somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্পঃ একজন MIO/ MR এবং আমরা ক’জন...........।

১১ ই অক্টোবর, ২০১৩ দুপুর ১২:২৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

-- স্লামুআলাইকুম স্যার, আসব ?
-- হুম, কোন কোম্পানী ?
-- স্যার, কিউব ফার্মা ।
-- যা বলার ৩০ সেকেন্ডে শেষ করবেন । আপনি আগে আসছেন বলে পেশেন্ট বসিয়ে আপনাকে ভিসিট দিলাম ।
-- ধন্যবাদ স্যার । স্যার আপনার কাছে আজ আসছি কিছু প্রোডাক্ট নিয়ে যেগুলো আপনি আপনার রেগুলার প্রাকটিসে প্রায়ই লিখে থাকেন । আমদের Omeprazole স্যার Beclo, ২০ এবং ৪০ মিঃ গ্রাঃ ট্যাবলেট, আমাদের Azithromycin স্যার Vimax, ৫০০ এবং ২৫০ মিঃ গ্রাঃ ট্যাবলেট । আর স্যার আমাদের আরেকটা প্রিপারেশন Losartan স্যার Bangilock, ৫০ এবং ১০০ মিঃ গ্রাঃ । স্যার সবগুলো পাশের দোকানগুলোতে দেয়া আছে । আপনি যদি একটু প্রেসক্রিপশন করেন স্যার ?

-- আচ্ছা ঠিক আছে লিখে দিবনে ।
-- ধন্যবাদ স্যার । স্যার আপনার জন্য কিছু স্যাম্পল রেখে গেলাম স্যার, আসি।
-- দাঁড়ান, এত কম স্যাম্পল দিলে হবে? অন্যদেরতো মাসে মাসে টাকা দেন, বিদেশ ভ্রমনে পাঠান আর আমার কাছে আসলে আপনার স্যাম্পলও শেষ হয়ে যায় না ? বের হন রুম থেকে, বের হন ।
-- স্লামুআলাইকুম স্যার ।


নতুন আসা এই ডাক্তারের রুম থেকে প্রবল ঝাড়ি খেয়ে বের হলেও ফরহাদ হাসি হাসি মুখে হাঁসপাতালের OPD তে পায়চারী করছে, যেন একটু আগে কিছুই হয় নি । MIO দের এত সহজে রাগ করলে হয় না । আর সত্যি কথা বলতে ফরহাদ এগুলো নিয়ে আর ভাবতেও চায় না। মাস্টার্স পড়ুয়া ফরহাদের কথায় মিলি যখন এক কাপড়ে ঘর থেকে বের হয়ে এলো, এ চাকরিটা তখন এক প্রকার বাধ্য হয়েই নিতে হল ।

গাইনীর রুবিনা ম্যাডাম রুমে আছেন । তাকে একটা ভিসিট দেয়া দরকার।

-- আপা আসব ?
-- আরে জহির না? আসেন ।
-- আপা আমি ফরহাদ, কিউব ফার্মা ।
-- ও ফরহাদ আসুন । আপনার স্ত্রী কেমন আছেন । ক’মাস চলছে ওনার ?

ফরহাদের মনটা খুশিতে নেচে ওঠে । মিলি আজ পাঁচ মাসের গর্ভবতী । আপার কাছেই প্রথম মাসে একবার নিয়ে এসেছিল সে । আপা সে কথা আজও মনে রেখেছে ।

-- আপা পাঁচ মাস ।
-- ও আচ্ছা, স্ত্রীর দিকে ভালমত খেয়াল রাখবেন কেমন । আর আপানার জন্য কি করতে পারি ?
-- আপা আমার দুটো ড্রাগ Bantonix আর Teclon টা যদি একটু লিখে দিতেন, আমার বাজেট টা হয়ে যেত আপা ।
-- আচ্ছা ঠিক আছে আপানার কার্ডের পেছনে নাম দুটো লিখে দিয়ে যান।
-- ধন্যবাদ আপা, আসি ।


ধন্যবাদ দিয়ে আপার রুম থেকে বের হয়ে আসে ফরহাদ । সব ডাক্তারগুলো এমন কেন হয় না? একটু ভাল ব্যাবহার করলে মান ইজ্জত কি আর থাকবে না?


