সুমন তার বাবার দিকে তাকিয়ে আছে । স্পষ্টই বুঝতেই পারছে তার বাবা বেশ উত্তজিত ! আনন্দ মাখা উত্তেজনা ! এই ছোট্ট বয়সেও বাবার আনন্দ দেখে সুমনের ভাল লাগছে !
-দেখো দেখো ! স্বাধীনতার আর বেশি দেরি নেই !
সুমনের বয়স মাত্র সাত বছর ! এরই ভিতর সে স্বাধীনতা কথাটার মানে বেশ ভাল ভাবেই বুঝে গেছে !
স্বাধীন দেশ মানে নিজেদের একটা দেশ ! কারো অধীন না ! একেবারে নিজেদের আপন একটা মাতৃভূমি !
সুমনের বাবা অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী আবার বললেন
-আর কেউ বাধা দিতে পারবে না । ২৪ ঘন্টার ভিতরে আমরা স্বাধীন হয়ে যাবো !
অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর ভেতরে দারুণ এক তোলপাড় হচ্ছে ! কিছুতেই তিনি নিজের এই উত্তেজনা ধরে রাখতে পারছে না ! অবশ্য খুব একটা চাইছেনও না ! কেবল একটা কথাই মনে হচ্ছে যে মুক্ত হতে যাচ্ছে দেশ। অনেক রক্ত আর প্রাণের বিনিময়ে মুক্ত হতে যাচ্ছে দেশ !
-আপনি এখনও দাড়িয়ে ?
মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী পেছন ঘুরে দেখলেন তার স্ত্রী তাহমিনা !
-আরে তুমিও এসো ! দেখে যাও সোনার ছেলেরা কি করে ফেলেছে ! দেশ স্বাধীন হতে যাচ্ছে !
স্বামীর উত্তেজনা দেখে তাহমিনার বেশ ভাল লাগলো ! খুশি হলে মানুষটা কেমন বাচ্চাদের মত আনন্দ প্রকাশ করে ! দেখতে ভাল লাগে !
তাহমিনা বলল
-সারাদিন বারান্দায় দাড়ালে চলবে ? এবার খওয়ার সময় হয়েছে ! টেবিলে ভাত দেওয়া হয়েছে !
-আমি তো গোসল করি নি এখনও !
-আচ্ছা ! আগে গোছল করে নিন ! আপনার গোসলের পানি ও কাপড়চোপড় সব প্রস্তুত।
তারপর সুমনের দিকে তাকিয়ে বলল
-যাও সুমন ঘরে যাও ! বাবা এখন গোসলে যাবে !
দরজা খুলেই লুত্ফুল হায়দার চৌধুরী একটু অবাক হলেন ! একটু ভয়ও পেলেন মনে মনে । কিন্তু মুখে তা প্রকাশ করলেন না ! যথা সম্ভব গম্ভীর গলায় বললেন
-কাকে চাই ?
তার প্রশ্নের উত্তর না দিয়েই নাক পর্যন্ত কাপড় দিয়ে ঢাকা কতগুলো লোক হাতের রাইফেল উঁচিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ল। লুত্ফুল হায়দার চৌধুরীর মনের ভয়টা আরো খানিকটা বেড়ে গেলে ! বারবার একটা প্রশ্নই মনে জাগছিল এরা কারা ?
এরা কি চায় ?
হঠাৎ তাদের ভিতর একজন বলে উঠলো
-স্যার কি বাসায় আছেন ?
যা ভয় করছিলেন শেষে তাই হল ! কদিন থেকে লুত্ফুল হায়দার চৌধুরীর বড় ভাই মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী তার এই শান্তিবাগের বাসায় এসে উঠেছে স্ত্রী পুত্র নিয়ে !
এই লোক গুলো তাহলে বড় ভাইকে খুজতেছে !
কেন ?
উনি তো কোন দোষ করেন নাই !
লুত্ফুল হায়দার চৌধুরী বললেন
-কেন ? ওনাকে কেন দরকার ?
আগের জনই বলল
-আমাদের কমান্ডার গাড়িতে বসে আছেন। উনি স্যারের সঙ্গে একটু কথা বলবেন !
লুতফর হায়দার একবার ভাবলেন বলেন যে তার বড় ভাই বাসায় নেই ! কিন্তু সেই কথা বলতে পারলেন না !
হইচই শুনে তার বড় ভাই মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী বেরিয়ে এসেছেন !
সে নিজেই লোক গুলোর দিকে তাকিয়ে বলল
-আমাকে কি দরকার ?
তখনই লোক গুলোর ভিতর থেকে আরেকজন এগিয়ে এসে বলল
-স্যার আমি মুঈনুদ্দীন ! আপনার ছাত্র ! আপনি একটু আমাদের সাথে আসবেন দয়াকরে !
মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী গম্ভীর গলায় বলল
-কেন ? আমাকে কি দরকার ?
মুইনুদ্দীন আবার বলল
-আমাদের কমান্ডার আপনার সাথে একটু কথা বলবেন ! একটু দরকার ছিল ! আপনি কোন চিন্তা করবেন না ! আমি নিজে আপনাকে আবার এখানে রেখে যাবো !
ততক্ষনে বাড়ির সবার বারান্দার বাড়ির সামনে চলে এসেছে ! তাহমিনা সহ বাড়ীর সবাই কান্নাকাটি শুরু করে দিয়েছে !
মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী বললেন
-আচ্ছা চল !
আরপর তাহমিনার দিকে তাকিয়ে বলল
-আমি এখুনি আসছি ! চিন্তা কর না ! আমি তো কোন দোষ করি নি ! আমার কিছু হবে না !
মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী বন্দুক ধারীদের সাথে বের হতে যাচ্ছিলেন তখন তাহমিনা তাদের সামনে এসে দাড়ালো । তাদেরকে উদ্দেশ্য করে বলল
-আমার স্বামীকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আপনারা? উনি এখনো গোসল করেননি, ভাত খাননি।
মঈনুদ্দীন আবার বলল
-ভাবী আপনি চিন্তা করবেন না । স্যারকে আমি কিছু হতে দিবো না !
মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী বাইরে রাস্তায় দাঁড়ানো কাদামাখা মাইক্রোবাসটায় গিয়ে উঠলেন। এগিয়ে গেলেন তাহমিনা ও লুত্ফুল হায়দার।
বাসের কাছে গিয়ে তাহমিনা বলল
-উনাকে যেখানে নিয়ে যাবেন, আমরাও সেখানে যাব।
রাইফেলধারী লোকগুলো তা শুনে খানিকটা বিরক্ত হল ! মুঈনুদ্দীন বলল
-তার আর দরকার নেই। উনি এখনই চলে আসবেন।
আর কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীকে নিয়ে চলে গেল তারা।
মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী মনে তখন চিন্তার ঝড় চলছে ! মাইক্রোবাসটা চলছে কোনদিকে ঠিক তিনি বুঝতে পারছেন না ! এদিক ওদিক তাকাতে যাবেন তখন লোকগুলোর একজন তার চোখ বেধে দিল !
মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী কিছু বলতে যাচ্ছিলেন কিন্তু ইশারায় তাকে কোন কথা বলতে মানা করলো ! চোখ বাঁধা অবস্থায় কেবল তার প্রিয় পুত্র সুমন আর তাহমিনার কথা মনে হচ্ছিল ! মনে হচ্ছিল এ জীবনে হয় তো কোন দিন তাদের কে দেখতে পাবেন না !
মাইক্রোবাস কতক্ষন চলার পরে একটা জায়গায় এসে থামলো ! মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীকে হাত ধরে নামানো হল বাস থেকে ! তারপর তাকে হাটিয়ে নিয়ে যাওয়া হল বড় একটা ঘরের ভিতর !
মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী যখন চোখ খুলে দেওয়া হল তখন তাকে একটা ঘরে আটকে রাখা হয়েছে ! তিনি চারিপাশে তাকিয়ে দেখেন সেই বিশাল বদ্ধ ঘরে তার আর কিছু পরিচিত লোকজন রয়েছে ! তাদের ভিতর অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীসহ সমমনা আরও অনেকে । যাঁদের প্রত্যেকের গায়েই পড়েছিল নৃশংস নির্যাতনের চিহ্ন। ছেঁড়া জামাকাপড় রক্তে মাখামাখি, এমনকি উপড়ে ফেলা হয়েছিল কারও কারও চোখ !
মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী কিছুই বুঝতে পারছিলেন না ! তবে একটা ব্যাপার ঠিকই আঁচ করতে পারছিলেন !
এভাবে কতটা সময় পার হয়েছে কেউ বলতে পারছিলেন না । একটা সময় লোহার রড হাতে অন্ধকার ঘরটাতে কিছু যুবক প্রবেশ করলো । প্রথমে তারা মুনীর চৌধুরীর মুখোমুখি হল । বলল
-ছাত্রদের তো অনেক কিছু শিখিয়েছেন। আজ আমরা আপনাকে কিছু শিক্ষা দেব। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে আপনি কয়টা বই লিখেছেন?
মুনীর চৌধুরী দুদিকে মাথা নেড়ে বলেলেন তিনি লেখেননি।
তারপর লোক গুলো মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর কাছেও একই প্রশ্ন করলো !
মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী বলেলেন
-হ্যাঁ, আমি লিখেছি।
এ কথা শুনেই লোকগুলোর ভিতরে একজন লোহার রড দিয়ে মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী মাথায় জোরে একটা আঘাত করলেন !
প্রতম আঘাত খেয়েই তিনি মাটিয়ে লুটিয়ে পড়লো ! গলগল করে রক্ত বের হতে শুরু করলো !
তারপর আবার এল আঘাত ! মাথা বরাবরই ! দুই আঘাতেই মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর চেতনা লোপ পেল ! কিন্তু আঘাত থামলো না ! প্রচন্ড আক্রসে মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর উপরে আঘাত চলতেই থাকলো !!
>>>>
(তথ্যসুত্রঃ প্রথম আলো, গুনিজন)
আলোচিত ব্লগ
জামাত কি দেশটাকে আবার পূর্ব পাকিস্তান বানাতে চায়? পারবে?
অন্য যে কোন সময়ে জামাতকে নিয়ে মানুষ যতটা চিন্তিত ছিলো, বর্তমানে তার থেকে অনেক বেশী চিন্তিত বলেই মনে করি।

