জানালা দিয়ে ছেলেটার মাথা দেখা যাচ্ছে। পাঁচিল টপকাচ্ছে পাঁজি ছেলেটা। দেয়ালের উপর পুরোপুরি উঠে গেলে তখন একটা হাঁক ছাড়ব ভাবছি। কোন দিকে লাফ দিবে কে জানে। কিন্তু কেন যেন ছেলেটা উঠতে পারছে না। অঙ্গভঙ্গী দেখে মনে হচ্ছে পেছন থেকে কেউ ধরে রেখেছে। পা দিয়ে কোন কিছুকে লাথি দিচ্ছে বুঝা যাচ্ছে।
মজার ঘটনা। আমি মোটকা বইটা বন্ধ করে ছেলেটার দিকে মনযোগ দিলাম। সম্ভবত নিচের লোকটার হাত থেকে মুক্ত হতে পেরেছে। হাচড়ে-পাচড়ে উপরে উঠছে। হঠাৎ আরেকটা মাথা দেখা গেল ওর পাশেই। এই ছেলটাই কি প্রথমটাকে ধরে রেখেছিল? হঠাৎ দ্বিতীয় ছেলেটাও অদৃশ্য কারো দিকে পা ছোড়া শুরু করল।
দ্বিতীয় ছেলেটার দূরবস্থা দেখে প্রথম ছেলেটা দেয়ালের উপর দাঁড়িয়ে খিলখিল করে হাঁসছে। আমি বাইরে বেরিয়ে এলাম। এখন দেখছি আরও একটা মাথা যুক্ত হয়েছে! সম্ভবত এই তৃতীয় ছেলেটা দ্বিতীয়টাকে ধরে রেখেছিল। প্রথম ছেলেটা লাফ দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে, দ্বিতীয় ছেলেটা সবে দেয়ালে উঠেছে, তৃতীয়টার বুক পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে- এমন সময় আমি হাঁক দিলাম, “এই পোলাপান, এই!”
সবাই যার যার কাজ ফেলে আমার দিকে তাকাল। “চাও কি এখানে?”
“আঙ্কেল, একটা ঘুড্ডি পড়ছে আপনাগো ছাদে, ওইটা নিতে আসছি। প্রথম ছেলেটা এমনভাবে বলল যেন ঘুড়িটা পাওয়া তার মৌলিক চাহিদাগুলার একটা।
সাথে সাথে দ্বিতীয় ছেলেটা বলল, “আঙ্কেল, আমি কাটছি ওইটা, আমারে দ্যান।”
তৃতীয় ছেলেটা দেয়ালে পুরোপুরি উঠবে কিনা সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। বানরের মত ঝুলতে ঝুলতে বলল, “আঙ্কেল ওইটা আমার ঘুড্ডি আমারে দ্যান।”
এই বয়সে আঙ্কেল শুনতে কেমনটা লাগে? আমি ঝাঁঝাল কণ্ঠে বললাম, “দেয়া যাবে না ঘুড়ি।”
“দ্যান না আঙ্কেল, প্লিজ।”
পোলাপানগুলোর বয়স সাত-আট হবে হয়তো। দুজনের গেঞ্জির সাথে হাফপ্যান্ট, একজনের লুঙ্গি, কাছা দেয়া। “আসো, বাসার ভেতরে আসো।”
লাফ দিয়ে সবাই পাঁচিল থেকে নামল ঠিকই, কিন্তু ভেতরে আসছে না।
“আসছো না কেন?”
“আঙ্কেল, এই বাসায় একটা পাগল থাকে শুনছিলাম।”
আমি হো হো করে হেঁসে উঠলাম। “পাগল এখন বাসায় নাই। বাইরে গেছে।” আমার কথায় আশ্বস্ত হয়ে ঘরের ভেতর এল। তিনজনই উশখুশ করছে। একজন সাহস করে বলে ফেলল, “ঘুড্ডি তো ছাদে, ঘরে নিয়া এলেন কেন?”
“চুপ করে এখানে বসো।” বলে আমি টেবিলের উপর থেকে বিস্কিটের বক্স ওদের দিকে দিলাম। “বিস্কিট খাও। নাম কি তোমাদের?”
“মাজেদ।”
“জহির।”
“শুভ।”
“ঘুড়ি কার?”
মাজেদ বলল, “আমার।”
“কাটছে কে?”
জহির বলল, “আমি।”
“আর তুমি কি করতে এসেছো?” তৃতীয়জনকে জিজ্ঞেস করলাম।
শুভ বলল, “আমি পেরথম আসছি ঘুড্ডি নিতে। কাটনের পর কি আর ঘুড্ডির মালিক থাকে?”
