somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বধ্যভূমির অভিজ্ঞতা-১

১২ ই ডিসেম্বর, ২০০৭ রাত ১১:০৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

[ মোহাম্মদপুর ফিজিকাল ট্রেনিং সেন্টার ছিলো আল-বদরদের হেড কোয়ার্টার। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের বুদ্ধিজীবিদের ধরে এখানেই আনা হতো। অমানুষিক অত্যাচার চলত তাদের ওপর। আর তারপর রায়ের বাজর ও মীরপুরের শিয়ালবাড়িসহ বিভিন্ন বধ্যভূমিতে গুলি করে মারা হতো। স্বাধীনতার পর মিলেছে তাদের বিকৃত লাশ। ঢাকার গ্রিনল্যান্ড মার্কেন্টাইল ব্যাংকের চিফ একাউনটেন্ট মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন ভাগ্যবান। তিনিই একমাত্র ব্যক্তি যিনি আল-বদরদের হাত থেকে পালাতে পেরেছিলেন। ১৯৭১ সালের ২১ ডিসেম্বর দৈনিক বাংলায় ছাপা হয়েছিলো ‘বধ্যভূমির অভিজ্ঞতা’ শিরোনামে তার সেই কাহিনী। দীর্ঘ বলে সংক্ষেপে দুই পর্বে দেয়া হলো ]

১৪ ডিসেম্বর সকাল ৯টা। শান্তিবাগে আমার বাসায় শুয়েছিলাম। হঠাত বাইরে ভারি পায়ের শব্দ পেলাম। বেড়ার ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে দেখি কয়েকজন রাইফেলধারী লোক আসছে। রাস্তার দরজায় এসে তারা জোরে জোরে ধাক্কা দিতে লাগল। কর্কশ স্বরে তারা বলছিল- ‘ঘরে কে আছো, দরজা খোলো।’

তারপর নানা কথাবার্তার পর তারা আমাকে ঘর থেকে বের করে নিয়ে গেল। বাসার পাশের একটি মেসের একটি ছেলেকেও তারা ধরে নিয়ে এল। আমাদের তারা মালিবাগ মোড়ে দাঁড় করানো একটি বাসে নিয়ে তুলল। বাসে তুলেই তারা আমার গায়ের জামা খুলে ফেলল এবং একটি কাপড় দিয়ে চোখ শক্ত করে কষে বেঁধে ফেলল। এছাড়া হাত দুটো নিয়েও পেছন দিকে শক্ত করে বেঁধে ফেলল। তারপর বাস ছেড়ে দিলো। পথে আরো কয়েক জায়গায় তারা বাসটি থামালো। আমি ঠিক বুঝতে পারছিলাম না আমরা কোথায় যাচ্ছি। অনুমানে মনে হলো মোহাম্মদপুর, সেকেন্ড ক্যাপিটাল (শেরে বাংলা নগর) কিংবা ক্যান্টনম্যান্টের দিকে যাচ্ছে।

এমনিভাবে ঘণ্টাখানেক চলার পর বাস এক জায়গায় থামল। তারপর আমাদের হাত ধরে একটি ঘরে নিয়ে যাওয়া হলো। ততক্ষণে কথাবার্তায় আমি টের পেয়েছি আমি বদর বাহিনীর হাতে পড়েছি। খানিকক্ষণ পর আমাকে ও আরো একজনকে উপরতলায় নিয়ে গেল। দরজা খুলে একটি রুমের মধ্যে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল। হুমড়ি খেয়ে পড়লাম মেঝের উপর। ঠিক পাকা মেঝের উপর নয়, কিছু লোকের উপর। অনেক কষ্টে সোজা হয়ে বসলাম। আমি ঠিক বুঝতে পারছিলাম না কক্ষের আর সব লোকেরো আমার মতো হাত-চোখ বাধা কিনা। শুধু বুঝতে পারছিলাম ঘরে আমার মতো আরো লোক আছে। এদিকে কষে বাঁধার জন্য আমার চোখ ও কানে দারুণ যন্ত্রনা হচ্ছে। আমি সহ্য করতে না পেরে কাঁদতে শুরু করেছি। মাথায় শুধু একটাই চিন্তা- কি করে এই বর্বর পশুদের হাত থেকে বাঁচতে পারি। আমি কি সত্যি বাঁচতে পারব?

