মহাকাব্য মহাভারত নিয়ে একটা প্রচলিত লাইন আছে। লাইনটা হচ্ছে ‘যা নেই ভারতে, তা নেই ভারতে’। লাইনের এই প্রথম ভারত দিয়ে বোঝানো হয়েছে মহাকাব্য মহাভারতকে আর দ্বিতীয় ভারত মানে হচ্ছে ভারত উপমহাদেশ । অর্থ্যাৎ যে জিনিস আপনি মহাভারত বইতে পাবেন না, সেই জিনিস পুরো ভারতের আর কোথাও নেই। এই মহাকাব্যে কত কাহিনীই না বর্ণনা করা হয়েছে! এই কাহিনীগুলোর ভেতরে একটা হচ্ছে দ্রৌপদী এবং পঞ্চপাণ্ডবের গল্প । ৫ ভাইয়ের এক স্ত্রী । আমাদের সমাজে এক ভাইয়ের পাঁচ স্ত্রী থাকাটা খুবই স্বাভাবিক একটা ব্যাপার হিসাবেই দেখা হয় কিন্তু এই পাঁচ ভাইয়ের যদি একজন স্ত্রী থাকে তাহলে ? ব্যাপারটা একবার ভাবুন ! তবে যদি বলি বাস্তবেও কিন্তু এই এক স্ত্রী কয়েকজন স্বামীর ব্যাপারটা রয়েছে। এটা একেবারে বাস্তব ঘটনা ! ভারতে টোডা নামে এক উপজাতি রয়েছে যাদের মেয়েরা একের অধিক স্বামীর সাথে একই ঘরে একসাথে বসবাস করে।
টোডা উপজাতির বসবাস দক্ষিণ ভারতে নীলগিরি পাহাড়ে । ইংরেজি উপনিবেশ স্থাপনের আগে টোডা উপজাতি ভারতীয় অন্যান্য উপজাতিদের মতই পাহাড়ের নানান উপত্যকায় বসবাস করত । উপজাতি হিসাবে টোডা জাতি ক্ষুদ্র এবং স্বনির্ভর । পূর্বে টোডা উপজাতিদের একমাত্র পেশা ছিল পশুপালন এবং দুধ উৎপাদন তবে ইংরেজ শাসন শুরুর পর থেকে এরা পশুপালন ছাড়াও আরো নানান পেশায় জড়িয়ে পড়ে। তাদের অর্থনীতি মূলত চারণভূমি ভিত্তিক এবং মহিষ নির্ভর। তাদের আয়ের প্রথম উৎস মহিষের দুধ ও মাংস। এরা মহিষের গাড়িতে করে ড্রাম ভর্তি মহিষের দুধ পার্শবর্তী হিন্দু ও নানান সম্প্রদায়কের কাছে বিক্রি করে । টোডারা এদের পার্শবর্তী সম্প্রদায় কৃষিজীবি আদিবাসী বাগাদাদেরকে দুধ ও মহিষের মাংসের বিনিময়ে কৃষি পন্য নিত। আবার বাগাদারা মাটির পাত্র, লোহার বাসনসহ নানান দরকারী জিনিস টোডাদের সাথে দুধ এবং মাংস দিয়ে বিনিময় করত । ইরুল নামক আরেক আদিবাসীদের কাছ থেকে তারা একই ভাবে বনজ জিনিসপত্র বিনিময় করত। প্রাচীন কালে এভাবেই টোডারা তাদের অর্থনীতি টিকিয়ে রাখত ।
টোডা সমাজে প্রতিটি মহিলা মহিষের নাম দেওয়ার রীতি প্রচলিত আছে। এছাড়া প্রতিটি মহিষের বংশ তালিকা সংরক্ষণ করা হয়। তবে পুরুষ মহিষদের কোন নাম দেওয়া হয় না। টোডা ধর্মে মহিষের রয়েছে এক পবিত্র স্থান। মহিষ এদের কাছে সম্মানীয়। এরা নিজেদেরকে মহিষের সন্তান মনে করে । ধর্মীয় এবং অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার মহিষের প্রশংসায় কাব্যগান গাওয়ার রীতি রয়েছে টোডা সমাজে । তবে এখানে সব মহিষকে এই সম্মানের আসনে বসানো হয় না। মহিষগুলো দুই ভাগে ভাগ করা হয়। এক হচ্ছে, সাধারণ মহিষ এবং অন্য দলে আছে পবিত্র মহিষ । সাধারণত স্ত্রী মহিষ এবং প্রজনন ক্ষমতা সম্পন্ন পুরুষ মহিষ গুলোকে পবিত্র মহিষ হিসাবে বিবেচনা করা হয়। আর বাকি দলে পড়ে সাধারণ মহিষ । পবিত্র মহিষ গুলো থাকা খাওয়া লালন পালন সব বিশেষ ভাবে করা । সাধারণ মহিষ গুলোকে পাহাড়ে ছেড়ে দেওয়া হয় । ওরা নিজেরাই ঘুরে বেড়িয়ে খাওয়া দাওয়া করে সন্ধ্যার ফিরে আসে।
