somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পুরনো পাণ্ডুলিপি - ৩য় অংশ

২১ শে জানুয়ারি, ২০১৪ সন্ধ্যা ৬:৩৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

২য় অংশের পরঃ

ঘুরতে ঘুরতে একটা পুরনো বাড়ির সামনে এসে পড়ে ওরা। বাড়ির রঙ খসে গেছে অনেক আগেই। সিংহদ্বারের একপাশের গেটটা নেই। “এটা কাদের বাড়ি?”, ফারজানা প্রশ্ন করে। “আমাদের পুরনো জমিদারবাড়ি।”, রিশাদ উত্তর দেয়, “চল এবার বাড়ি যাই। অনেক ঘোরা হল।” “বাড়িটা ঘুরে তারপর যাই।”, আবির প্রস্তাব দেয়। “না, সবাই বাড়ি চল।” “আসলাম যখন একবার দেখেই যাই”, রাহি বলে, “আর বেশি দেরি তো হয় নি।” বাবলুও সায় দেয়, “চল একবার দেখেই তারপর ফিরি।” অগত্যা রিশাদের আপত্তি সত্ত্বেও ওরা ভাঙা সিংহদ্বার দিয়ে পুরাতন জমিদারবাড়িতে প্রবেশ করে। নিশি মালিহাকে বলতে থাকে, “বাড়িটা দুইশ বছর পুরনো। সেই ব্রিটিশ আমলের কথা। তখন আমাদের এলাকার জমিদার ছিলেন নবাব তোগলক খাঁ। বাবার মুখে শুনেছি এসব। বাবা জেনেছেন তার দাদার কাছ থেকে। নবাব ছিলেন খুবই অহংকারী আর অত্যাচারী। খাজনা আদায় করতে না পারলে কৃষকদের ধরে নিয়ে যেতেন তিনি। তারপর. . . .” সবাই মনোযোগ দিয়ে শুনছিল নিশির কথা। রিশাদ ওদের মনোযোগে বিঘ্ন ঘটায়, “এই দেখ, এই হল নবাবের মজলিশ ঘর। এখানে বসেই তিনি খাজনা আদায় করতেন।” ওরা ঘুরে ফিরে দেখে। লম্বা হলরুমের একমাথায় একটা সিংহাসন। দু’পাশে সারি সারি আসন পাতা। রুমের মাঝ বরাবর একটা প্রকাণ্ড ঝাড়বাতি ঝুলছে সিলিং থেকে। ঘরময় মাকড়শাগুলো বহুদিন পর মানুষের পদধ্বনি শুনতে পেয়ে ছুটোছুটি করতে থাকে। হলরুমের ডান দিক দিয়ে আরেকটা ঘরে প্রবেশ করে ওরা। রিশাদ ওদের দেখিয়ে দেয় সবকিছু, “এই শাহী পালংকেই ঘুমাতেন নবাব।” ঘরের এক কোণে একটা তানপুরা আর দুটো তবলা দেখিয়ে বলল, “মাঝে মাঝে নবাবের ঘুম না আসলে নাচ গানের ব্যবস্থা।” “কে নাচত? নবাবের সিপাহীশালা?”, নাহিয়ান কৌতুক করে। “রুপালী”, নিশি বলে, “নবাবের প্রিয় নাচিয়ে ছিল। আসামের নবাবের নিমন্ত্রণে তার ওখানে গিয়ে রুপালীর নাচ দেখেন নবাব। দেখে তার ভালো লেগে যায়। তাই তো অনেক স্বর্ণমুদ্রা দিয়ে কিনে রুপালীকে ঠাঁই দেন নিজের নবাবীতে।” “রুপালীও কি তাহলে এগিয়ে থাকত?”, ফারজানা প্রশ্ন করে। “হ্যাঁ, পাশের ঘরটাই রুপালীর। এসো।”, রিশাদ এগিয়ে চলে।
