বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এসে যাদের রেজাল্ট ভাল হয় না তারা খুব একটা পাত্তা দেয় না। স্কুল জামানায় পরীক্ষার রেজাল্ট পোলাপানের জন্য একটা আলাদা ফিলিংসের ব্যাপার তা সে খারাপ হো আর ভাল ছাত্রই হোক না কেন। পরীক্ষার রেজাল্টের পরে অনেকেরই আশা ভঙ্গ হয়। কেউ হয়ত অনেক খারাপ নম্বর পাওয়া ভয়ে থাকে, কিন্তু বেশি পেয়ে যায়। আবার খুব ভাল রেজাল্টের আশা করে অনেকেই ধরা খায়। এই ঘটনাগুলো ছাড়াও আর একটা ব্যাপার ঘটে কারো কারো সাথে, তা হল যত নম্বরের প্রশ্নের উত্তর দিয়েছে তার চাইতে বেশি নম্বর পাওয়া। এমন হবার পেছনের কিছু কাহিনী থাকে, যা সেই সময়ে অনেকেই জানে না, পরে খোলাসাও হয় না। আমি এমন কিছু ঘটনার সাক্ষি, ব্লগের আদালতে সাক্ষি দিতে এলাম। ব্লগ জনতা বিচার করুক।
আমি এসএসসি দিলাম ১৯৯৯-এ। পরীক্ষার পরে রিলাস্ক মুডে আত্মীয়-স্বজনদের বাড়ি বাড়ি ঘুরাঘুরি করছিলাম। একদিন বাবা ফোনে করে বলে স্কুলের আহসান স্যার (আসল নাম বললাম না) আমার বন্ধুদের দিয়ে আমাকে ডেকে পাঠিয়েছে, খুব জরুরী। ঘোরাঘুরি ফেলে আমি বাসায় চলে এলাম। এসেই দেখি ক্লাসের ফার্স্টবয় আমির বাসায় বসে আছে। স্যার ওকে বলেছে, আমাকে নিয়ে সরাসরি স্যারের বাসায় চলে যেতে। এত মাতামাতি দেখে খানিকটা চিন্তিতই হলাম, ঘটনা কি। স্যারের কাছে আমি, আমির সেই ক্লাস এইট থেকে পড়ি। স্যার যেমন আমাদের পছন্দ করতেন ঠিক আমরাও স্যারে চেলা ছিলাম। উনি পদার্থবিজ্ঞান আর রসায়ন অসাধারণ বোঝাতেন। আমার স্বীকার করতেই হবে, উনার মত বিজ্ঞানের শিক্ষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটাও পাই নাই। এসএসসি পরীক্ষার স্যার প্রতিদিন আমাদের বাসায় সেই দূর থেকে হেটে এসে আমার খবর নিয়ে যেতেন। একটা সময় আমি আমার বাবা-মায়ের উপর এক ধরণের বোঝা ছিলাম, আজকে আমি যেই অবস্থায় আছি তা শুধু স্যারের অবদান। স্যারকে নিয়ে আলাদা পোস্ট দিব একদিন।
যা বলছিলাম, তা আমি আর আমির গেলাম স্যারের বাসায়। গিয়ে দেখি আরো দুই বন্ধু বসে আছে। স্যার বলে, “তোরা ফ্রি আছিস তো? আমার একটা কাজ করে দিতে হবে”। স্যারের মুখের কথাই আমাদের জন্য হুকুম, উত্তর দিলাম “ইয়েস স্যার, আমরা ফ্রি”। স্যার তার টেবিলের নিচ থেকে কয়েক বান্ডিল খাতা বের করে দিলেন। এসএসসির পদার্থ বিজ্ঞান খাতা ও ক্লাস টেনের অংক খাতা। আমার আর আমিরের কাজ হচ্ছে এই খাতা গুলো দেখা, আর বাকি দুজনের কাজ নাম্বার যোগ করে লিস্টে উঠানো। আমাকে দিল এসএসসির পদার্থ বিজ্ঞান, আর আমিরকে দিল ক্লাস টেনের অংক।
কাজটা ঠিক না ভুল সেটা বিবেচনা করার মনমানসিকতা আমাদের তখনও হয়নি। আমি সেই বার এসএসসি দিয়েছি, আর স্যার আমাকে দিয়েই এসএসসির খাতা কাটাচ্ছে এতে গর্বে বুক ফুলে উঠেছিল। মনের আনন্দে শুরু করলাম। প্রতি বান্ডিলে ৫০ টা করে খাতা থাকে। দেখা যায় এক বান্ডিলে নম্বর বিশের (চল্লিশে পরীক্ষা) উপরেই উঠে না তো অন্য বান্ডিলে ৩৫ এর নিচে নামে না। এটা খুব সম্ভবত ভাল স্কুল খারাপ স্কুলের প্রভাব। যেই খাতা গুলোতে ১২/১৩/১৪ উঠত স্যারে নির্দেশ ছিল সেগুলোকে যে ভাবেই হোক ১৫ (পাশ নম্বর) করতে হবে। নইলে সেই খাতা হেড এক্সামিনার চেক করবে। আবার যেগুলোতে ৩৭/৩৮ এর উপরে উঠবে সেগুলা আবার দেখতে হবে নইলে সেগুলোও হেড এক্সামিনার দেখতে পারে। আমরা তাই করতাম। হয়ত অনেকে ১০ নম্বর এর উত্তর দিয়েছে। নিজেরাই অংক করে তারে ১৫ দিয়ে দিতাম। আবার খুব বেশি পাওয়া খাতাগুলোতে নম্বর কমাতাম না, মাথায় ঘুরত হয়ত কোথাও কেউ আমার খাতাও এভাবেই দেখছে। আমি কম দিলে না আবার আমার উপর গজব নামে। এটাই ছিল ভেতরের ঘটনা, যে ১০ এর উত্তর দিয়েছে সে হয়ত নিজেকে নিশ্চিত ফেল ধরে বসে আছে। কিন্তু রেজাল্টে দেখবে সে পাশ।
