গভীর প্রেমে নিমজ্জিত মানব-মানবীকে লাভবার্ডের সাথে তুলনা কেন করা হয়, মেয়েটি বোঝেনা ঠিক। সপ্তম কি অষ্টম শ্রেণীতে পড়ে ও। ওর মনে প্রশ্ন ছিল, পশু-পাখির মাঝে কি আর অত ভালবাসা থাকতে পারে? ওরা কি আর এতটা অনুভব করতে পারে?
সেদিন মায়ের সাথে স্কুল থেকে বাসায় ফিরছিল, হঠাত পথের পাশে পাখির দোকানের ঠিক বাইরে বেশ কিছু লাভ বার্ড দেখে উত্তেজিত হয়ে মাকে ডাকতে লাগলো। মা, একজোড়া লাভবার্ড কিনে দাওনা প্লিজ? মা ওকে মৃদু ধমকে বললেন, "অযথা এসব ঝামেলা করোনা তো, "দেখাশোনা করবেনা ঠিক মত আর বাসাও নোংরা করবে।" আবার জেদ করে কিছু বলতে যাচ্ছিল, মা ফোনে কারো সাথে কথা বলতে শুরু করলেন।
বিকেলটা ওর জন্যে অনেক বিষন্ন ছিল সেদিন। শুধু মনে হচ্ছিল ও বড় হলে একছুটে গিয়ে কিনে নিয়ে আসত। বড় বোনের কাছে গিয়ে বলাই সার হলো, উনি পড়ছেন, ওর কোনো কথায় তার কানে পৌঁছায়নি। একা একা গান শুনে পার করে দিলে সন্ধ্যা। সন্ধ্যার পড়ে হাউজ টিউটর এলো। সবকিছু খুলে বলল ও, টিউটর ওর খুব ভালো বন্ধুর মত। নিশা অনেক ভালো ছবি আঁকতে পারে, কবিতা লেখে, গান গাইতে পারে। কিন্তু ছবিগুলো দেখার কেউ নেই, কবিতা পড়ার কেউ নেই, গানগুলো শোনার কেউ নেই। শুধু এই মানুষটাই নিজের সব কাজ ফেলে ওর শিল্পে মনোযোগ দেয়, অনেক প্রসংসা করে ওকে অনুপ্রেরণা দেয়। অনেক ভালো ছাত্রী হবার পরেও ওর রেজাল্ট টেবিলে পড়ে থাকে, কেউ দেখারও সময় পায়না। বাবা বেঁচে নেই নিশার, মা একাই সংসার চালান, অনেক ব্যস্ত থাকতে হয় ওনাকে। নিশা সবই বুঝে, কিন্তু একা একা ওর মন খারাপ লাগে। অন্য মেয়েদের মত ফেসবুকের স্ট্যাটাস দিয়ে লাইক পেয়ে ভালো থাকাটা ওর ধরন নয়। ছেলেদের সাথে সেভাবে মিশতে পারেনা ও। নিশা শুধু একজন বন্ধুর জন্যে ব্যাকুল ছিল.......
লাভ বার্ডগুলো এত রঙিন আর প্রানবন্ত, এক মুহুর্তেই যেন ওর মন কেড়ে নিয়েছিল। ওর খুবই কিনতে ইচ্ছে করছে। আম্মুকে অনেক ভয় পায়, বলতে সাহস পাচ্ছেনা কিছুই, বললেও লাভ হবে বলে মনে হয়না। শুধু ওর স্যারকে প্রতিদিন বলে, সব কথা। হঠাত করে কখনো যেন লাভ বার্ডের কথা বলতে শুরু করে ও নিজেও বুঝতে পারেনা, কখনো কখনো আকস্মিক বলতে শুরু করে!
