঁজা….” (http://mukto-mona.com/bangla_blog/?p=18389) শিরোনামে একটা লেখা চোখে পড়লো। লেখকের লেখার শিরোনামে “কিছু প্রশ্নের উত্তর খোঁজা” থাকলেও প্রশ্ন তেমন দেখিনি। তাই উত্তরও বেশি চোখে পড়েনি। তবে তিনি “আদিবাসী” প্রসঙ্গ নিয়ে ইতিবাচক মনোভঙ্গি নিয়ে লিখেছেন। মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করেছেন। সেজন্যে ব্লগার নি:সঙ্গ বায়সকে ধন্যবাদ জানাই। ব্লগার নি:সঙ্গ বায়স-এর লেখা থেকে দু’টো বিষয় তুলে নিলাম। একটা হলো, “আদিবাসী” কেন্দ্রিক বিতর্ক, আর অন্যটা হলো পূর্ব তিমুর ও দক্ষিণ সুদানের সাথে পার্বত্য চট্টগ্রামের তুলনা। এ দু’টো বিষয়ের উপর আমার কথাগুলো পাঠক ও ব্লগার ভাইবোনদের কাছে তুলে ধরতে চাচ্ছি। আশা করি, তারাও পড়বেন আর আলোচনায় অংশ নেবেন।
আদিবাসী প্রসঙ্গে
আদিবাসী কারা - এ ব্যাপারে সংজ্ঞা খুঁজা অনর্থক। কোন জাতির সংজ্ঞা খুঁজাও অনর্থক। বাংলাদেশ সরকার তথা তথাকথিত বাঙালি সুশীল সমাজের একটা বড় অংশ এ অনর্থক কাজ নিয়ে মশগুল হয়ে আছে। অপ্রয়োজনীয়ভাবে বিতর্ক টেনে এনে বা কুটতর্ক সৃষ্টি করে পরিস্থিতি অন্যরকম করতে চাচ্ছে। এ কুটতর্কে খুব বেশি কান দেওয়ার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না। আর “আদিবাসী” ধারণা নিয়ে তাত্ত্বিক আলোচনায় যাওয়ার প্রয়োজন নেই। সব কথার এক কথা, কারা আদিবাসী আর কারা আদিবাসী নয়, সেটা সংশ্লিষ্ট জনগণই ঠিক করবে। এখানে সরকার বা অন্য কেউ জোর করে কোন পরিচিতি চাপিয়ে দেবে, আমরা বিনা বাক্য ব্যয়ে মেনে নেবো – সে চিন্তাটাই ভুল। সেই ভুলটা করছেন বাংলাদেশ সরকার ও মৌলবাদী ও তথাকথিত বাঙাল বুদ্ধিজীবিদের একটা বড় অংশ। আর কারোর উপর জোর করে পরিচিতি চাপিয়ে দেওয়াটাও অনধিকার চর্চা। সরকার বা তথাকথিত বাঙাল বুদ্ধিজীবিদের ঐ অংশ এই অনধিকার চর্চাটা করতে চাচ্ছেন।
এখানে আরো একটা কথা বলা ভালো, যারা এখন “আদিবাসী”, “উপজাতি” ইত্যাদি নিয়ে আবোল তাবোল বকছেন, আর আদিবাসী স্বীকৃতি দিলে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ক্ষুন্ন হবে ইত্যাদি যুক্তি দাঁড় করাতে চাচ্ছেন, তাদের উদ্দেশ্য কখনো সৎ ছিলো না। এখনো সৎ উদ্দেশ্য নিয়ে “উপজাতি” বা “আদিবাসী” শব্দ নিয়ে কথা বলছেন না। বরং তারা শব্দগত ধাঁধা বা শব্দ নিয়ে ভেলকিবাজী খেলতে চাচ্ছেন।কয়েকটা উদাহরণ দিলে বিষয়টা পরিস্কার হয়ে যাবে।
১) আদিবাসী শব্দটি বাংলাদেশে নতুন নয়। অনেক আগে থেকেই বিভিন্ন আইনে আদিবাসী শব্দ ছিলো এবং এখনো বাংলাদেশে প্রচলিত অনেক আইনে লেখা আছে। যেমন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি ১৯০০’, ‘বঙ্গীয় প্রজাসত্ত্ব আইন ১৯৫০’, ও আয়কর সংক্রান্ত আইন। এসব আইনে indigenous hillmen ও aboriginals লেখা আছে। এসব শব্দের বাংলা অনুবাদ “আদিবাসী” লেখা হয়। indigenous hillmen শব্দদ্বয়ের কারণে আয়কর আইনে আওতায় পার্বত্য অঞ্চলের মানুষকে এখনো আয়কর দিতে হয় না। আরো অনেক সরকারী দলিলে আদিবাসী লেখা আছে। যেমন, দারিদ্র বিমোচন কৌশলপত্র। এছাড়া বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা আদিবাসী দিবস উপলক্ষে আদিবাসীদের অনেকবার শুভেচ্ছা জানিয়েছিলেন। তাই এখন “আদিবাসী নেই” বলাটা হলো সরকারের বা তথাকথিত বাঙাল বুদ্ধিজীবিদের ভাওতাবাজী ও ভন্ডামি ছাড়া আর কিছুই নয়।