দুপুর ১.৩০ বাজে, ফরহাদ গত ৩০ মিনিট ধরে এনামুল হকের চেম্বারের সামনে দাঁড়ান । এনামুল হক মেডিসিনের বড় ডাক্তার । তাকে ভিসিট না দিয়ে তো আর দুপুরের মত কাজ শেষ করা যায় না । অবশেষে তার এনামুল হকের রুমে ঢুকার পালা ।

-- স্লামুআলাইকুম স্যার, আসব ?
-- না, বের হন রুম থেকে ।
-- স্যার আমি আপনার বেশি সময় নিবনা । দুইটা মিনিট সময় দেন স্যার ।
-- এক মিনিট ও না । আমি আপনাকে কি বলছিলাম বলেনতো ? মনে আছে?
-- স্যার আমি তো কতৃপক্ষকে জানিয়েছি, কিন্তু তারা যদি........................
-- আমি আপনার কাছে Samsung এর সামান্য একটা ট্যাব চাইছি আর আপনে আমায় হাইকোর্ট দেখান? আপনাদের যে সাপোর্ট আমি দেই, এইটা অন্য কোম্পানীকে দিলে আমি একবার চাইলেই হত ।
-- স্যার আমি চেষ্টা .....................
-- কোন চেষ্টা ফেস্টা নাই । সামনে আসলে ট্যাব নিয়ে আসবেন নাহলে আসবেন না । এই সলিম একে রুম থেকে বের কর তো ।

সলিমকে আসতে হল না, হাসি হাসি মুখ করে ফরহাদ নিজেই রুম থেকে বের হয়ে গেছে । ফরহাদের নিজের কাছেই আশ্চর্য লাগে ও কিভাবে হাসতে পারছে ভেবে। ফরহাদ মনে মনে ভাবছে, একটু আগে ডাক্তাররা যা বলব এক হিসাবে তো ভুল বলেনি । তার কোম্পানী তো প্রায় বেশিরভাগ ডাক্তারকেই প্রতি মাসেই কিছু টাকা অথবা দামী কোন উপহার যেমন ফ্রিজ, এসি নাহয় প্রতি বছরই বিদেশ থেকে ঘুড়িয়ে আনে, তো এই ডাক্তারগুলো তো চাইবেই । কিন্তু এসব ব্যাপারে সেই বা কি করতে পারে, এগুলোর জন্য বড় বড় স্যাররা আছে । তাদেরকে সে বলেওছে, কিন্তু সে কি করবে ?


রুম থেকে বের হয়েই আরেক বিপদে পড়েছে ফরহাদ । আজ শনিবার, তার সামনে দাড়িয়ে আছে তার সুপারভাইজার ও জোনাল হেড । একের পর এক প্রশ্ন আসছে বাজেট, সেল আর টার্গেট নিয়ে ।
-- ফরহাদ আপনার এই মাসে বাজেট কত ছিল?
-- স্যার ৮ লাখ ১৫ হাজার টাকা ।
-- এই পর্যন্ত কত হল?
-- স্যার ৩ লাখ ৮০ হাজার ।
-- এই মিয়া কি করেন সারাদিন ? *ল ফেলান ? মাসের অর্ধেক শেষ আর আপনার ৪ লাখ টাকাও সেল নাই । বাপ দাদার চাকরী করেন নাকি?
-- স্যার এই মাসে ক্লিনিকগুলোর অর্ডার কিছু কম আসছে তো...
-- শোনেন এই সমস্ত *লের আলাপ বাদ দেন ? হয় বাজেট করেন নাইলে বউয়ের আঁচলের নিচে বসে থাকেন গিয়া । নবাবদের জন্য এই চাকরী না .................................।


এসব কথা শুনতে শুনতে কান লাল হয়ে যায় ফরহাদের । বিপর্যস্ত ফরহাদ যখন হাঁসপাতাল ছেড়ে বের হয় তখন দুপুর ২.৩০ । মুখে যদিও একটা হাসি হাসি ভাব, কিন্তু এই হাসি হাসি ভাব আর কতদিন থাকবে ফরহাদ তা জানে না । ইস্পাতকেও একটা তাপমাত্রায় এসে গলে যেতে হয় বৈকি ।


মোবাইলটা অনেকক্ষণ ধরেই ভাইব্রেট করছে । মোবাইলটা বের করতেই মুখের হাসিটা একটু প্রশস্ত করে লাইনটা কেটে দেয় ফরহাদ, মিলির ফোন । বাসায় যাওয়া দরকার । বাসায় ফেরার পথে গনি মুন্সির দোকানের বা পাশের বাসায় To-Let লেখা সাইনবোর্ড চোখ এড়ায় না ফরহাদের ।


