সীমি একটা লম্বা করে শ্বাস নিল । প্রত্যেকবার কাজ টা করার সময় সে এরকম করে একটা লম্বা শ্বাস নেয় । তখন মনে একটা সাহস আসে । অন্য কোন কিছু চিন্তায় না এসে কেবল মুল বিষয়টার উপর ফোকাস করতে পারে । ফলে রাগ টা আরেকটু বাড়িয়ে নিতে পারে সামনে কিংবা পাশে বসা মানুষটার দিকে ।
সীমি আরেকবার তাকালো লোকটার দিকে । বয়স কত হবে ?
চল্লিশের কাছা কাছি । বাসায় নিশ্চই বউ আছে । ছেলে মেয়েও আছে । একটু সময় সীমি তাদের কথা ভাবতে লাগলো । একবার ভাবলো মাফ করে দেই কিন্তু পরক্ষনেই চিন্তাটা বাদ দিয়ে দিল । এই ভাবে ক্ষমা করে দেওয়ার মানে তাদের কে আরও লাই দেওয়া ! লাই পেলে সামনের দিনে আবারও ঠিক একই কাজ টা করবে বদমাশ টা !
সীমি আরেকবার লম্বা নিঃশ্বাস নিল । তারপর নিজের ব্যাগ থেকে লাল রংয়ের ছোট বাক্সটা বের করলো । সেখানে থেকে একটা চিকন সুই বের করে হাত নিয়ে আস্তে করে ফুটিয়ে দিল পাশে বসা লোকটার গায়ে । এমন ভাবে কাজ টা করলো যেন বাসের ঝাকিতে সীমি তার পাশের জনের উপর একটু সরে গিয়েছে । ব্যাপার টা ইচ্ছা কৃত নয় !
লোকটা সীমির দিকে তাকিয়ে একটু দাঁত বের করে হাসলো ! যেন এমন ভাবে তার দিকে হেলে পড়াতে সে খুবই খুশি হয়েছে । পাশের লোকটা একটা বারের মতও ভাবলো না ঠিক এই মাত্র টার শরীরে মশার কাপড়ের মত একটা একটা সুইয়ের মাধ্যমে মারাত্বক বিষ প্রবেশ করানো হয়েছে । সে হাসতেই লাগলো !
সীমির মাঝে একটু চাঞ্চল্য দেখা দিল । যদিও খুব বেশি তাড়াহুড়ার করার কোন কারন নেই । আষ্ট্রেলিয়া থেকে আনানো এই বিষটা তার কার্যকারিতা দেখাতে আরও মিনিট পয়তাল্লিশেক সময় নেবে । আর সীমির স্টপেজ এখান থেকে খুব বেশি হলে মিনিট দশেরকের পথ । সীমি নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করলো । একটু সতর্কও হওয়ার চেষ্টা করলো । লোকটা আবারও সেই কাজ করতে পারে যে কাজের জন্য তাকে এতো বড় শাস্তি দেওয়া হয়েছে ।
সীমি জানে এখন থেকে ঠিক ৪৫ মিনিট পরে লোকটার হঠাৎ করেই খুব গরম লাগা শুরু করবে । এতো গরম যেন গায়ের গায়ের থাকা সব জামা কাপড় খুলতে ইচ্ছা হবে । অনেকে আবার খুলেও ফেলে না থাকতে পেরে । সেই সাথে খুব ঘাম হবে । এরপর এমন ভাবে বুকটা লাফাতে শুরু করবে যেন বুক থেকে বেরিয়ে আসতে চাইবে । সারা শরীরে যেন আগুন ধরে যাবে এমন মনে হবে ! এই উত্তেজনা সে কিছুতেই সহ্য করতে পারবে না । যত শক্ত হার্টের মানুষই হোক না কেন খুব বেশি হলে ৫ মিনিট, তারপরেই ঠুস !
শুনতে অবিশ্বাস্য হলেও এমনই হবে । এই ৫ মিনিটেই লোকটা নরক যন্ত্রনা ভোগ করবে । অবশ্য এটা খুব কম শাস্তি । যে মানুষ গুলো মেয়েদেরকে বিব্রত করে, তাদের সম্মান হানি করার চেষ্টা করে তাদেরকে এরও বড় শাস্তি দেওয়া উচিৎ । কিন্তু এই দেশের অসস্থাই এমন যে এখানে এসব যেন খুবই সাধারন ঘটনা ! উল্টো মানুষের এমন একটা মনভাব যেন দোষ আসলে মেয়েটারই । নিশ্চই মেয়েটার পোষাকে কোন দোষ ছিল ! তার চালচলনে কোন দোষ ছিল !