২) বাংলাদেশের সমগ্র তথাকথিত “উপজাতি”দের আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি দিলেও বাঙালরা বহিরাগত হয়ে যাবে না। কারণ, জনবল, ধনবল, সামরিক বল, রাষ্ট্রক্ষমতা - সব বাঙালদের হাতে। অর্থাৎ পুরো রাষ্ট্রক্ষমতা বাঙালদের হাতে। কাজেই আদিবাসীরা তাদের ক্ষীণ বল নিয়ে বাঙালদের রাষ্ট্র থেকে কিছু একটা খাবলে ছিনিয়ে নিতে পারবে - এমন ধারনা যারা নিজেদের মনের মধ্যে পোষণ করেন, তাদের মানসিক সুষ্ঠুতা বা মানব উপযোগী যৌক্তিকতা (human rationality) নিয়ে বড়ই সন্দেহ হয়। মানুষকে যে যুক্তিবাদী প্রাণী বলা হয়, তারা সেই যুক্তিবাদী প্রাণী বর্গের মধ্যে পড়ে কী না তা নিয়েও সন্দেহ জাগে।
৩) বিভিন্ন অজুহাতে যারা আদিবাসী মানতে নারাজ তাদের উছিলার শেষ নেই, কোন কালে শেষ হবেও না। একটার পর একটা বের করতে থাকবে। তারা আসলে কখনো “আদিবাসী”, “উপজাতি” বা অন্য কোন দাবী মানেন না, মানবেনও কেবল বাঙালদের দাবী ছাড়া। এ বিষয়টা ঐতিহাসিকভাবে পরিস্কার। যেমন, দেখুন ১৯৭২ সালে জেএসএস-এর প্রতিষ্ঠাতা ও তঃকালীন সংসদ সদস্য (বলা যায় একমাত্র বিরোধীদলীয় সদস্য) এম এন লারমা যখন সংসদে দাঁড়িয়ে “উপজাতি” হিসেবে সংবিধানে স্বীকৃতি চাইলেন, তখন বাঙালি নেতারা এম.এন লারমাকে তিরস্কার করেছিলেন। তারা “উপজাতি” মানতে রাজী ছিলেন না। শেখ সাহেব ও তার দলের নেতারা (বর্তমান সংসদ উপনেতা সাজেদা চৌধুরীও ছিলেন) এম এন লারমাকে বললেন, “তোরা উপজাতি না। তোরা বাঙালি জাতির অংশ।মানে সবাই “বাঙালি”। এম.এন লারমা বোঝাতে চাইলেন, “আমরা বাঙালি নয়, বাপ দাদা চৌদ্দপুরুষ কেউ বলেনি আমরা বাঙালি”।তিনি জোর দিয়ে বললেন, “আমরা বাংলাদেশী”। একথা বলাতে তৎকালীন আওয়ামীলীগের নেতারা এম.এন লারমাকে সংসদে তুলো ধুনো করেছিলেন। এক এমপি তো (বর্তমান পাটমন্ত্রী আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী) রীতিমত অসৌজন্যমূলকভাষায় সংসদে এম.এন লারমাকে হুমকি দিয়েছিলেন।ফলে তৎকালীন স্পীকারকে তার বক্তব্য একপাঞ্জ করতে হয়েছিলো। এই হলো ইতিহাসের কথা।
এম. এন লারমার সেই “উপজাতি” হিসেবে স্বীকৃতি চাওয়ার দাবী তৎকালীন বাঙাল নেতারা মানেননি। শেখ সাহেব রাঙামাটির এক সভায় বলেছিলেন, “আজ থেকে তোমাদের উপজাতি থেকে [বাঙালি] জাতিতে প্রমোশন দিলাম”। সংবিধানে ৬ অনুচ্ছেদে “বাংলাদেশের সকল নাগরিক বাঙালি বলিয়া পরিচিত হইবেন” অন্তর্ভুক্ত করে শেখ সাহেবের উক্তি পুরোপুরি বাস্তবায়িত করা হয়।
