somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

অপারেশন জ্যাকপট ও একজন নৌকমান্ডো

১০ ই ডিসেম্বর, ২০১১ রাত ১২:০২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

খবরটা শুনে ফজু মিয়ার মেজাজ চরম খারাপ । ‘ঢাকা শহর মেলেটারীরা গোরস্তান বানাইয়া ফালাইছে’। ফজু মিয়া আখাউড়া রেল স্টেশনের কুলি। মাল টানা ছাড়া তার আর কোন কাজ নেই। নেহায়েত নিরীহ এই মানুষটার শরীরে আগুন ধরে গেছে। কেন ধরেছে সে নিজেও জানেনা। শুধু মনে হচ্ছে “শরীল থেইক্কা রক্ত ফুইট্টা বাইরাইতাছে”।
ফজু মিয়া যুদ্ধে যায়। এপ্রিল মাসের শেষের দিকে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় মেজর শফিউল্লাহর সামনে । নৌ কমান্ড দল গঠন হবে। সুইসাইডাল স্কোয়াড।ফজু মিয়া রাজি।
পেছনের কথাঃ মার্চের শুরুর দিকে পাকিস্তানি সাবমেরিন পি এন এস ম্যাংরো ফ্রান্সের তুলন সাবমেরিন ডকইয়ার্ডে যায় পাকিস্তানি সাবমেরিনারদের প্রশিক্ষন দেয়ার জন্য। সেই ৪১ জন সাবমেরিনারদের মধ্যে ১৩ জন ছিলেন বাঙালি অফিসার। তারা আনতর্জাতিক প্রচার মাধ্যমে ২৫ মার্চের গণহত্যার কথা শুনে পালিয়ে বাংলাদেশে চলে আসার সিদ্ধানত নেন। এর মধ্যে ৮ জন ৩০ মার্চ বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। ৯ এপ্রিল ১৯৭১ তারা দিল্লিতে এসে পৌছান। এরা হলেন
১. মোঃ রহমতউল্লাহ।
২. মোঃ সৈয়দ মোশাররফ হোসেন।
৩. মোঃ শেখ আমানউল্লাহ।
৪. মোঃ আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরী।
৫. মোঃ আহসানউল্লাহ।
৬. মোঃ আবদুর রকিব মিয়া।
৭. মো আবদুর রহমান আবেদ।
৮. মোঃ বদিউল আলম।
তারপর উক্ত ৮জনের সাথে আরো কয়েকজনকে একত্র করে ২০ জনের একটি গেরিলা দল গঠন করে তাদের ভারতে বিশেষ ট্রেনিং দেয়া হয়। তারপর দেশে আসলে তাদের সাথে কর্নেল ওসমানীর দেখা করানো হয়। তখন ওসমানী নৌ-কমান্ডো বাহিনী গঠনের সিদ্ধানত নেন।
নৌকমান্ডো ফজু মিয়া ঃ ফজু মিয়া নৌ কমান্ডো দলে নাম লেখান। আখাউড়া রেল স্টেশনের মালটানা কুলি ফজুমিয়া এখন নৌ কমান্ডো। তাকে নেওয়া হলো পলাশী, ভাগিরথী নদীর তীরে। প্রতিদিন আঠারো ঘন্টা পানিতে ডুবে ট্রেনিং চলে। আখাওড়া বিলে কত সাঁতরেছে ফজু মিয়া! পাল্লা দিয়ে তিতাস এপার ওপার করেছে। এখন দেশের জন্য তার জল বিহার। ফজু মিয়ার জীবন এখন বাজির তাশ। পেটে লিমপেট মাইন, কোমওে ছুরি, মুখে জয় বাঙলা। “আমরা মরবার লাইগ্গাই তো আইছি” ফজু মিয়া বলে। ভারতীয় প্রশিক্ষকের চোখে পানি চলে আসে “হায়, ভগবান এদেও কি ধাতু দিয়ে গড়েছে”!
ট্রেনিং পর্বঃ নৌ-কমান্ডোদের ঐ প্রশিক্ষণ ক্যাম্পের দায়িত্বে ছিলেন ভারতীয় নেভাল অফিসার লেঃ কমান্ডার জি এম মার্টিস। প্রশিক্ষকদের মধ্যে ফ্রান্স থেকে পালিয়ে আসা ৮ জন সাব-মেরিনার ছাড়াও আরো ছিলেন মিঃ গুপ্ত, পি কে ভট্টাচার্য, কে সিং, এল সিং, মারাঠি নানা বুজ এবং সমীর কুমার দাশসহ আরো কয়েকজন।
ট্রেনিং শুরু হবার আগেই বাছাইকরা যোদ্ধাদের বলে দেয়া হয় যে এটি একটি সুইসাইডাল অপারেশন বা আত্মঘাতী যুদ্ধ হবে। তাই প্রশিক্ষণের শুরুতেই প্রত্যেকের ছবি সহ একটি সম্মতিসূচক ফর্মে স্বাক্ষর নেয়া হতো।সেখানে লেখা থাকতো যে, আমি দেশের স্বাধীনতার জন্য জীবন বিসর্জন দিতে সম্মত হয়েই এই প্রশিক্ষণ গ্রহণ করছি, আর যুদ্ধে আমার মৃত্যু ঘটলে কেউ দায়ী থাকবে না।