প্রথম যেদিন এমন ঘটনা ঘটে তখন সীমি কেবল মাত্র এসএসসিতে পড়ে । ওদেরই বাড়িওয়ালার ছেলে একদিন লিফটের ভেতরে একা পেয়ে ওকে চেপে ধরে শরীরের বিভিন্ন জায়গায় হাত দেয় ! সীমি প্রথমে কিছু ভেবে উঠতেই পারে নি । ওর কাছে মানুষের এরকম আচরন ছিল সম্পূর্ন নতুন ! কোন ছেলে যে তার সাথে এরকম কিছু করতে পারে এটা তার ধারনার বাইরে ছিল !
বাসায় এসে মা কে বলতে যথারীতি বিচার নিয়ে যাওয়া হল বাড়িওয়ালার বাসায় । ছেলেকে শাসন করবে কি উল্টো সীমির নামেই উল্টো কথা বলতে শুরু করলো । নিশ্চই সীমির চাল চলন ঠিক ছিল না । সেদিন রাতে সীমির ঘুমই এল না । চোখ বুঝলেই কেবল লিফটের দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে আসছিল । এরপর চলতে ফিরতে এরকম পরিস্থির ভেতর পরতে হয়েছে ওকে ! সব ক্ষেত্রেই দোষ তার !
মানুষের কথা একটা সময় মনে হয়েছে হতো লোকে কেবল ওর গায়েও হাত দেয় কিন্তু আসে পাশের আরও অনেকেরই একম অভিজ্ঞতা থেকে জানতে পারে যে এরকম প্রায় সবার সাথেই হয় ! দোষ কোন ভাবেই তার নয় বরং দোষ ঐ জানোয়ার গুলোর !
কিছু বলার নেই, কেউ শোনার নেই । মাঝে মাঝে মরে যেতে ইচ্ছে করতো ! সব সময় ভিড় এড়িয়ে চলতো । নিউমার্কেটে যাওয়াই বন্ধ করে দিল ! ওখানে সব থেকে বেশি মানুষের ভিড় । আর সব সময় সতর্ক থাকতো ! কিন্তু যতই ভিড় এড়িয়ে চলতে চাক না কেন ঢাকার বাস গুলোতে ভিড় এড়ানো কোন ভাবেই সম্ভব হত না । বিশেষ করে চাকরী শুরু করার পর থেকে বাসের কোন বিকল্প সে খুজেই পেল না । সিএনজিতে চলাচল টা তার জন্য বড্ড বেশি বিলাশিতা হয়ে যায় ।
আবারও এরকম ঘটনা ঘটতে থাকলো ! মুখ বুজে যখন সহ্য করে যাচ্ছিলো তখনই এই মারাত্বক অদ্ভুদ বিষের কথা জানতে পারে একটা ওয়াল্ড লাইফ ম্যাগাজিন থেকে । মাত্র সুইয়ের আগা সমান বিষ কারো শরীরে প্রবেশ করলেই তার মৃত্ব্য অবধারিত । এবং মরার আগে সে ভোগ অকল্পনীয় এক নরক যন্ত্রনা ! অস্ট্রলিয়া পড়তে যাওয়া এক কাজিনের মাধ্যমে মাঝের প্রায় অর্ধেক বেতন দিয়ে এক কৌটা বিষ কিনে নিয়ে এলো ।
এরপর সুই গরম করে তার সাথে বিষ মেশানোর কাজ চলল কদিন । খুবই সবাধানে ছিল সে যাতে নিজের হাতে কোন প্রকার না লাগে ! সব কিছু তৈরি হয়ে গেলে একটা লাল কৌটায় এনে ভরে রাখলো । এরপর কেবল অপেক্ষা পালা । অবশ্য খুব বেশি দিন অপেক্ষা করতে হয় নি । দিন সাতেক পরেই প্রথম সুই টা ব্যবহার করার সুযোগ চলে আসে ।
সেদিন অফিস থেকে বের হগতে একটু দেরিই হয়ে গিয়েছিল । বাসে উঠতে উঠতে প্রায় সন্ধ্যা । মহিলা সিটে সিট না পেয়ে কোন রকমে একটা কমন সিটে এসে বসলো । পাশে এক বৃদ্ধমত লোক বসে ছিল । সীমি মনে মনে একটু স্বস্থি বোধ করলো, বুড়ো মানুষেরা এমন কাজ করে না । কিন্তু সেই ভুল ভাঙ্গতে খুব বেশি দেরি হল না । বাস একবার ব্রেক করে ঝাকি খেতেই সীমি অনুভব করলো ওর গায়ের স্পর্শ কাতর জায়গায় একটা হাত এসে পরেছে । একে তো ভিড় তার উপর বাস ব্রেক করেছে । কেউ কোন কিছু লক্ষ্যই করে নি । কিন্তু সীমি ঠিকই লক্ষ্য করেছে কাজটা কে করেছে । প্রথমে ওর ঠিক মত বিশ্বাসই হয় নি পাশের বসা এই বুড়ো মত লোকটা কাজ টা করেছে । কিন্তু পরের বার যখন আবার ঘটনা টা ঘটলো সীমি নিজের মধ্যে একটা অবাধ্য ক্রোধ অনুভব করলো । তখনই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল কি করতে হবে ওকে । ব্যাগ থেকে সুই বের করে খুব সাবধানে লোকটা কুনুইয়ে ফুটিয়ে দিল ।
বৃদ্ধ লোকটা একটু আউ করে উঠলোও পরক্ষনে হেসে উঠলো ওর দিকে তাকিয়ে । তারপর মিশমিশ করে হাসতে লাগলো ! যেন তার ছেলেমানুষী কাজে খুব মজা পেয়েছে ।
সীমি আর বসে নি । পরের স্টপেজেই নেমে গিয়েছে । রাগের মাথায় কাজটা করলেও বাস থেকে নামার পরে সীমি বুঝতে পারলো সে কি এক ভয়ংকর কাজ করে ফেলেছে । পুরো রাস্তায় আর বাসে উঠতে পারে নি টেনশনে । রিক্সা করে বাসায় গেছে । এমন কি রাতে ঠিক মত ঘুমাতেও পারে নি ।
পরদিন খবরের কাগজের এক কোনার ঠিকই খবর টা বেরুলো !