এরপর এম.এন লারমা জেএসএস নামক রাজনৈতিক দল গঠন করে জুম্মজাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে পাহাড়ী জনগণকে সংগঠিত করলেন। “জুম্ম” হিসেবে স্বীকৃতির দাবী করলেন। বলে রাখা ভালো, “জুম্ম” শব্দটা চট্টগ্রাম অঞ্চলের বাঙালরা গালি হিসেবে ব্যবহার করতো।এই গালি যখন আত্মপরিচিতির একটা ভিত্তি পেলো তখন বাঙাল রাষ্ট্রের নেতারা কী বললেন? বাঙাল নেতারা ও তথাকথিত বুদ্ধিজীবীরা ধুঁয়া তুলতে লাগলেন, “না, জুম্ম হলো চাকমা শব্দ। আর এ শব্দের কোন ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই। তাছাড়া জুম্ম শব্দটি একটি সেকেলে ও আদিম চাষ পদ্ধতি থেকে নেওয়া হয়েছে। কাজেই পাহাড়ের মানুষ “জুম্ম” হিসেবে পরিচিতি পাবে সেটা মেনে নেওয়া যায় না। তাদেরকে আমেরিকার রেড ইন্ডিয়ানদের মত খোঁয়াড়ে আবদ্ধ রাখা হবে - এটা আধুনিক (?) বাংলাদেশ রাষ্ট্রে সম্ভব হতে দেওয়া যায় না। দেখুন তো কী যুক্তি!
ব্যাস, কী আর করা জুম্মদের! বাঙালরা “উপজাতি” মানে না, “জুম্ম”ও মানে না। তাহলে কী মানে?
শেষমেশ ’৯০-এ এসে পাহাড় ও সমতলের মানুষের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপিত হতে লাগলো। ক্রমে সেটা আরো সুদৃঢ় হতে লাগলো। সাংগঠনিক কাঠামোর মধ্যে এসে তারা জড়ো হতে লাগলো। বিভিন্ন সংগঠন হতে লাগলো। সমতলের লোকরা নিজেদের আদিবাসী বলে পরিচয় দিতে পছন্দ করে। অন্যদিকে পাহাড়ের লোকজন “পাহাড়ী” বা “জুম্ম” হিসেবে পরিচয় দিতে পছন্দ করে। কিন্ত একটা জায়গায় একটু সমস্যা দেখা দিচ্ছিলো। ‘আদিবাসী’ বললে পাহাড়ের লোকজন বিশেষ করে নতুন প্রজন্ম কেমন কেমন করতো, অন্যদিকে ‘পাহাড়ী’ বা ‘জুম্ম’ বললে সমতলের লোকজন বাদ পড়ে যায়। কিন্তু একত্রিত হওয়ার তো একটা জায়গা লাগবে। শেষমেশ পাহাড়ের নেতারা দেখলো, আদিবাসী বা indigenous বা aboriginals শব্দ তো অনেক আগে ছিলো। কাজেই আদিবাসী পরিচিতির মধ্যে কোন আপত্তি থাকার কথা নয়। পাহাড়ের “জুম্ম” জনগণ “আদিবাসী” শব্দটা মেনে নিলো। পাহাড়-সমতলের ঐক্য হলো। পরে “আদিবাসী” পরিচিতি সবার গ্রহণযোগ্যতা পেয়ে গেলো। আদিবাসী ব্যানারে বাংলাদেশের সকল তথাকথিত “উপজাতিরা” একত্রিত হতে লাগলো। এক স্বরে “আদিবাসী” হিসেবে সংবিধানে স্বীকৃতির দাবী জানাতে লাগলো। এই ন্যায্য দাবীর প্রতি দেশে বিদেশে ব্যাপক সমর্থন পাওয়া গেলো। এখনো আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে।
এই “আদিবাসী” দাবী যখন জোরালো হলো, তখন বাঙাল নেতারা, আমলা-সেনাতন্ত্র ও বাঙাল বুদ্ধিজীবিদের একটা অংশ প্রশ্ন করতে লাগলেন, “ওরা আদিবাসী হবে কেন? আমরাই আসল আদিবাসী। ওরা তো বাইরে থেকে এদেশে এসেছিল অর্থনৈতিক অভিবাসী হিসেবে”। “উপজাতি” মানেন না, “জুম্ম” মানেন না, এখন “আদিবাসী”ও মানেন না। ব্যাস, আর কী করা আদিবাসীদের! এখন পররাষ্ট্রমন্ত্রী, আইনমন্ত্রী থেকে শুরু করে সরকারে প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত আদিবাসী মানেন না। সরকারীভাবে বলা হচ্ছে, “বাংলাদেশে আদিবাসী নেই, যারা আছে সবাই উপজাতি”। হা! হা! ‘উপজাতি’ হিসেবে যদি মানেন, তাহলে ‘৭২ সালে মানেননি কেন? তখন ‘উপজাতি’ থেকে বাঙালি জাতিতে প্রমোশন দিতে গেলে কেন? হায়রে বাঙাল নেতারা, হায়রে বাঙাল বুদ্ধিজীবিরা!
