somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

’৭১-এ নারী ধর্ষণের ফলাফল — যা চেয়েছিল পাকিস্তানি শাসকরা

২০ শে মার্চ, ২০১৩ সন্ধ্যা ৭:৩২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

‘আমি বাঁচাতে চেয়েছি সেসব শিশুদের, যাদের জন্ম পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বন্দীশিবিরে কারারুদ্ধ থাকা বাঙালি নারীর গর্ভে।’ এ কথা ডা. জিওফ্রে ডেভিস-এর।
১৯৭২ সালে অস্ট্রেলিয়ান এই চিকিৎসক বাংলাদেশে ছুটে আসেন মানবিক সহায়তা দিতে। সে সময় বহু নারীকে গর্ভপাত ঘটিয়ে সহায়তা করেন তিনি। ওইসব নারী পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী দ্বারা ধর্ষিত হয়েছিলেন। অনেকেই আটক ছিলেন বন্দীশিবিরে। ডা. ডেভিসের ওই সময়কার অভিজ্ঞতার ওপর ২০০২ সালে একটি সাক্ষাৎকার নেন ইতিহাস গবেষক অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ড. বিনা ডি কস্তা। বিনা ডি কস্তা অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্ভুক্ত ইতিহাস বিষয়ক প্রবন্ধ নিবন্ধকে আরো সমৃদ্ধ করতে বাংলাদেশে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে নির্যাতিত নারীদের ওপর গবেষণা চালান। আর ওই গবেষণার ধারাবাহিকতায় তিনি ডা. ডেভিসের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন।
ওই প্রবন্ধে বিনা ডি কস্তা ডা. ডেভিসকে ১৯৭১ সালে নির্যাতিত নারীদের অসহায়ত্ব ও দুর্ভোগের প্রামাণিক সাক্ষী হিসেবে উল্লেখ করেন। যার কাছ থেকে হানাদার বাহিনীর নির্যাতনের একটি মূল্যবান দলিল পাওয়া যাবে।
সাক্ষাৎকারটিতে বিভিন্ন বিষয় উঠে আসলেও মূলত পাক সেনাদের নারী ধর্ষণের ফলে পরবর্তীতে যে নেতিবাচক সামাজিক ও মানবিক প্রভাব পড়ে বাংলাদেশের সমাজে সেটাই তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন বিনা ডি কস্তা।
যে নারীরা ওই সময় ধর্ষিত হয়েছিলেন তারা পরবর্তীতে সামাজিকভাবে কী অবস্থার সম্মুখীন হয়েছিলেন? এ বিষয়টি বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পরও আড়ালে থেকে গেছে। জানা গেছে, বিভিন্ন সামাজিক প্রতিবন্ধকতার জন্য সে সময় বন্দীশিবির থেকে মুক্ত হয়ে আসা নারীদের একটা বড় অংশই তখন গর্ভবতী হয়ে পড়েন। আর এ বিষয়টি একটা বড় বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় নারীদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে। ফলে অনেকেই বেছে নেয় আত্মহত্যার পথ। তবে তাদের একটি বড় অংশ গর্ভপাত ঘটানোর চেষ্টা করেন। বিভিন্ন হাসপাতালে কিংবা সহায়তা কেন্দ্রে তখন উপচে পড়া ভিড়। আবার লোক লজ্জায় যারা আসতে ভয় পাচ্ছিলেন তাদের জন্য বিভিন্ন সংগঠন মানবিক সহায়তায় এগিয়ে আসে। খোলা হয়েছিল গর্ভপাত করানোর কেন্দ্র।
