somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

যে গল্পের নাম হয় না

১৯ শে মার্চ, ২০১৬ সন্ধ্যা ৭:২৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

অন্ধকার রুম। তবে একেবারে নিকষ কালিগোলা অন্ধকার না। খাটের মাথার দিকে কাঁচের একটা জানালা আছে। জানালার একটা পাল্লা পুরোটা খোলা। সেখান দিয়ে বাইরে থেকে নীল আলো আসছে। হালকা নীলাভ আলো রুমের মধ্যে বিষন্ন হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে। খোলা জানালা দিয়ে বাতাসও আসছে। মৃদু, ঠান্ডা বাতাস। দূরে কোথাও বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টিভেজা আর্দ্র বাতাস শরীরে কাপন ধরিয়ে দেয় না, শিরশিরে একটা আনন্দ ছড়িয়ে দেয়।
বাতাসে জানালার পর্দা তিড়তিড় করে কাঁপছে। একটু পরপর বাতাসের দমক বেড়ে গেলে পর্দা উড়ে চলে আসছে আমার মাথার উপরে। পাতলা সাদা পর্দা। এক যায়গা দিয়ে পর্দা কিছুটা ছেড়া। পর্দা যখন মাথার উপরে চলে আসে তখন অন্যরকম ভালো লাগে। ভালো লাগার সাথে রঙের কোন সম্পর্ক আছে নিশ্চয়ই। সাদা রঙের সাথে যে ভালো লাগার সম্পর্ক সেটা হচ্ছে শুভ্র, পবিত্র ভালো লাগা। এখানে ভালো লাগাই শেষ কথা, এর আর কোন ফলাফল †নই।
সিলিংয়ে একটা নকশা ফুটে আছে। নীল আলোর নকশা। জানালার উপরের ভেন্টিলেটর দিয়ে বাইরে থেকে আসা নীল আলোর নকশা। নকশাটা প্রজাপতির মতো। বিষন্ন এক নীল প্রজাপতি মাথার উপর ভেসে বেড়াচ্ছে। হঠাৎ তাকালে কেন যেন মনে হয় এটা আলোর প্রজাপতি না, ছায়ার প্রজাপতি।
সামান্য একটু শব্দ করে কাঠের দরজা খুলে গেল। অন্ধকার রুমে দেখা যাচ্ছে না কে এসেছে। তবে কে এসেছে আমি জানি। শিউলি। আমার স্ত্রী। গত পাঁচ বছর প্রতি রাতে শিউলি যখন রুমে ঢুকে তখন এভাবে করে সাবধানে দরজাটা সামান্য খুলে ঢুকে, যাতে তেমন শব্দ না হয়। আমি শব্দ পছন্দ করি না। ইহজগতে আমার যা কিছু পছন্দ আর যা কিছু অপছন্দ শিউলির সবকিছু মুখস্থ।
শিউলি মৃদু পায়ে হেঁটে খাটের কাছে এসে দাঁড়ালো। ওর গা থেকে বেলীফুলের মিষ্টি গন্ধ ভেসে আসছে। জানালা থেকে আসা মৃদু নীল আলোয় শিউলির অবয়ব আবছা দেখা যাচ্ছে। কাধ পর্যন্ত নেমে আসা ওর ঢেউখেলানো চুলগুলো থেকে মনে হচ্ছে নীল আভা ছড়াচ্ছে। ওর মুখ দেখার চেষ্টা করলাম। পাতলা ঠোঁটের কোনায় মৃদু একটা প্রশান্ত হাঁসি লেগে আছে। গত পাঁচ বছরে একবারের জন্যও এই হাঁসি ওর মুখ থেকে মুছে যায় নি। ওর আর যেন কোন অনুভূতি নেই। কিংবা থাকলেও দক্ষ অভিনেত্রীর মতো গোপন করে রাখে।