পাঠক বন্ধুরা, উপরের কিছু উদাহরণ টানলাম। এসব উদাহরণ থেকে এখন আপনারাই বলুন, বাঙাল নেতারা বা বাঙালরা আসলে কোন শব্দটা মানেন? “উপজাতি”, নাকি “আদিবাসী”? নাকি অন্যকিছু? [অবশ্য সরকার আরো একটি শব্দের প্রতি স্বীকৃতি দিয়েছে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী। এই শব্দটা যদি আগে থেকে “উপজাতিরা” গ্রহণ করতো তাহলে কী সরকার মেনে নিতো?]
পূর্ব তিমুর ও দক্ষিণ সুদান প্রসঙ্গে
ব্লগার নি:সঙ্গ বায়স এক জায়গায় প্রশ্ন করেছেন,
“সাম্প্রতিক অনেক ঘটনা দেখেই আমি একটু চিন্তিত আসলে আমেরিকা-জাতিসংঘের পলিসি কি?! সুদান-দক্ষিন সুদানের ঘটনাটাই দেখুন…”
নিজের প্রয়োজনে বাংলাদেশও এক সময় জাতিসংঘের স্বীকৃতি পেতে কত দৌঁড়-ঝাঁপ দিয়েছিলো। বলা যায়, দিতে হয়েছিলো। কেননা, তখন দুই পরাশক্তি আমেরিকা ও চীন বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে ছিলো না। চীন তো শেখ সাহেবের মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি। চীনের তখন যুক্তি ছিলো, তারা পাকিস্তানের সার্বভৌমত্বের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। অর্থাৎ চীন তখন যুক্তি দিয়েছিলো, চিরাচরিত বে-উপনিবেশিকরণ প্রক্রিয়ায় (conventional decolonization process) বাংলাদেশ স্বাধীন হয়নি। সে যাক, অনেক লম্বা কথা হয়ে যাবে।আর আমেরিকা-জাতিসংঘের পলিসি কী সেটা নিয়েও আলোচনায় যাওয়ার সুযোগ এখানে নেই। এখানে আলোচ্য বিষয় হলো, পূর্ব তিমুর ও দক্ষিণ সুদানের সাথে পার্বত্য চট্টগ্রামের তুলনা। ইদানিং অনেক বিশেষ[অ]জ্ঞ আশংকা প্রকাশ করে বলা শুরু করেছেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম যেন পূর্ব তিমুর ও দক্ষিণ সুদান না হয়। তাদের মধ্যে আছেন এক সময়ের কুখ্যাত সেনা কর্মকর্তা মেজর জেনারেল (অব সৈয়দ ইব্রাহিম। তার কথার প্রতিধ্বনি মাঝেমাঝে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নিরপাত্তা সংক্রান্ত সভা থেকেও বের হয়। বুঝতে অসুবিধা নেই, কার উর্বর মাথা থেকে পূর্ব তিমুর ও দক্ষিণ সুদানের চিন্তা বের হচ্ছে। সে যা হোক, কেউ পার্বত্য চট্টগ্রামকে পূর্ব তিমুর ও দক্ষিণ সুদানের সাথে তুলনা করে ব্যক্তিগতভাবে আমার বেশ ভালো লাগে। কেননা, ঐসব কথাবার্তা থেকে বাঙাল এলিটদের পার্বত্য চট্টগ্রামের ব্যাপারে দৃষ্টিভঙ্গি খুঁজে পাওয়া যায়।
নি:সঙ্গ বায়স আরো প্রশ্ন করেছেন,
“…ওখানে মানুষে মানুষে যে সংঘাত তৈরি হয়েছে, জাতিগত যে অনাস্থা তৈরি হয়েছে, তার কিন্তু বস্তুগত ভিত্তি ঐ দেশগুলোতেই ছিলো, তৈরি করা হয়েছিলো, একদিন না, অনেকদিনের প্রচেষ্টায়; কিন্তু এখন লাভটা হচ্ছে কার? ঐ দেশের জনগণের নাকি সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ইঙ্গ-মার্কিনীদের?!”
