দেশবাসী এমনকি বিশ্ববাসীও পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ও পূর্ব পাকিস্তানের বিজয়ী সংখ্যাগুরু দলের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের মধ্যে সমঝোতার ব্যাপারে কিছুটা আশাবাদী ছিল। আওয়ামী লিগের সাধারণ সমপাদক তাজউদ্দিন আহমেদ বলেছিলেন, 'আর আলোচনা নয়, এবার সুসপষ্ট ঘোষণা চাই।' জুলফিকার আলী ভুট্টো ইয়াহিয়ার সঙ্গে এক আলোচনার পর সংবাদ সম্মেলনে মন্তব্য করলেন, 'পরিস্থিতি অত্যন্ত আশঙ্কাজনক।'
সম্মেলন শেষে সাংবাদিকদের কাছে বঙ্গবন্ধু খবর শুনে খুবই চিন্তিত হলেন। তিনি আওয়ামী লিগ নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে বসলেন।
সবাই ইয়াহিয়া-মুজিবের বৈঠকের ব্যর্থতা সমপর্কে জেনে গেল। খবর এল কিছুক্ষণ আগে ইয়াহিয়া খান প্রেসিডেন্ট ভবন থেকে সাদা পোষাকে বেরিয়ে বিমান বন্দরের দিকে গেছেন। কিছুক্ষণ পরেই একটি বোয়িং বিমান বিকট শব্দে পশ্চিমাকাশে মিলিয়ে গেল।
চট্টগ্রাম থেকে এ সময় ভয়াবহ এক খবর এসে পৌছল ঢাকায়। 'সোয়াত' নামে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে একটি অস্ত্র বোঝাই জাহাজ নোঙ্গর করেছে চট্টগ্রাম বন্দরে, কিন্তু চট্টগ্রামবাসীরা ঐ অস্ত্র চট্টলার মাটিতে কোনো অবস্থাতেই নামাতে দেবে না। তারা চট্টগ্রামের রাস্তায় রাস্তায় ব্যারিকেড সৃষ্টি করেছে। ওই প্রতিরোধ ভাঙতে সেনাবাহিনী তাদের ওপর ঝাপিয়ে পড়েছে।
রাত 8টার কিছু বেশি। বঙ্গবন্ধু অন্যান্য নেতাদের সঙ্গে বাইরের ঘরে আলোচনায় ব্যস্ত। কর্নেল (পরে জেনারেল) ওসমানী জরুরী সংবাদ নিয়ে উপস্থিত হলেন। বঙ্গবন্ধু তার সঙ্গেও আলোচনা করলেন। ইতিমধ্যে বাড়ি ফাকা হতে শুরু করেছে। রাত ন'টার দিকে হাইকোর্ট মোড় ও অন্যান্য কয়েকটি স্থান থেকে বিক্ষিপ্ত গুলির আওয়াজ ভেসে আসছিল। জনগন রাস্তায় রাস্তায় ব্যারিকেড সৃষ্টি করছে। সবার মুখে একটা কথা ছড়িয়ে পড়ল- সেনাবাহিনী বেরিয়ে পড়েছে।
বর্বর হানাদার বাহিনী নৃশংস পাশবিকতায় বাঙালীদের ওপর ঝাপিয়ে পড়ল 25 মার্চের এই রাতে। শুরু হলো বাংলার বুকে ইতিহাসের নিষ্ঠুরতম ও জঘন্যতম অধ্যায়। সর্বাধুনিক অস্ত্রেসজ্জিত 96টি ট্রাক বোঝাই সৈন্য ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে শহরে ঢুকল। তাদের সঙ্গে ছিল আটোমেটিক রাইফেল, মর্টার ফিল্ডগান, মেশিনগান, লাইটমেশিনগান, বাজুকা ইত্যাদিসব মারণাস্ত্র। সঙ্গে ট্যাঙ্ক বহর।
