ছুটির অলস বিকেলে শুয়েই ছিলাম । আমার কাছে শুয়ে থাকাটাই সব থেকে আনন্দের কাজ । কোন কাজ ছাড়া এবং নিতান্তই বাধ্য না হলে বাইরে যেতে একদমই ভাল লাগে না । শুয়ে শুয়ে গান শুনছিলাম এফএমে ! এমন সময় নিশির ফোন ।
-তেমন কিছু না । শুয়ে শুয়ে গান শুনছিলাম ।
-একটু বের হব । যাবা আমার সাথে ?
আজকে ওর কন্ঠস্বর অন্যরকম । কেমন একটা মোলায়েম ভাব । খানিকটা অনুরোধের সুরে । অন্য দিনের মত না । অন্য দিন ও বলত
-এই একটু নিচে নামো তো । নিউমার্কেট যাবো ।
খানিকটা কর্তৃত্বের সুরেই বলত । আর আজ কত মোলায়েম সুর । অবশ্য এর কারনও আছে ।
কাল রাতে আমি ওর সাথে ব্রেক আপ করতে চেয়েছিলাম । এমন কি বলেও ফেলেছিলাম কথা টা ওকে ! কিন্তু ফলাফলটা যে এমন হবে সেটা ভাবি নি ।
নিশির সাথে ব্রেক আপ করার কথাটা কিছু দিন থেকেই ভাবছিলাম । আসলে নিশির সাথে ঠিক খাপ খাওয়াতে আমার কষ্ট হচ্ছিল । এমনিতে ও ঢাকার মেয়ে তার উপর যথেষ্ট আধুনিক ।
ওর কথা বার্তা চাল চলন সব কিছুই আমার থেকে আলাদা । আমি যেই পরিবেশ থেকে এসেছি সেখানটাতে এমনটা দেখে আমি অভস্ত্য নই । তার উপর কদিন ধরে আমার এই কথাটা খুব বেশি করে মনে হচ্ছে যে আমি যেন নিশির যোগ্য নই ।
আগে অল্প অল্প এই কথাটা মনে হত কিন্তু যে দিন নিশির কিছু বন্ধুদের সাথে দেখা করতে গেলাম সেদিনের পর থেকেই ব্যাপারটা আমার মনে আরো বেশি করে মনে হচ্ছে । সত্যি বোধহয় আমি ওর যোগ্যই না ।
নিশির বন্ধুবান্ধব গুলোর আচরনও দায়ী ছিল এর পেছনে । ওদের আচরন দেখেও আমার মনে হয়েছে ওরাও ঠিক আমাকে গ্রহন করতে পারছে না নিশির বয়ফ্রেন্ড হিসাবে ।
তাই গতকাল সিদ্ধান্ত নিয়েই নিলাম । কথাটা বলবো আজকেই । নিশিকে ছাদে ডাক দিলাম ।
নিশি খুব তাড়াহুড়ার মধ্যে এল । বলল
-কি বলবা জলদি বল । এক জায়গায় যেতে হবে ।
আলো কম থাকায় খুব ভাল দেখা যাচ্ছিল না । তবুও এটুকু মনে হচ্ছিল যে নিশি কোন পার্টিতে যাচ্ছে এই রাতের বেলা ।
-কই বল !
নিশি আবার তাগাদা দিল । আমি ওর মুখোমুখি দাড়ালাম । বললাম
-নিশি তোমার সাথে আমি ঠিক খাপ খাওয়াতে পারছি না । আমার মনে হয় আমাদের রিলেশনটা আর কনটিনিউ করা উচিত্ নয় ।
-কি ?
নিশি প্রথমে হেসে ফেলল ।
-কি বলছ এসব ?
ও প্রথমে বিশ্বাসই করল না । আমি হয়তো ঠাট্টা করছি এই ভেবে উড়িয়ে দিল ।
-শোন আমার এখন খুব ...
কিন্তু আমার মুখ দেখে ও চুপ করে গেল । আমি যে সিরিয়াস আমার মুখ দেখেই ও বুঝে গেল । বলল
-তুমি কি এসব ? কেন বলছ ? আমি কি করলাম ?
