গতকাল ব্লগার সাঈফ শেরিফ “মেধাহীন 'করপোরেট' মেরুকরণ, গড্ডালিকার নর্দমা, ডিজুস তারুণ্য” শিরোণামে একটি পোস্ট দিলেন। আজ পর্যন্ত সেই পোস্টে যত আলাপ আলোচনা হল তা মূলত প্রাইভেট বনাম পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় দ্বন্দ কেন্দ্রিক। এই বিষয়ে অনেক আগেই ব্লগে কিছু লিখবার ইচ্ছা ছিল কিন্তু, নানা কারনে লিখতে বসা হচ্ছিল না। আজ লিখতে বসে গেলাম।
গত শতকের নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত বাংলাদেশে উচ্চ শিক্ষা মূলত জনগনের জন্য সরকার প্রদত্ত একটি সার্ভিস বা সুবিধা হিসেবে গন্য হত। খুব সম্ভবত ১৯৯২ সালে বাংলাদেশ সরকার এদেশে উচ্চ শিক্ষাকে বেসরকারিখাতের জন্য উম্মুক্ত করবার সিদ্ধান্ত নেন। যার ফলাফল প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়। এক বা একাধিক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কিছু শর্ত পূরণের পরে সরকার হতে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের অনুমতি লাভ করেন। এহেন সিদ্ধান্তের পেছনে সরকারের নীতিনির্ধারকগন হয়ত ভেবেছিলেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে এবং জনগনের জন্য উচ্চ শিক্ষার পথ আরো সুগম হবে। কিন্তু আইন তৈরি করবার সময় তারা যে বিষয়টি মাথায় আনেননি তা হল স্কুল-কলেজ বা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের থেকে নতুন ধারার বিশ্ববিদ্যালয় গুলোর পার্থক্য কোথায় হবে। এ সম্পর্কে ১৯৩৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে উপাচার্য ড. রমেশচন্দ্র মজুমদারের প্রদত্ত সমাবর্তন বক্তৃতা হতে কিছু অংশ উল্লেখ করতে চাই। অধ্যাপক মজুমদার তার ভাষণে স্কুল-কলেজ, পলিটেকনিক্যাল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বতন্ত্র চরিত্র ও বৈশিষ্ট ব্যাখ্যা করতে গিয়ে কিছু মূল্যবান কথা বলেছিলে। তিনি বলেন, “ A university, true to its ideals, should with courage and firmness, stand against the current, however strong it may be. It should boldly proclaim that a very different thing from a technical college or a place of vocational training. It has got some definite and specific objects to serve, and these may be defined as advancement of learning by dissemination of knowledge and exploration of new truths, and creation of personality and leadership, in other words, the highest possible development of intellect and character, Humanism is the watchword of the University; the pursuit of the highest standard of knowledge is its distinctive character, and a passionate search for truth is the sublime ideal” । আমার বিশ্বাস ৮০ বছর আগের এই বৈশিষ্ট গুলো আজও খন্ডানো সম্ভব নয়।
বাংলাদেশের প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে প্রধানত পড়ানো হয় কম্পিউটার সাইন্স আন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং, টেলিকমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং, ইলেক্ট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং, বিবিএ-এমবিএ, ফার্মাসি, মাইক্রোবায়োলজি আরো টুকটাক কিছু বিষয়। একটু নজর দিলে দেখা যাবে এগুলো বর্তমান বাজারে বহুল প্রচলিত বিষয়। বুয়েট ও ঢাবির ভর্তি পরীক্ষায় যে সব ছাত্রছাত্রীরা অনেক সামনের দিকে থাকে তারাই এই সব বিষয় পড়তে পারেন। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে জ্ঞানের মৌলিক শাখা যেমন সাহিত্য, পদার্থ বিদ্যা, গণিত, রসায়ন, ইতিহাস, সমাজবিজ্ঞান ইত্যাদির কোন স্থান নেই। এখানকার ছাত্র-ছাত্রীদের মূল উদ্দেশ্য এসব ফলিত বিষয় (Applied subject)পড়া ও সংশ্লিষ্ট চাকরিতে যোগদান। শিক্ষকদের শিক্ষাদানের মূল উদ্দেশ্যও তাই। জ্ঞান বিজ্ঞানের উদ্ভাবন এখানকার আলোচনার বিষয় নয় একেবারেই। এখানকার ছাত্র ছাত্রীদের সংস্কৃতি প্রধানত ঐ চাকরি বা কর্পোরেট দুনিয়া কেন্দ্রিক। অর্থাৎ,প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়কে বলা যায় কর্পোরেট জগতের টেকনিক্যাল স্কুল/কলেজ।
আমি এটা বলব না যে এগুলোর প্রয়োজন নেই। ব্যবসা-বানিজ্য হতে শত-সহস্র ক্রোশ দূরে থাকা বাঙালি জাতির জন্য কর্পোরেট বিহেভিয়ার শিখবার প্রয়োজন আছে অবশ্যই। এই ব্যাপারে সৈয়দ মুজতবা আলি তার দেশে-বিদেশে গ্রন্থে একটা গল্প বলেছিলেন। গল্পটা অনেকটা এরকম, মুজতবা আলি জানতে পারলেন জনৈক বাঙালি কলকাতার বাজারে দোকান দিয়েছে। তিনি এতে বড়ই আগ্রহি হলেন, কারন কলকাতার বাজারে ব্যবসা নিয়ন্ত্রন করত গুজরাটিরা। তো তিনি যখন বাজারে গেলেন, বিভিন্ন দোকান হতে দোকানদাররা তাকে ডাকতে শুরু করল কেনাকাটা করবার জন্য। কিন্তু তিনি অনেক খুঁজে গেলেন সেই বাঙালির দোকানে। সেখানে দেখতে পেলেন ঘুমের ঘোরে শুয়ে থাকা দোকানিকে। তিনি যে জিনিসের কথাই জিজ্ঞাসা করেন দোকানির ঘুমের ঘোরে একই উত্তর, “নাই নাই নাই”। যাইহোক, সেই বাঙালি আমরা আর থাকতে চাই না। আমাদের বানিজ্যিক ব্যবহার শিখতে হবে, হতে হবে ব্যবসা সফল। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, তার জন্য আস্ত বিশ্ববিদ্যালয় কেন???