প্রায় টানা দু'মাস ট্রেনিঙের পর আগস্টের প্রথম সপ্তাহে তাদের ট্রেনিং শেষ হয়।

অপারশনে জ্যাকপটঃ
প্রশিক্ষণ শেষের দিকে। আক্রমনের পরিকল্পনা সাজানো হতে থাকে। একই সাথে একই সময়ে দুই সমুদ্র বন্দর ও দুই নদী বন্দরে আক্রমন চালানোর পরিকল্পনা হয়। ৬০ জনের ২টি দল এবং ২০ জনের আরো ২টি দল। চারটি দলের চারজন লিডার ঠিক করা হল। টিম লিডারদের অপারেশন পরিচালনার জন্য শিখিয়ে দেয়া হয়েছিল বিশেষ পদ্ধতি যা টিমের অন্যান্য সদস্যদের কাছে গোপন রাখা হয়েছিল। দুটি পুরোনো দিনের বাংলা গানকে সতর্ক সঙ্কেত হিসেবে ব্যবহার করা হবে। গানদুটি ও তাদের সঙ্কেত হলোঃ-

১. আমি তোমায যত শুনিয়েছিলাম গান,তার বদলে চাইনি প্রতিদান......। এটি হবে প্রথম সঙ্কেত, এর অর্থ হবে ২৪ ঘন্টার মধ্যে ২য় গান প্রচার হবে। এর মধ্যে আক্রমনের সকল প্রসতুতি সম্পন্ন কর।

২. আমার পুতুল আজকে প্রথম যাবে শ্বশুর বাড়ি......। এটি ২য় এবং চূড়ানত সঙ্কেত। অর্থাৎ এরপর যে ভাবেই হোক আক্রমণ করতে হবে।
যাত্রা শুরুঃ পলাশির হরিনা ক্যাম্প থেকে যাত্রা শুরু । পরিকল্পনা অনুযায়ী সিদ্ধানত হয়েছিল, তারা একযোগে পৌছে যাবেন স্ব স্ব এলাকা চট্টগ্রাম,খুলনা, চাঁদপুর ও নারায়ণগঞ্জ। তাদেরকে প্রয়োজনীয় অস্ত্র দিয়ে দেয়া হয়। প্রত্যেক নৌ-কমান্ডোকে একটি করে লিমপেট মাইন,ছুরি,একজোড়া সাঁতারের ফিন আর কিছু শুকনো খাবার। প্রতি তিন জনের জন্য একটি করে স্টেনগান এবং গ্রুপ লিডারদের একটি করে ট্রানজিস্টার। অপারেশনের দিন ধার্য করা হয়েছিল ১৪ আগস্ট অর্থাৎ পাকিসতানের স্বাধীনতা দিবস। তবে সূদূর পলাশী থেকে গন্তব্যস্থলে পৌছাতে বা পথের নানা প্রতিবন্ধকতা কারণে এসব অভিযান দু'এক দিন বিলম্ব হয়।
চট্টগ্রাম বন্দরে অপারেশন পরিচালিত হয় ১৫ আগস্ট মধ্যরাতে অর্থাৎ ১৬ আগস্ট প্রথম প্রহরে। এ সফল অপারেশনে তিনটি বড় অস্ত্রবাহী জাহাজ এবং একটি সোমালি জাহাজসহ আরো অনেকগুলো জাহাজ ধ্বংস হয। ১৬ আগস্ট একই সাথে মংলা বন্দরেও অপারেশন হয। এ অপারেশনে তারা বন্দরে অবস্থানরত ২টি মারাঠি, ২টি চীনা, ১টি জাপানী ও ১টি পাকিস্তানি অর্থাৎ মোট ৬টি জাহাজ এবং আরো কিছু নৌযান ডুবিয়ে দিতে সক্ষম হন।১৫ আগস্টের ঐ অপারেশন গুলোতেই প্রায ২৬টি জাহাজ ধ্বংসপ্রাপ্ত হয এবং আরো অনেক নৌযান ক্ষতিগ্রস্থ হয। বলা যায় পাকিস্তানীদের কোমর ভেঙ্গে যায়, আত্ম বিশ্বাসে চিড় ধরে। তাছাড়া ধ্বংসের তালিকায় বেশ কয়েকটি বিদেশী জাহাজ থাকায় আন্তজার্তিক মিডিয়ায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের কথা ছড়িয়ে পড়ে।
এবং একজন ডাক্তারঃ এই ঘটনার চল্লিশ বছর পর ডিসেম্বর মাসে এক ডাক্তার যায় নৌ কমান্ডো ফজলুর রহমান ভুঁইয়ার বাড়িতে। বাড়ি বলা যাবে কি? সরকারি খাস জায়গা, একটা পুকুরের বর্ধিত পাড়ে কোন রকম একটা ঘর। ডাক্তার সাহেব ঢাকায় থাকেন। পেপার টেপারেও লেখেন। নাটক টাটক ও করেন। সব মিলিয়ে এক উদ্ভট মানুষ। ডাক্তার একটা ক্যাম কর্ডার নিয়ে এসেছেন। উদ্দেশ্য একটা ইন্টারভিউ নেবেন। ভিডিও করবেন তার কথা। ফজলুর রহমান কথা বলেন। বলতে বলতে কাঁদেন, কখনো ফোঁসেন। তার সহযোদ্ধাদের কিভাবে ভুলিয়ে ভালিয়ে পাকিস্তানীদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন সাবেক এক মন্ত্রী , সেই কাহিনী বললেন। বলতে বলতে দুটো অশ্লীল গালি দেন। ডাক্তার ফজলুর রহমানকে আরো উত্তেজিত করার চেষ্টা করেন। ডাক্তার চালু মানুষ, তিনি জানেন উত্তেজনা ছাড়া বিষয়টা জমবেনা। “এই যে যুদ্ধ করলেন,কি পাইলেন? দেশ স্বাধীন করলেন অথচ এখন এই বয়সে ও আপনে ঠেলা গাড়ি চালান, পুকুর পাড়ে ভাঙ্গা ঘরে থাকেন”। ফজলুর রহমান , নৌ কমান্ডো, ভাবলেশ হীন।“ বিল্ডিং দেওনের লাইগ্গা তো আর দেশ স্বাধীন করি নাই। আমরা আসিলাম সুইসাইড টিম। মরনের লাইগ্গা যুদ্ধ করছি। বাইচ্চা যে রইছি , স্বাধীন দেশটারে দেখলাম, এইডাইতো বেশী”। ডাক্তার হতবুদ্ধি হন,মানুষটা বলে কি? চোখে পানি চলে আসে, এই ফজলুর রহমানরা কি ধাতু দিয়ে তৈরী কে জানে?