তাছাড়া আরো কিছু রহস্যের উদ্ঘাটন হল। স্কুলে প্রিটেস্টের অংক পরীক্ষায় দেখি আমার একটা অংক কাটা, একটা জায়গায় লাল কালিতে গোল করা। আহসান স্যার খাতা দেখেছিলেন, আমি স্যারে কাছে প্রশ্ন করলাম স্যার আমার উত্তর তো ঠিক আছে আর লাল গোল দেওয়া অংশতেও কোন ভুল নাই। স্যার কিছুক্ষণ খাতাটা দেখলেন, তারপর অন্য একটা ভুল দেখিয়ে বললেন এই কারনে নম্বর দেই নাই। আমার কাছে ব্যাপারটা সন্দেহজনক লাগে, স্যার নিজে দেখে থাকলে নিশ্চয়ই অন্য ভুলটা ধরতেন, অহেতুক সঠিক অংশে কেন দাগ দেবেন। এসএসসির খাতা কাটতে গিয়ে বুঝলাম পেছনের ঘটনা।
কলেজ জীবনে টিচারদের সাথে তেমন মেলামেশা হয় নি। অনেকটা মুক্ত ছিলাম, উপভোগ করেছি মুক্ত জীবনের আনন্দ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে আবার সিরিয়াস হলাম। এখানেও অনেকটা একই ঘটনার সম্মুক্ষিণ হই। খুব সম্ভবত সেকেন্ড ইয়ারে আমাদের ক্লাসের কয়েকজন গেল এক স্যারের কাছে মিডটার্মের নাম্বার আনতে। স্যার ওকে একটা সাদা কাগজ ধরিয়ে বললেন, “লেখ”। সে এক একটা খাতা হাতে নিয়ে পৃষ্টা উল্টিয়ে পালটিয়ে নাম্বার বলতে লাগলেন। বেশি হলে ১০ মিনিটে ২৫টা খাতার নম্বর দিয়ে দিলেন। আমরা অনেকেই পরীক্ষাটা খুব ভাল দিয়েছিলাম, দশে দশ পাব ধারনা ছিল কিন্তু পেলাম ৫/৬/৭ এরকম। আর এক সহপাঠী খুব খারাপ পরীক্ষা দিয়েও পেল ৯। পার্থক্য একটা তার হাতের লেখা ভাল ও খাতা পরিস্কার ছিল (তেমন কিছু লেখে নাই)। উক্ত শিক্ষক এখন এক স্বনামধন্য প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের মাননীয় উপাচার্য!
সেশন জটের ফ্যাসাদে আমি এখনও মাস্টার্সের গন্ডি পেরুতে পারলাম না। শংকা ছিল হয়ত বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে যাবে, সেইরকমই শুনছিলাম। শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে, ঢাবি এখনও চলছে। ফলে চলছে আমার পরীক্ষাও। চারটা পরীক্ষা ঈদের আগে বাকি চারটা ঈদের পর। ঈদের আগের তিনটা পরীক্ষা হয়েছে, একটা বাকি। আমি নিশ্চিন্তে ব্লগিং করে যাচ্ছি। চার নম্বর পরীক্ষাটা নিয়ে চিন্তা নাই, কারন খেটে লাভ নাই। বাংলাদেশে একজন স্বনামধন্য বিজ্ঞানীর বিষয় সেটা। দেশে জ্ঞানিগুনিজনের নাম উঠলে স্যারের নাম আসবেই। উনিও পরীক্ষার ব্যাপারে কেয়ারলেস। না দেখে নম্বর দেন। আমরাও রিলাক্স থাকি।
তবে এসএসসির ব্যাপারে কিছু বলতে চাই। অনেক শিক্ষকই মূলত এসএসসির সব খাতা দেখেনই না, দেখলেও ভাল করে দেখেন না। প্রতি বান্ডিলের চার/পাঁচটা খাতা দেখে আন্দাজ করে বাকি গুলায় নাম্বার দেন। পরীক্ষার খাতা হাতে পাওয়ার আগে হেড এক্সামিনারদের একটা ওয়ার্কশপে নানা নির্দেশনা দেওয়া হয়। সেখানে ঠিক করা হয় নম্বর কেমন দেওয়া হবে। যেমন ধরুন, বাংলার হেড এক্সামিনারদের যদি বলা হল নম্বর বেশি দিতে। তারা আগে হয়ত যেই রচনা খুব ভাল লিখতে বিশে ১৫/১৬ দিতেন সেখানে হয়ত একেবারে বিশই দিয়ে ফেলেন। এটাই এখনকার অতিরিক্ত এ+ এর নেপত্থের একটা কাহিনী। আর একটা ব্যাপার হল টিচারদের খাতা দেখতে দেওয়ার সময় এক ধরণের উত্তরপত্র দেওয়া হয়। এতে থাকে কোন প্রশ্নের উত্তরে কতটুকু বা কি কি লিখলে কেমন নম্বর দিতে হবে। যদি লেখা থাকে কোন রকম উত্তর দিলেই ফুল মার্কস দিতে হবে, তখনই এ+ -এ দেশ ভেসে যায়। নেপত্থের ঘটনা হল এরকম, শিক্ষার মানের সাথে এর কোন সম্পর্ক নাই।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে ফেব্রুয়ারি, ২০০৯ বিকাল ৪:১০