এই ব্লগে আছি প্রায় সাড়ে তিন মাস হতে চলল। কত বৈচিত্রই না দেখলাম এখানে!! প্রেম বিরহ, হাসি ঠাট্টা, কবিতা, চিঠি, খোলাচিঠি, গল্প, কবিতা, উপন্যাস, রাজনৈতিক তর্ক-বিতর্ক, জনগুরুত্বপূর্ন বিষয়, প্রযুক্তি, বিজ্ঞান, ধর্মকথা, ইতিহাস আরো কত কি!!! কাগজে লেখা থেকে ব্লগে লেখার সবথেকে সুবিধা হল সাথে সাথেই অন্যের অন্যের মন্তব্য পাওয়া যায়। নিজের মনের ভাব প্রকাশের পর মনে হয় না, যে নির্জীব দেয়ালের সাথে কথা বললাম। এজন্যই ব্লগটা খুবটানে।
সমস্যা শুধু একস্থানে তার হল রাজনীতি কেন্দ্রিক তর্কবিতর্ক। আমাদের দেশে জাতীয় ইতিহাস যেমন রাজনীতি দ্বারা প্রভাবিত ফলে, ইতিহাস বিষয়ক আলোচনাও মূলত এক পর্যায়ে রাজনীতি কেন্দ্রীক হয়ে পড়ে। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, “যা আমার ভাল লাগে তাই আর – একজনের ভাল লাগে না, এই নিয়েই পৃথিবীতে যত রক্তপাত”। নিজের যুক্তি কেন অপরে মেনে নিবে না, এটা কেউ মেনে নিতে পারে না। যুক্তির পিঠে যুক্তি দিয়ে চলতে থাকে পোস্টের পর পোস্ট। তারপরেও কেউ কারো যুক্তি মেনে নেয় না। নিজের অজান্তে কখন যে যুক্তি পাশে ঠেলে দিয়ে, নিজের বিশ্বাসের উপর ভর করে চলা শুরু করে দেই ধরতে পারি না। বিশ্বাসের পেছনে পেছনে চলে আসে রাগ, ঘৃণা, যার প্রকাশ ঘটে গালাগালিতে। একদিকে যখন গালাগালি চলতে থাকে, তখন প্রতিপক্ষ তার যুক্তির থলেতে আর যুক্তি খুজে না পেয়ে গালাগালিটাকেই প্রধান করে তোলে। যুক্তিতর্কের খেলায় পিছিয়ে পরা প্রতিপক্ষ গালাগালির ব্যাপারটা দিয়ে তার পিছিয়ে পড়া অংশটুকু ব্যালেন্স করে নেয়। আসল কাজের কাজ কিছুই হয় না; কেউ ছাগল রাজাকার ইত্যাদি উপাধী পায়েও হাসে, কেউ অন্যের ব্লগে ব্যান হয়, কেউ প্রথম পেইজে ব্যান হয়; তার জন্যে ব্লগীং বিরতি; কর্তৃপক্ষের কঠিন অবস্থান; আবার কঠিন অবস্থান থেকে ফিরে আসা; কালো ব্যাজ; কারো উল্লাস, কারো ক্ষোভ, রেটিং বাড়ানো, রেটিং কমানো আরো কত কি!!