সাদা রঙের সালোয়ার কামিজ পরে আছে শিউলি। জানালার আলোয় শুধুমাত্র ওড়না দেখা যাচ্ছে। কিন্তু আমি জানি ও সবকিছুই সাদা পরে। জিজ্ঞেস করলে বলে, সাদা ছাড়া অন্য কিছু পড়ার ওর অভ্যাস নেই। পড়লে খুব অস্বস্তি হয়।
অন্ধকারে ঠাওর করতে পারলাম শিউলির কালো চোখগুলো আমার চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। বোঝার চেষ্টা করছে আমি ঘুমিয়ে পড়েছি নাকি সজাগ। গাঢ় কাজল দেয়া চোখগুলো আমার চোখের উপর স্থির রেখে শিউলি মৃদু স্বরে বললো, ”ঘুমিয়ে গেছো নাকি?”
রাতের অন্ধকারে হালকা নীল আলো, শীতল বাতাসে মাথার উপরে পর্দার আসা যাওয়া - এসবের মাঝে শিউলির কণ্ঠ শুনতে অপার্থিব লাগছে। মনে হচ্ছে দূরে কোথাও এক দক্ষ বাঁশিওয়ালা বাঁশিতে ফুঁ দিচ্ছে। বাঁশির সেই ভরাট সুর খুব সাবধানে আমার ঘুম না ভাঙিয়ে দিয়ে জানতে চাইছে, ঘুমিয়ে গেছো নাকি?
“অবশ্যই ঘুমাচ্ছি না। আর তুমি সেটা জানো।” অনেকক্ষন পরে কথা বলাতে আমার কথা জড়িয়ে জড়িয়ে এলো।
“কি করছিলে তাহলে?”
“তোমার জন্য অপেক্ষা করছিলাম।”
আমার কথা শুনে শিউলির হাঁসি আরেকটু প্রশস্ত হলো। জানালার দিকে এগিয়ে গিয়ে বললো, “জানালা বন্ধ করে দেই? চোখের সামনে পর্দা উড়তে থাকলে কি কারো ঘুম আসে?”
আমি মাথা ঘুরিয়ে ওর দিকে তাকালাম। “শিউলি তোমাকে একটা রিকোয়েস্ট করি?”
শিউলি জানালা থেকে দৃষ্টি সরিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললো, “করো?”
“জানালাটা লাগিও না প্লিজ। আমার এম্নি ঘুম আসবে।”
“আমি জানি তোমার ঘুম আসতে চাইবে না। কিন্তু যেভাবে রিকোয়েস্ট করলে, যাও লাগালাম না।”
শিউলি আমার মাথার কাছে এসে বসলো। বাঁশির মতো কণ্ঠ আরও এক স্কেল নিচে নামিয়ে বললো, “তোমার চুলে হাত বুলিয়ে দেই?” আমার উত্তরের অপেক্ষা না করে শিউলি আমার মাথায় হাত বুলাতে শুরু করলো।
আমি কোন কথা বললাম না। শিউলির লম্বা লম্বা আঙুলগুলো মাথায় স্পর্শের সাথে সাথে মাথার স্নায়ুগুলো যেন নিরব হয়ে এলো। চোখ আপনা আপনি বুঁজে এলো। চোখ খুলে আমি শিউলির দিকে তাকালাম। ও বসে থেকে আমার দিকে ঝুঁকে আছে। ওর ভেঁজা চুলগুলো আমার গাল স্পর্শ করছে। আমি বললাম, “তুমি বসে আছো কেন? শুয়ে পড়ো!”
মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে শিউলি বললো, “আমার ঘুম আসছে না। আমি তো সারা দিনই রেস্ট নেই।”