বাসে অজ্ঞাত ব্যক্তির অদ্ভুদ মৃত্যু !
ছবি দেখে চিনতে একটুও অসুবিধা হল না সীমির । প্রত্যেক্ষ দর্শীদের বর্ণনা শুনেও বুঝতে অসুবিধা হল না কি ঘটেছে । তীব্র এক অনুশোচনা বোধ ঘিরে ধরলো ওকে । সিদ্ধান্ত নিল এমন কাজ আর করবে না ! কিন্তু পরের সপ্তাহে যখন আবারও ঘটনা ঘটলো তখন ওর সিদ্ধান্তের কথা আর মনে রইলো না !
এরপর চলতেই থাকলো ! যতবার কোন পুরুষ রূপী জানোয়ার ওর সাথে কিংবা ওর চোখের সামনে অন্য কারো সাথে এমন কোন কাজ করেছে ততবারই সে এমন করে একটা সুইয়ের ব্যবহার করেছে !
সীমি পাশে বসা লোকটার দিকে আবারও তাকালো । লোকটা এমন একটা ভাব করছে যেন কিছুই হয় নি । অথচ এরই ভেতর সে দুদুবার অকাজ টা করে ফেলেছে ।
সীমি আর অপেক্ষা করলো না ! এখানে বসে থাকার আর কোন মানে নেই । সির ছেড়ে উঠতে যেতেই লোকটা আবারও ওর নিতরম্বে হাত দিয়ে চাপ দিল ! খুব কষ্টে রাগটা দমন করে সীমি লোকটার দিকে তাকিয়ে বলল
"হ্যাপি জার্নি" !
এই বলে বাসের গেটের দিকে হাটা দিল !
লোকটা একটু অবাকই হল মনে হল ! এতোদিন ধরে সে এই কাজ গুলো করে আসতেছে সুযোগ পেলঐ । যাদের সাথে এমন করে তারা কেমন চোখ তাকায় কেবল । কিছু বলতে সাহস পায় না ! কিন্তু এমন করে হ্যাপি জার্নি তো কেউ বলে না !
সীমি দরজার কাছে গিয়ে আবার ফিরে চাইলো লোকটার দিকে । এমন একটা হসি দিল সেই হাসি দেখে লোকটা কেন জানি পিলে চমকে উঠলো । এমন তো হওয়ার কথা নয় ! মেয়েটার হাসির ভেতরে অদ্ভুদ কিছু ছিল ।
লোকটা এই প্রশ্নের উত্তর খুজে পেল না ! অবশ্য খুব বেশি সময়ই নেই তার হাতে !
(অন্তত এরকম ভয়ংকর অস্ত্র না হলেও মেয়েদের সাথে প্রিপার স্পে, ব্যাটারী শকার কিংবা এন্টি কাটার জাতীয় অস্ত্র তাদের ব্যাগে থাকা উচিৎ ! আর সব থেকে বেশি যেটা থাকা উচিৎ যেটা হল প্রতিবাদ করার সাহস ! কেউ যদি আপনার সাথে বেয়াদবী করে সোজাসুজি তার গালে অন্তত একটা চড় লাগিয়ে দিন । এরা হচ্ছে সমাজের সব থেকে নংপুষক সম্প্রদায় । একবার চড় খেলে সামনে আর সাহস করবে না এরকম কাজ করার ! লজ্জা কিংবা ভয় পেয়ে কোন লাভ নেই । একটু সাহসী হন)