প্রশ্ন হচ্ছে এই যুক্তিতর্কের খেলার আদৌ কি কোন ফলাফল আসে? যুক্তির রাজা সক্রেটিস। দর্শনের ছাত্র ছাত্রীরা লজিকের জ্ঞান নেয় প্লেটোর রিপাবলিক হতে। প্লেটোর রিপাবলিকের প্রথম পুস্তকে (প্লেটোর রিপাবলিক; অনবাদ: সরদার ফজলুল করিম) সক্রেটিস ও থ্রাসিমেকাসের যুক্তির লড়াই চলে। থ্রাসিমেকাস যুক্তিতর্কে ধরাশায়ী হয়ে পড়ে সক্রেটিসের কাছে। একপর্যায়ে থ্রাসিমেকাস মেনে নেয় সক্রেটিসের যুক্তি! কিন্তু মনে নেয় কি? অর্থাৎ থ্রাসিমেকাসের বিশ্বাসে কোন পরিবর্তন আসে কি? মোটেও না। প্রথম পুস্তকে থ্রাসিমেকাসের শেষ বাক্য ছিল, “সক্রেটিস, তোমার মনস্তুষ্টির জন্য কথাটাকে আমি স্বীকার করেই নিলাম”। শেষের কবিতায় রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, “মেনে নেওয়া আর মনে নেওয়া, এই দুয়ের যে তফাৎ আছে”। খাঁচা বন্দি বাঘ শিকার করায় যেমন বীরত্ব নেই, তেমনি সংলাপে যুক্তি যদি প্রতিপক্ষের মনে না ধরে; সে সংলাপ জয়েও কোন উল্লাস থাকা উচিত নয়। যুক্তিতে থ্রাসিমেকাসকে পরাজিত করতে পারলেও, থ্রাসিমেকাসের বিশ্বাসের কাছে সক্রেটিসের পরাজয় ঘটেছে। কারণ, সক্রেটিস থ্রাসিমেকাসের বিশ্বাসকে টলাতে পারে না।
বাস্তবে প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের খুব অল্প কিছু বিষয় গুলো ছাড়া মানুষের মন কখনই যুক্তি দ্বারা পরিচালিত হয় না। বৌদ্ধরা তাদের ধর্মে এক প্রাণীর কল্পনা করে। যার নাম তারা দিয়েছে অপরাজেয় প্রাণী। এই প্রাণীর দেহ কল্পনা করা হয়েছে, বিভিন্ন প্রানীর শক্তিশালী অঙ্গ সমন্বয়ে। যেমন হাতির শুঁড়, ঘোড়ার খুর, ড্রাগনের দেহ, হরিনের শিং, সিংহের মাথা ইত্যাদি। কিন্তু বুদ্ধরা বলে এই প্রাণীর চেয়েও অপরাজেয় মানুষের মন, যাকে নিয়ন্ত্রন করা বড় সাধনার বিষয়। কথা হচ্ছে এই কথার প্রমান কি? বেশিদূর যেতে হবে না, এই ব্লগেই ভুরি ভুরি প্রমান আছে। এ পর্যন্ত এই ব্লগে শত শত পোস্ট আর মন্তব্য করা হয়েছে প্রতিপক্ষকে রাজনৈতিক যুক্তি বুঝাতে গিয়ে। কিন্তু, আমাকে এমন একজন ব্লগারের উদাহরণ কি কেউ দিতে পারবেন যার কিনা প্রতিপক্ষের যুক্তি মনে ধরেছে? যে যুক্তিতর্কে পরাজিত হয়ে, পরবর্তী পোস্টগুলো নতুন ধারণার আঙ্গিকে দিয়েছে। বাংলাদেশে কত মতবাদ চালু ধর্মনিরপেক্ষতা, সাম্প্রদায়িকতা, অসাম্প্রদায়িকতা, বাঙালি জাতীয়তাবাদ, বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ, বিএনপি-আওয়ামী লীগ, জামাত, কমুনিষ্ট, তবলীগ। সব মতবাদের পেছনে কত হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ যুক্তি। কিন্তু এ সব যুক্তি বিরুদ্ধপক্ষের একজনও কখনও মন থেকে স্বীকার করে তার মানসিকতার পরিবর্তন এনেছে, এমন উদাহরণ আছে কি। নির্বাচনে রাজনৈতিক সুবিধা অর্জনের জন্যে আওয়ামীলীগ-বিএনপি জামাতকে সাথে নিয়ে সুবিধা নিয়েছে যদিও, কিন্তু কোন দলই জামাত হয়ে যায়নি।
এইডস্ রোগের ক্ষেত্রে মৃত্যু হারও ১০০% না। কিন্তু, যুক্তির খেলায় ফল না পাওয়ার সম্ভবনা ১০০%। কথা হচ্ছে তাহলে এই যুক্তি নিয়ে মারামারি করে লাভ কি? নিজের যুক্তির জন্য, অন্যের যুক্তির সমর্থনের ভিক্ষা আমরা কেন করব। নিজেদের উপর কি আমাদের এতটুকু আত্মবিশ্বাস নেই। আসুন নিজের কথা নিজে বলে যাই, অন্যে আমার যুক্তি মানল কি না মানল সেটা নিয়ে মাথা না ঘামাই। যদি এটা সম্ভব হয়, তবেই বৃথা রক্তপাত বন্ধ হবে।
অবশেষে একটা প্রশ্ন, “যুক্তির লড়াইয়ের বিরুদ্ধে প্রশ্ন তুলে, আমি নিজেই কি আর একটি যুক্তির লড়াই শুরু করলাম?। যেন কোন যুক্তিতর্কের খেলা শুরু না হয়, তাই আমি এই পোস্টে নিজে কোন মন্তব্য করব না।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে ফেব্রুয়ারি, ২০০৯ বিকাল ৩:২৯

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