বায়স সাহেবের মত, আমারও প্রশ্নঃ পার্বত্য চট্টগ্রামকে পূর্ব তিমুর ও দক্ষিণ সুদানের সাথে তুলনা করলে কার লাভ হবে? কার স্বার্থে এই তুলনা? দেশের স্বার্থে নাকি কিছু বাঙালের কোটারি স্বার্থে? ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, এ তুলনা দিয়ে কিছু সময়ের জন্যে উত্তেজনা সৃষ্টি করা যায়, মানুষকে বিভ্রান্ত করা যায়, কিন্তু সেখানে সমাধানের সূত্র খুঁজে পাওয়া যায় না। আর পার্বত্য চট্টগ্রামকে পূর্ব তিমুর ও দক্ষিণ সুদানের সাথে তুলনা করাও বাঙাল এলিটদের একধরনের ন্যাকামি, যার মাধ্যমে তারা দেখাতে করতে চায় তারা অনেককিছু জানে। আসলে তাদের জানার মধ্যে কত গোঁজামিল আছে তা তারা জানেন না। পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে দক্ষিণ সুদান ও পূর্ব তিমুরের ইতিহাস সম্পূর্ণ ভিন্ন। লম্বা ইতিহাস অবতারণা করার সুযোগ এখানে নেই।তবে তাদের জানা উচিত, সামরিক শাসন, দমনপীড়ন ও অত্যাচারের পথ ধরে ইন্দোনেশিয়া ও সুদানের শাসকরা রাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করেছিলো বলে, মানুষের আশা-আকাংখাকে নির্যাতনের স্টীমরোলারে পিষ্ট করেছিলো বলে পূর্ব তিমুর ও দক্ষিণ সুদান আজ স্বাধীন।
পূর্ব তিমুর প্রসঙ্গে
লম্বা ইতিহাস আছে। সোজাসরল ভাষায় বললে, পূর্ব তিমুর কখনো ইন্দোনেশিয়ার অংশ ছিলো না। যে ভূ-খন্ড নিজের নয়, সেখানে ইন্দোনেশিয়া কীভাবে, কতদিন সেখানে জোর-জবরদস্তি করে শাসন বজায় রাখবে? সোজা ইতিহাস।
পূর্ব তিমুর পর্তুগীজদের কলোনি ছিলো। ষোড়শ শতাব্দী থেকে।
বে-উপনিবেশিকরণ প্রক্রিয়া হিসেবে পর্তুগীজরা পূর্ব তিমুর ছেড়ে চলে যায় এবং ১৯৭৫ সালে পূর্ব তিমুরের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়। এতে প্রতিবেশি রাষ্ট্র ইন্দোনেশিয়া শংকিত হয়ে উঠে। এখানে বলে রাখা ভালো, তখন দুনিয়াটা দুই শিবিরে বিভক্ত – সোভিয়েত ব্লক, আর আমেরিকা ব্লক। দুই শিবির চেষ্টা চালিয়েছিলো বিশ্বে নিজেদের আদর্শ প্রতিষ্ঠা করতে।ইন্দোনেশিয়ার আশংকা ছিলো, পূর্ব তিমুর স্বাধীন হয়ে গেলে সেখানে যদি সমাজতন্ত্রীদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়, তাহলে মুসলিম প্রধান ইন্দোনেশিয়ার বড় ক্ষতি হয়ে যাবে। সেই আশংকা থেকে ইন্দোনেশিয়া পূর্ণমাত্রায় সামরিক অভিযান চালিয়ে জোর করে পূর্ব তিমুর দখল করে নেয়। সেখানে আমেরিকা সমর্থন দিয়ে যায়।
পূর্ব তিমুর দখল করে নেওয়ার পর ইন্দোনেশিয়া নিজের ক্ষমতা সুসংহত করতে দমনপীড়নের পথ বেছে নেয়। আর পূর্ব তিমুরের জনগণও তাদের ন্যায্য সংগ্রাম চালিয়ে যেতে থাকে। অবশ্য এটা স্পষ্ট, পূর্ব তিমুর শাসন করার নৈতিক ও আইনি কর্তৃত্ব ইন্দোনেশিয়ার কখনো ছিলো না। ৭৫ থেকে ৯৯ সাল পর্যন্ত ইন্দোনেশিয়া পূর্ব তিমুর শাসন করতে পেরেছিলো তার পেছনে