somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

অন্যরকম একাত্তরের চিঠি

২১ শে এপ্রিল, ২০০৯ সন্ধ্যা ৬:৫৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

একাত্তরে রণাঙ্গনে থাকা মুক্তিযোদ্ধাদের লেখা চিঠি এই মুহূর্তে বেশ আলোচিত। চলুন আজ বরং মুক্তিযোদ্ধাদের ছিনতাই করা চিঠি নিয়ে কিছু জানা যাক। ছিনতাই শুনে অবাক হচ্ছেন বুঝি! কথাটায় কিন্তু কোনো ভ্রান্তি নেই। তারা ছিনতাই করতেন, আবার ফেরতও দিতেন। কিন্তু মাঝখানে বদলে যেতো অনেক কিছুই।

ভারতীয় সেনাবাহিনীর কর্ণেল রিখীর নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধকালীন মুজিব নগর সরকারের তথ্য ও প্রচারণা বিভাগে একটি বিশেষ কোর্স করানো হয়েছিলো। এটির বিষয়বস্তু ছিলো সাইকোলজিকাল ওয়ারফেয়ার। মনস্তাত্বিক যুদ্ধনীতি। নানা কূটকৌশলে শত্রুর মনোবল ভেঙ্গে দেয়ার এই মাধ্যমে ব্যবহার করা হতো প্রচারমাধ্যমকে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রসহ নানা প্রকাশনাই যুক্ত ছিলো এতে। আর এই লড়াইয়ে একটি অন্যতম ভূমিকা রেখেছিলো পাকিস্তানী সেনাদের লেখা চিঠি ছিনতাই। তারা বিশেষ কিছু এলাকার ডাকবাক্স ভেঙে এই চিঠিগুলো নিয়ে আসতেন। কলকাতায় সদর দপ্তরে এগুলো বাংলায় অনুবাদ করা হতো। তারপর বদলে দেওয়া হতো চিঠির ভাষা, আর তা ফের নতুন করে লেখা হতো উর্দূ, পশতু নানা ভাষায়। মুক্তিযোদ্ধারা সেই চিঠি নিয়ে আবারও রেখে আসতেন আগের জায়গায়। সেগুলো চলে যেতো গন্তব্যে।

প্রসঙ্গত উল্লেখ করতেই হয়, পাকিস্তানী সেনাবাহিনীতে জাতিগত বিভেদটা বেশ প্রকটই ছিলো। সংখ্যাগরিষ্ঠ পাঞ্জাবীদের সঙ্গে বেলুচ, পাঠান ও সিন্ধের সেনাদের নানা বৈষম্যের ব্যাপারটা কাজে লাগাতেই এই কৌশল গ্রহণ করেছিলো মুজিব নগর সরকার। কৌশলে এসব চিঠিতে এই অবিশ্বাস ও দ্বন্দ্বের কথাগুলো ঢুকিয়ে দেওয়া হতো। যার অংশবিশেষ নিয়ে ১৫-২০ দিন পর বিশেষ ফলোআপ আর্টিকেল প্রকাশিত হতো বিভিন্ন পত্রিকায়। এতে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আসা কোনো বিদেশী পর্যটকের উদ্ধৃতি দিয়ে লেখা হতো পাঠান, বেলুচ ও পাঞ্জাবীদের মধ্যে পারস্পরিক অবিশ্বাসের নানা মনগড়া তথ্য যা আদতেই কাজে আসতো। একটি ঘটনা হিসেবে বলা যায় যে একবার প্রচারিত হলো লাহোর বিমানবন্দরে কজন পাকিস্তানী সেনার লাশ এত তারিখে নামানো হবে। সেদিন সেখানে উদ্বিগ্ন আত্মীয়স্বজনের ভিড় শেষ পর্যন্ত যুদ্ধবিরোধী মিছিলে রূপ নিয়েছিলো।

চলুন এবার দেখা যাক এ ধরণের চিঠির কিছু নমুনা। এক পাঞ্জাবী সেনা তার মাকে লিখেছে :

"আমার প্রিয় আম্মি, আমার সালাম এবং চুমু নিও। স্বাস্থ্য ও মন ভালো নেই। তোমাদের থেকে অনেক দূরে আছি যুদ্ধক্ষেত্রে। কোন সময় শত্রুর গুলিতে মৃত্যু হয় ঠিক নেই। আমার জন্য দোয়া করো। এ যুদ্ধ কবে শেষ হবে জানি না। এ যুদ্ধের কোনো দরকার ছিলো না। সামরিক জান্তারা অহেতুক এ যুদ্ধ লাগিয়ে আমাদের জীবনকে বিপন্ন করে তুলেছে। তোমার বুক খালি করার ব্যবস্থা করেছে। এ যুদ্ধে আমরা কিছুতেই জয়ী হতে পারবো না। পাকিস্তানকেও বাচাতে পারবো না।