ডা. ডেভিস জানিয়েছেন, সে সময় বাংলাদেশের বিভিন্ন শহরেই এ ধরনের কেন্দ্র গড়ে তোলা হয়। অন্তত যেসব শহরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী প্রবেশ করে। ডেভিস মূলত বোঝাতে চেয়েছেন দেশের এমন কোনো শহর নেই যেখানে এ সমস্যাটি তখন মোকাবেলা করতে হয়নি।
ডা. ডেভিসের অভিজ্ঞতায় আরো জানা গেছে, ওই সময় কেবল নারী ধর্ষণের বিষয়টিই মুখ্য ছিল না; যুদ্ধ শিশু বিষয়টিও প্রধান হয়ে ওঠে। এসব যুদ্ধ শিশুর লালন পালনের ভার তুলে দেয়া যাচ্ছিল না কারো ওপর। সে সময় কয়েকটি সংগঠন এসব যুদ্ধ শিশুদের ইউরোপে পাঠাতে তৎপর হয়ে ওঠে। কারণ সেখানে তাদের দেখভালের যথেষ্ট পরিধি ছিল। আর যেসব হোমস ছিল সেখান থেকে বিভিন্ন দেশের মানুষ এসব যুদ্ধ শিশুর দত্তক নিতো।
যদিও যুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনী ধর্ষণকে ‘অস্ত্র’ হিসেবে ব্যবহার করে। যা ভয়ঙ্কর রূপ পায় ১৯৭১-এর যুদ্ধে। ডা. ডেভিস বিনা ডি কস্তাকে জানান, এমন এক নারীর অভিজ্ঞতা আমার জানা আছে যাকে দীর্ঘদেহী পাঞ্জাবী সৈনিক দিয়ে বারবার ধর্ষণ করানো হয়েছিল। যাতে তিনি যন্ত্রণা পান এবং গর্ভবতী হয়ে পড়েন। আর এ আচরণ সবার ক্ষেত্রেই ওই সময় সত্য হয়ে ওঠে। তবে ডা. ডেভিস এও বলেন, যারা নির্যাতিত হয়েছেন তাদের স্বামীরা কিংবা পরিবারের সদস্যরা এ বিষয়ে মুখ খুলতে চাইতো না। যেমনটি চাইতো না গর্ভে থাকা যুদ্ধ শিশুর জন্ম হোক।
আরো অনেক কথা উঠে এসেছে ডা. ডেভিসের কথায়। ডা. ডেভিসের সাক্ষাৎকারের চৌম্বক অংশ তুলে ধরা হলো-
বিনা : সে সময় আপনি মূলত কোন কাজটি করতে উৎসাহী ছিলেন?
ডেভিস : অপরিকল্পিত গর্ভধারণ রোধ করতে আমার টেকনিক্যালি জ্ঞান ছিল। আমি ইউকে থেকে প্রশিক্ষণ নিই। যদিও আমি বাংলাদেশে গর্ভধারণের ৩০ সপ্তাহের পরও গর্ভপাত ঘটিয়েছি।
বিনা : আপনি ঢাকার কোন জায়গায় কাজ করেছিলেন?
ডেভিস : আমি ধানম-ির কোনো একটি কিনিকে কাজ করি। আমি দেশের অন্য শহরগুলোতেও কাজ করেছি যেখানে হাসপাতালের সুষ্ঠু কোনো ব্যবস্থা ছিল না। সেখানে আমি প্রধানত কী করি। (একটু থেমে) এর সংখ্যা অনেক। আমি সেখানকার অনেক মানুষকেই প্রশিক্ষণ দিয়েছি। এরপর দেখলাম এ সংখ্যা (গর্ভবতী) আরো বেড়েই চলেছে। প্রশিক্ষণপ্রাপ্তরা হাল ধরলে আমি সে স্থান ছেড়ে অন্য স্থানে ছুটে গেছি।
বিনা : এ বিষয়ে নিশ্চিত কোন কাজটি আপনি করেন তা যদি নির্ধারণ করে বলতেন?
