আমি বারান্দা দিয়ে একটু দেখার চেষ্টা করলাম । ঐ তো মেয়েটাকে দেখা যাচ্ছে । রিক্সার উপর চুপচাপ বসে আছে । হাতে একটা সাইনবোর্ড ।
আমি ভাবতেই পারি নি মেয়েটা এমন একটা কাজ করতে পারে ।
এই মেয়েটা কেন, কোন মেয়ে এমন কোন কাজ করতে পারে এই টাই আমার চিন্তার বাইরে ছিল !!
এই মেয়ে গুলা যে কখন কি করে বসে !!
বোঝা বড় মুসকিল !!
-ভাইয়া ।
পিছনে ঘুরে দেখি ইরিন দাড়িয়ে আছে পিছনে ।
-কি হল ?
-আব্বা ডাকছে ।
-কেন ?
-কেন ডাকছে সেটা আমি কিভাবে বলবো ?
আমি খানিকটা ভয় পেলাম । আমি ইরিনকে বললাম
-আব্বার মেজাজ কেমন রে ?
-মেজাজ খুব গরম । চুপচাপ বারান্দায় বসে আছে । ফারিয়া আপুকে যখন থেকে বাসার সামনে পজিশন নিয়েছে তখন থেকে একটা কথাও বলে নি ।
-পজিশন নিয়েছে মানে কি ?
ইরিন একটু মুচকি হাসল । বলল
-যাও বাবার কাছে টের পাবা !
-যা দুর হ !
আমি আর একবার বারান্দা দিয়ে তাকালাম ফারিয়ার দিকে । এই মিষ্টি মেয়েটা এমন কাজ কেমন করে করল ?
কেমন করে?
মিষ্টি মেয়ে তো আমি মনে করেছিলাম । এখন দেখছি আস্ত ফাজিল একটা মেয়ে !!
সকালবেলা ঘুমিয়েই ছিলাম সুমনের ফোন পেয়ে ঘুম ভাঙ্গল । ফোন রিসিভ করতেই সুমন বলল
-ফারিয়া কি করছে দেখছিস ?
ফারিয়া আমার গার্লফ্রেন্ড । খুবই মিষ্টি একটা মেয়ে । আর খুব নরম স্বভাবের ।
কিন্তু এই মিষ্টি মেয়েটার সাথে আমি রিলেশন ব্রেক করেছি । না ফারিয়ার কোন দোষ নাই ।
দোষটা আমার ।
না ।
দোষটা আমার নিজেরও না । সব দোষ আমার ঐ বাপটার । এমন একটা বাপ আমার সারা জীবন তার সিদ্ধান্ত গুলো আমার উপর চাপিয়ে দিয়েছে আর আমি তার বাধ্য সন্তানের মত সেগুলো মেনে চলেছি এবং চলছি ।
ঠিক দুসপ্তাহ আগে বাবা আমাকে কাছে দেকে বলল যে সে আমার জন্য একটা মেয়ে পছন্দ করেছে ।
মাসের শেষ শুক্রবার বিয়ে । আমি যেন আকাশ থেকে পড়লাম । ফারিয়ার সাথে প্রায় দুবছরের সম্পর্ক । ইরিন ব্যাপারটা জানে । মাকেও খানিকটা ইঙ্গিত দিয়েছি কিন্তু বাবাকে বলার সাহস হয় নি ।
কাল যখন ফারিয়াকে বললাম কথাটা ফারিয়া কোন কথা বলে নি । কেবল মাথা নিচ করে বসে ছিল আমার পাশে ।
আমি যখন উঠে যাবো ফারিয়া আমার হাত চেপে ধরলো । বলল
-চলে যাও ? আর একটু বসো না ! আর তো আসবা না ! আর তো দেখা হবে না !
ফারিয়ার কথা শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেল । ফারিয়াকে ভালবাসি সত্য কিন্তু তার থেকেও বেশি ভয় পাই আমি আমার বাপ কে ।
সারা রাত কেবল এপাশ ওপাশ করেছি । বারবার ফারিয়ার কথাটাই কেবল মনে হচ্ছিল ।
ওর শেষ কথা গুলো !
আর তো দেখা হবে না ! একটু ভয়ও করছিল । মেয়েটা এমনিতে খুব ইমোশনাল ।
কিছু না আবার করে বসে , এই ভয়টা কিছুটা ছিল ।
সকালবেলা তাই সুমনের ফোন পেয়ে তাই একটু ভয়ই পেয়েছিলাম । সুমন ঠিক আমার নিচের তলায় থাকে । সুমন যখন বলল যে ফারিয়া কি করেছে জানিস ?