“আচ্ছা, ঘুড়ি কাটার পরে যে প্রথম নিতে পারে ঘুড়ি তো তারই হবে। আমি ঘুড়ি পেয়েছি, ওটা আমার।” জানালার দিকে তাকিয়ে বললাম আমি। সাথে সাথে সবার মুখ অন্ধকার হয়ে গেল।
“বিস্কিট নিচ্ছ না কেন?”
“আঙ্কেল, ঘুড্ডিটা দেন, যাই গা।” বিস্কিট খাওয়ার দিকে কোন আগ্রহ নেই মাজেদের।
“নাও বিস্কিট, নাও!” দিলাম এক ঝাড়ি। ঝাড়ি দেয়াতে কাজ হল, সবাই বিস্কিট নিল। “ঘুড়ির দাম কত?”
“দশ টাকা।”
“তাহলে সবাই দুইটা করে বিস্কিট নাও। ঘুড়ির দাম উসুল হয়ে যাবে।”
আমাকে অবাক করে দিয়ে তিনজনই হাতের বিস্কিট রেখে দিল। ঘুড্ডির বদলে বিস্কিট নিতে কেউই রাজী না।
“কোন ক্লাসে পড় তোমরা?”
“ক্লাস থ্রি। প্রাইমারি স্কুল।”
“ক্লাস থ্রি। প্রাইমারি স্কুল।”
“ক্লাস থ্রি। প্রাইমারি স্কুল।”
“তোমাদের অর্ধবার্ষিকী পরীক্ষা কবে?”
“পরশু থিকা।”
“পড়শু থেকে পরীক্ষা আর আজকে ঘুড়ি উড়াও?”
সবাই চুপ।
“বিস্কিট নাও।”
সবাই আধখাওয়া বিস্কিট আবার হাতে নিল।
“শোন, ঘুড়ির জন্য কে কি করতে পারবা? যে সবচেয়ে কঠিন কাজ করতে পারবা তাকেই দিব ঘুড়ি।”
“আঙ্কেল, আমি আপনেরে চাইর টাকা দিব।”
“আমি আপনাগো ওই গাছটা থিকা লাফ দিব।”
“আঙ্কেল, আমারে বেত দিয়া দুইট্টা বাড়ি দেন, কিন্তু ঘুড্ডিটা দিয়া দেন।”
“শোন, আমি তোমাদের বলে দেই কি করতে হবে। অর্ধবার্ষিকী পরীক্ষায় যে সবচেয়ে বেশি নম্বর পাবে তাকে আমি ঘুড়িটা... না, পাঁচটা ঘুড়ি দিব। ঠিক আছে? কিন্তু রেজাল্ট কার্ড এনে দেখাতে হবে।”
“কয় ট্যাকা দামের ঘুড্ডি দিবেন?”
“দশ টাকা!”
“না বিশ ট্যাকা দামেরটা দিতে হবে।”
“ঠিক আছে, বিশ টাকার টাই দিব। তিনজনকেই আসতে হবে। যারা সেকেন্ড আর থার্ড হবে তাদের জন্যও পুরষ্কার থাকবে। এখন বিস্কিটগুলা শেষ কর।”
তিনজনই চুপচাপ বসে বিস্কিট খাচ্ছে। এরা খুশি না অখুশি বুঝা যাচ্ছে না। ছোটদের মনের ভাব সহজে বাইরে প্রকাশ পেয়ে যায়, কিন্তু এদেরটা প্রকাশ পাচ্ছে না। সম্ভবত সবাই মহা চিন্তার মধ্যে আছে। আমি অবশ্য নিশ্চিত এরা কখনোই আর আসবে না। ঘুড়ির জন্য কি আর পড়াশোনার মত কঠিন কাজ করা যায়?
“বিস্কিট খাওয়া শেষ, এখন বিদায় হও।” আমিও ওদের সাথে বাইরে এলাম।
“দেয়াল দিয়ে এসছো, দেয়াল দিয়েই যাও।” ওরা গেটের দিকে যেতে লাগলে বললাম।
অবাক হয়ে আমার দিকে তাকাল ওরা। জহির জিজ্ঞেস করল, “ক্যান আঙ্কেল?”
“গেট তালা দেয়া। চাবি নিয়ে চলে গেছে।”
“ক্যান?” ওদের মুখে বিস্ময় দেখতে ভাল লাগছে।
“তোমরা যে পাগলের কথা জিজ্ঞেস করছো না, আমিই সেই পাগল। পাগলকে কি চাবি দিয়ে যাবে, বোকার দল!”
আমার কথা আত্মস্থ করতে কয়েক মুহূর্ত সময় লাগল ওদের। বুঝার সাথে সাথেই অলিম্পিক দৌড়। হাচড়ে-পাচড়ে দেয়ালে উঠে গেল ওরা।
আমি চিৎকার করে বললাম, “তোমাদের ঘুড়ি চা খেয়েছে। বৃষ্টিতে ছাদে পানি জমে আছে।”
আমার কথা কেউই শুনতে পায়নি। আমি নিশ্চিত।