ডেভিস : এর পূর্বেই আমি যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের নারীদের পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনতে একটি সংস্থা গড়ে তুলি। যেটির ইনচার্জ ছিলেন বিচারপতি সোবহান। চেষ্টা করা হয়েছিল যুদ্ধে গর্ভবতী হয়ে পড়া নারীদের একত্রিত করার। যারা গর্ভপাত ঘটাতে চেয়েছেন তাদের সহায়তা করা আর যারা শিশু জন্ম দিতে চেয়েছেন কিন্তু শিশুর দেখভালের দায়িত্ব নিতে চাননি তাদের শিশুগুলোকে ইন্টারন্যাশনাল সোস্যাল সার্ভিসে (আইএসএস) জড়ো করার চেষ্টা করেছি।
বিনা : আপনি কি মনে করতে পারেন ওই সময় কারা আপনাকে সঙ্গ দিয়েছেন কিংবা আপনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন?
ডেভিস : বিচারপতি সোবহানই ওই সংগঠনের প্রধান ছিলেন, আরো একজন খুব একটিভ ছিলেন। ভন ইস্কুক; আমি তার নামের প্রথম শব্দটি মনে করতে পারছি না। আমার মনে হয় তার স্ত্রীর নাম ছিল মেরি। তারা আর্থিকভাবে সহায়তা করেছিলেন। যেসব বাঙালি আমার সঙ্গে ছিলেন তাদের নাম মনে করতে পারছি না। সাধারণত এর আগে কেউ এ ধরনের ইতিহাস জানতে চায়নি।
বিনা : ওই সময় আপনি যা বলছিলেন?
ডেভিস : ওহ্, গর্ভপাত ও শিশুদত্তক নেয়ার বিষয়টি। এটা সবারই জানা কমনওয়েলথের সদস্য পশ্চিম পাকিস্তানের সেনাবাহিনী তখন ইংল্যান্ড থেকে প্রশিক্ষিত। সুনাম অর্জন করেছে বিদেশেও। যা ব্রিটিশ সরকারকে তীব্র লজ্জায় ফেলে। অথচ এ বিষয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের প্রশাসকদের কোনো স্নায়বিক উত্তেজনাও ছিল না। আমি তাদের অনেকের সাক্ষাৎকার নিয়েছি। যাদের অনেকেই কুমিল্লার কারাগারে বন্দী ছিল। তাদের অনেক বলছিল, এটা ছিল যুদ্ধ। যেখানে আমাদের জন্য সব বৈধ ছিল।
বিনা : যুদ্ধ চলাকালে তারা কিভাবে নারী ধর্ষণকে বৈধ করেছিল?
ডেভিস : তারা জেনারেল টিক্কা খানের সমন পেয়েছিল। যেখানে নির্দিষ্ট করে দিকনির্দেশ দেয়া ছিল। বলা হয়েছিল একজন প্রকৃত মুসলমান যে কারও বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে পারে। যার ফলে তারা বাঙালি নারীদের গর্ভ নিষিক্ত করায় মত্ত হয়ে পড়েছিল। এটাই এ ঘটনার পেছনের মূল কারণ।
বিনা : তারা কেন মেয়েদের গর্ভ নিষিক্ত করে? তারা কি আপনাকে জানিয়েছে?
ডেভিস : হ্যাঁ, পুরো পশ্চিমের আদলে একটি প্রজন্ম গড়ে উঠবে পূর্বে। যা তারা বলেছিল। হয়তো এখানে তাদের দীর্ঘ কোনো পরিকল্পনাও ছিল।
বিনা : পাকিস্তান থেকে পাওয়া অনেক তথ্য থেকে জানা গেছে, এখনো তাদের দাবি ধর্ষণের এ সংখ্যাকে অন্যায়ভাবে অতিরঞ্জিত করা হয়েছে। আপনি কী মনে করেন এটি সত্যি?