আমার বুকের ভিতরে কেমন একটা ভয় মত লাগল ।
ফারিয়া আবার কিছু করে বসল না তো ? আমি বললাম
-কি করেছে ?
-আরে বাসার সামনে রিক্সায় বসে আছে ।
-মানে কি ? কাদের বাসার সামনে ?
-আরে ইডিয়েট আমাদের বাসার সামনে । রিক্সায় বসে আছে ।
এবার আমি একটু ভয় পেলাম ।
ফারিয়া বাসার সামনে কি করছে ?
যদি ও বাসায় চলে আসে আর যদি আমার বাবার সামনে পড়ে আমার খবর হয়ে যাবে । সুমন বলল
-তোকে তো আসল খবর বলিই নাই ।
এর থেকে আবার আসল খবর কি হতে পারে ? তারপর সুমন যা বলল তার জন্য আমি সত্যিই প্রস্তুত ছিলাম না । সুমন বলল
-ফারিয়া একটা সাইনবোর্ড নিয়ে বসে আছে ।
-সাইনবোর্ড ? মানে ?
-এতো মানে মানে করিস ক্যান ? সাইনবোর্ড বুঝিছ না ?
-বুঝি তো । কিন্তু সাইনবোর্ড নিয়ে ফারিয়া কি করছে ? আর কিসের সাইনবোর্ড ?
-সাইনবোর্ডে কি লেখা আছে জানি ।
আই উইস!! সাইনবোর্ডে কি লেখা আছে সেটা সুমন আমাকে না বলত !!
সুমন বলল
-সাইনবোর্ডে লেখা "আমাকে ব্যতীত রুদ্র অন্য কাউকে বিয়ে করলে গায়ে কেরসিন ঢেলে আত্মহত্যা করবো" !
-কি করবো ? কি বললি তুই?? আবার বল?
-তুই বারান্দায় গিয়ে দেখ । তাহলে ভাল করে দেখতে পাবি ।
ফোন রেখে বারান্দায় গিয়ে সত্যি সত্যি আমার চোখ কপালে উঠল । আমাদের বাড়ির সামনে একটা রিক্সা দাড়িয়ে । রিক্সা কে ঘিরে বেশ কিছু লোকজন দাড়িয়ে ।
রিক্সার উপর ফারিয়া চুপচাপ বসে । হাতে সেই সাইনবোর্ড ধরে বসে আছে ।
এই মেয়েটা এমন একটা কাজ করলো কিভাবে ?
সব চেয়ে বড় কথা এতো সাহস পেল কোথায় মেয়েটা ? কোন আমার কথার উপর একটা কথাও বলে নি । যখন যেমনটা বলেছি চুপচাপ তাই মেনে নিয়েছে ।
আর সেই মেয়ে আমার বাড়ির সামনে !!
সাইনবোর্ড হাতে নিয়ে বসে আছে যে রুদ্রকে বিয়ে করবে ।
আশ্চার্য !
আমি ফোন দিলাম ফারিয়াকে ।
-হ্যালো ।
-তুমি আমার বাড়ির সামনে কেন ?
-পড়ালেখা ভুলে গেছ ? চোখের পাওয়ার কমে গেছে ? সাইনবোর্ডে কি আছে দেখতে পাচ্ছ না ?
-ফারিয়া তুমি এই কাজটা কিভাবে করলা ?
-শোন আমি তো এখনও কিছু করিই নাই । কেরোসিন তেল কিন্তু আমি সাথে করেই নিয়েছি ।
-মানে কি ?
-মানে কি তুমি খুব ভাল করেই জানো । আজ মেয়ে পক্ষদেয় তোমাদের বাড়ি আসার কথা তাই না ?
আমি কোন কথা বলল না । কথা সত্য । গত সপ্তাহে আব্বা মেয়ের বাড়িতে গিয়ে মেয়ে দেখে এসেছে । আজ মেয়ের বাড়ি থেকে আসার কথা ।
আচ্ছা এই কথা তো আমি ওকে বলি নাই তাহলে ও জানলো কিভাবে ?
কে বলল ওকে ?
ইরিন বলেছে ? যে বলে বলুক ?
হু কেয়ার্স ?