“প্লিজ।” বলে আমি একটু সরে গেলাম ওকে যায়গা করে দিতে।
শিউলি আমার পাশে শুতে শুতে বললো, “আমার না হয় কাজ থাকে না, কিন্তু তুমি তো সারা দিন ব্যস্ত থাকো। তবুও তুমি ঠিকঠাক ঘুমাও না কেন? তুমি দিনদিন কতো শুকিয়ে যাচ্ছো জানো?”
এই প্রশ্ন শিউলি প্রতিদিন করে। আমি একটা শুকনো হাঁসি দিলাম।
শিউলি কাত হয়ে আমার দিকে ফিরে একটা হাতের উপরে মাথা রাখলো। আরেকটা হাত দিয়ে আমার চুলে হাত বোলাতে বোলাতে বললো, “তোমাকে একটা কথা বলি?”
“বলো।”
“তুমি এই যে সারাদিন অফিসে পরে থাকো, এটা আমার ভালো লাগে না। এতো কাজ করে করে তুমি তো একসময় অসুস্থ হয়ে যাবা।”
“কাজ করে কেউ অসুস্থ হয় না। আর...”
“তুমি কি এখন লেকচার শুরু করবা?”
“আচ্ছা যাও, লেকচার বাদ। কিন্তু কাজ না করলে এতো খরচের টাকা আসবে কোথা থেকে। আর তোমার জন্য ওষুধ কিনবো কোথা থেকে?”
শিউলি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। আমার নিজের ওপর রাগ হচ্ছে। শেষ কথাটা বলা উচিত হয় নি।
তাড়াতাড়ি করে বললাম, “তবে কাজ করতে আমার অভ্যাস হয়ে গেছে। অফিস না করলে এখন আমার ভালোও লাগে না।”
শিউলি চুপ করে আছে। ওর মাথার ভেতরে কি চিন্তা চলছে কে জানে? ওর দিকে ফিরে আমি একটা হাত ওর মাথায় রাখলাম। ওর সিল্কি চুলগুলোর ভেতরে মাথাটা আমার হাতে খুব ঠান্ডা ঠান্ডা লাগছে। এমন যদি হতো, মাথায় হাত দিয়ে মাথার চিন্তা-ভাবনাগুলো ছোয়া যেত, অনুভব করা যেত! তাহলে ওর চিন্তুার কথা বলে ওকে চমকে দিতে পারতাম।
“শিউলি, একটা গান শোনাও।”
“তুমি কিভাবে বুঝলে আমার গান গাইতে ইচ্ছা হচ্ছে?” শিউলি অবাক কণ্ঠে জানতে চাইলো।
আমি জানি এ কথাটা শিউলি আমাকে স্রেফ খুশি করতে বলেছে। “প্রতি রাতেই তুমি আমাকে গান শোনাও। এখানে অবাক হওয়ার কি আছে?”
শিউলি খিলখিল করে হেঁসে উঠলো। কিছু মানুষ আছে যাদের কথা বলার সময় প্রতিটা শব্দ আলাদা আলাদা কানে আসে। শিউলি হাঁসির ব্যাপারটা সেরকম। হাঁসির প্রতিটা শব্দ যেন আলাদা আলাদা কানে বেজে ওঠে, আলাদা আলাদা অনুভব করা যায়। আবার মাঝে মাঝে ওর হাঁসি শুনলে মনে হয় পিয়ানোতে কেউ জ্যাজ মিউজিকের সুর তুলছে।
শিউলি হাঁসতে হাঁসতে বললো, “আচ্ছা দাঁড়াও, গাইছি।”
আমার মাথা থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে শিউলি উঠে বসলো। ও সবসময় বসে বসে গান করে। বসে বসে গান করে আর গানের তালে তালে ডানে বায়ে দুলতে থাকে। শিউলি গান শুরু করলো।