ডেভিস : না। সম্ভবত এ সংখ্যাকে খুব সংক্ষিপ্ত করা হয়েছে যা তারা ঘটিয়েছে। এর ব্যাখ্যা আসতে পারে তারা কয়টি শহর দখল করেছিল। তারা পদাতিক বাহিনীকে পশ্চাতে রেখে গোলোন্দাজ বাহিনীকে পাঠিয়েছিল হাসপাতাল, স্কুলে শেল নিক্ষেপ করতে। আর এ কারণেই শহরে নৈরাজ্য সৃষ্টি হয়েছিল। হয়েছিল বিশৃঙ্খলা। পদাতিক বাহিনী পরবর্তীতে প্রবেশ করায় তারা হয়তো নারীদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল। এর মানে এ নয় যে তারা সম্ভোগে লিপ্ত হয়নি। যৌনতা বুঝতে সবে মাত্র বুঝে উঠেছে এমন শিশুকেও তারা রেহায় দেয়নি। তাদের বুলেটের সামনে থেকে কেউ রক্ষা পায়নি। পদাতিক বাহিনী শহরের শেষ সম্বলও লুণ্ঠন করে। নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালায়। নারী শিশু ধর্ষণ করে। যারা তৎকালীন আওয়ামী পন্থী ছিলেন কিংবা মুক্তিযদ্ধে সংশ্লিষ্ট হয়ে পড়েন তাদের তো কোনো রেহাই ছিল না। আর সে সময় মেয়েদেরকে পাহারারত অবস্থায় কম্পাউন্ডে আটকে রাখা হয় যাতে সৈনিকদের সরবরাহ করা যেতে পারে।
বিনা : আপনি কী এমন কারো সঙ্গে কথা বলেছেন হতে পারে কোনো নারী কিংবা পুরুষ কিংবা কোনো সমাজকর্মী যে ওই সময়ের যুদ্ধে সরাসরি অভিজ্ঞ। বিশেষ করে কোনো নারী যিনি বন্দিশিবিরে ধর্ষিত হয়েছেন?
ডেভিস : হ্যাঁ। আমরা প্রতিনিয়তই এ ধরনের ঘটনার বিবরণ শুনেছি। তারা বলতে গিয়ে আতঙ্কিত হয়ে পড়তো। যেমন তারা জানিয়েছিল দীর্ঘদেহী পাঠান সৈনিকেরা কিভাবে বারবার ধর্ষণ করতো। কিভাবে তাদের সেনাবাহিনীর কাছে পাঠানো হতো। সাধারণত ধনী পরিবারের কিংবা সুন্দরী নারীদের পাঠানো হতো উপরের সারির সেনা কর্মকর্তাদের কাছে। তারপর র‌্যাঙ্ক অনুযায়ী বিভিন্ন স্থান থেকে তুলে আনা মেয়েদের সরবরাহ করা হতো। ওই নারীদের পর্যাপ্ত খেতে দেয়া হতো না। কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে ছিল না কোনো চিকিৎসার ব্যবস্থা। ফলে অনেকেই মারা যায় ওই সব ক্যাম্পে। আর এটি প্রমাণ করতে এমন অনেক নিদর্শনই সামনে উপস্থিত ছিল যা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু অবিশ্বাসীরাই গুজব উঠায়।
বিনা : হ্যাঁ, আমি বুঝেছি যা আপনি বলতে চাইছেন। আপনি জানেন আমি গত চার বছর ধরে এ বিষয়ে সন্ধান করছি। ওই নারীদের সনাক্ত করার চেষ্টা করেছি। এ সংখ্যা অনেক যদিও একজন তাদের অনেকের সন্ধান পেয়েছিলেন। তবে আমি নিজে তাদের খুব কম সংখ্যককেই খুঁজে পেয়েছিলাম।
ডেভিস : হ্যাঁ, কারণ তাদের অনেকেই এখন বিষয়টিকে অস্বীকার করতে চেয়েছে। ভুলে যেতে চাইছে। ছুঁড়ে ফেলতে চাইছে ওই অধ্যায় যা তাদের জীবনে ঘটেছিল।
বিনা : যুদ্ধপরবর্তী সময়ে এটা কী ভিন্ন ছিল? কেউ কি তাদের ওই অভিজ্ঞতা জানিয়েছেন?
ডেভিস : না, কেউ এ বিষয়ে বলতে আগ্রহী হয়নি। তুমি প্রশ্ন করলে ঠিকই একটা জবাব পাবে। কিন্তু এটা পর্যাপ্ত নয় যা তারা স্মরণ করতে চাইতো না। কারণ পুরুষরাও এ বিষয়ে বলতে চায়নি।
বিনা : আপনি অবশ্যই বাংলা বলতে পারতেন না। যোগাযোগের জন্য এটি কী খুব কঠিন হয়েছিল?