এখন প্রধান সমস্যা হল ফারিয়া বাড়ি সামনে !
ও মাই গড !
আব্বা জানলে কি করবে জানলে ?
জানলে কি ?
আমার তো মনে আব্বা এতোক্ষনে জেনে গেছে ! আল্লাহ জানে কি করবে আমাকে ?
ইরিন একটু পর আবার আমার ঘরে এসে হাজির ।
-কি হল ?
-আব্বা ডাকছে !
এই সেরেছে রে ! আমার বুকের ভিতর কেমন একটা ভয় ভয় করতে লাগল । আব্বা যখন দেকেছে তখন ভয়ের তো একটা কথা আছেই । এই মেয়েটা আমাকে কি যে বিপদে ফেলবে !
ফেলবে কি বিপদে ফেলে দিয়েছে ।
খাবার টেবিলে আব্বা গম্ভীর মুখে বসে রয়েছে । আমি পাশে গিয়ে চুপচাপ দাড়ালাম । বুকের ভিতর টিপটিপ করছে । না জানি আজ কি হয় ?
আব্বা কি বলবে কে জানে ? আমার কেন জানি ফারিয়ার চেহারা খুব মনে পড়ল ।
ও প্রায়ই আমাকে অনুনয় করে বলত
-তুমি একবার বলবে আমার কথা ?
-কার কাছে বলব ?
ফারিয়া আরো সংকোচ করে বলল
-তোমার আব্বার কাছে । যদি উনি তোমার জন্য অন্য কাউকে ঠিক করে ফেলে ? তখন ?
-না, বাবা । আমি পারবো না । মোটেই পারবো না ।
-তাহলে ? রুদ্র তোমাকে ছেড়ে আমি কিভাবে থাকবো ?
-কি ব্যাপার দাড়িয়ে আছো কেন ?
আমি বাস্তবে ফিরে এলাম ।
-জি বাবা ?
-দাড়িয়ে আছো কেন? বস ।
আমি চুপ করে বসলাম । একটু জড়সড় হয়ে বসলাম । আব্বা একটু চুপ করে থেকে বলল
-মেয়েটার নাম কি ?
-কো-কোন মেয়েটা ?
আব্বা আমার দিকে তাকিয়ে খুব জোরে একটা ধমক দিলো ।
-মেয়েদের মত ন্যাকামো করবা না খবরদার । থাপড়িয়ে তোমার দাত আমি খুলে ফেলব । ঐ ফাজিল মেয়ের নাম কি ?
-ফারিয়া ।
-তোমাকে কিভাবে চিনে ?
-আসলে আব্বা ও আমার ইউনিভার্সিটিতে পড়ত । আমার দুই বছরের জুনিয়র ।
-ও তাহলে এই ব্যাপার । বিকেল বেলা তোমার শ্বশুর বাড়ি থেকে লোক আসবে । তার আগে এই মেয়েটাকে বাড়ির থেকে বিদায় করবে । ঠিক আছে ?
-জি আব্বা ।
আমি আমার ঘরে চলে এলাম । এই মেয়েটাকে আমি কিভাবে চলে যেতে বলব ?
বললে কি শুনবে ?
শোনার কথা । ফারিয়া তো এমন জেদি মেয়ে না । আমার সব কথা তো ও শোনে । তাহলে আগে একবার ফোন দিয়ে একটু কথা বলে নেই তারপর না হয় নিচে গিয়ে ওকে বাসায় পৌছে দেওয়া যাবে ।
নাকি সরাসরি ওর সামনে গিয়ে হাজির হব । বলতে বলতে ফারিয়ার ফোন
-কোথায় তুমি ?
-বাসায় ।
-আর কতক্ষন বাসায় থাকবে ? আমি কতক্ষন ধরে তোমান তোমার বাড়ির সামনে দাড়িয়ে আর তুমি ! আমার খুব ক্ষুদা লেগেছে ।
-কি ?
-কি লেগেছে ?
-ক্ষুদা লেগেছে । সকাল থেকে কিছু খাই নি । একটু বিরানী নিয়ে আসো না ?
আমি যেন আকাশ থেকে পড়লাম ।
এই মেয়ের মনের মধ্যে কি চলছে ?
এই মেয়ে কেরোসিনের ডিব্বা নিয়ে আমার বাড়ির সামনে হাজির হয়েছে আর এখন আবার আমার কাছেই বলছে বিরানী খাবে !