একদিন বিকেলে ওর টিউটর একটা মস্ত বাক্স নিয়ে হাজির হলেন, চোখ বড় বড় করে তাকয়ে দেখছে ও। "এটার ভেতরে কি স্যার?" স্যার হেসে বললেন, "খুলেই দেখো? আজ আমি পড়াতে পারবনা, আমার খুব জরুরি একটি কাজ আছে, পড়ে এসে শুনব তোমার কেমন লাগলো।"
নিশা কিছু বলার আগেই ওর স্যার চলে গেল। অবাক কিকাক্ষণ তাকিয়ে দেখল ও। তরপর নেড়েচেড়ে বোঝার চেষ্টা করলো কি আছে, এমন ঘটনা ওর জন্যে খুবই নতুন ছিল।
বাক্স খুলে একটি খাঁচা পেল, একজোড়া টুকটুকে লাভ বার্ড! ওর চিত্কারে তখন ঘরের প্রতিটি ইট-পাথর যেন উচ্ছল হেসে উঠল। কিছুক্ষণ লাফালাফি করে শান্ত হয়ে পাখিদুটোকে দেখতে লাগলো ও। এতো সুন্দর! একজোড়া রংধনু যেন ওর খাঁচায় এসে বন্দি হয়েছে। অবাক ও একা একা দেখতে লাগল, দেখতেই থাকল।
দোতলার ওর ঘরের ব্যাল্কনিতে ঝুলিয়ে দিল খাঁচাটা। পাখিদুটো এই কোনা ওই কোনা করে লাফিয়ে মাতছে! ওদের মিষ্টি কিচির-মিচিরে ওর ঘরটা যতটা মুখরিতহলো, ওর একা মনটা হলো তার থেকে শতগুণ বেশি। পাখিদুটোর একসাথে নাক গুঁজে থাকা, পাখা ঝাপটানো গায়ে লেগে লেগে থাকার সর্বক্ষনির প্রচেষ্টা ওকে অবাক ও বিমোহিত করছিল। নাওয়া, খাওয়া, পড়াশুনা কিচ্ছুর কথা মনে থাকলোনা আর। রাত হলে ওর বড় বোন দেকে খাওয়ালো। ও ওর বোনকে পাখিগুলো দেখালো। অনেক ভালো লাগা ছিল ওর মনে সেদিন, জীবনের সবচেয়ে সুন্দর দিনগুলো একটি মনে হচ্ছিল। পাখি দুটোর মধ্যে মেয়ে কোনটি, ছেলে কোনটি বুঝতে প্রায় অনেক দিন লেগে গেল ওর, ততদিনে দারুন বন্ধুত্ব হয়ে গেছে ওর সাথে পাখিদের। ছেলেটির নাম রাখল সুক আর মেয়েটির নাম পাখি। লাভ-বার্ড একজন আরেকজনের ঠোঁটে তুলে খাইয়ে দেয়, ডানা দিয়ে জড়িয়ে রাখে একজন আরেকজনকে। ওদের ভালবাসা দেখে নিশা শুধুই অবাক হয়! ওরও ভালবাসতে ইচ্ছে করে, ঠিক লাভবার্ড দুটোর মত করে।
পরদিন ও স্যারকে ফোন করেছিল, ধন্যবাদ দিতে, কেউ তুলেনি ফোন। তারপর থেকেই ওনার ফোন একদমই বন্ধ। নিশার অসহ্য লাগছিল। মা ঠিকানা জানে, কিন্তু মাকে বলতে ইচ্ছে করছিল না। ও শুধু ওর লাভ বার্ড দুটোর সাথেই সময় কাটাচ্ছিল। দশ বারোদিন মত পেরিয়ে যাবার পরে আর চুপ থাকা গেলনা, ওর পড়াশোনারও ক্ষতি হচ্ছে। মাকে বলল, "স্যার বেশ কদিন থেকে আসছেনা, কিছু বলেও নি, খোঁজ নেয়া লাগত।"
কয়েকদিন পরের কথা, হঠাত করেই মরে গেল "পাখি", সকালে উঠে নিশা দেখল পাখি নিথর পড়ে রয়েছে, আর সুক ঠোঁট ঘষে ওকে ওঠাবার চেষ্টা করছে। মাঝে মাঝে বিষন্ন ডেকে ডানা ঝাপটে মৃদু লাফ দিচ্ছে। সুক এদিকে তাকাচ্ছে, ওদিকে তাকাচ্ছে, আর পাখিকে ওঠানোর প্রানপন চেষ্টা করেই যাচ্ছে। প্রায় একঘন্টা নিশা তাকিয়ে রইলো। ওর নড়ারও সাধ্য ছিলনা। পাখি মরে গেছে, সুক এর দিকে আর ও তাকাতে পারছিল, ওর বুক ফেটে কান্না পাচ্ছিল। কাউকে বলতে ইচ্ছে করছে ওর, "আমার পাখিটা মরে গেছে, সুক এখন একা কি করে বাঁচবে............" কেউ নেই ওর আসে পাশে, শোনার জন্যে। ওর খুব কষ্ট হচ্ছিল, ও সুকের কান্না ও আর নিতে পারছিলনা, বড় কষ্টের সেই শব্দ। সুককে খাঁচার বাইরে নিয়ে এলো ও, হাতের উপরে বসে আছে সুক, ওর মাথা নিচু, হেরে গেছে যেন......হারিয়ে ফেলেছে সব। নিজের চোখের জলকে অধর পেরিয়ে যেতে দেখল নিশা, জলকণাগুলো এখন সুকের গায়ে গিয়ে পরছে। নিশার চোখের জল সেদিন সুকই ছুঁয়ে দেখেছিল। সুক কে গ্রিলের বাইরে বের করে ছেড়ে দিল নিশা। কিছুদূর উড়ে আবার ফিরে এলো সুক, বারান্দার কোনায় বসলো। কোনটায় বসে ডাকছিল ও, ডানা ঝাপটাচ্ছিল........ ও মানুষ হলে হয়ত বলা যেন, বিলাপ করে কাঁদছিল। একসময় উড়ে গেল সুক...........নিশা অঝোরে কাঁদছিল.... আকাশটা আর সহ্য করতে পারেনি, বৃষ্টির অঝোর বর্ষণ যেন নিশার প্রতি সমবেদন এর কিছু জলকণা ছিল।
ওর মা দরজায় নক করলো, চোখ মুছে বের হলো ও। মাথা নিচু করে শুনলো, ওর স্যার এক্সিডেন্ট করে মারা গিয়েছেন। সেদিনই, যেদিন খাঁচাটি দিয়ে তিনি জরুরি কাজে চলে যান।
__________________________________________________

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