শহর বা ক্যান্টনমেন্ট থেকে বের হলে আর নিরাপদে ফিরে আসার ভরসা নেই। মফস্বলে খাবার পাওয়া যায় না। উপোস করতে হয় দিনের পর দিন। সামনে পেলে দেখতে তোমার ছেলে কত শুকিয়ে গেছে। বাঙালী মুক্তিযোদ্ধারা গোপন আস্তানা থেকে আমাদের ওপর গোলাবর্ষণ করে। মারা গেলে আমাদের লাশগুলো বাংলাদেশের পথেপ্রান্তরে বনেজঙ্গলে পড়ে থাকে। শিয়াল-কুকুর-শকুন ছিড়ে খায়। দাফন হয় না। আর পাঠান বেলুচি ও সিন্ধুর সৈন্যরা বেইমান। তারা প্রাণ দিয়ে যুদ্ধ করে না। গোপনে বাঙালীদের পক্ষে কাজ করে। এদের বেইমানীর জন্য পাঞ্জাবী সৈন্যদের মৃত্যু হচ্ছে বাঙালীদের হাতে। .... এ কারণে এই বেইমানরা যুদ্ধক্ষেত্রে আমাদের সঙ্গে গাদ্দারী করছে। তোমরা দাবী করো এ যুদ্ধ থামাতে। আর বলো এই বেঈমান সিন্ধি, পাঠান ও বালুচ সৈন্যদের সম্পর্কে সতর্ক হতে, তাদের ফিরিয়ে নিতে। ওরা যুদ্ধে থাকলে কোনো পাঞ্জাবী সৈন্য বাচতে পারবে না।"

আবার স্ত্রীর কাছে চিঠিতে লেখা হতো : "তোমরা পাঞ্জাবের যেসব হতভাগিনী মা-বোন, স্ত্রী, বাবা, ভাই, ছেলেমেয়ে আছো, তারা যদি যুদ্ধ বন্ধ ও বাঙ্গাল মুলুক থেকে আমাদের ফিরিয়ে নেয়ার দাবিতে পাঞ্জাবে আন্দোলন শুরু করো তাহলে সামরিকজান্তা বাধ্য হবে এই যুদ্ধ থামাতে। তা না হলে ইকবালের স্বপ্নের পাকিস্তান আর আস্ত থাকবে না। বরং প্রত্যেক পাকিস্তানী সৈনিকের মাবাবা হবে পুত্রহারা, ভগ্নি হবে ভাইহারা, স্ত্রী হবে স্বামীহারা আর সন্তানরা হবে এতিম।"


বেলুচ বা পাঠান সৈন্যের লেখা চিঠিতে থাকতো : " বাংলা মুল্লুকে যুদ্ধ করতে এসে জীবনের নিরাপত্তা নেই। ঠিকমতো খাবার পাই না। হারামী পাঞ্জাবী কমান্ডার আমাদের ঠিকমতো খাবার বা বেতন দেয় না। পাঠান ও বালুচদের পাঞ্জাবীরা বিশ্বাস করে না। তারা আমাদের মোনাফেক বলে গালি দেয়। তারা বলে আমরা নাকি পাকিস্তান চাই না। আমরা যারা সিন্ধি, তারা নাকি জিএম সৈয়দের সমর্থক ও সিন্ধূর স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখি। আর পাঠানরা নাকি স্বাধীন পাখতুনিস্তান গঠন করতে চায়। পাঞ্জাবী অফিসার ও সৈন্যরা এভাবে আমাদের বিরুদ্ধে গীবত করে ও গালাগালি করে। আমাদের সঙ্গে দূর্ব্যবহার করে।.... যুদ্ধক্ষেত্রে পাঞ্জাবীরা পেছনে থাকে, আমাদের ঠেলে দেওয়া হয় সামনে। মুক্তিদের গুলিতে ও পেতে রাখা মাইনে আমাদের জীবন যায়। যুদ্ধে আমরা মারা গেলে লাশগুলো পর্যন্ত উদ্ধার করা হয় না। শিয়াল-কুকুর ছিড়ে খায়। অন্যদিকে পাঞ্জাবীদের লাশ হেলিকপ্টারে করে ঢাকায় নিয়ে মুসলিম কায়দায় দাফন করে।...তাই আল্লাহ রসুলের দোহাই, তোমরা আর ঘরে বসে থেকো না। তোমরা তোমাদের অসহায় পুত্র, স্বামী ও আত্মীয় স্বজনদের রক্ষার জন্য আল্লাহর নামে রাস্তায় বের হয়ে পড়ো। আর দেরী করো না। আর চিঠি দেয়ার সুযোগ পাবো কিনা জানি না। এটাই হয়তো আমার শেষ খত। খোদা হাফেজ।"

এসব চিঠির একদম প্রভাব যে পড়েনি তা নয়। অনেক জায়গাতেই এসব চিঠির প্রতিক্রিয়া হিসেবে দাঙ্গা হয়েছে। পাঠান-বেলুচ-পাঞ্জাবীদের মধ্যে অবিশ্বাস ও দূরত্ব বেড়েছে। এ ছিলো সফল এক যুদ্ধ।


২২টি মন্তব্য ৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছবির গল্প, গল্পের ছবি

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৩:১৫



সজিনা বিক্রি করছে ছোট্ট বিক্রেতা। এতো ছোট বিক্রেতা ও আমাদের ক্যামেরা দেখে যখন আশেপাশের মানুষ জমা হয়েছিল তখন বাচ্চাটি খুবই লজ্জায় পড়ে যায়। পরে আমরা তাকে আর বিরক্ত না করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে লীগ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে জামাত

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৪৬


বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪৩

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

চা বাগানের ছবি কৃতজ্ঞতা: http://www.peakpx.com এর প্রতি।

আমাদের সময় একাডেমিক পড়াশোনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চয়নিকা বইয়ের গল্পগুলো বেশ আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, চাষীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×