বৈশ্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি তার অনুকূলে ছিলো। অর্থাৎ এতদিন আমেরিকা ইন্দোনেশিয়ার পেছনে ছিলো। সে কারণে পূর্ব তিমুরের জনগণকে স্বাধীনতা পেতে অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছিলো। কিন্তু ৯০-এ এসে স্নায়ুযুদ্ধের অবসান হলে পূর্ব তিমুরের ইস্যূতে আমেরিকার আগ্রহ কমে যায়। দুই পরাশক্তির স্নায়ুবিক সম্পন্ন স্বাভাবিক হয়ে এলে জাতিসংঘও তার কাজের স্বাধীনতা পেয়ে গেলো।
পূর্ব তিমুরে সানানা গুজমাও-র মত বিপ্লবী নেতা ছিলেন, আর প্রফেসর রামোস হোর্তার মত আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন লবিস্ট ছিলেন। দেশে তারা যুদ্ধ করেছেন। অন্যদিকে তারা আন্তর্জাতিক আ্ইনের আশ্রয় নিয়েছেন। কিন্তু ইন্দোনেশিয়ার কখনো হুঁশ হয়নি। পূর্ব তিমুরের জনগণের ন্যায্য দাবীর প্রতি জাতিসংঘও সম্মান দেখাতে বাধ্য হয়। পূর্ব তিমুরে মানবাধিকার রক্ষা ও সমুন্নত রাখতে জাতিসংঘকে মধ্যস্থতায় নামতে হয়। আর জাতিসংঘের সদস্য হিসেবে ইন্দোনেশিয়ার জাতিসংঘ সনদ ও আন্তর্জাতিক আইন না মানার কোন উপায় ছিলো না।
শেষমেশ পূর্ব তিমুরের জনগণ স্বাধীনভাবে গণভোটের মাধ্যমে নিজেদের ভাগ্য নিজেরাই নির্ধারণ করেছিলো। এখানে ইন্দোনেশিয়ার করার কিছুই নেই। জনমতের প্রতি শ্রদ্ধা না থাকলে এমন পরিণতি এক সময় দেখতে হয়, যা ইন্দোনেশিয়াকে দেখতে হয়েছিলো।
দক্ষিণ সুদান প্রসঙ্গে
অন্যদিকে দক্ষিণ সুদানের জনগণও স্বাধীনভাবে গণভোটের মাধ্যমে স্বাধীনতার পথ বেছে নিয়েছিলো। উত্তর সুদানের দক্ষিণ সুদানের উপর বৈধ কর্তৃত্ব কখনো ছিলো না। এখানেও জবরদস্তি করে দক্ষিণ সুদানকে “সুদানের” সাথে একীভূত করা হয়েছিলো। তাদের ইতিহাসও অনেক লম্বা। উত্তর সুদানের জনগণ বা নেতারা কখনো দক্ষিণ সুদানের জনগণের সাথে ভালো ব্যবহার করেনি। করেনি বলে আজ দক্ষিণ সুদান উত্তর সুদান থেকে বের হয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র। দক্ষিণ সুদানের স্বাধীনতার পথও অনেক লম্বা।
সুদান কলোনী ছিলো। অনেক হাত বদল হয়েছিলো। তুর্কি-মিশরীয়দের দখলের পূর্ব পর্যন্ত অর্থাৎ ১৮২১ সাল পর্যন্ত সুদান বলে কোন রাষ্ট্র ছিলো না। তখন বিভিন্ন রাজা ও গোত্র প্রধানদের অধীনে বর্তমান অবিভক্ত সুদানের বিভিন্ন অংশ শাসিত হতো। তুর্কি-মিশরীয়দের দখলে আসার পর তারা ক্ষমতা সুসংহত করার চেষ্টা করে। সেই সময়ে তুর্কি-মিশরীয় উপনিবেশিকদের মূল আকর্ষণ ছিলো শ্রমদাস, সোনা, হাতির দাঁত ও কাঠ। তারা দক্ষিণ সুদান থেকে আরব বিশ্বসহ বিভিন্ন জায়গায় দাস পাঠাতো। এ কাজে উত্তর সুদানের জনগণ উপনিবেশিকদের সাথে হাত মিলিয়েছিলো। এক কথায়, উত্তর সুদানের জনগণ রাজাকার ছিলো। কাজেই, উত্তর-দক্ষিণ সুদানের দ্বন্দ্ব সংঘাত অনেক আগে থেকেই শুরু হয়।