১৯৭১ এ জামাতের যে অবস্থান, তা নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের অস্তিত্বের বিরুদ্ধে... ...বাকিটুকু পড়ুন
১৯৭১ সালে পাক ভারত যুদ্ধে ভারত বিজয়ী!

দীর্ঘ ২৫ বছরের নানা লাঞ্ছনা গঞ্জনা বঞ্চনা সহ্য করে যখন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বীর বাঙালী অস্ত্র হাতে তুলে নিয়ে বীরবিক্রমে যুদ্ধ করে দেশ প্রায় স্বাধীন করে ফেলবে এমন সময় বাংলাদেশী ভারতীয়... ...বাকিটুকু পড়ুন
ইন্দিরা গান্ধীর চোখে মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক: ওরিয়ানা ফলাচির সাক্ষাৎকার

১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ইতালীয় সাংবাদিক ওরিয়ানা ফলাচি ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাক্ষাৎকার নেন। এই সাক্ষাৎকারে মুক্তিযুদ্ধ, শরনার্থী সমস্যা, ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক, আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদী পররাষ্ট্রনীতি এবং পাকিস্তানে তাদের সামরিক... ...বাকিটুকু পড়ুন
=যাচ্ছি হেঁটে, সঙ্গে যাবি?=

যাচ্ছি হেঁটে দূরের বনে
তুই কি আমার সঙ্গি হবি?
পাশাপাশি হেঁটে কি তুই
দুঃখ সুখের কথা ক'বি?
যাচ্ছি একা অন্য কোথাও,
যেখানটাতে সবুজ আলো
এই শহরে পেরেশানি
আর লাগে না আমার ভালো!
যাবি কি তুই সঙ্গে আমার
যেথায়... ...বাকিটুকু পড়ুন
আগামী নির্বাচন কি জাতিকে সাহায্য করবে, নাকি আরো বিপদের দিকে ঠেলে দিবে?

আগামী নির্বচন জাতিকে আরো কমপ্লেক্স সমস্যার মাঝে ঠেলে দিবে; জাতির সমস্যাগুলো কঠিন থেকে কঠিনতর হবে। এই নির্বাচনটা মুলত করা হচ্ছে আমেরিকান দুতাবাসের প্রয়োজনে, আমাদের দেশের কি হবে, সেটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।