মোর ঘুম ঘোরে এলে মনোহর
নমনমঃ নমনমঃ নমনমঃ
শ্রাবণ মেঘে নাচে নটোবর
রমঝম ঝমঝম রমঝম...

শিউলি গান করে যাচ্ছে। আমি চোখ বন্ধ করে শুনছি। ওর গান শুনলে আমার বাঁশি কিংবা পিয়ানো - কোন বাদ্যযন্ত্রের কথা মনে পড়ে না। মনের মধ্যে পুরনো কোন ছবি ভেসে ওঠে। মধুর কোন ছবি।
একবার শিউলি আর আমি ট্রেনে করে সিলেট যাচ্ছিলাম, ওর গ্রামের বাড়িতে। আমাদের বিয়ের পরপর, বছর ছয়েক আগে। রাত দুটার দিকে ট্রেন ভৈরব স্টেশন পার হয়ে ব্রিজে ওঠার একটু আগে হঠাৎ থেমে গেল। থেমে যে গেল থেমেই গেল। ট্রেনের লাইন কারা যেন উপড়ে ফেলেছে। ট্রেনভর্তি মানুষ অপেক্ষা করছে। কারো চোখে ঘুম নেই। একটু আগে প্রচন্ড ঝাঁকুনির মধ্যে যারা হাঁ করে ঘুমাচ্ছিলো, এখন ঝাঁকুনি নেই তাদের আরামে ঘুমুবার কথা। কিন্তু তারা চোখ বড় বড় করে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। ট্রেনের ভেতরে কিংবা রেল লাইনের পাশে যে দুয়েকটা দোকান সারারাত খোলা থাকে কোথাও কোন খাবার নেই। ট্রেনের জানালা দিয়ে এক দোকানদারকে সন্তুষ্টচিত্তে দোকানের ঝাঁপি বন্ধ করতে দেখছিলাম। এমন সময়ে শিউলি বললো, “চলো।”
আমি তাকিয়ে দেখি শিউলি উঠে দাঁড়িয়েছে। উপর থেকে ব্যাগ নামিয়ে ট্রেন থেকে নামার জন্য প্রস্তুত। সারা রাত ট্রেনে কাটাবার পরেও ওর চোখ থেকে কাজল মুছে যায় নি। ঘুমঘুম চোখদুটো আমার দিকে বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “চলো মানে? কোথায় যাবে?”
“ট্রেনে আমার আর এক মুহূর্ত থাকতে ইচ্ছা হচ্ছে না। আমি বাসে যাবো।”
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম পাঁচটা বাজে। “আরেকটু বসো। টি টি বললো কাজ চলছে, দুয়েক ঘন্টার মধ্যে ঠিক হয়ে যাবে।”
“আমার ভাল্লাগছে না। আমি বাসেই যাবো।” বলে শিউলি ট্রেনের দরজার দিকে হাঁটতে শুরু করলো।
শিউলিকে আটকে রাখা সম্ভব না। ওর পিছু পিছু আমিও ট্রেন থেকে নেমে এলাম। ভোরের আলো একটু একটু ফুটতে শুরু করেছে। ওই দোকানদার বন্ধ দোকানের পাশে দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট ধরিয়েছে। কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “ভাই সিলেট যাবার বাস কোথায় পাওয়া যাবে?”
লোকটা ভাবলেশহীন ভঙ্গীতে পেছনদিকে আঙুল তুলে বললো, “পেছনে ভৈরব বাসস্ট্যান্ডে যান গা।” আবার সামনে নদীর দিকে হাত তুলে বললো, “পেছনে যাইতে না চাইলে ব্রীজ পার হইয়া আশুগঞ্জ বাসস্ট্যান্ডেও যাইতে পারেন।” বলে লোকটা সিগারেটে লম্বা একটা টান দিলো।
আমি শিউলির দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালাম, ও কোন দিকে যেতে চায়? শিউলি কিছু না বলে নদীর দিকে হাঁটতে লাগলো। আমিও ওদিকে এগুলাম। নদীর কাছাকাছি এসে শিউলি বললো, “এই শোন।”
“কি?”
“চলো ব্রিজ দিয়ে নদী পার না হয়ে নৌকা দিয়ে পার হই।”
“এতো ভোরে কি নৌকা পাওয়া যাবে?”
“গিয়েই দেখি না ঘাটের ওদিকে,” শিউলি ভৈরব বাজারের ঘাটের দিকে আঙুল তুলে বললো। নদীর পার দিয়ে হেঁটে ঘাটের দিকে যাবার সিদ্ধান্ত নিলাম। নদীর পারে গিয়ে দেখি ছোট্ট একটা ডিঙি নৌকা ভেড়ানো। সাদা দাড়িওয়ালা বৃদ্ধ মাঝি নৌকায় বসে গামছা দিয়ে বৈঠা মুছছে।
“চাচা, ওপাড় যাবেন?” আমি হাঁক ছাড়লাম।
বৃদ্ধ লোকটা আমাদের দিকে তাকিয়ে কয়েক সেকেন্ড পরে বললো, “যামু।” লোকটা মনে হয় চোখে ভালো দেখে না।
“কত নিবেন?”
“দিয়েন ইনসাফ কইরা।”
শিউলি নদীর ধারে আরেকটু এগিয়ে গিয়ে বললো, “আমাদেরকে একঘন্টা নৌকায় ঘুরাবেন। তারপর ওপারে নামিয়ে দিয়ে আসবেন। কত নিবেন ঠিক করে বলেন।”
বুড়ো চাচা বললো, “তিনশো টাকা।”
শিউলি আমার দিকে তাকিয়ে বললো, “কি উঠবো?”
আমি চাচাকে বললাম, “চাচা, আড়াইশো টাকা হয় না?”
“না বাবা, তিনশো’র এক টাকা কমে পারমু না।”
“চলো উঠি।” বলে শিউলির হাত ধরে সাবধানে ওকে নৌকায় উঠালাম। আমিও উঠলাম।
নদীর দুপাশ সারা দিন ব্যস্ত থাকে বুঝা যাচ্ছে। কিন্তু এই ভোর সকালে চারপাশ জনশূন্য। মাঝি চাচা ছপাৎ ছপাৎ শব্দ তুলে নৌকা ঘাট থেকে দূরে নিয়ে যেতে থাকলো। এখানে নদীর দুপাশে গাছের সারি দেখা যাচ্ছে। পূর্ব দিকে সূর্য উঠি উঠি করছে। হঠাৎ শিউলি গান শুরু করলো।

“মোর ঘুম ঘোরে এলে মনোহর...”