তখনও বারোটা বাজেনি, হঠাৎ রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে গর্জে উঠল অসংখ্য মেশিনগান। আগুনের লেলিহান শিখায় লাল হয়ে উঠল সারা আকাশ। ট্রেসার ও ম্যাগনেশিয়াম ফেয়ারে আলোকিত হয়ে উঠল রাতের অন্ধকার। হানাদার নরপশুরা ট্যাঙ্ক ও স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র নিয়ে আক্রমণ করল রাজারবাগ পুলিশ লাইন, পিলখানা ইপিআর ক্যামপ, বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো। এমনকি মেয়েদের রোকেয়া হলও নিস্তার পেল না। আগুন জ্বলল পিলখানায়, আগুন জ্বলল ঢাকার বস্তিতে বস্তিতে, হাহাকার উঠল ঘরে ঘরে। হাজার হাজার নারী-শিশুর মর্মভেদী আর্তনাদে ঢাকার আকাশ বাতাস ভরে উঠল। রাস্তায় রাস্তায় জমে উঠল লাশের স্তুপ।
কিন্তু এর মধ্যেও জনগন থামল না। তারা ঝাপিয়ে পড়ল পাল্টা প্রতিরোধে। হানাদার বাহিনীকে ঠেকাতে রাস্তায় রাস্তায় গড়ে উঠল ব্যারিকেড। হানাদারদের প্রতিরোধ করা হলো রাজারবাগে, পিলখানায়। ফলে জ্বলে উঠল রাজারবাগ পুলিশ ব্যারাক। 26 মার্চ ভোর পর্যন্ত জ্বলল সে আগুন। বাঙালীর গর্ব বীর পুলিশ বাহিনী আত্মসমর্পন না করে সাধারণ থ্রি নট থ্রি রাইফেল নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করে গেল_ শহীদ হলেন বাংলা মায়ের 1180 জন বীর সন্তান। 26 মার্চ সকালের দিকে গুলি ফুরিয়ে যাওয়ায় উধর্্বতন কর্মকর্তা, এসআই, এএসআই, হাবিলদার, সুবেদার, নায়েক ও সিপাহীসহ প্রায় দেড়শ বীর যোদ্ধা বন্দী হলেন হানাদারদের হাতে।
মারণাস্ত্রে সজ্জিত 30 লরি সৈন্য ও আমেরিকান এস-24 ট্যাঙ্ক বহর কামান উচিয়ে ঢুকে পড়ল বিশ্ববিদ্যালয় ক্যামপাসে। ব্রিটিশ কাউন্সিল লাইব্রেরিকে ঘাটি বানিয়ে সৈন্যরা ইকবাল হলকে ল্য করে মর্টারের গোলা ছোড়া শুরু করল। ইকবাল হলে 200 জন ছাত্র শাহাদৎ বরণ করেন। গ্রেনেড চার্জ করে সৈন্যরা জগন্নাথ হলে ঢুকে পড়ল। হলে ছাত্র ছিল 103 জন। 6 জন ছাত্রকে কবর খুড়তে বাধ্য করা হলো, বাকিদের গুলি করে হত্যা করা হলো নিষ্ঠুরভাবে। ওই 6 জন ছাত্রই সঙ্গীদের কবর দিচ্ছিলেন। পরে তাদেরকেও গুলি করে হানাদাররা। একজন ছাত্র ওই পাশবিক হত্যাকাণ্ডের স্বাক্ষী হয়ে আহত অবস্থায় বেঁচে ছিলেন- কালীরঞ্জন। তার গলার পাশ দিয়ে মেশিন গানের গুলি বেরিয়ে গিয়েছিল। ওদিকে ম্যাগনেশিয়াম ফেয়ারের আলোয় সৈন্যরা রোকেয়া হলের ভেতর ছুটোছুটি করে মেয়েদের ধরছিল। 50 জন ছাত্রী ছাদ থেকে লাফিয়ে তাদের ইজ্জত ও আব্রু বাঁচালেন।
বর্বর হানাদাররা এক 25 মার্চের রাতেই লক্ষাধিক বাঙালীকে হত্যা করে। বন্দী হওয়ার আগে শেখ মুজিব একে একে সমস্ত আওয়ামী লিগ নেতাদের গোপন স্থানে চলে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন। তিনি চট্টগ্রামের আওয়ামী লিগ নেতা জহুর আহমেদ চৌধুরী সহ প্রদেশের বিভিন্ন এলাকায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার লিখিত বাণী ওয়ারলেস যোগে পাঠানোর ব্যবস্থা করে গেলেন। এই বাণীর মুদ্রিত হ্যান্ডবিলটি 26 মার্চ সকালে চট্টগ্রামবাসীর হাতে আসে। হ্যান্ডবিলটি ছিল ইংরেজিতে। তার বঙ্গানুবাদ করেন ডাঃ সৈয়দ আনোয়ার আলী ও মনজুলা আনোয়ার। বঙ্গানুবাদটি ছিল-
