somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

RK 623 : মুক্তিযুদ্ধের রহস্যময় এক নৌ-কাফেলা

১৩ ই সেপ্টেম্বর, ২০০৯ দুপুর ২:১৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

১০ ডিসেম্বর ১৯৭১। পাকিস্তানের ভারত আক্রমণ এবং সুবাদে মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সরাসরি অংশগ্রহনের এক সপ্তাহ পুরো হয়েছে। পূর্ব রণাঙ্গনে মুক্তিবাহিনীর দখলকৃত অঞ্চল দিয়ে ঢাকার দিকে এগোচ্ছে তাদের পদাতিকরা। আকাশে একচ্ছত্র অধিপত্র ভারতীয় বিমান বাহিনীর। জলেও তাই। পাকিস্তানী সাবমেরিন পিএনএস গাজীর অকালপ্রয়াণে বঙ্গোপসাগরে একাধিপত্য ক্যারিয়ার আইএনএস বিক্রান্তের। এই নেভাল ফ্লিট থেকে একে একে উড়ে চট্টগ্রাম-চালনা-খুলনা-মংলায় হামলা চালাচ্ছে তাদের হোয়াইট স্নেক (সি হক) ও কোবরা (এলিজ) বোমারুরা।

দুটো তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনার জন্ম এসময়, গুরুত্বের বিচারেও তাদের মূল্য সীমাহীন। প্রথমটি মার্কিন সপ্তম নৌবহর ইউএসএস এন্টারপ্রাইজের বঙ্গোপসাগর অভিমূখে যাত্রা। বর্তমান গতিতে (ঘন্টায় ৩৫ নট) তিন-চারদিনের মধ্যেই যুদ্ধক্ষেত্রে নাক গলাবে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী এই পারমানবিক নৌবহর। দ্বিতীয়টি পাকিস্তানীদের একটি ইন্টারসেপটেড সিগনাল। এই বার্তার সারমর্ম হচ্ছে রাজাপুরে পাকিরা খুব গোপনে ছোট ছোট নৌযান দিয়ে একটি নৌবহর গঠন করেছে। এর মাধ্যমে চট্টগ্রামে পালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছে কিছু উচ্চপদস্থ সেনাকর্মকর্তা ও গুরুত্বপূর্ণ ক’জন রাজনীতিবিদ এবং ব্যবসায়ী। এরপর চট্টগ্রাম থেকে কিছু বানিজ্যিক জাহাজের ছদ্মাবরণে তারা মার্কিন নৌবহরে পালাবে। পাকিস্তানীদের এই গোপন কাফেলার কোড নেম- RK 623, যার অর্থটা বের করা সম্ভব হয়নি।

যদিও সপ্তম নৌবহরের বঙ্গোপসাগরমূখী অভিযাত্রাকে নিক্সন অন্যভাবে ব্যাখ্যা দিয়েছেন পরে। তার বক্তব্য ছিলো পূর্ব পাকিস্তানে মার্কিন নাগরিকদের উদ্ধার করার জন্যই এন্টারপ্রাইজকে পাঠিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু গানবোট ডিপ্লোমেসির এই কূটব্যাখ্যাটা কেউই বিশ্বাস করেনি। ভারতকে ভয় দেখানোর পাশাপাশি মিত্র ইয়াহিয়ার খুনে সহযোগীদের বিপদ থেকে রক্ষা করাই ছিলো এই মিশনের মূল উদ্দেশ্য।

দুয়ে দুয়ে চারের অঙ্কটি মেলানোর পর পূর্ব রণাঙ্গনে ভারতীয় নৌপ্রধানের তরফে একটি নির্দেশমূলক বার্তা আসে ভারতীয় নৌবহরের অধ্যক্ষের বরাবর। এতে লেখা ছিল:

১. জানা গেছে আজ রাতে পূর্ব পাকিস্তানের সেনাধ্যক্ষসহ শত্রুপক্ষের বেশ কজন উচ্চপদস্থ অফিসার পালানোর চেষ্টা করবে এবং সম্ভবত তারা নৌপথ ব্যবহার করবে। কিছু কর্মকর্তা আকাশপথ ব্যবহারের চেষ্টা করবে। উপকুলে সম্ভবত মাইন ছড়িয়ে রাখা হয়েছে।