ওর গান গাওয়ার মধ্যেই সূর্য পুরোটা উঠে গেল। চারপাশে সোনালী আভা ছড়িয়ে পড়তে লাগলো। শিউলির কাধ পর্যন্ত ছড়ানো চুলগুলো থেকে সোনালী আভা ঠিকরে বেরোচ্ছে। মাথার উপর দিয়ে কয়েকটা পাখি ডাকতে ডাকতে উড়ে গেল। আমি গান শুনতে শুনতে মুগ্ধ চোখে চারপাশে তাকাতে লাগলাম।
শিউলির গান শেষ হতেই মাঝি চাচা বলে উঠলো, “মা, আপনে খুব চমৎকার গান গান। শুইনা অন্তর জুড়ায়ে যায়।”
শিউলি হেঁসে বললো, “থ্যাংক ইউ চাচা।”
“আপনেরে একটা কথা কই মা?”
“বলেন।”
লোকটা একটু ইতস্তত করে বললো, “আপনেরে দেইখা আমার খুব ভালো লাগছে। আপনে অনেক ভালো থাকেন গো মা এই দোয়া করি। কিন্তু আমি কইতে পারি না ক্যান যেন আমার মনডা খুব অস্থির বিস্থির লাগতাছে। মনে হইতাছে আপনার উপরে আবার কোন বিপদ না আসে। আপনে একটু সাবধানে থাইকেন।”
এই ফোঁকলা দাঁতের বুড়ো মাঝির কথা শুনে আমি অবাক হয়ে গেলাম। একটু রাগও হলো।
“কি বলেন এসব আবোল তাবোল চাচা?” আমি ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলাম।
“ভুল হইলে মাপ কইরা দিয়েন বাবা। বুড়া মানুষ তো, যা মনের মইধ্যে বাইজা ওঠে তা-ই কই।” লোকটা আর †কান কথা না বলে বৈঠা চালাতে লাগলো।
আমি শিউলির দিকে তাকালাম। মেয়েটা ভয় পেয়েছে নাকি কে জানে? চাচার কথা শুনার পর থেকে গম্ভীর হয়ে বসে আছে। হঠাৎ শিউলি খিলখিল করে হেঁসে উঠলো। ও আমার সামনে বসে ছিলো। হাঁসতে হাঁসতে উঠে এসে আমার গালে আলতো করে একটা চুমু দিলো। শিউলি বুঝতে পেরেছে চাচার কথা শুনে আমি ভড়কে গিয়েছিলাম।
কল্পনায় সেদিনের সেই ঘটনা পুরোপুরি জ্যান্ত হয়ে উঠেছিলো। শিউলির গান শেষ হওয়াতে আবার বিছানায় ফিরে এলাম। চোখবুজে শুয়ে থেকেই গালে শিউলির আর্দ্র ঠোঁটের ছোয়া অনুভব করলাম। চোখ খুলতে পারলাম না, সাথে সাথে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলাম।
চোখ খুলে দেখলাম মাথার উপরে এখনো সাদা পাতলা পর্দাটা উড়ে উড়ে আসছে। এই পর্দাটা বছর ছয়েক আগে শিউলি কিনেছিলো। কমদামি, কিন্তু ওর খুব পছন্দের একটা পর্দা। তখন আমাদের টাকার খুব টানাটানি। শিউলি বলতো, যেদিন আমাদের অনেক টাকা হবে, তখনও এই পর্দাটা বেডরুমে খাটের পাশের জানালায় ঝুলিয়ে রাখবো।
রুমে বেলীফুলের গন্ধ নেই। তার বদলে আরেকটা খুব পরিচিত গন্ধ। নীল আলোর বদলে ভোরের হালকা সাদাটে আলো রুমে ঢুকতে শুরু করছে। বা পাশের টেবিলে ঘড়ির দিকে তাকালাম। ছয়টা বাজে। ডান পাশে শিউলির দিকে ফিরলাম। ও ঘুমিয়ে আছে। ওর ডান হাতটা চেক করে দেখখলাম, ঠিক আছে কিনা। ডান হাত থেকে উঠে যাওয়া পাইপটা উপরে স্ট্যান্ডে ঝোলানো আই ভি ব্যাগের সাথে লাগানো। সেদিকে তাকালাম। সেখানে টপ টপ করে ফোটা ফোট ওষুধ পড়ছে। ওর নাক আর মুখ মাস্কের নিচে ঢাকা। চোখুদুটো বন্ধ।
গত পাঁচ বছরে শিউলির বন্ধ চোখদুটো একটা বার একটু কেঁপেও দেখেনি। এতগুলো বছর ধরে শিউলি হাসপাতালের এই খাটের উপর নিশ্চল শুয়ে থাকে। উপর থেকে টপ টপ করে ওষুধ নেমে আসতে থাকে। ওষুধের গন্ধে রুমের বাতাস ভারি হয়ে থাকে। আমি সারাদিন অফিস করে রাতে এখানে চলে আসি। এটাই এখন আমাদের জগত। আমাদের সংসার। এখন আর বেলীফুলের গন্ধ অতটা আপন মনে হয় না। তার চেয়ে ওষুধের গন্ধই ভালো।
শিউলি আমাকে এখনো আগের মতো ভালোবাসে। আমি বুঝতে পারি। ওর ভালোবাসা একেবার সূক্ষ, কিন্তু তীব্র। সেই প্রচন্ড ভালোবাসা সব বাধার ভেতর দিয়ে প্রতি রাতে আমার কাছে ফিরে আসে। আমি যখন ঘুমের ঘোরে চলে যাই, ঠিক তখন। এসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়, গান শুনিয়ে আমাকে আবার ঘুম পাড়িয়ে দেয়।
শিউলি ঠিক বলতো। ভালোবাসা কি আমি বুঝি না। আমার কাছে ভালোবাসা মানে একটা পাতলা, সাদা, কমদামি, ছেড়া পর্দা। সেই পর্দাটা ওর মাথার কাছে জানালায় লাগিয়ে রেখেছি। শিউলি যদি কোন দিন কোমা থেকে উঠে, ওর প্রিয় পর্দাটা দেখে হয়তো ওর ভালো লাগবে।
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে মার্চ, ২০১৬ সন্ধ্যা ৭:২৫
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

