একটু ভূমিকা দিই। বছর দুয়েক আগে বন্ধু রোহন কুদ্দুসের সৃষ্টিতে বেরিয়েছিলো লেখাটা। মেইলবক্স খুড়ে বের করলাম সহ-ব্লগার হাসান মাহবুবের ফরমায়েশে। মূলত একটা গিটার নিয়ে গল্প হলেও এর চরিত্রগুলো খুব চেনা। বাংলা ব্যান্ড সঙ্গীতের বড় দুই প্রতিভা। গল্পটা গাজাখুরিও লাগতে পারে কারো কাছে, কারণ স্বাক্ষী দেয়ার জন্য বেচে নেই গল্পের কেউ। এমনকি যেই গিটারটা নিয়ে লেখাটা- সেটাও কোথায় হারিয়ে গেছে। কিংবা ভেঙ্গে চুরে হয়তো পড়ে রয়েছে কোনো খানে। খোজা হয় না।
......................................................................................................
এই গিটার দিয়েছে আমায় এনে, ভালোবাসার সেই মানুষ,
খুলে দিয়েছে তার চোখ দুটো আমারই জন্য- হয়তো লুকিয়ে কষ্ট নিজের, যেন এক বন্ধু আমার
সুমন- এই গিটার, অ্যালবাম- মেঘের দেশে; জন ডেনভারের দিস ওল্ড গিটার অবলম্বনে
আমার থাকার ঘরটা খুব অগোছালো। দেখলেই বোঝা যায় শোয়া ছাড়া এর বাসিন্দার আর কোনো দায় নেই। এখানে সেখানে পোড়া সিগারেটের টুকরো- ছাই, ফোন কার্ডের সেলোফেন- ইত্যাদি ইত্যাদি। বলে ফুরোবে না। পুরো ঘরটায় একদম বেমানান জিনিসটা কিন্তু বড্ড ঝকঝকে। এক কোণে শোপিসের মতোই এলানো- একটা গিভসন। ঝা চকচক করছে ওপরের চামড়ার ঢাকনি। তারগুলোও বেশ টানটান, নিয়মিতই ওগুলো বাদকের হাতের পরশ পায়।
কিন্তু ওর আগের জন! তার ঠাঁই হয়েছে আমার বিছানার তলটায়। ফ্রেড বোর্ড একটু বাঁকা, সাউন্ড বোর্ডও ফেটে গেছে জায়গায় জায়গায়। তারগুলোয় মরচে ধরেছে। আমার পুরনো গিটার। আমার প্রথম গিটার। কত্ত স্মৃতির, কত্ত সুখ-দুখের সঙ্গী আমার। অযত্নে রেখেছি বটে, কিন্তু ফেলতে পারিনি। ফেলিনি। কারণটা বল্লামই তো।
'৮৩তে ঢাকা কলেজে পড়ার সময়ই হেভি মেটালের সঙ্গে খুব ভাব হয়ে গেল। সেই সূত্রে কবির ভাইয়ের সঙ্গে। ভদ্রলোকের এলপি কালেকশন লোভনীয়, আর রনি জেমস ডিওর আরো ক'জন ভক্ত পেয়ে তার ‘রেইনবো’র দরজা আমাদের জন্য অলটাইম খোলা। আমি, তারেক, মন্টি, রুহুল, সোহেল- আইডিয়াল স্কুল থেকে পাশ করা পুরো দলটাই তার নিয়মিত খদ্দের। বনিএম-অ্যাবা-বিজিস থেকে রাতারাতি এসিডিসি-ডিপ পার্পল আর মটর হেডের ভক্ত হওয়াটা স্রেফ হুজুগেই। লিরিকস নয়, ওই হেভি চেচামেচিতেই আমরা খুজতাম সুর। ওদের না হয় নাই টানলাম, নিজেরটাই বলি- প্রেমে পড়লাম গিটার বাদনের। রিচি ব্ল্যাকমোর শোনার পড়তো আমি পাগলপারা! কবির ভাই তখন চেনালেন আরো কিছু বাজিয়েকে, আমি ভক্ত হলাম পিঙ্ক ফ্লয়েডের ডেভিড গিলমোর, লেড জেপলিনের ডাবল ফ্রেড গিটারিস্ট জিমি পেজ, বাঁহাতি পাগলাটে জিমি হেনড্রিক্স, লাতিনো লিজেন্ড সানতানা, ঈগলসের গ্লেন ফ্রেসহ অনেকের। সময়ের সাথে শুধু গিটার শুনতেই রুচি বদলে চলে গেলাম ব্লুজে- এরিক ক্ল্যাপটন, মার্ক নফলারদের স্লার তখন রক্তে দোলা জাগায়। কিন্তু তখনো আমার গিটার হয়নি।