'বাঙালী ভাইবোনদের কাছে এবং বিশ্ববাসীর কাছে আমার আবেদন। রাজারবাগ পুলিশক্যামপ ও পিলখানা ইপিআর ক্যামপে রাত বারোটায় পাকিস্তানী সৈন্যরা অতর্কিতে হামলা চালিয়ে হাজার হাজার লোককে হত্যা করেছে। হানাদার পাকিস্তানী সৈন্যদের সঙ্গে আমরা লড়ে যাচ্ছি। আমাদের সাহায্যের প্রয়োজন, এবং তা পৃথিবীর যে কোনো স্থান থেকেই হোক। এমতাবস্থায় আমি বাংলাদেশকে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র বলে ঘোষণা করছি। তোমরা তোমাদের সমস্তশক্তি দিয়ে মাতৃভূমিকে রক্ষা কর। আল্লাহ তোমাদের সহায় হউন।'
শেখ মুজিবর রহমান
25 মার্চ, 1971।
একে একে সবাই বিদায় নিলেন শেখ মুজিবের 32 নং ধানমন্ডির বাড়ি থেকে। কিন্তু তিনি কোথাও গেলেন না। রাত 11টায় নীল নক্সার বাস্তবায়নে কমান্ডিং অফিসার এবং কোমপানি কমান্ডার মেজর বেলাল এক প্লাটুন কমান্ডো নিয়ে শেখ মুজিবকে বন্দী করতে রওনা দিল। তারা মিরপুর রাস্তার সমস্ত ব্যারিকেড রকেটের সাহায্যে উড়িয়ে দিল। রাত দেড়টায় তারা বিদু্যৎগতিতে শেখ মুজিবের বাড়ি ঘেরাও করে ফেলল। 50 জন কমান্ডো বাড়ির চার ফুট উচু পাচিলের ওপর উঠে বাড়ি লক্ষ্য করে স্টেনগানের এক পশলা গুলিবর্ষণ করল। এরপর বাড়ির আঙ্গিনায় দাঁড়িয়ে নিজেদের উপস্থিতি ঘোষণা করল ও শেখ মুজিবকে বেরিয়ে আসতে বলল। দোতলায় উঠে কমান্ডোরা শেখের বেডরুমের দরজা ও জানালার দিকে গুলি ছুড়তে লাগল। উনি বেরিয়ে এসে সৈন্যদের গুলি থামাতে বললেন। সৈন্যরা খোলা বেয়নেট হাতে ওনাকে চার্জ করার জন্য চারদিক থেকে এগিয়ে এল। ওনার কাছেই দাঁড়ানো এক অফিসার বঙ্গবন্ধুকে জড়িয়ে হুকুম দিল, 'ওকে হত্যা করো না।'
এরপর টেনে হেচড়ে নিয়ে চলল তারা বঙ্গবন্ধুকে। পেছন থেকে কিল, ঘুষি, লাথি থেকে শুরু করে চলল বন্দুকের কুঁদোর বাড়ি। অফিসার তার হাত ধরে রাখা স্বত্ত্বেও সৈন্যরা তাকে নিচে নামানোর জন্য টানতে লাগল। উনি চিৎকার করে বললেন, 'আমাকে টানাটানি করো না। দাঁড়াও আমি আমার পাইপ ও তামাক নিয়ে আসি। নাহলে আমার স্ত্রীকে ওসব নিয়ে আসতে দাও। পাইপ আমাকে সঙ্গে নিতেই হবে।'
এরপর উনি ঘরে এলেন। তার স্ত্রী তখন দুই ছেলেকে নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছেন, ছোট রাসেল ঘুমাচেছন বিছানায়। বেগম মুজিব তখন তাকে পাইপ আর একটা ছোট্ট সু্যটকেস গুছিয়ে দিলেন। সৈন্যদের ঘেরে বন্দী হয়ে মুজিব রওয়ানা দিলেন। দেখলেন আশে পাশে আগুন জ্বলছে। ওখান থেকে তাকে সামরিক জিপে করে ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় নিয়ে যাওয়া হয়- রাতে রাখা হলো আদমজী ক্যান্টনমেন্ট স্কুলে। পরদিন ফ্যাগস্টাফ হাউসে তাকে স্থানান্তর করা হয়। তিনদিন পরে বিমানযোগে করাচি নিয়ে যাওয়া হয় তাকে।