যুক্তরাষ্ট্রে ইসরাইল বিরোধী প্রতিবাদ বিক্ষোভ

লিখেছেন হাসান কালবৈশাখী, ০৩ রা মে, ২০২৪ সকাল ৮:০২

গাজায় হামাস উচ্ছেদ অতি সন্নিকটে হওয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিউইয়র্ক ও লসএঞ্জেলসে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পরেছিল। আস্তে আস্তে নিউ ইয়র্ক ও অন্যান্ন ইউনিভার্সিটিতে বিক্ষোভকারীরা রীতিমত তাঁবু টানিয়ে সেখানে অবস্থান নিয়েছিল।


... ...বাকিটুকু পড়ুন

৫০১–এর মুক্তিতে অনেকেই আলহামদুলিল্লাহ বলছে…

লিখেছেন বিচার মানি তালগাছ আমার, ০৩ রা মে, ২০২৪ বিকাল ৩:০০



১. মামুনুল হক কোন সময় ৫০১-এ ধরা পড়েছিলেন? যে সময় অনেক মাদ্রাসা ছাত্র রাজনৈতিক হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছিল। দেশ তখন উত্তাল। ঐ সময় তার মত পরিচিত একজন লোকের কীভাবে মাথায় আসলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

মেহেদীর পরিবার সংক্রান্ত আপডেট

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ৮:৪৯


মার্চ মাস থেকেই বিষয়টি নিয়ে ভাবছিলাম। ক'দিন আগেও খুলনায় যাওয়ার ইচ্ছের কথা জানিয়েও আমার বিগত লিখায় কিছু তথ্য চেয়েছিলাম। অনেক ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও মেহেদীর পরিবারকে দেখতে আমার খুলনা যাওয়া হয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

'চুরি তো চুরি, আবার সিনাজুরি'

লিখেছেন এমজেডএফ, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৮


নীলসাধুকে চকলেট বিতরণের দায়িত্ব দিয়ে প্রবাসী ব্লগার সোহানীর যে তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছিল তা বিলম্বে হলেও আমরা জেনেছি। যাদেরকে চকলেট দেওয়ার কথা ছিল তাদের একজনকেও তিনি চকলেট দেননি। এমতাবস্থায় প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বরাবর ব্লগ কর্তৃপক্ষ

লিখেছেন নীলসাধু, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১১:২২

আমি ব্লগে নিয়মিত নই।
মাঝে মাঝে আসি। নিজের লেখা পোষ্ট করি আবার চলে যাই।
মাঝেমাঝে সহ ব্লগারদের পোষ্টে মন্তব্য করি
তাদের লেখা পড়ি।
এই ব্লগের কয়েকজন ব্লগার নিজ নিক ও ফেইক... ...বাকিটুকু পড়ুন

×