ডেভিস : না, আমার একজন দোভাষী ছিল। তারা খুব সহজেই সমাধান করতে পারতো। তারা আমাকে একজন দিকনির্দেশক, একজন ড্রাইভার এবং একজন মাঠকর্মীকে সঙ্গে দিয়েছিল। তারাও দোভাষীর কাজ চালিয়েছে। ড্রাইভারের নাম যতদূর মনে পড়ে মমতাজ। তবে মাঠ কর্মীর নাম মনে আসছে না। অবাক করা বিষয় সেখানকার একট বড় অংশ ইংরেজি জানতো। যে সমস্যা আমি তিউনিসিয়ায় বোধ করেছি।
বিনা : আপনার মতে তারা (বাংলাদেশী নির্যাতিত নারীরা) কেন চুপ হয়ে যেত?
ডেভিস : কারণ আমরা ভিনদেশী ছিলাম। তারা আমাদের বিশ্বাস করে উঠতে পারেনি। তারা জানতোও না আমরা কি করতে যাচ্ছি।
বিনা : আপনি কি এমন কোনো এলাকা পরিদর্শন করেছিরেন যেখানে ধর্ষণ ক্যাম্প তৈরি করা হয়েছিল?
ডেভিস : ওই ক্যাম্পগুলো গুড়িয়ে দেয়া হয়েছিল। আর রিহ্যাবিলিটেশন সংগঠন চেষ্টা করেছিল নির্যাতিত নারীদের তাদের গ্রামে শহরে ফিরিয়ে আনতে। কিন্তু ওইসব নির্যাতিত নারীদের স্বামী যা করেছিল তা উদ্বেগই বাড়াবে। তারা তাদের হত্যা করতে চেয়েছিল। কারণ ওই নারীরা পরিত্যাক্ত হয়েছিল। এবং তাদের অনেকেই জানতো সত্যিকার অর্থে কি ঘটেছিল ওইসব নারীর ওপর। তাদের অনেকেই দেহত্যাগ করেছিল যমুনায়। আর এ ঘটনা ইউরোপীয়ানদের উত্তেজনা বাড়িয়েছিল।
বিনা : স্মরণ করতে পারেন কী কতোজন নারীর গর্ভপাত ঘটিয়েছিলেনে আপনি?
ডেভিস : এটি বলা খুবই কঠিন। কিন্তু দিন প্রতি কম হলেও ১০০ জন নারীকে।
বিনা : এটি ঢাকা নাকি বাংলাদেশের অন্য কোনো শহরে?
ডেভিস : এ বিষয়ে একটি সঠিক পরিসংখ্যান বের করা যে খুবই কষ্টসাধ্য ব্যাপার তা বলার ব্যাখ্যা রাখে না। ঢাকায়ই যেখানে অন্তত ১০০ জন সেখানে অন্যান্য শহরের কথা আসলে সে সংখ্যা অনেক বড় আকার ধারণ করে। এছাড়া অনেকেই কলকাতা গিয়েছিলেন গর্ভপাত ঘটাতে।
বিনা : একটা শতকরা হিসাব কি বলতে পারেন? শ্রেণী ভিত্তিক কিংবা ধর্মীয় ভিত্তিক কতজন নারী হবেন?
ডেভিস : এটা সব শ্রেণীর ওপরই হয়েছিল। তাদের ধর্মীয় কিংবা শ্রেণীগতভাবে আলাদা করা যাবে না। সেসময় তাদের মূল সমস্যায় সমাধানই আমাদের কর্তব্য ছিল। সাধারণত, অবশ্যই ধনীরা চটজলদি কলকাতা অভিমুখী হয়েছিলেন গর্ভপাত ঘটাতে।
বিনা : গর্ভপাত ঘটানোর বিষয়ে তারা কী জিজ্ঞেস করতো? কিংবা তাদের কী কোনো মতামত ছিল? কোনো পছন্দ?
ডেভিস : হ্যাঁ, কখনো। আমরা যাদের পেয়েছি তারা সবাই গর্ভপাত করানোর জন্যেই আসেন। অন্যদিকে, যারা জন্মদানের পক্ষ অবলম্বন করেছিল, যারা রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টারে আসে তাদের সংখ্যা কতো এ বিষয়ে আমার খুব একটা স্বচ্ছ ধারণা নেই।
বিনা : গর্ভপাত ঘটানোর সময় আপনি কী তাদের কাঁদতে দেখেছেন কিংবা দুঃখিত হতে?