ইন্টারমিডিয়েটের পর আমার হলো চিটাগাং মেডিকেল। সোহেল ঢাকা, বাকিরা ভার্সিটিতে। তখন আড্ডা বসত আমার প্রথম স্কুল মনোয়ারা শিশুবাগের উল্টোদিকে এজি অফিসের গ্যারেজে। আইডিয়ালেরই রুবেল সলিমুল্লাহ মেডিকেলে চান্স পেয়েছে। গানের গলা ওর বরাবরই ভালো। সেই প্রথম গিটার নিয়ে এল একটা। ওই প্রথম খুব কাছ থেকে আমার গিটার ছুঁয়ে দেখা। যদিও সেই সময়টায় বেশ কনসার্ট হতো ঢাকায়। সোলস, মাইলস, সুইডেনের প্রবাসিদের ব্যান্ড ওয়েভস এর প্রতিটি শো তে আছি আমরা। ওয়েভসের মিনু তো আমাদের স্বপ্নরাণী! তার সঙেগ ‘গুরু’ আযম খানের কনসার্ট মানেই বিনা টিকেটে দেখতে হবে। এবং দরকারে মারামারি করেও।
পাবলিক লাইব্রেরির সামনে গাড়ি পুড়িয়েছি আমরা সোলসের অনুষ্ঠানে ঢুকতে না পেরে। রুবেল মাথায় ঢোকালো নিজে বাজিয়েও গান গাওয়া যায়, চেষ্টা করলে আমিও হতে পারি একজন মার্ক নফলার! কিন্তু ততদিনে রক্তে আরেকটা জিনিস ঢুকে গেছে- ব্রাউন সুগার। গাঁজা-চরস বা হ্যাস অয়েলের চেয়েও চটকদার মৌতাত। কিন্তু নিয়মিত না নিলে শরীর বেহাল হয়ে পড়ে।
চিটাগাংয়ে গিয়েই একদম সোনার খনিতে পড়লাম। আমার বেয়াই মাসুদের সূত্রে আড্ডা দিতাম ফরেস্ট হিলে। ওখানেই সোলসের কিবোর্ডিস্ট সুহাসের সঙ্গে পরিচয়। পার্থ বড়–য়া আমাদের মালবিকাদির ভাই, সে তখন বাজায় ম্যাসেজে। জেমস ফিলিংস নামাচ্ছে- এরা সবাই বয়সে আমার বড় হলেও বেয়াই সূত্রে ইয়ার। আমার ব্রাউনসুগারটা ওদের পছন্দ হয়নি, বিকল্প শেখালো ফেন্সিডিল।
এর মাঝে ঢাকায় এলাম ছুটিতে। ছন্দার সঙ্গে ধুমধারাক্কা প্রেম বলে তখন সপ্তাহে ৫ দিনই আমার ছুটি। কিন্তু সুগারের সঙ্গে গোপন প্রেমটাও চলছে চুটিয়ে। কাটাবনে গেলাম মাল কিনতে, দেখি হ্যাপি আখন্দ হাতে একটা শাড়ি! বোঝাই যায় তুলে এনেছে, 'আড্ডা'র (ওখানেই কেনাবেচা ও সেবন) খালাকে সাধছে ’মিনিমাম দাম ৫০০ টাকা, দুইটা মাল তো দিবেন’। আর আমার মাথায় তখন ঘুরছে, ‘হ্যাপি আখন্দ’- যার ’আবার এলো যে সন্ধ্যা’ আর ‘এই নীল মনিহার’ বাংলা ব্যান্ড গানের ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছে! আমার পকেট তখন গনগনে গরম। সালাম দিলাম হ্যাপি ভাইকে। পাত্তাই দিলেন না! ভাবলেন আর্ট কলেজের জুনিয়র কেউ। বেশ বিনয়ের সঙ্গে পেশ করলাম আর্জিটা, 'আমি আপনার মহাভক্ত, কত মাল খাইবেন খাওয়ামু। খালি একটু গান শোনান।' তখনো শাড়ি ছাড়েননি হাত থেকে। ভাবছেন প্রস্তাবটা বোঝা গেল। এরপর বললেন, গান শুনলে বাসায় আইস, নাইলে ক্যামপাসে। এখন ব্যাড়ায় আছি। হাল ছাড়লাম না। ইনিয়েবিনিয়ে বললাম- চিটাগাং থাকি। এইখানে এতদুর আসছি, আপনাকে পাইছি আমার জীবন ধন্য। গান শোনান, মাল কত খাইবেন!