ওকে !
একটা বুদ্ধি এসছে ।
ওকে বিরানী খাওয়ানোর নাম করে নিয়ে যাই । বাসার সামনে থেকে এখন সরাতে পারলেই আপাতত বিপদ কোন মতে কাটবে ।
আমি নিচে নেমে এলাম । এখন ভিড় মোটামুটি নেই । আমাকে দেখে ফারিয়া একটু হাসল ।
-কিছু এনেছ ? খুব ক্ষুদা লেগেছে ।
আমি বললাম
-বিরানী কোথায় পাবো এখন ? চল ঐ মোড়ের মাথায় বিরানীর দোকান আছে । ওখান থেকে খেয়ে আসি ।
ফারিয়ার মুখটা একটু মলিন হল ।
-আমি যাবো না । খেতে যাই আর তুমি এখান থেকে নিয়ে যাও । আমার দাবী আদায় না হওয়া পর্যন্ত আমি এখান থেকে একটুও সরবো না ।
দাবী আদায় মানে ?
এই মেয়ে যে রাজনৈতিক দল গুলোর মত কথা বলছে ।
আমাদের দাবী আদায় না হওয়া পর্যন্ত আমরা রাজ পথ ছাড়বো না ।
ভায়েরা আমার রক্ত যখন দিয়ে রক্ত আরো দিবো ।
-এমন কেন করছো ?
-কেন করছি জানো না ? আমি সারা জীবন তোমার সব কথা শুনেছি সামনেও তোমার সব কথা শুনবো । কেবল আজ আমার একটা কথা শুনো । শুধু তোমার আব্বা কে গিয়ে বল যে তুমি আমাকে বিয়ে করতে চাও ।
-কি ?? ফারিয়ার মাথা ঠিক আছে তো ? আব্বা আমাকে চিবিয়ে খেয়ে ফেলবে ।
আমার মুখের অবস্থা দেখে ফারিয়া বলল
-তোমার বাবা তোমাকে খেয়ে ফেলবে না ? তবে তোমাকে একটা কথা আমি বলি যদি তুমি না বল তাহলে আমি কিন্তু সত্যি সত্যি কেরোসিন ঢেলে দিবো ।
আমি ফারিয়ার চোখের দিকে তাকিয়ে দেখি ও খুব ঠান্ডা চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে । আমার কেন জানি মনে হচ্ছে সত্যিই কাজটা করবে ! আমি মোড়ের দোকান থেকে বিরানী কিনে এনে দিলাম ।
এবার আমি কই যাই ?
একদিকে আমার বাপ আর একদিকে এই মেয়ে !
আমি পরেছি মাঝখানে ?
কোন দিকে যে যাই ?
বিকেল বেলা মেয়ে পক্ষ এল আর গেল । আব্বা গম্ভীর মুখ আরো গম্ভীর হয়ে গেল । রাতের বেলা আব্বা আবার আমাকে ডেকে পাঠাল তার ঘরে । আমার দিকে তাকিয়ে বলল
-তুমি এখনই আমার বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে । আমি তোমার মুখ আর দেখতে চাই না । এখনই ঐ মেয়েকে নিয়ে আমার বাড়ির সীমানা থেকে বের হয়ে যাবে ।
-ঠিক আছে ?
-জি আব্বা ।
-আবার বলে ঠিক আছে । এখনই দুর হ আমার সামনে থেকে । বেটা ফাজিলের ফাজিল !!
আমি বাইরে এসে দেখলাম ফারিয়া চুপচাপ বসেই আছে রিক্সার উপর ।
ওর মুখটা কেমন একটু মলিন । আমাকে দেখে একটু হাসি ফুটলো মুখে । কাছে যেতেই বলল
-বলেছ ?
-নাহ । বলার সুযোগ পাই নি । তার আগেই বাবা বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতে বলেছে ।
-তারপর ?
-তারপর আর কি ! বের হয়ে এলাম ।
-এখন কি করবা ?
-কি জানি ? চল ঘুরে আসি ।
-কোথায় ?
-আগে তো কাজী অফিসে যাই তারপর দেখা যাক কোথায় যাওয়া যায় । -কাজী অফিসে যাবা ঘুরতে ?
ফারিয়া হাসি মুখে একটু সরে বসলো ! আমি রিক্সার উঠে বসলাম ।
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই নভেম্বর, ২০১২ রাত ১০:০১