নতুন একটি ঘরে প্রবেশ করে সবাই। এ ঘরটিও আগেরটার মতো মাকড়শার জালে আচ্ছাদিত। অনেক দিন কেউ আসে না এই ঘরে দেখলেই বোঝা যায়। ওরা ঢোকার সাথে সাথেই ওদের পায়ের ছাপ পড়তে থাকে একরাশ ধূলোর আস্তরণে। দেয়ালের উপর একটা প্রকাণ্ড আয়না। তাতে বিভিন্ন রকম নামের আগে পিছে প্লাস আর হৃদয়ের চিহ্ন খুঁজে পায় আবির। গ্রামের কিছু ছেলের কাজ হবে হয়তো। নাহিয়ানের পায়ের উপর দিয়ে একটা ইঁদুর চলে যেতেই সে লাফ দিয়ে ওঠে। ঘরের মাঝ বরাবর একটা ধূলোময় খাট। আয়নাটার বিপরীতে একটা কাঠের আলমারি। আলমারিটা দেখিয়ে নিশি বলে, “এটাতে রুপালীর জামাকাপড়, সাজার জন্য অলংকার আর নাচের জন্য পায়েল, ঘুঙরু রাখা ছিল।” “এখন নেই?”, ফারজানা প্রশ্ন করে। “সে তো কবেই চুরি হয়ে গেছে।”, রিশাদ উত্তর দেয়। “ভাইয়া, অনেক দেরি হয়ে গেছে। চল ফিরি।”, মালিহা বলে। হঠাৎ আবির চেঁচিয়ে ওঠে, “এই বাবলু কই গেল?” “আরে, তাই তো।”, রাহির চোখেমুখে উৎকণ্ঠার স্পষ্ট। ছাপ। নাহিয়ান বাবলুর মোবাইলে কল করে ফোনটা বন্ধ বলে জানায় সবাইকে। “ইস! আমারই দোষ। সবাইকে দেখে রাখা উচিত ছিল। এমনিতেই. . . .”, রিশাদ হন্তদন্ত হয়ে জমিদারবাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ে। বাকিরা রিশাদকে অনুসরণ করে। অনেক খুঁজেও কোথাও বাবলুর দেখা পাওয়া যায় না। এদিকে ওর ফোনটা এখনও সুইচড অফ। দিশেহারা তরুণ দল অবশেষে বাড়ি ফেরে।
বাবলু উঠোনে বসে মুড়ি আর চানাচুর চিবুচ্ছিল। নাহিয়ান চেঁচিয়ে উঠল, “বাবলু, কই ছিলি তুই এতক্ষণ?” বাবলু তার বৃতান্ত বর্ণনা করল। ওরা সবাই যখন রুপালীর ঘরে ঢোকে ঠিক তখনই বাবলুর মুঠোফোনে একটা বার্তা আসে, “joldi call koro” রিয়ার বার্তা পেয়েই বাবলু ওকে কল করে। কথা বলতে বলতে একসময় জমিদারবাড়ির বাইরে এসে পড়ে। হঠাৎ করেই মোবাইলের চার্জ শেষ হয়ে যায়। সুইচড অফ মোবাইল নিয়ে ওদের কিছু না জানিয়েই বাড়ির পথ ধরে বাবলু। বাড়িতে আবার বিদুৎ নাই। তাই বেচারা বসে বসে মুড়ি চানাচুর চিবোচ্ছে। সবাই মিলে ঘরে ঢুকতেই বিদুৎ চলে আসে। রাহি বাবলুকে একটা ধাক্কা দিয়ে বলে, “যা দৌড়া, মোবাইল চার্জে দে।” বাবলু নিরুত্তাপ, “আগে থেকেই লাগাইয়া রাখছি।” ফারজানা বলে, “যা যা। গিয়ে দেখ তোর ডার্লিং মেসেজ পাঠাইতে পারে।” রিশাদ কিছুটা রাগের সুরে বলে, “যাই হোক। তোর বলে আসা উচিত ছিল। নতুন এসেছিস। সবকিছু তো জানিস না।” “Sorry দোস্ত।”, মোবাইলের মেসেজ টোন শুনে দৌড় লাগায় বাবলু।
এমন জমজমাট সন্ধ্যার প্রত্যাশাতেই যেন এতদিন ছিল ওরা। হঠাৎ গ্রামে এসে প্রত্যেকের প্রতিভা যেন নিজে থেকেই প্রকাশিত হচ্ছে। সবাই মিলে পিঠা খাচ্ছে আর আপন প্রতিভার বিস্ফোরণ ঘটাচ্ছে। একটা বাটিতে কিছু কাগজ ভাঁজ করে রাখা আছে। একজন একজন করে একেকটা কাগজ উঠাচ্ছে আর যা লেখা তাই করছে। ফারজানার ভাগ্যে পড়ল নাচ, রিশাদ সবাইকে আবৃত্তি করে শোনাল আর বাবলুর সংগীত উন্মাদনা। রাহি দুটো জোকস বলে একা একাই হাসল। তানিম আর আবির অভিনয় করে দেখাল। শুধু এই আড্ডায় দু’জন অনুপস্থিত। নাহিয়ান আর নিশি।