২. তোমাদের মিশন হচ্ছে :

ক. চট্টগ্রাম বিমানবন্দরকে ব্যবহার অনুপযোগী করা
খ. বিমান এবং জাহাজ থেকে বন্দরে জাহাজগুলো আক্রমণ।
গ. কুতুবদিয়ার আউটার এবং ইনার চ্যানেলে মাইন স্থাপন করা।

৩. সম্ভবত পূর্ব রণাঙ্গনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মিশন হতে যাচ্ছে এটি। শত্রুকে যে কোনো উপায়ে ধ্বংস করতেই হবে। শুভকামনা রইল।




পাকিরা এই ঝুঁকিটা নেওয়ার পেছনে একটি হিসেব কাজ করছিলো। তাদের কাছে খবর ছিলো আইএনএস বিক্রান্তের জ্বালানী ফুরোচ্ছে। রিফুয়েলিংয়ের জন্য যাওয়া ও আসায় এর দুদিন লাগবে। এই দুদিনের অনুপস্থিতি সফলভাবে কাজে লাগাতেই মূল পরিকল্পনা। এর বাইরে আরেকটি গোয়েন্দা প্রতিবেদনের খবর আমরা পাই যেখানে রাও ফরমান আলীসহ বেশ কজন সিনিয়র পাকিস্তানী অফিসারকে হেলিকপ্টারে করে চট্টগ্রামে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা ফাঁস হয়ে যায়। সুবাদেই সেরাতে ঢাকায় বিমানহামলা তীব্রতর করেছিল ভারতীয় বিমান বাহিনী।



১১ ডিসেম্বর দিনটা ‘নো উইন্ড ডে’ যে কারণে বিক্রান্ত থেকে সি-হক ওড়ানো সম্ভব হচ্ছিল না। দায়িত্বটা নেয় এলিজ। ভোর ৬টায় প্রথম এলিজটি আকাশে ওড়ে। রাজাপুরে RK 623র সম্ভাব্য গোপনস্থানসহ বেশ কটি জায়গায় বোমাবর্ষন করে এটি। পাশাপাশি নজরদারি উড়াল দেয় বরিশাল, মেঘনা নদী এবং দক্ষিণ শাহবাজপুরের ওপর।

সকাল দশটায় আরেকটি এলিজ একই উদ্দেশ্যে ওড়ার পর অদ্ভুত একটি ব্যাপার লক্ষ্য করে। ছোট একটি দ্বীপ নড়াচড়া করছে! ব্যাপারটা কি ভালো করে দেখার জন্য ডাইভ দেয় এলিজ এবং কাছাকাছি আসতে বুঝে যায় এটি আসলে একটি গানবোট (পরে এর পরিচয় নিশ্চিত হওয়া গেছে পিএনএস যশোর বলে)। খুব কাছাকাছি অবস্থানে থাকা কয়েকটি বার্জ ও একটি টাগবোট সহকারে একটি বহর এটি। বিমানের চোখে ধুলো দিতে কৌশলে উপরিভাগে কাদা ও ঘাসের চাপড়া ব্যবহার করা হয়েছে যার জন্য এটিকে দ্বীপ মনে হয়। বেশ কিছু বিমানবিধ্বংসী কামান দিয়ে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সাজানো হয়েছে বহরটির। এলিজের বৈমানিক বুঝে যান RK 623 এর দেখা পেয়ে গেছেন তিনি।
রকেট এবং ডেপথচার্জ সহকারে আক্রমনে যায় এলিজ। সঙ্গী হয় আগেরটিও। বহরের কামানগুলো গর্জে ওঠে, নিস্তব্ধ হতেও সময় নেয় না। একটি এলিজে ৬টি বুলেট আঘাত হানে, কিন্তু দক্ষ পাইলট তা ফিরিয়ে নিয়ে যান ক্যারিয়ারে। বিধ্বস্ত পাকি নৌবহর ছত্রখান হয়ে যায়। সাড়ে ১১টায় একই জায়গায় দুটো সন্দেহজনক বজরায় হামলা চালায় আরেকটি এলিজ। ডেপথ চার্জে বিস্তর ক্ষয়ক্ষতি হয় নৌযান দুটোর। পাইলট সাঁতরাতে দেখেন সেনাবাহিনীর পোষাকধারী যাত্রীদের।