আল্লাহ আল্লাহ বলে আমি উচ্চস্বরে কাঁদতে লাগলাম। ভাবছিলাম বদর বাহিনীর লোকরা তো শুনেছি মাদ্রাসা ও ইসলামী শিক্ষা লাইনের ছেলে। আল্লাহর আহাজারিতে যদি বদর বাহিনীর লোকদের দয়া হয়। যদি দয়াপরবশ হয়ে চোখের ও হাতের বাঁধন একটু খুলে দেয়, নিদেনপক্ষে একটু ঢিলে করে দেয়। অনেকক্ষণ কাঁদার পর কে যেন আমার হাতের বাঁধন খুলে দিল। ফিসফিস করে বলল- সাবধান। হাত খোলা দেখলে আপনাকে পিটিয়ে মেরে ফেলবে।’ কচি কণ্ঠ। বুঝলাম অল্পবয়সী কোনো ছেলে এবং সে বদর বাহিনীর কেউ নয়। আমি তাড়াতাড়ি চোখের বাঁধন ঢিলে করে দিলাম। বাঁধন এমনভাবে রাখলাম, যাতে- আবছা আবছা দেখা যায়। এর মধ্যেই দেখে নিয়েছি, যে আমার হাতের বাঁধন খুলে দিল আট-নয় বছর বয়সী একটি ছেলে। তার দুহাতের চামড়া কাটা। হাত ফোলা। সারা কক্ষে শুধু রক্ত আর রক্ত। এখন সেখানে ইতস্ততভাবে ছড়িয়ে রয়েছে রক্তে রঞ্জিত জামা ও গেঞ্জি। আমার মতো প্রত্যেকের গায়েই গেঞ্জি। তাদের দেহের বিভিন্ন অংশে কাটাছেড়ার দাগ। হাতের বা পায়ের আঙুল কাটা। কারো দেহে দীর্ঘ ও গভীর ক্ষত। কারো হাতে হাত-পায়ের নখ উপড়ে ফেলা হয়েছে।

ছেলেটি আমার হাতে আবার কাপড় জড়িয়ে বাঁধনের মত করে দিল। আমি ভাবছিলাম- আমি কি করে এই জল্লাদদের হাত থেকে বাঁচব। কক্ষটিতে শুধু একটি কাঁচের জানালা, তবে মনে হলো বেশ মজবুত। এল-টাইপের ত্রিতল অথবা চারতলা বাড়ি। বিরাট এলাকা দেয়াল দিয়ে ঘেরা। বাড়িটি সম্ভবত মোহাম্মদপুরের নিকটবর্তী এলাকার কোথাও হবে।

এমনিভাবে সারাদিন কেটে গেল। সন্ধ্যার দিকে বদর বাহিনী বা রাজাকারের দলের লোকজন আরো কিছু লোককে ধরে নিয়ে এল। সন্ধ্যার পর তিন-চারজন লোক আমাদের কক্ষে এলো জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য। একেক করে সবাইকে তারা জিজ্ঞাসাবাদ করা শুরু করল। শুনলাম, কেউ বলছে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, কেউ বলল আমি ডাক্তার, আমি সাংবাদিক, আমি চিফ একাউন্টেন্ট, আমি কম্বাইন্ড মিলিটারি হাসপাতালের সার্জনের ছেলে। লোকগুলোর একজন বলে উঠল, শালা, তুমি ইউনিভার্সিটির প্রফেসর হয়ে এদ্দিন মন্ত্র পড়িয়েছো, আজ আমি তোমাকে পড়াব। তুমি তো গভর্মেন্ট অফিসার, সরকারের টাকা খেয়েছ আর গাদ্দারি করেছ। এবার টের পাবে।