অনেক উপনিবেশিকদের সাথে যুদ্ধ করে ব্রিটিশ উপনিবেশিকরা সুদানে আসে। তখন ১৮৯৮ সাল। তারা মিশরীয়দের সাথে সন্ধি করে। ব্রিটিশ-মিশরীয় উপনিবেশিকরা ১৮৯৮ থেকে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত যৌথভাবে সুদানকে শাসন করে। তবে ব্রিটিশরা আসার পর উত্তর-দক্ষিনের জন্যে আলাদা শাসনব্যবস্থা কায়েম করে।দক্ষিণ সুদানের জন্যে ব্রিটিশরা “বন্ধ দরজা নীতি” (closed door policy) গ্রহণ করে। উত্তরের জনগণকে ভিসা নিয়ে দক্ষিণে যেতে হতো। এর পেছনেও অনেক কারণ ছিলো। উত্তর-দক্ষিণ সুদানের মধ্যে ভৌগলিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় দিকে থেকে অনেক পার্থক্য ছিলো। ধর্মের দিক থেকে দক্ষিণ সুদানের জনগণের বড় অংশ খ্রীস্টান। তবে ব্রিটিশদের “বন্ধ দরজা নীতি”র কারণে দক্ষিণ সুদানের জনগণ সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলো, তারা অনেক দিক থেকে পিছিয়ে পড়ে।
অন্যদিকে ব্রিটিশরা উত্তর সুদানে তাদের শাসনকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করে। সকল প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক কর্মকান্ডের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠে উত্তর সুদান। উত্তর থেকে দক্ষিণ সুদানকে পরিচালনা করা হতো। এতে করে উত্তর সুদানের জনগণ ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে আগে আসতে পেরেছিলো।
অবশেষে ব্রিটিশরা ১৯৫৬ সালে সুদান থেকে তাদের উপনিবেশ প্রত্যাহার করে নেয়। সুদানকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করে এবং সমস্ত ক্ষমতা উত্তর সুদানের নেতাদের হাতে বুঝিয়ে দিয়ে যায়। ফলে এ স্বাধীনতায় দক্ষিণ সুদানের কোন লাভ হয়নি। দক্ষিণ সুদানের জনগণ ব্রিটিশদের এ কাজকে চরম বিশ্বাসঘাতকতা হিসেবে আখ্যায়িত করে।তারা এ স্বাধীনতাকে কেবল “প্রভু পরিবর্তন” হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলো। ফলে স্বাধীনতার শুরু থেকেই দক্ষিণ সুদানের জনগণের মধ্যে ক্ষোভ দানা বেঁধে উঠে।
অন্যদিকে উত্তর সুদানের এলিটরা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় গিয়ে দক্ষিণ সুদানের বিষয়গুলোকে পাত্তা দেয়নি। রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে তারা বহুভাষিক, বহু সাংস্কৃতিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক কোন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে পারেনি বা করেনি। কাজেই সুদানের রাষ্ট্রীয় সংহতি ও ঐক্য কখনো সুদৃঢ় হয়নি। বরং উত্তর সুদানের এলিটরা দমনপীড়নের মাধ্যমে শাসন পরিচালনা করে। দক্ষিণ সুদানের উপর ইসলামি ব্যবস্থা চাপিয়ে দিয়ে সুদানের জাতীয় সংহতি রক্ষার চিন্তা করেছিলো। বহু সংস্কৃতি, বহু জাতি ও বহু ভাষা – এককথায় বহুমাত্রিক গণতান্ত্রিক চেতনা তাদের মধ্যে কাজ করেনি। ফলে দক্ষিণ সুদানের জনগণের অবরুদ্ধ বেদনা দারুণ ক্ষোভে পরিণত হয়। আর সেই ক্ষোভ থেকে এক সময় শুরু হয় চরম গৃহযুদ্ধ।