একই সময় তুমুল আক্রমণে চট্টগ্রাম নৌবন্দর একদমই ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ে। এভাবেই ভেস্তে যায় পাকিদের একটি পালানোর চেষ্টা।



সূত্র : ভারতীয় নৌবাহিনীর দলিলপত্র

কৃতজ্ঞতা : জন্মযুদ্ধ ‘৭১ (পান্ডুলিপি)
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই সেপ্টেম্বর, ২০০৯ দুপুর ২:২৭
৪টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

হেঁটে আসে বৈশাখ

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০০


বৈশাখ, বৈশাখের ঝড় ধূলিবালি
উঠন জুড়ে ঝলমল করছে;
মৌ মৌ ঘ্রান নাকের চারপাশ
তবু বৈশাখ কেনো জানি অহাহাকার-
কালমেঘ দেখে চমকে উঠি!
আজ বুঝি বৈশাখ আমাকে ছুঁয়ে যাবে-
অথচ বৈশাখের নিলাখেলা বুঝা বড় দায়
আজও বৈশাখ... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছায়ানটের ‘বটমূল’ নামকরণ নিয়ে মৌলবাদীদের ব্যঙ্গোক্তি

লিখেছেন মিশু মিলন, ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



পহেলা বৈশাখ পালনের বিরোধীতাকারী কূপমণ্ডুক মৌলবাদীগোষ্ঠী তাদের ফেইসবুক পেইজগুলোতে এই ফটোকার্ডটি পোস্ট করে ব্যঙ্গোক্তি, হাসাহাসি করছে। কেন করছে? এতদিনে তারা উদঘাটন করতে পেরেছে রমনার যে বৃক্ষতলায় ছায়ানটের বর্ষবরণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

বয়কটের সাথে ধর্মের সম্পর্কে নাই, আছে সম্পর্ক ব্যবসার।

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৫০


ভারতীয় প্রোডাক্ট বয়কটটা আসলে মুখ্য না, তারা চায় সব প্রোডাক্ট বয়কট করে শুধু তাদের নতুন প্রোডাক্ট দিয়ে বাজার দখলে নিতে। তাই তারা দেশীয় প্রতিষ্ঠিত ড্রিংককেও বয়কট করছে। কোকাকোলা, সেভেন আপ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মানুষের জন্য নিয়ম নয়, নিয়মের জন্য মানুষ?

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৫:৪৭



কুমিল্লা থেকে বাসযোগে (রূপান্তর পরিবহণ) ঢাকায় আসছিলাম। সাইনবোর্ড এলাকায় আসার পর ট্রাফিক পুলিশ গাড়ি আটকালেন। ঘটনা কী জানতে চাইলে বললেন, আপনাদের অন্য গাড়িতে তুলে দেওয়া হবে। আপনারা নামুন।

এটা তো... ...বাকিটুকু পড়ুন

একজন খাঁটি ব্যবসায়ী ও তার গ্রাহক ভিক্ষুকের গল্প!

লিখেছেন শেরজা তপন, ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:০৪


ভারতের রাজস্থানী ও মাড়ওয়ার সম্প্রদায়ের লোকজনকে মূলত মাড়ওয়ারি বলে আমরা জানি। এরা মূলত ভারতবর্ষের সবচাইতে সফল ব্যবসায়িক সম্প্রদায়- মাড়ওয়ারি ব্যবসায়ীরা ঐতিহাসিকভাবে অভ্যাসগতভাবে পরিযায়ী। বাংলাদেশ-ভারত নেপাল পাকিস্তান থেকে শুরু করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×