তথ্যঋণঃ অপারেশন জ্যাকপট- সেজান মাহমুদ
ব্লগার আলী মাহমেদ
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই ডিসেম্বর, ২০১১ সকাল ৯:৪৬
৩টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

=বেনারসী রঙে সাজিয়ে দিলাম চায়ের আসর=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫২



©কাজী ফাতেমা ছবি
মনে কি পড়ে সেই স্মৃতিময় সময়, সেই লাজুক লাজুক দিন,
যেদিন তুমি আমি ভেবেছিলাম এ আমাদের সুদিন,
আহা খয়েরী চা রঙা টিপ কপালে, বউ সাজানো ক্ষণ,
এমন রঙবাহারী আসর,সাজিয়েছি... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিজ্ঞানময় গ্রন্থ!

লিখেছেন জ্যাক স্মিথ, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৪২

একটু আগে জনৈক ব্লগারের একটি পোস্টে কমেন্ট করেছিলাম, কমেন্ট করার পর দেখি বেশ বড় একটি কমেন্ট হয়ে গেছে, তাই ভাবলাম জনস্বার্থে কমেন্ট'টি পোস্ট আকারে শেয়ার করি :-P । তাছাড়া বেশ... ...বাকিটুকু পড়ুন

অস্ট্রেলিয়ার গল্প ২০২৪-৪

লিখেছেন শায়মা, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:৪৫


চলে যাবার দিন ঘনিয়ে আসছিলো। ফুরিয়ে আসছিলো ছুটি। ছোট থেকেই দুদিনের জন্য কোথাও গেলেও ফিরে আসার সময় মানে বিদায় বেলা আমার কাছে বড়ই বেদনাদায়ক। সেদিন চ্যাটসউডের স্ট্রিট ফুড... ...বাকিটুকু পড়ুন

আপনি কি বেদ, উপনিষদ, পুরাণ, ঋগ্বেদ এর তত্ত্ব বিশ্বাস করেন?

লিখেছেন শেরজা তপন, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫২


ব্লগে কেন বারবার কোরআন ও ইসলামকে টেনে আনা হয়? আর এই ধর্ম বিশ্বাসকে নিয়েই তর্ক বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে সবাই? অন্য ধর্ম কেন ব্লগে তেমন আলোচনা হয় না? আমাদের ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার ‘অন্তরবাসিনী’ উপন্যাসের নায়িকাকে একদিন দেখতে গেলাম

লিখেছেন সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:২৫

যে মেয়েকে নিয়ে ‘অন্তরবাসিনী’ উপন্যাসটি লিখেছিলাম, তার নাম ভুলে গেছি। এ গল্প শেষ করার আগে তার নাম মনে পড়বে কিনা জানি না। গল্পের খাতিরে ওর নাম ‘অ’ ধরে নিচ্ছি।

... ...বাকিটুকু পড়ুন

×