-না নিশি তুমি কিছু কর নি । আসলে আমি নিজেই তোমার সাথে খাপ খাওয়াতে পারছি না । তোমার লাইফ স্টাইল আর আমার লাইফ স্টাইল এক না । আর আমরা এক লেভেলের মানুষও না । পরে আমাদের আরো সমস্যা হবে ।
আমি ওর সামনে থেকে সরে এসে ছাদের রেলিংয়ের এক পাশটাতে বসলাম । একটু পর দেখলাম নিশিও আমার পাশে এসে বসল । চুপচাপ বসে রইলাম কিছুক্ষন । কেউ কোন কথা বলছে না । যেন কারো কোন কথা বলার নেই ।
একটু পর আমি নিশির দিকে তাকিয়ে দেখি ও আমার দিকেই তাকিয়ে আছে । ছাদে কোন লাইট জ্বলছে না । আশেপাশের বাড়ি থেকে আলো এসে কেমন একটা আলো আধার পরিবেশ সৃষ্টি করেছে ।
আমি খুব অবাক হয়ে লক্ষ্য করতাম নিশি কাঁদছে । কেবল নিরবে ওর চোখ দিয়ে পানি পড়ছে ।
আর কি গভীর চোখে ও আমার দিকে তাকিয়ে আছে । আমি আমার বুকের মধ্যেই কেমন একটা কাঁপন অনুভব করলাম । নিশির ঐ গভীর চোখ যেন চিৎকার করে বলছে ওর ভালবাসার কথা !
নিশির চোখের দিকে তাকিয়ে আমি এই প্রথম বারের মত অনুভব করলাম যে নিশি সত্যি আমাকে অনেক ভালবাসে ।
আমি কি বলব কি করবো এই যখন ভাবছি ঠিক এমন সময় নিশি আমাকে জড়িয়ে ধরল ।
নিশি আমার গার্লফ্রেন্ড হবার পর থেকে এই প্রথম ও আমাকে জড়িয়ে ধরল । বুকের মধ্যে আবার সেই অদ্ভুদ অনুভূতি হল । আসলে এর আগে কোন মেয়ের এতো কাছে আমি আসি নি ।
কেমন যেন একটা অস্বস্থি লাগছিল । মিথ্যা বলব না ভালও লাগছিল অনেক ।
হঠাৎ নিশির শরীরটা একটু কেঁপে উঠল । বুঝতে পারলাম ও কাঁদছে । খুব মায়া লাগল ওর জন্য । সেই সাথে নিজের উপর খুব রাগ হল নিশিকে এভাবে কাঁদাবার জন্য । নিজেকে খুব অপরাধী মনে হল । ভালই তো চলছিল । একটু সমস্যা হচ্ছিল চেষ্টা করলেই মানিয়ে নেওয়া যেত !
তাহলে এমন কেন করলাম ?
বেচারীকে কেন কষ্ট দিলাম ?
নিশি তখনও কেঁদেই চলেছে আমাকে জড়িয়ে ধরে । আমি ওর মাথায় হাত রাখলাম । কিন্তু কোন কথা বলতে পারলাম না । কতক্ষন এভাবে ছিলাম ঠিক মনে নেই তবে আস্তে আস্তে ওর কান্না থেমে এল । একটা সময় ও আমার বাহু বন্ধন থেকে নিজেকে মুক্ত করে নিল ।
আমার হাত ধরে ওর মাথার উপর ধরে বলল
-বল আর কোন দিন এই ধরনের কথা বলবা না । বল ।
কোন মতে বললাম
-আচ্ছা ।
-কি আচ্ছা ?
-আর বলব না ।
-হুমমম ! ঠিক আছে ! এখন আমি যাই । কেমন ? রাত হয়ে যাচ্ছে ।
নিশি চলে যাবার পরও অনেকক্ষন বসে থাকলাম । তারপর নিশি ফোন ফোন দিল এই । বাইরে যাবো কিনা জানতে চাইল ।
নিশি আবার জানতে চাইল
-যাবা আমার সাথে ?
-হুম । যাবো না কেন ?
-তাহলে আসো কেমন ! আমি নিচে নামছি ।
নিচে নেমে দেখলাম নিশি দাড়িয়ে আছে । আমাকে দেখেই হাসল ।
-চল ।
-তুমি আগে যাও আমি পেছনে আছি ।
এরকম করেই আমাদের বাইরে যেতে হয় । এলাকার মধ্যে তো আর পাশাপাশি হাটা যায় না । তাই নিশি একটু আগে আগে যায় আর একটু পরে আসি । নিশি আবার হাসলো । বলল
-সমস্যা নাই আজ এক সাথেই যাবো ।
ওর পাশাপাশি হাটতে শুরু করলাম । সত্যি বলতে কি একটু অস্বস্থি লাগছিল । ওর সাথে পাড়ার মধ্যে এভাবে হাটি নি । লোকজন কি ভাববে কে জানে ?