“নিশি, বল কি বলবে?”, নাহিয়ান ব্যস্ততা দেখায়। নদীর জলে নিশির আনমনা প্রতিচ্ছবি দেখা যায়। নিশি হঠাৎ উঠে দাঁড়ায়। বলে, “নাহিয়ান ভাই, আপনাকে সবসময় দেখি কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে থাকেন। কি হয়েছে আপনার?” “ও, কিছু না।”, নাহিয়ানের চোখে অস্পষ্ট দুঃখের ছাপ। নিশি আবার বসে পড়ে। নাহিয়ানের হাতটা ধরে, “আমাকে কি বলা যায় আপনার দুঃখের কাহিনীটা?” নিকষ কালো আঁধারে নিশির চোখে তাকিয়ে কিছুটা ঘাবড়ে যায় নাহিয়ান। হালকা আলোতে সে চোখ কিছু মানবীয় সম্পর্কের ইঙ্গিত প্রদান করে।
“একজনকে ভালোবাসতাম। খুব ভালোবাসতাম। In fact ও ও খুব ভালোবাসতো। কত রঙিন স্বপ্ন ছিল। একটা দূর্ঘটনায় ওর পুরো পরিবারটা মারা যায় গত তিন মাস আগে। ও ও ছিল।”
নিশির হাতে এক ফোঁটা জল পড়ে। নিশি নাহিয়ানের হাতটা ছেড়ে দিয়ে ওর চোখের জল মুছে দেয়। বলে, “যে চলে গেছে তাকে মনে রেখে কষ্ট পাওয়ার কি কোন মানে হয়? চলুন বাড়ি যাই।” “তুমি যাও। আমি পরে আসছি।”, নাহিয়ান জানায়।
পরদিন ছেলেমেয়েরা একটু দেরিতেই ঘুম থেকে ওঠে। গত রাতে নাহিয়ান আর নিশি যোগ দেয়ার পর ওদের আড্ডা আরও জমে যায়। তাই ঘুমুতে একটু রাত হয়ে যায় সবার।
Hi.
-Hey, what’s up?
মাত্র ঘুম থেকে উঠলাম।
-Good morning.
ব্রাশ করতে গিয়ে তোমার কথা মনে পড়ল।
-ও আচ্ছা। আজকাল আমার কথা মনে হয় দেখছি।
তুমি ছাড়া আর কাকে মনে করব?
-আবির কি যে বল না!
রিশাদ আবিরের পিঠে একটা ধাক্কা দিয়ে বলে, “কিরে ঘুম থেকে উঠেই শুরু করে দিলি?” আবির মুচকি হেসে জবাব দেয়, “flirting এর আবার নির্দিষ্ট time লাগে নাকি?” “চল ওঠ। সবাই মিলে মৎস শিকারে যাব।” আবির ল্যাপটপটা বন্ধ করে উঠে দাঁড়ায়। উঠানে এসে দাঁড়াতেই অট্টহাসি জুড়ে দেয়। রিশাদ পেছন থেকে বলে, “কি রে কি হল?” “বাইরে এসে দেখ”, হাসতেই হাসতেই বলে আবির। বাইরে তানিম আর নাহিয়ান লুঙ্গি পড়ে দাঁড়িয়ে আছে। “ওরা অ্যানালগ জেলে I mean জাইল্যা”, হাসতে হাসতেই রিশাদ বলে, “চল এখানে দাঁড়িয়ে আর হাসা লাগবে না।” “রাহি-বাবলু কই?”, আবির জিজ্ঞাসা করে। “ওরা বাজারে গেছে। নিশি আর মালিহার কি যেন কেনাকাটা আছে। আর ওরা মৎস শিকারী হতে চায় না। রাহি তো বইলাই ফেলল, জীব হত্যা মহাপাপ। তাই দুজন মেয়েদের সাথে গেছে।”, রিশাদ পুকুরপাড়ের দিকে এগিয়ে চলে।