ডেভিস : না, তাদের কেউই কাঁদেনি। তাদের মনে গভীর দাগ পড়েছিল এটা স্পষ্ট। তবে তারা কেউ সে রকম কাঁদেনি। তারা কেবল নিশ্চুপ ছিল। যেটি আমাদের জন্য সহজ হয়েছিল।
বিনা : আপনি উল্লেখ করেছেন যে আপনি কেবল তাদের সহায়তা করেছেন যারা তাদের গর্ভে থাকা যুদ্ধ শিশু গর্ভপাত করতে চেয়েছেন। আমি এ বিষয়টিতে আবার ফিরে আসছি। নির্যাতিত ওই নারীদের করার ডাক্তার, নার্স কিংবা সমাজ কর্মীদের মাধ্যমে গর্ভপাত করাতে রাজি করিয়েছিলেন? তারা কোনো কাগজপত্রে সই করেছিলেন?
ডেভিস : আমি মনে করি তারা কোনো রাজিপত্রে সই করে থাকবে। সরকার প্রত্যক্ষভাবে না হলেও এবিষয়ে এগিয়ে আসে। এটি ব্যাপকভাবে সংঘঠিত হয়েছিল রিহ্যাবিলিটেশন সংস্থার মাধ্যমে। কেউই নিকটস্থ কোনো স্বাস্থ্যকেন্দ্রেই গর্ভপাত ঘটাতে রাজি হয়নি। এটি অবশ্যই সঠিক। তাই এ বিষয়টি কোনো ইস্যু হতে পারে না।
বিনা : আপনি কী গর্ভধারণের একদম শেষ পর্যায়ের কোনো গর্ভপাত ঘটিয়েছেন? কিংবা কোনো অপরিপক্ক গর্ভধারণে?
ডেভিস : হ্যাঁ, আমি সেখানে যে ছয় মাস ছিলাম তার পুরো সময়ই এ পরিস্থিতি মোকাবেলা করেছি। তারা ভীষমভাবে অপুষ্টিতে ভুগছিলো। ফলে দেখা গেছে ৪০ সপ্তাহের গর্ভবতী নারীর পেট ঠিক ১৮ সপ্তাহের গর্ভবতীর মাপের সমান।
বিনা : যারা সন্তান নিয়েছেন সেসব নারীদের আপনি কী কোনো উপদেশ দিয়েছেন?
ডেভিস : উপদেশ, হ্যাঁ রিহ্যাবিলিটেশন সংস্থায়। সেখানকার নারী কর্মীদের যারা নির্যাতিতদের সঙ্গে কথা বলতো। আমি মনে করি না এটা তাদের সহায়ক ছিল। কারণ তারা সবাই অপুষ্টিতে ভুগছিল বিভন্ন রোগে আক্রান্ত ছিল। তাদের বেশিরভাগই যৌন রোগে আক্রান্ত ছিল। দেশটিতে খুবই কম সুবিধা ছিল। ওষুধপত্র সরঞ্জামাদির তীব্র অভাব ছিল। যার অনেক কিছু আমরা নিজেরাই সংগ্রহ করেছিলাম।
বিনা : আপনি কোথা থেকে সেগুলো আনিয়েছিলেন? তা কি পর্যাপ্ত ছিল?
ডেভিস : ইংল্যান্ড থেকে। আমি বলেছিলাম আমার নিজের আনা ব্যবস্থাপত্রের কথা। এছাড়া আমি দুই সেট যন্ত্রপাতি আর এন্টিবায়োটিক নিয়েছিলাম।
বিনা : আপনি কি ওই দুই সেট দিয়েই পুরো ছমাস গর্ভধারণ রোধ করেছিলেন?
ডেভিস : হ্যাঁ, স্থানীয় হাসপাতালগুলোর যন্ত্রপাতি ধ্বংস হয়েগিয়েছিল। আর তা পর্যাপ্তও ছিল না।
বিনা : চিকিৎসার কাজে এটি কি নিরাপদ ছিল?
ডেভিস : এ অবস্থা অন্তত ওই সব রোগের থেকে কম বিপজ্জনক ছিল। যা তারা ধারণ করছিল।
বিনা : আর এভাবে আপনি গর্ভপাত এবং দত্তক দেয়া নেয়া দুই কাজে সংশ্লিষ্ট ছিলেন?
ডেভিস : হ্যাঁ, কিন্তু নিষ্ঠভাবে দত্তক দেয়ার বিষয়টিতে আমি আইএসএসকে সহায়তা করেছি।
বিনা : ঢাকার বাইরের অবস্থাটা তখন কি ছিল? যেখানে আপনি গিয়েছেন? সে এলাকাগুলোতে কি ধরনের সুবিধা পেয়েছিলেন?