সমস্যা এখানেই!! প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে বাংলাদেশে যা চলছে তা মূলত বিভিন্ন ইনস্টিটিউট বা টেকনিক্যাল কলেজ হবার যোগ্য। যদি হত Up Down Institute of Business Studies (উদাহরণ দেবার জন্য উত্তর দক্ষিণ, পূর্ব পশ্চিমে কিছুই ফ্রি পেলাম না)তবে কোন সমস্যা থাকত না। সেখানে ব্যবসা বানিজ্যে সফল হবার রাস্তা দেখানো হত। সমস্যা বাধে তখনই যখন Up-Down University নামে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চালু হয়। বাঙালির বিশ্ববিদ্যালয়ের মোহ হতেই এ বিড়ম্বনার সৃষ্টি। যেখানে California Institute of Technology, Karolinska Institute of Technology, Massachusetts Institute of Technology ইত্যদিতে বিশ্ববাসীর কোন সমস্যা হচ্ছে না, সেখানে University-এর ডিগ্রি না থাকলে বাঙালি শিক্ষিত হচ্ছে না।
এর সাথে সৃষ্টি হচ্ছে অন্যান্য সমস্যা। এসব তথাকথিত বিশ্ববিদ্যালয় হতে পাশ করা ছাত্রছাত্রীরা দেশের মূল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর (পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়) ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে সমমর্যাদা দাবি করছে। যেটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের পক্ষে একেবারেই সহ্য করা অসম্ভব। একটা উদাহরণ দেই, আমি ২০০১ সালে এইচএসসি দেই। আমরা কয়েকজন বন্ধু সানরাইজে বুয়েট ভর্তি কোচিং ও ইউসিসিতে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কোচিং করতাম। এইচএসসির রেজাল্ট বের হবার সাথে সাথে কয়েকজন কোচিং করা বন্ধ করে দেয়, কারন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তিযুদ্ধে অবতীর্ণ হবার জন্য নুন্যতম যে নম্বরটুকু দরকার ছিল তা সেই বন্ধুদের আসেনি। প্রায় একমাসের মাঝেই তারা কয়েকজনই বিভিন্ন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে যায়। আমরা কয়েকজন বুয়েট, ঢাবি, ও মেডিকেলে চান্স পাই। সেই সব প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুরা যখন লেখাপড়া শেষে আমাদের সাথে সমমর্যাদা দাবি করবে (অবশ্যই বন্ধুত্বের ক্ষেত্রে নয়, শুধু শিক্ষাগত যোগ্যতার ক্ষেত্রে) তখন আমরা তা কেন সহ্য করব??
অনেকেই বলবেন, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের মান যদি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের সমমানের হয় তবে সমমর্যাদা দিতে সমস্যা কোথায়? হ্যাঁ, আমি বলি কোন সমস্যা নেই! কিন্তু তাদের মান কি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের সমমানের হচ্ছে? একেই আমাদের দেশে সর্বোচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট ইত্যাদির শিক্ষার মান নিয়ে অনেক অনেক প্রশ্ন আছে। অনেকেই বলেন এগুলোর শিক্ষা আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন নয়। সেখানে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় গুলোর ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষার মান কেমন হবে তা বলাই বাহুল্য!
তাই বলি অহেতুক কথা বাড়িয়ে লাভ কি? সাঈফ শেরিফের সেই পোস্টের বিরুদ্ধে হয়ত অনেকেই অনেক যুক্তি দেবেন। আমি স্বীকার করি সাঈফ ভাইয়ের লেখার ভাষা অনেকটাই রুক্ষ ছিল (যদিও আমি ১০০% সহমত তার সাথে), কিন্তু তার কথা গুলো কি অস্বীকার করা যায়? আসলে দোষটা সাধারণ মানুষেরও না। সরকার ও তার নীতিনির্ধারকদের উচিত ছিল এ জাতির ঘাড় হতে বিশ্ববিদ্যালয় ডিগ্রির ভূত সরানোর ব্যবস্থা করা। তা না করে সরকার ভূতের সাথে কিছু পেত্নিও আমাদের ঘাড়ে বসিয়ে দিয়েছেন!!
(আশা রাখি সবাই খোলা মনে আলোচনায় অংশ নেবেন)
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে ফেব্রুয়ারি, ২০০৯ বিকাল ৩:৫৮

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