তখন সন্ধ্যা প্রায় হয় হয়। বললেন- কিনো মাল। নিলাম একসঙ্গে ৫ গ্রাম! এই বার একটু আগ্রহী হলেন মনে হলো। বললেন কই যাবা? বললাম -আমার বাসাতেই চলেন। ছাদ আছে বড়, চিলেকোঠায় মাল খামু তারপর পিনিকে গান শুনমু। জানতে চাইলেন গিটার আছে কিনা, বললাম- না। উনি সম্ভবত আজিমপুর থাকতেন। কিন্তু আমাকে ওখানে নেওয়ার কোনো ইচ্ছে তার নেই। এতো জুনিয়র পোলার লগে দেখলে সমস্যা! শুধু বললেন দেখি ম্যানেজ করা যায় কিনা!
রিকশা ঘুরিয়ে নিলেন এলিফেন্ট রোডের দিকে। সঠিক জায়গাটা স্মরণ নেই, সম্ভবত ‘গীতাঞ্জলী’র সামনে। রিকশা দাঁড় করিয়ে নেমে পড়লেন। ফিরলেন ক্যাপ পরা একজনকে নিয়ে। হ্যাপি ভাইর বন্ধু। আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন ছোটভাই বলে। নিলয় দাসকে ওই প্রথম দেখি আমি।
পরের অংশটা সারমর্ম এরকম। হ্যাপি ভাই বললেন এই মুহূর্তে নিলয় ছাড়া কেউ গিটার ম্যানেজ করতে পারবে না, আর তাকেও সঙ্গে নিতে হবে। নিলয় দা যে কত বড় মাপের বাজিয়ে তা তখনও জানি না আমি। তবে আপত্তি করার প্রশ্নই ওঠে না। বাসায় গেলাম আমি রিকশার সিটের ওপরের দিকে, দুপাশে নিলয় দা আর হ্যাপি ভাই। গিটারটা তেমন আহামরি কিছু ছিল না। মানে ব্র্যান্ড আইটেম না। তবে সুর ভালো। মাল খাচ্ছি, নিলয় দা তার পালার টান দিয়ে বাজাচ্ছেন। আমি সুপারিশ করছি আর দেখছি হুবহু তুলে দিচ্ছেন। সানতানা তো সানতানা, বাদ পড়ল না বড় বাজিয়েদেও কেউ।
এরপর হ্যাপি ভাইয়ের গান। মাল পুরোটা শেষ হয়নি। ন’টার দিকে নিলয় দা কি কাজ আছে বলে উঠে পড়লেন। আমরা আছি। হ্যাপি ভাইয়ের গলায় তখন বাজছে, নীল নীল শাড়ি পড়ে, আবার এল যে সন্ধ্যা, কে বাশি বাজায় রে। আমার তখন ঈদ। পুরো ঝুম ধরল যখন তখন বেলা প্রায় ১২টা বাজে, ছন্দা এর মাঝে দুবার উকি দিয়ে গেছে। মানুষ আছে দেখে কিছু বলেনি। অবশ্য আমাদের কে মাল খেতে দেখেনি ও।
চোখ ঢুলুঢুলু হ্যাপি ভাইকে রিক্সায় তুলে দিয়ে যখন চিলেকোঠা সাফ করছি তখন দেখি গিটারটা রয়ে গেছে!