বিশ বছরের গৃহযুদ্ধ শেষে ব্যাপকভিত্তিক শান্তিচুক্তি [Comprehensive Peace Agreement (CPA)] সম্পাদিত হয় দক্ষিণ ও উত্তরের মধ্যে ২০০৫ সালে।চুক্তির শর্ত অনুসারে সিদ্ধান্ত হয়, ছয় বছর স্বায়ত্তশাসিত প্রশাসন চালানোর পর দক্ষিণ সুদানের জনগণ ঠিক করবে উত্তর সুদানের সাথে থাকবে কি থাকবে না। এই শর্ত অনুসারে, ২০১১ সালে ৯ জুলাই, গণভোটের মাধ্যমে দক্ষিণ সুদানের জনগণ নিজেদের ভাগ্য নিজেরাই নির্ধারণ করে নেয়। বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ (৯৮%) হ্যাঁ ভোট দিয়ে স্বাধীনতার পথ বেছে নেয়। এ ফলাফল থেকে বুঝা যায়, উত্তর সুদানের শাসকরা দক্ষিণ সুদানের জনগণের উপর কী করেছিলো।
শেষকথা
যারা পূর্ব তিমুর ও দক্ষিণ সুদানের সঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রামের তুলনা করেন, তাদেরকে দুটো দেশের ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে বলবো। কোন জাতিগোষ্ঠীর উপর দমন, পীড়ন, অত্যাচার, নির্যাতন চালাতে থাকলে তাদের উপর শাসন করার বৈধতা থাকে না, সেটার বড় উদাহরণ সদ্য স্বাধীন দেশ পূর্ব তিমুর ও দক্ষিণ সুদান।
এখানে বাঙাল শাসক ও এলিটদের মনে রাখতে হবে রাষ্ট্রগঠনে মানে দেশের সংবিধান ও বিধিব্যবস্থা প্রণয়নে আদিবাসীদের একটা দাড়িও নেই, একটি কমাও নেই। কাজেই রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারকদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে তারা কেবল পূর্ব তিমুর ও দক্ষিণ সুদানের উদাহরণ টেনে টেনে জুজুর ভয় দেখিয়ে দিন কাটাবেন নাকি রাষ্ট্রগঠনে আদিবাসী জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করবেন? পূর্ব তিমুর ও দক্ষিণ সুদান থেকে শিক্ষা নিয়ে বাংলাদেশকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে তারা কোন পথ বেছে নেবেন। দমন-পীড়ন, নাকি শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান? আদিবাসীদের অস্বীকৃতি জানিয়ে তাদেরকে বিচ্ছিন্নতার পথে ঠেলে দেবে নাকি রাষ্ট্রকাঠামোর এনে নিরাপদ ঘরে রাখবে?
সবশেষে যারা বিচ্ছিন্নতাবাদের ভয় দেখায় তাদের মুখে থু থু দিয়ে আমার লেখাটা শেষ করতে চাই। আদিবাসীরা কখনো বিচ্ছিন্ন হওয়ার দাবী করেনি।এখনো করেনি। করেনি বলে সংবিধানে আদিবাসীদের স্বীকৃতির দাবী করছে। আর পাহাড়ে জেএসএস শান্তিবাহিনী গঠন করে অস্ত্র হাতে নিয়েও বলেছিলো, বাংলাদেশের সংবিধানে জুম্মজনগণের অধিকারের স্বীকৃতি দেওয়া হোক। সেই সাংবিধানিক স্বীকৃতির দাবী এখনো পুরন হয়নি।
অতএব, বাঙাল এলিটরা যারা রাষ্ট্রপরিচালনা করছেন, পূর্ব তিমুর ও দক্ষিণ সুদানের উদাহরণ মাথায় রেখে আপনাদের সিদ্ধান্ত নিন আপনারা বাংলাদেশকে কোন পথে নেবেন – সংঘাতে নাকি সামঞ্জস্যে?
অডঙ চাকমা, ৩০ আগস্ট ২০১১