(চলবে)

২য় অংশঃ Click This Link
১ম অংশঃ Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ দুপুর ১:২১
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

=আকাশে তাকিয়ে ডাকি আল্লাহকে=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:০১


জীবনে দুঃখ... আসলে নেমে
শান্তি গেলে থেমে;
আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে হই উর্ধ্বমুখী,
আল্লাহকে বলি সব খুলে, কমে যায় কষ্টের ঝুঁকি।

আমি আল্লাহকে বলি আকাশে চেয়ে,
জীবন নাজেহাল প্রভু দুনিয়ায় কিঞ্চিত কষ্ট পেয়ে;
দূর করে দাও সব... ...বাকিটুকু পড়ুন

"ছাত্র-জনতার বেপ্লবের" ১৮ মাস পরে, আপনার ভাবনাচিন্তা ঠিক আগের মতোই আছে?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৫:৫৭



২০২৪ সালের পহেলা জুলাই "ছাত্র-জনতার বেপ্লব শুরু হয়, "৩৬শে জুলাই" উহা বাংলাদেশে "নতুন বাংলাদেশ" আনে; তখন আপনি ইহাকে ব্যাখ্যা করেছেন, ইহার উপর পোষ্ট লিখেছেন, কমেন্ট করেছেন; আপনার... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের হাদিকে গুলি করা, আর আওয়ামী শুয়োরদের উল্লাস। আমাদের ভুল কোথায়?

লিখেছেন তানভির জুমার, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:৫৩



৩০ জনের একটা হিটলিস্ট দেখলাম। সেখানে আমার ও আমার স্নেহের-পরিচিত অনেকের নাম আছে। খুব বিশ্বাস করেছি তা না, আবার খুব অবিশ্বাস করারও সুযোগ নাই। এটাই আমার প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

এ যুগের বুদ্ধিজীবীরা !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১:৪০


ডিসেম্বর মাসের চৌদ্দ তারিখ বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবী দিবস পালন করা হয়। পাকিস্তান মিলিটারী ও তাদের সহযোগীরা মিলে ঘর থেকে ডেকে নিয়ে হত্যা করেন লেখক, ডাক্তার, চিকিৎসক সহ নানান পেশার বাংলাদেশপন্থী বুদ্ধিজীবীদের!... ...বাকিটুকু পড়ুন

টাঙ্গাইল শাড়িঃ অবশেষে মিললো ইউনস্কর স্বীকৃতি

লিখেছেন কিরকুট, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:৫৭



চারিদিকে যে পরিমান দুঃসংবাদ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এর মধ্যে নতুন এক গৌরবময় অধ্যায়ের সূচনা হলো বাংলাদেশের টাঙ্গাইলের তাতের শাড়ি এর জন্য, ইউনেস্কো এই প্রাচীন হ্যান্ডলুম বুননের শিল্পকে Intangible Cultural... ...বাকিটুকু পড়ুন

×