দুদিন পর চিটাগাং ফিরলাম যখন তখন আমার সঙ্গী ওটা। কিন্তু বাজাতে তো পারি না। উকিল ধরলাম মেডিকেলেই আমার পাড়াতো বড় ভাই জেমি কে, উনি ওনার মতো বাজালেন কিন্তু শিখলাম না কিছুই। মিজান আরিফ ভাই, তুহীন ভাইরা বললেন কর্ড শেখো আগে। আমার কাছে ওটা হিব্র“ ভাষা! উদ্ধার করলেন আমাদেও মিতুর প্রেমিক সোহাগ ভাই। তার ছোটজন চন্দন উইনিংয়ের ভোকাল কাম গিটারিস্ট। তার কাছেই হাতে খড়ি। একদম চার্ট দিয়ে দিলেন।
আমার ইচে।ছ ছিল ফরেস্ট হিলের আড্ডায় একটু চমক দেব- দেখ আমিও পারি! কিন্তু ব্যাপারটা যে সহজ নয় সেটা টের পেলাম বাজাতে গিয়ে। বা হাতের আঙ্গুলে আর ডান হাতের বুড়োটায় রীতিমতো ফোস্কা! এর মধ্যে আমাকে ভালোমতো পেয়ে বসেছে হেরোইন। পার্টির বড় ভাইরা একদিন ডেকে খুব শাসালেন, মদ খা, গাঞ্জা খা, তোরে মানা করছে কেউ। ওই বালটা খাছ কেন? ওই অপমানেই ভাবলাম ঠিক আছে এবার ছাড়তে হবে। তাই শরীরে ব্যাড়া নিয়েই আমি দিন রাত গিটার সাধনায় রত।
এভাবেই একদিন হঠাৎ করেই দেখি আমার মুখ থেকে বেরিয়ে আসছে, আবার এলো যে সনধ্যা, কিন্তু সমান তালে হাতে চলছে! গিটারের দিকে তাকাতে হচেছ না! কর্ডে ভুল ভাল হচ্ছে না। এরপর বেশ কিছু গান তুলে ফেললাম। ফরেস্ট হিল তখন মাথা থেকে বাদ। আমার উলু বনে শিয়াল রাজা হওয়াই ভালো মনে হলো। ব্যাস অডিটরিয়ামের সামনে বিশাল গাজার আড্ডা, মটর সাইকেল-গাড়ির ঘেরে বসে মিশু আজম খান আর আমি রকেট। সমানে চলছে- আসি আসি বলে তুমি আর এলে না, অভিমানী, ও চাঁদ সুন্দর রূপ তোমার। একই গান প্রতিদিন।
এর মধ্যে সাহিত্য-সংস্কৃতিক সপ্তাহে গান গেয়ে দুটো করে সেকেন্ড প্রাইজও জুটিয়ে নিলাম আমি আর মিশু। তবে সত্যিটা হচ্ছে, একটায় প্রতিযোগী ছিল তিন জোড়া, আরেকটায় আমরাই দ্বিতীয়! তবে গান চলেছে। ততদিনে হ্যাপি ভাই মারা গেছেন। সম্ভবত ’৮৭ সালের ২৮ ডিসেম্বর। ওনার দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকীতে আমরা বেশ বড় একটা প্রোগ্রাম করেছিলাম। নিলয়দার সঙ্গে এরপর দেখা হয়েছে একবার চিনতে পারেননি। তার ছাত্র আর্ট কলেজের শিল্পী একসময় আমার মালের পার্টনার হয়েছে। জুনিয়রও বেশ কয়েকজন শূনেছি ওনার কাছে শিখেছেন।
গত ১১ জানুয়ারি খবর পেলাম নিলয় দাও নেই।
কীভাবে, সেটা আর জানার ইচ্ছে হয়নি। জিনিয়াসদের মৃত্যুটা তাদের জন্ম ও কর্মের মতোই অস্বাভাবিক হয়। আমি নেশা ছেড়েছি বেশিদিন হয়নি, প্রায় বছর তিনেক হলো। গিটার ধরেছি আবার সাত বছর বাদে। নিজের মনে বাজাই। অর্থহীন-এর সুমন আর অর্নবের ফ্যান এখন। কিন্তু নতুন গিটারে। পুরনো গিটারটা আমার স্মৃতির সঙেগই এখন মরচে ধরা। ওটার অ্যান্টিক ভ্যালু! পুরো ব্যাপারটা নতুন করে ভাবতে হবে।
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই মার্চ, ২০০৯ দুপুর ১২:৪৭

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