এক ইংরেজ পরিচালিত আদমশুমারি থেকে জানা যায় যে ১৯০১ সালে টোডা উপজাতিদের মোট জনসংখ্য্যা ছিল ৮০৭ জন । এদের ভেতরে নারীর সংখ্যা ছিল মাত্র ৩০৭ জন। এর ১০০ বছর পরে টোডাদের জনসংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১৭০০ । ১৯৫১ সালে এদের জনসংখ্যা ছিল ৮৭৯ জন, ১৯৬১ সালে ৭৫৯ জন তবে ১৯৭১ সালে তাদের জন সংখ্য্যা কমে দাঁড়ায় ৮১২ জনে । অন্যদিকে ২০০০ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১৭০০ জনে।
প্রাচীন কালে টোডা সম্প্রদায়ের মাঝে এক ভয়ংকর রীতি ছিল । সেই সময়ে কোন কন্যা সন্তান জন্ম হলেই তাকে মাটিতে পুতে ফেলা হত। এভাবে মেয়ে শিশু হত্যার কারণে তাদের গোত্রের ভেতরে নারীদের সংখ্যা আশংঙ্কাজনক ভাবে কমে যায় । এখন অবশ্য এই প্রথা আর পালিত হয় না । এখন যে একজন নারী একাধিক পুরুষের সাথে বিয়ে করে সেটার আদি উৎস এই মেয়ে শিশু হত্যার ভেতরেই নিহিত বলে অনেকে মনে করেন। কোন পরিবারে একাধিক ভাই থাকলে তাদের সবার বিয়ে একজন মেয়ের সাথেই হয়। এবং একজন স্ত্রী নিয়ে ভাইদের ভেতরে কোন মনমালিন্য হয় না । এছাড়া একজন নারী একই পরিবারের বাইরে একই গোত্রের কিংবা অন্য গ্রামের পুরুষের সাথেও বিয়ে করতে পারে । একজন নারী সর্বোচ্চ সাতজন পুরুষকে বিয়ে করতে পারে।
১৮৩৭ সালের দিকে ইংরেজ চিত্রশিল্পী রিচার্ড ব্যারেনের আঁকা ভিউ ইন ইন্ডিয়াঃ চিফলি অ্যামাং দ্য নীলগিরী হিলস নামক এক তৈলচিত্রে (পোস্টের প্রথম ছবিটা) টোডা উপজাতির জীবন চিত্র তুলে ধরা হয়েছিল । সেই ছবিটি সারা বিশ্বে ব্যাপক সাড়া ফেলেছিল । ২১ শতকের শুরু থেকেই টোডা সমাজ ও তাদের সংস্কৃতির উপর আন্তর্জাতিক আলোকপাত শুরু হয়। ইউনেস্কো টোডা উপিজাতি এবং তাদের বসবাসের আশের পাহাড় এলাকাকে বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হিসাবে ঘোষাণা দিয়েছে।
____
এই ধরনের পোস্ট লেখার সময় আমি সাধারণত নেটে ঘাটাঘাটি করে তারপর লিখি। বেশ কিছু পোস্ট পড়ে সেগুলো থেকে তথ্য সংগ্রহ করি । তবে এই পোস্টটা লেখার সময় এমন কিছুই করি নি । এবারের বই মেলা থেকে একটা বই কিনেছিলাম । বইটার নাম ''টোডা উপজাতি'' বইটার লেখক মনজুর রহমান শান্ত । সেই বইটা আজকে পড়ে শেষ করলাম । মনে হল সেই পড়া থেকে একটা পোস্ট লেখা যাক । বইটিতে টোডা উপজাতি বিস্তারিত লেখা রয়েছে । আরও বিস্তারিত জানতে চাইলে বইটা সংগ্রহ করতে পারেন ।
ছবি গুলো ইউকিপিডিয়া থেকে সংগ্রহ করা।
বইটা
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৫৬