-- স্লামুআলাইকুম স্যার, আসব ?
-- হুম, কোন কোম্পানী ?
-- স্যার, কিউব ফার্মা ।
-- যা বলার ৩০ সেকেন্ডে শেষ করবেন । আপনি আগে আসছেন বলে পেশেন্ট বসিয়ে আপনাকে ভিসিট দিলাম ।
-- ধন্যবাদ স্যার । স্যার আপনার কাছে আজ আসছি কিছু প্রোডাক্ট নিয়ে যেগুলো আপনি আপনার রেগুলার প্রাকটিসে প্রায়ই লিখে থাকেন । আমদের Omeprazole স্যার Beclo, ২০ এবং ৪০ মিঃ গ্রাঃ ট্যাবলেট, আমাদের Azithromycin স্যার Vimax, ৫০০ এবং ২৫০ মিঃ গ্রাঃ ট্যাবলেট । আর স্যার আমাদের আরেকটা প্রিপারেশন Losartan স্যার Bangilock, ৫০ এবং ১০০ মিঃ গ্রাঃ । স্যার সবগুলো পাশের দোকানগুলোতে দেয়া আছে । আপনি যদি একটু প্রেসক্রিপশন করেন স্যার ?
-- আচ্ছা ঠিক আছে লিখে দিবনে ।
-- ধন্যবাদ স্যার । স্যার আপনার জন্য কিছু স্যাম্পল রেখে গেলাম স্যার, আসি।
-- দাঁড়ান, এত কম স্যাম্পল দিলে হবে? অন্যদেরতো মাসে মাসে টাকা দেন, বিদেশ ভ্রমনে পাঠান আর আমার কাছে আসলে আপনার স্যাম্পলও শেষ হয়ে যায় না ? বের হন রুম থেকে, বের হন ।
-- স্লামুআলাইকুম স্যার ।
নতুন আসা এই ডাক্তারের রুম থেকে প্রবল ঝাড়ি খেয়ে বের হলেও ফরহাদ হাসি হাসি মুখে হাঁসপাতালের OPD তে পায়চারী করছে, যেন একটু আগে কিছুই হয় নি । MIO দের এত সহজে রাগ করলে হয় না । আর সত্যি কথা বলতে ফরহাদ এগুলো নিয়ে আর ভাবতেও চায় না। মাস্টার্স পড়ুয়া ফরহাদের কথায় মিলি যখন এক কাপড়ে ঘর থেকে বের হয়ে এলো, এ চাকরিটা তখন এক প্রকার বাধ্য হয়েই নিতে হল ।
গাইনীর রুবিনা ম্যাডাম রুমে আছেন । তাকে একটা ভিসিট দেয়া দরকার।
-- আপা আসব ?
-- আরে জহির না? আসেন ।
-- আপা আমি ফরহাদ, কিউব ফার্মা ।
-- ও ফরহাদ আসুন । আপনার স্ত্রী কেমন আছেন । ক’মাস চলছে ওনার ?
ফরহাদের মনটা খুশিতে নেচে ওঠে । মিলি আজ পাঁচ মাসের গর্ভবতী । আপার কাছেই প্রথম মাসে একবার নিয়ে এসেছিল সে । আপা সে কথা আজও মনে রেখেছে ।
-- আপা পাঁচ মাস ।
-- ও আচ্ছা, স্ত্রীর দিকে ভালমত খেয়াল রাখবেন কেমন । আর আপানার জন্য কি করতে পারি ?
-- আপা আমার দুটো ড্রাগ Bantonix আর Teclon টা যদি একটু লিখে দিতেন, আমার বাজেট টা হয়ে যেত আপা ।
-- আচ্ছা ঠিক আছে আপানার কার্ডের পেছনে নাম দুটো লিখে দিয়ে যান।
-- ধন্যবাদ আপা, আসি ।
ধন্যবাদ দিয়ে আপার রুম থেকে বের হয়ে আসে ফরহাদ । সব ডাক্তারগুলো এমন কেন হয় না? একটু ভাল ব্যাবহার করলে মান ইজ্জত কি আর থাকবে না?
দুপুর ১.৩০ বাজে, ফরহাদ গত ৩০ মিনিট ধরে এনামুল হকের চেম্বারের সামনে দাঁড়ান । এনামুল হক মেডিসিনের বড় ডাক্তার । তাকে ভিসিট না দিয়ে তো আর দুপুরের মত কাজ শেষ করা যায় না । অবশেষে তার এনামুল হকের রুমে ঢুকার পালা ।
-- স্লামুআলাইকুম স্যার, আসব ?
-- না, বের হন রুম থেকে ।
-- স্যার আমি আপনার বেশি সময় নিবনা । দুইটা মিনিট সময় দেন স্যার ।
-- এক মিনিট ও না । আমি আপনাকে কি বলছিলাম বলেনতো ? মনে আছে?
-- স্যার আমি তো কতৃপক্ষকে জানিয়েছি, কিন্তু তারা যদি........................
-- আমি আপনার কাছে Samsung এর সামান্য একটা ট্যাব চাইছি আর আপনে আমায় হাইকোর্ট দেখান? আপনাদের যে সাপোর্ট আমি দেই, এইটা অন্য কোম্পানীকে দিলে আমি একবার চাইলেই হত ।
-- স্যার আমি চেষ্টা .....................
