সুপরিকল্পিতভাবে বিকৃত ধর্মোন্মাদনা সৃষ্টি করে আল-বদরে যোগ দিতে তাদের কর্মীদের উদ্বুদ্ধ করত ইসলামী ছাত্র সংঘ। এ ব্যাপারে একটি প্রমাণ হতে পারে ১৯৭১ সালের ৭ নভেম্বর আল-বদর দিবস উপলক্ষে দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকায় ছাপা একটি নাটিকা। মাহফুজুল হক নামে এক আল বদর কমান্ডারের লেখা ‘আলবদর, আলবদর, আলবদর-থ্রি ওয়ান থ্রি, থ্রি ওয়ান থ্রি, থ্রি ওয়ান থ্রি’ নামের একাঙ্কিকাটি তুলে দেওয়া হলো-
প্রস্তাবনা
ফারাবী, আজাদা, ফারুক, আশফাক, বদরুল। এরা ক’জন তরুণ সঙ্গীদের সাথে করেছে অঙ্গীকার। এরা বলে সঙ্গীন আমার বন্ধু। প্রশ্ন করলে এরা হাতের দু আঙুলে তুলে দেখায় ‘ভি’ অর্থাৎ ভিক্টরি। নিশ্চিত বিজয়। তিনশ তের এদের উজ্জ্বলতম দৃষ্টান্ত। তাই প্রত্যয়দৃপ্ত শপথে এরা হাতিয়ার তুলে নেয়। রাইফেল, স্টেনগান, এল.এম.জির মাঝে খুঁজে নেয় জিন্দেগির স্বপ্নিল ফুলঝুরি।
এক
( মোহসিন হলে ফারাবীর কক্ষ। টেবিল, চেয়ার, আলনা, এক গাদা বইতে সাজানো কক্ষ। ফারাবী আধশোয়া অবস্থায় বই পড়ছে। আজাদ ও ফারুকের প্রবেশ।)
আজাদ- কিরে এত মনযোগ দিয়ে কি পড়ছিস?
ফারাবী- আরে তোরা- আয় আয় বোস।
ফারুক- কি পড়ছিলি?
ফারাবী- এই সাইয়েদ কুতুবের বইটা
আজাদ- তারপর কবে যাচ্ছিস?
ফারাবী- কোথায়?
আজাদ- কেন আশফাক তোকে কিছু বলেনি?
ফারাবী- ওহ, আলবদর ট্রেনিংয়ের কথা?
আজাদ- হ্যাঁ, আমরা তো সবাই আগামী দশ তারিখে যাচ্ছি ক্যাম্পে। তুইও যাচ্ছিস তো?
ফারাবী- নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই। যাবনা কি বলছিস (একটু থেমে) সত্যি এটা ভাবতে আশ্চর্য লাগে, আজ এই দেশের বুকে দাঁড়িয়ে এমন প্রকাশ্যে সশস্ত্র ট্রেনিং লাভের সুযোগ পাচ্ছি দেখে। এতদিন যা ছিল কল্পনা আজ তা বাস্তবে পরিণত হতে যাচ্ছে- (থেমে) সত্যি তোদের আনন্দ লাগছে না?
আজাদ- কিন্তু এই আনন্দের সাথে মিশে আছে অনেক বেদনা, অনেক কান্নার ইতিহাস। আজ সারা দেশে কত শত শত মানুষকে শুধুমাত্র ইসলাম অনুসারী হবার অপরাধে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হচ্ছে। জীবন্ত খেজুরের কাঁটা বিছানো গর্তে কবর দেওয়া হচ্ছে। গাছের সাথে বেধে পৈশাচিকভাবে চোখে, মুখে, বুকে গজাল ঠুকে ঠুকে হত্যা করা হচ্ছে। গরম লোহার শলাকা দিয়ে চোখ উপড়ে দিয়ে বলছে, বল আরও ইসলাম ইসলাম বলবি নাকি? শুধু তাই নয়, এদের কেটে টুকরো টুকরো করে ছালায় ভরে নদীতে ফেলে দেওয়া হচ্ছে। এদের রক্তে পদ্মা-যমুনার রক্ত লালে লাল হয়ে যাচ্ছে-
ফারুক-থাম, থাম আজাদ- থাম।
আজাদ- এদের দোষ, এদের দোষ এরা চেয়েছিল পাকিস্তানকে একটা সুন্দর দেশরূপে গড়ে তুলবে। এরা চেয়েছিল এখানে আল্লাহর শ্বাশত জীবন বিধান ইসলামকে প্রতিষ্ঠিত করতে। যাতে পাকিস্তানের মানুষ দুবেলা দুমুঠো ভাত, মোটা কাপড়, একটা আশ্রয়, একটু সুখের মুখ দেখতে পায়। সারাদিন মাটির ঘর্মকান্ত পরিশ্রমের ফলস্বরূপ পায় কিছু সুখের হাতছানি-
ফারাবী- সেদিন শুনলাম মওলানা *মাদানী সাহেব শহীদ হয়েছেন (* সৈয়দ মাহমুদ মোস্তফা আল মাদানী পুর্ব পাকিস্তান নেজামে ইসলামী দলের সহসভাপতি। ১০ আগস্ট ’৭১ ঢাকার অদূরে মিরকাদিমে বক্তৃতা দেওয়ার সময় এই কুখ্যাত দালালকে গুলি করে হত্যা করে মুক্তিযোদ্ধারা)
আজাদ- শুধু মাদানী সাহেব কেন, এরকম প্রতিদিন কত শত শত মাদানী অকাতরে জীবন বিলিয়ে দিচ্ছেন তার খবর রাখিস! গতকাল নোয়াখালী হতে টেলিগ্রাম এল, মাত্র ১০ দিনে সেখানে ৫০ জন ইসলামী ছাত্র সংঘের কর্মী শহীদ হয়েছেন (উদগত কান্না রোধ করে)- এসব ইতিহাস বড় কান্নার ইতিহাসরে- বড় করুণ ইতিহাস
... .... .... ...
ফারাবী- আচ্ছা আমরা ক’জনা যাচ্ছি তাহলে?
আজাদ- প্রথম ব্যাচে প্রায় শ’দুয়েক, পরে আরো আসতে পারে
ফারাবী- সত্যি আমার কিযে আনন্দ লাগছে আজ। আগে যখন ইসলামের ইতিহাস পড়তাম- বদর, ওহুদ, খন্দকের যুদ্ধের ইতিহাস পড়তাম, তখন মনে হতো, আচ্ছা আমরাও অমন ইসলামী মুজাহিদ হয়ে যুদ্ধের ময়দানে নামতে পারি না কেন? কেন আমরাও আল্লাহর পথে শহীদ হওয়ার সুযোগ পাই না? (একটু থেমে) সত্যি আজ সেই সোনালী সুযোগ এসেছে, সত্যি আজ কি আনন্দ লাগছে- কি আনন্দ।
ফারুক- আলবদর আলবদর
সমস্বরে- জিন্দাবাদ, জিন্দাবাদ
(সবাই ক থেকে বেরিয়ে যাবে)
দেখুন রায়ের বাজারে বুদ্ধিজীবিদের বদ্ধভূমি আবিস্কারের পর বিদেশী সংবাদ মাধ্যমে তাদের হত্যার কারণ বলছেন এক স্বজন :