ডেভিস : হাসপাতাল কিংবা রিহ্যাবিলিটিশন সংস্থা; আমি মনে করতে পারছি না এটাকে কি বলে ডাকা হয়েছিল! হয়তো বাংলাদেশের নারীদের জাতীয় সহায়তা সংস্থা ডাকা হতে পারে। যেটি পরিচালিত হয়েছিল সবচেয়ে বড় কেন্দ্র হিসেবে। হাসপাতালের বেশীরভাগ কর্মীরা মনে করতেন এটি অবৈধ। যদিও এ বিষয়ে আমি স্টেট সেক্রেটারি রব চৌধুরীর একটি পত্র পেয়েছিলাম। তিনি আমার কাজে সহায়তা করেছিল। এটি উল্লেখ করা প্রয়োজন যে আমি চেয়েছি সব কাজ বৈধভাবে করতে আর তারা আমাকে পর্যাপ্ত সহায়তা দেয়ার চেষ্টা করেছিলেন। আমি এখন ওই পত্রটি খুঁজে পাবো না। এটি কোথাও থেকে থাকবে; বাংলাদেশ থেকে আসা অন্য কাগজপত্রগুলোর সাথে। আমি মনে করেছিলাম এগুলো প্রয়োজনীয় যতদিন আমি আর এমন কোনো ঘটনার সামনে না দাঁড়াই। তাই আমি চেয়েছি এগুলো সংরক্ষণ করতে।
এটি ওই সময় খুব কঠিন ছিল।
বিনা : সব মেয়ারাই কী সাধারণভাবে গর্ভাপাত ঘটাতে চেয়েছিলো? কিংবা জন্মদানের পর দত্তক দেয়ার কথা ভেবেছিলো? এমনকি কেউ ছিলো যে তার জন্মদেয়া শিশুকে নিজের কাছে রাখতে চেয়েছিলো?
ডেভিস : জ্বি.. . তাদের খুব কমজনই এমন আগ্রহ প্রকাশ করেছিলো।
বিনা : আপনি কি জানেন তাদের কি হয়েছিলো?
ডেভিস : আমার কোনো ধারণা নেই এ বিষয়ে। আইএসএস যতটা সম্ভব ওই শিশুদের নিয়ে গেছে। কারণ তখন আমেরিকা কিংবা পশ্চিমা দেশগুলোতে পর্যাপ্ত শিশু ছিল না দত্তক নেয়ার জন্য। তারা চেয়েছিলো যতো সংখ্যক শিশু সম্ভব জড়ো করার।
বিনা : (আইএসএসের কথা জানতে চাইলেন বিনা)
ইন্টারন্যাশনাল সোস্যাল সার্ভিসেস?
ডেভিস : হ্যাঁ, এটি ওয়াশিংটন ডিসি ভিত্তিক একটি সংস্থা।
বিনা : ওই মায়েদের কি হয়েছিলো?
ডেভিস : গর্ভপাত ঘটানোর পর খুব কম সময়ের জন্যই তারা সেখানে ছিল। যতদূর মনে পড়ে তারা রিলিফ এবং রিহ্যাবিলিটিশন সেন্টারগুলোতে আশ্রয় নিয়েছিল। তারা সেখানে যতোদিন খুশী ততোদিন অবস্থান করতে পারতো। পরবর্তীতে তাদের বিভিন্ন প্রশিক্ষিণে যুক্ত করা হয়েছিল। আমি তার কিছু দেখেছি। ঢাকা, দিনাজপুর, রংপুর, নোয়াখালীতে তাদের পরিধেয় বস্ত্র তৈরীর প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছিল।
#ড. বিনা ডি কস্তা#
তিনি বিশেষ ভাবে পরিচিত উন্নয়ন ও মানবাধিকারকর্মী হিসেবে। এছাড়া তিনি দক্ষিণ এশিয়ার নিরাপত্তা বিষয়ের উপরও গবেষণা করেন। তিনি অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক এবং নিরাপত্তা বিষয়ক পাঠদান করে থাকেন। নটর ডেম ইউনিভার্সিটি থেকে তিনি যুদ্ধ ও শান্তি বিষয়ক পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন
উৎসঃ View this link
১১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। কালবৈশাখী