-- কোন চেষ্টা ফেস্টা নাই । সামনে আসলে ট্যাব নিয়ে আসবেন নাহলে আসবেন না । এই সলিম একে রুম থেকে বের কর তো ।
সলিমকে আসতে হল না, হাসি হাসি মুখ করে ফরহাদ নিজেই রুম থেকে বের হয়ে গেছে । ফরহাদের নিজের কাছেই আশ্চর্য লাগে ও কিভাবে হাসতে পারছে ভেবে। ফরহাদ মনে মনে ভাবছে, একটু আগে ডাক্তাররা যা বলব এক হিসাবে তো ভুল বলেনি । তার কোম্পানী তো প্রায় বেশিরভাগ ডাক্তারকেই প্রতি মাসেই কিছু টাকা অথবা দামী কোন উপহার যেমন ফ্রিজ, এসি নাহয় প্রতি বছরই বিদেশ থেকে ঘুড়িয়ে আনে, তো এই ডাক্তারগুলো তো চাইবেই । কিন্তু এসব ব্যাপারে সেই বা কি করতে পারে, এগুলোর জন্য বড় বড় স্যাররা আছে । তাদেরকে সে বলেওছে, কিন্তু সে কি করবে ?
রুম থেকে বের হয়েই আরেক বিপদে পড়েছে ফরহাদ । আজ শনিবার, তার সামনে দাড়িয়ে আছে তার সুপারভাইজার ও জোনাল হেড । একের পর এক প্রশ্ন আসছে বাজেট, সেল আর টার্গেট নিয়ে ।
-- ফরহাদ আপনার এই মাসে বাজেট কত ছিল?
-- স্যার ৮ লাখ ১৫ হাজার টাকা ।
-- এই পর্যন্ত কত হল?
-- স্যার ৩ লাখ ৮০ হাজার ।
-- এই মিয়া কি করেন সারাদিন ? *ল ফেলান ? মাসের অর্ধেক শেষ আর আপনার ৪ লাখ টাকাও সেল নাই । বাপ দাদার চাকরী করেন নাকি?
-- স্যার এই মাসে ক্লিনিকগুলোর অর্ডার কিছু কম আসছে তো...
-- শোনেন এই সমস্ত *লের আলাপ বাদ দেন ? হয় বাজেট করেন নাইলে বউয়ের আঁচলের নিচে বসে থাকেন গিয়া । নবাবদের জন্য এই চাকরী না .................................।
এসব কথা শুনতে শুনতে কান লাল হয়ে যায় ফরহাদের । বিপর্যস্ত ফরহাদ যখন হাঁসপাতাল ছেড়ে বের হয় তখন দুপুর ২.৩০ । মুখে যদিও একটা হাসি হাসি ভাব, কিন্তু এই হাসি হাসি ভাব আর কতদিন থাকবে ফরহাদ তা জানে না । ইস্পাতকেও একটা তাপমাত্রায় এসে গলে যেতে হয় বৈকি ।
মোবাইলটা অনেকক্ষণ ধরেই ভাইব্রেট করছে । মোবাইলটা বের করতেই মুখের হাসিটা একটু প্রশস্ত করে লাইনটা কেটে দেয় ফরহাদ, মিলির ফোন । বাসায় যাওয়া দরকার । বাসায় ফেরার পথে গনি মুন্সির দোকানের বা পাশের বাসায় To-Let লেখা সাইনবোর্ড চোখ এড়ায় না ফরহাদের ।
কলিংবেলে চাপ দিয়ে দরজার সামনে দাড়িয়ে আছে ফরহাদ । ছোট্ট দুই রুমের একটা বাসা ঠিক করে এসেছে আজ । বাড়ীওয়ালা যেদিন হুট করেই তাকে বাসা ছাড়তে বলল, একেবারে অথৈ জলে পড়েছিল সে । অনেক বাসাই সে দেখেছে কিন্তু হয়নি । কয়েকজন বাড়ীওয়ালাতো বলেই দিল “MIO দের কাছে বাড়ী ভাড়া দিব না” । দাতে দাত চেপে হাসিমুখে সে বের হয়ে এসেছে তখন।
দরজা খোলার শব্দে সামনে তাকায় ফরহাদ । দরজা ধরে দাড়িয়ে আছে তার সাত রাজার ধন মিলি । চোখ দুটো ভেজা । ফরহাদের হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে ঘরের দিকে যাত্রা শুরু করেও যাওয়া হয়না মিলির । ফরহাদ পেছন থেকে তার হাতটা ধরে বুকে জড়িয়ে নিয়ে মনে মনে ভাবে, “সবাই চলে গেলেও আমাকে রেখে তুমি চলে যেও না”। অস্ফুটে বলে ওঠে মিলি, “যাব না, কক্ষনো যাব না” ।
পরিশিষ্টঃ ব্লগে এবং ব্লগের বাইরের সকল ডাক্তার আপু এবং ভাইয়াদের প্রতি যথাযথ সম্মান জানিয়ে বলতে চাই যে, এখানে আমি ডাক্তারদের হেয় করার জন্য কিছু বলিনি । আমি চেয়েছি শুধু একজন MIO কে সারাদিন কতটা কষ্টের মধ্যে যেতে হয় সেটা একটু হলেও বোঝাতে । আর সবার প্রতি একটা অনুরোধ, যদি সম্ভব হয় আমরা যেন MIO/ MR দের প্রাপ্য সম্মান দেই, অন্তত অপমান যেন না করি ।
“মানুষ তো মানুষের জন্য,
জীবন তো জীবনের জন্য,
একটু সহানুভূতি কি
মানুষ পেতে পারে না ও বন্ধু ?” .।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