মোড়ের মাথায় এসে দেখলাম রুমেল দাড়িয়ে আছে । আর জ্বলন্ত দৃষ্টিতে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে ।
আমি এখন খুব ভাল করে জানি রুমেলের এরকম তাকিয়ে ছাড়া আর কিছুই করার নাই । নিশি ঐ দিনই ওর বাবাকে বলে সব কিছু ঠিক করে ফেলেছিল ।
নিশি রিক্সা ডাকল । এবং আমাকে উঠতে বলল ।
আমি এবার খানিকটা অবাক হলাম ।
পাশাপাশি হাটলাম । ঠিক আছে ।
কিন্তু একই সাথে রিক্সায় ওঠা একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে । রুমেলরা দেখছে । আরো অনেকেই দেখছে ।
নিশির বাবাকে বলে দিলে একটু সমস্যা হতেই পারে । তবুও রিক্সায় উঠে পরলাম ।
নিশি রিক্সায়ালা কে বলল মামা
-হুডটা তুলে দেন ।
রিক্সা চলতে শুরু করল । আমি বললাম
-একটু বেশি বেশি হয়ে গেল না ?
-কোন টা ?
-এই যে এলাকা থেকে একসাথে রিক্সায় ওঠাটা । এটা মানুষ কিভাবে নিবে ? আর তোমার আব্বাকে যদি বলে দেয় , তাহলে ?
নিশি হাসল । বলল
-তুমি খুব বেশি ভয় পাও । আর আব্বা জানে ।
আমি ধাক্কার মত খেলাম ।
-জানে মানে ? কি জানে ?
-এই যে তোমার আমার ব্যাপার টা ।
নিশি খুব শান্ত ভাবে জবাব দিল ।
-কি বলছ এসব ? কে বলল ? কবে থেকে জানে ?
যদিও আমার ব্লাড প্রেসার নেই তবুও মনে হল শরীরে রক্তের প্রেসার যেন বেড়ে গেছে । নিশি আবারও খুব শান্ত ভাবে বলল
-কাল রাত থেকে । আমি বলেছি ।
-তুমি বলেছ ? কেন ?
আমি যেন আকাশ থেকে পড়লাম । নিশির মুখটা কেমন যেন মলিন হয়ে উঠল । বলল
-কাল রাতে তুমি যখন ঐ কথাটা বললে , তোমাকে বোঝাতে পারবো আমার কি মনে হচ্ছিল ! মনে হচ্ছিল যেন আমার পুরো পৃথিবী আমার কাছ থেকে এক নিমিষেই হারিয়ে গেল । আমি কালকেই ঠিক বুঝতে পারলাম তোমাকে আমি কি পরিমান ভালবাসি ! আর তুমি আমার কাছে কতটা জরুরী ।
নিশি চুপ করল একটু । আমি ঠিক বুঝলাম না এর সাথে বাবাকে বলার সম্পর্ক কি ?
নিশি আবার বলা শুরু করলো
-তাই এমন ব্যাবস্থা করেছি যেন যেন তুমি আর এমনটা না করতে পারো ।
-মানে কি ?
-মানে হল সোনা পাখি ........
নিশি আমার দিকে তাকিয়ে হাসল । তারপর আমার হাতটা ধরে বলল
-মানে হল আমি বাবাকে সোজাসুজি বলেছি তোমাকে আমি ভালবাসি । আর তোমাকেই আমি বিয়ে করবো । এবং জলদি ।
-জলদি ?
-হুম ।
-তোমার বাবা কি বলল ?
নিশি আবারও হাসল । বলল
-বাবা কি বলেছে সেটা কয়দিনের মধ্যেই টের পাবা !
আমি বড়সড় একটা ঢোক গিললাম । আল্লাহ জানে আমার কপালে কি আছে !
নিশি যে ভাবে আমার গার্লফ্রেন্ড হল !!!
গল্পটা এখানে আছে
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে মে, ২০১২ রাত ১১:২৯