জিজ্ঞাসাবাদের পর শুরু হলো প্রহার। এমনি ধুমধাম মার দেয়া শুরু হলো যে নিঃশ্বাস ফেলারও জো নেই। সবাই চিৎকার করে কাঁদছে। কেউ জোরে জোরে দোয়া দরুদ পড়ছে, আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ জানাচ্ছে। কিন্তু পশুগুলোর সেদিকে ভ্রুক্ষেপও নেই। মারধোর করে প্রায় আধঘণ্টা পরে লোকগুলো চলে গেলো। মার খেয়ে অনেকেই অচেতন হয়ে পড়েছে। রাত তখন অনুমান দশটা। এক অধ্যাপক সাহেব আমার পাশে এসে দাঁড়ালেন। দেয়ালে হেলান দিয়ে বললেন, ভাই, আপনার হাত কি খোলা? আমার বাঁধনটা একটু ঢিলে করে দেন। লুঙ্গিটা হাটু থেকে নিচে নামিয়ে দেন। খানিকপরে কোনোক্রমে দেয়াল ঘেষে বসে তিনি অচেতন হয়ে পড়লেন।

রাত দশটা থেকে অনুমান একটা পর্যন্ত বেশ কয়েকবার বদর বাহিনীর জল্লাদরা আমাদের খানিক পরপর দেখে গেল। রাত প্রায় সাড়ে বারোটায় আমাদের উপরতলা থেকে কয়েকজন মহিলার আর্তনাদ ভেসে এল। সেই আর্তনাদের বর্ণনা দেয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। মাঝে মাঝে রাস্তায় গাড়ির শব্দ শুনতে পেলাম। মারের চোটে প্রায় সবাই অচেতন হয়ে পড়ে রয়েছে। আমি জ্ঞান হারাইনি। আমি আল্লাহকে ডেকে যাচ্ছি। শেষবারের মতো আল্লাহর কাছে আমার যদি কোনো গুনাহ হয়ে থাকে, তার জন্য পানাহ চাইছি। (পরের পর্বে শেষ)
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে এপ্রিল, ২০০৮ দুপুর ২:৫৬
২৯টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে...

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে,
পড়তো তারা প্লে গ্রুপে এক প্রিপারেটরি স্কুলে।
রোজ সকালে মা তাদের বিছানা থেকে তুলে,
টেনে টুনে রেডি করাতেন মহা হুলস্থূলে।

মেয়ের মুখে থাকতো হাসি, ছেলের চোখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

হার জিত চ্যাপ্টার ৩০

লিখেছেন স্প্যানকড, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



তোমার হুটহাট
চলে আসার অপেক্ষায় থাকি
কি যে এক ছটফটানি
তোমার ফিরে আসা
যেন প্রিয় কারো সনে
কোথাও ঘুরতে যাবার মতো আনন্দ
বারবার ঘড়ি দেখা
বারবার অস্থির হতে হতে
ঘুম ছুটে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবনাস্ত

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৪৪



ভোরবেলা তুমি নিশ্চুপ হয়ে গেলে একদম,
তোমার বাম হাত আমার গলায় পেঁচিয়ে নেই,
ভাবলাম,তুমি অতিনিদ্রায় আচ্ছন্ন ,
কিন্তু এমন তো কখনো হয়নি
তুমি বরফ জমা নিথর হয়ে আছ ,
আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে দেশে সকাল শুরু হয় দুর্ঘটনার খবর দেখে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১১

প্রতি মিনিটে দুর্ঘটনার খবর দেখে অভ্যস্ত। প্রতিনিয়ত বন্যা জলোচ্ছ্বাস আসে না, প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার খবর আসে। আগে খুব ভোরে হকার এসে বাসায় পত্রিকা দিয়ে যেত। বর্তমানেও প্রচলিত আছে তবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জেনে নিন আপনি স্বাভাবিক মানুষ নাকি সাইকো?

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:১৮


আপনার কি কারো ভালো সহ্য হয়না? আপনার পোস্ট কেউ পড়েনা কিন্তু আরিফ আর হুসাইন এর পোস্ট সবাই পড়ে তাই বলে আরিফ ভাইকে হিংসা হয়?কেউ একজন মানুষকে হাসাতে পারে, মানুষ তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×