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:২৪



গত পরশু এমনটি ঘটেছিল , আজও ঘটলো । ৩৮ / ৩৯ সে, গরমে পুড়ে বিকেলে হটাৎ কালবৈশাখী রুদ্র বেশে হানা দিল । খুশি হলাম বেদম । রূপনগর... ...বাকিটুকু পড়ুন

একজন খাঁটি ব্যবসায়ী ও তার গ্রাহক ভিক্ষুকের গল্প!

লিখেছেন শেরজা তপন, ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:০৪


ভারতের রাজস্থানী ও মাড়ওয়ার সম্প্রদায়ের লোকজনকে মূলত মাড়ওয়ারি বলে আমরা জানি। এরা মূলত ভারতবর্ষের সবচাইতে সফল ব্যবসায়িক সম্প্রদায়- মাড়ওয়ারি ব্যবসায়ীরা ঐতিহাসিকভাবে অভ্যাসগতভাবে পরিযায়ী। বাংলাদেশ-ভারত নেপাল পাকিস্তান থেকে শুরু করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরান-ইজরায়েল যুদ্ধ

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:০৮

আমরা সবাই জানি, ইরানের সাথে ইজরায়েলের সম্পর্ক সাপে নেউলে বললেও কম বলা হবে। ইরান ইজরায়েলকে দুচোখে দেখতে পারেনা, এবং ওর ক্ষমতা থাকলে সে আজই এর অস্তিত্ব বিলীন করে দেয়।
ইজরায়েল ভাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

নগ্ন রাজা কর্তৃক LGBTQ নামক লজ্জা নিবারনকারী গাছের পাতা আবিষ্কার

লিখেছেন মুহাম্মদ মামুনূর রশীদ, ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৪০

LGBTQ কমিউনিটি নিয়ে বা এর নরমালাইজেশনের বিরুদ্ধে শোরগোল যারা তুলছেন, তারা যে হিপোক্রেট নন, তার কি নিশ্চয়তা? কয়েক দশক ধরে গোটা সমাজটাই তো অধঃপতনে। পরিস্থিতি এখন এরকম যে "সর্বাঙ্গে ব্যথা... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে...

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে,
পড়তো তারা প্লে গ্রুপে এক প্রিপারেটরি স্কুলে।
রোজ সকালে মা তাদের বিছানা থেকে তুলে,
টেনে টুনে রেডি করাতেন মহা হুলস্থূলে।

মেয়ের মুখে থাকতো হাসি, ছেলের চোখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×