26 মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দিলেন, '....আপনারা জানেন যে আওয়ামী লিগ সামরিক আইন প্রত্যাহার ও জাতীয় পরিষদের বৈঠকের আগেই মতা হস্তান্তরের দাবি জানিয়েছিল। আমাদের মধ্যে আলোচনা চলাকালে মুজিব এ মর্মে প্রস্তাব করেছিল যে অন্তবর্তীকালীন সময়ের ব্যাপারটা আমি একটা ঘোষণা দিয়ে নিয়মিত করতে পারি। এই ঘোষণায় সামরিক আইন প্রত্যাহার করা হবে।..... এরপর আমি অন্যান্য রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে এ ব্যাপারে আলোচনা করি। প্রত্যেকে একবাক্যে স্বীকার করেন যে এধরণের প্রস্তাবিত ঘোষনা আইনসম্মত হবে না।... মুজিব যে ঘোষনার প্রস্তাব দিয়েছিল তা একটি ফাঁদ ছাড়া আর কিছুই ছিল না।.... তার একগুয়েমি, একরোখা মনোভাব ও যুক্তিপূর্ণ আলোচনায় অনীহা শুধু একটা কথাই প্রমাণ করে যে এই ভদ্রলোক ও তার দল হচ্ছে পাকিস্তানের শত্রু এবং এরা দেশের অন্য অংশ থেকে পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করে দিতে চায়। মুজিব দেশের অখণ্ডতা ও নিরাপত্তার উপর আঘাত হেনেছে। এ অপরাধের জন্য তাকে শাস্তি পেতেই হবে।
কিছু সংখ্যক দেশদ্রোহী ও ক্ষমতালোভী ব্যক্তি দেশকে ধ্বংস করুক ও 12 কোটি মানুষের ভবিষ্যত নিয়ে ছিনিমিনি খেলুক তা আমরা বরদাশত করতে পারি না।....দেশের এই ভয়াবহ পরিস্থিতির জন্য আমি দেশব্যাপী রাজনৈতিক কর্মকান্ড নিষিদ্ধ ঘোষণার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আর রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লিগকে সমপূর্ণভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলো। সংবাদপত্রের ওপর পূর্ণ সেন্সরশিপ আরোপ করা হলো।'
এই বিবৃতি থেকে পরিষ্কার বোঝা গেল ইয়াহিয়া খান মুজিবের সঙ্গে আলোচনার নামে প্রহসনই করেছে। তার উদ্দেশ্য ছিল সময়ক্ষেপন এবং এরমধ্যে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আরো অস্ত্র ও সৈন্য এদেশে আনা। ঢাকায় ইয়াহিয়ার নানা উস্কানির মুখেও শেখ মুজিব শান্তি ও শৃংখলা সমপূর্ণ নিয়ন্ত্রনে রেখেছিলেন। কিন্তু ইয়াহিয়া ঠাণ্ডা মাথায় জল্লাদ টিক্কা খানকে গনহত্যার নির্দেশ দিয়ে যান যাওয়ার সময়। 25 মার্চ সন্ধ্যায়ই মুজিব বলেছিলেন, 'পাকিস্তানের দুই অংশকে একত্র রাখার জন্য আমি আপ্রাণ চেষ্টা করেছি। কিন্তু ইয়াহিয়া খান সমস্যা সমাধানের জন্য সামরিক অ্যাকশনকে বেছে নিলেন এবং এখানেই পাকিস্তানের সমাপ্তি হলো।' তিনি আরো বলেছিলেন, 'আমি মনে করি আমাকে হয়ত হত্যা করা হবে। কিন্তু আমার কবরের ওপর দিয়েই সৃষ্টি হবে একটা স্বাধীন বাংলাদেশের।' (চলবে)
ছবি : 1.অ্যাকশনে হানাদাররা
2. বন্দি মুজিব
3. লাশের সারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে অক্টোবর, ২০০৮ সকাল ৭:৩৮

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