কলিংবেলে চাপ দিয়ে দরজার সামনে দাড়িয়ে আছে ফরহাদ । ছোট্ট দুই রুমের একটা বাসা ঠিক করে এসেছে আজ । বাড়ীওয়ালা যেদিন হুট করেই তাকে বাসা ছাড়তে বলল, একেবারে অথৈ জলে পড়েছিল সে । অনেক বাসাই সে দেখেছে কিন্তু হয়নি । কয়েকজন বাড়ীওয়ালাতো বলেই দিল “MIO দের কাছে বাড়ী ভাড়া দিব না” । দাতে দাত চেপে হাসিমুখে সে বের হয়ে এসেছে তখন।


দরজা খোলার শব্দে সামনে তাকায় ফরহাদ । দরজা ধরে দাড়িয়ে আছে তার সাত রাজার ধন মিলি । চোখ দুটো ভেজা । ফরহাদের হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে ঘরের দিকে যাত্রা শুরু করেও যাওয়া হয়না মিলির । ফরহাদ পেছন থেকে তার হাতটা ধরে বুকে জড়িয়ে নিয়ে মনে মনে ভাবে, “সবাই চলে গেলেও আমাকে রেখে তুমি চলে যেও না”। অস্ফুটে বলে ওঠে মিলি, “যাব না, কক্ষনো যাব না” ।


পরিশিষ্টঃ ব্লগে এবং ব্লগের বাইরের সকল ডাক্তার আপু এবং ভাইয়াদের প্রতি যথাযথ সম্মান জানিয়ে বলতে চাই যে, এখানে আমি ডাক্তারদের হেয় করার জন্য কিছু বলিনি । আমি চেয়েছি শুধু একজন MIO কে সারাদিন কতটা কষ্টের মধ্যে যেতে হয় সেটা একটু হলেও বোঝাতে । আর সবার প্রতি একটা অনুরোধ, যদি সম্ভব হয় আমরা যেন MIO/ MR দের প্রাপ্য সম্মান দেই, অন্তত অপমান যেন না করি ।


“মানুষ তো মানুষের জন্য,
জীবন তো জীবনের জন্য,
একটু সহানুভূতি কি
মানুষ পেতে পারে না ও বন্ধু ?”
.।
১৭টি মন্তব্য ১৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বাংলাদেশে কোন প্রজন্ম সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত? ১৯৭১ থেকে একটি সংক্ষিপ্ত ভাবনা

লিখেছেন মুনতাসির, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৮:৪৩

বাংলাদেশে দুর্নীতির প্রশ্নটি প্রায়ই ব্যক্তি বা দলের দিকে ছুড়ে দেওয়া হয়। কিন্তু একটু গভীরে গেলে দেখা যায়, এটি অনেক বেশি প্রজন্মভিত্তিক রাজনৈতিক - অর্থনৈতিক বাস্তবতার সঙ্গে যুক্ত। ১৯৭১ এর পর... ...বাকিটুকু পড়ুন

চাঁদগাজীর মত শিম্পাঞ্জিদের পোস্টে আটকে থাকবেন নাকি মাথাটা খাটাবেন?

লিখেছেন শ্রাবণধারা, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:৫৭



আমাদের ব্রেইন বা মস্তিষ্ক কিভাবে কাজ করে লেখাটি সে বিষয়ে। এখানে এক শিম্পাঞ্জির কথা উদাহরণ হিসেবে টেনেছি মাত্র।

ধরুন ব্লগে ঢুকে আপনি দেখলেন, আপনার পোস্টে মন্তব্যকারীর নামের মধ্যে "জেন একাত্তর" ওরফে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্মীয় উগ্রবাদ ও জঙ্গী সৃষ্টি দিল্লী থেকে।

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:১৫


((গত ১১ ডিসেম্বর ধর্মীয় উগ্রবাদ ও জঙ্গী সৃষ্টির ইতিবৃত্ত ১ শিরোনামে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম। সেটা নাকি ব্লগ রুলসের ধারা ৩ঘ. violation হয়েছে। ধারা ৩ঘ. এ বলা আছে "যেকোন ধরণের... ...বাকিটুকু পড়ুন

"ছাত্র-জনতার বেপ্লবের" ১৮ মাস পরে, আপনার ভাবনাচিন্তা ঠিক আগের মতোই আছে?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৫:৫৭



২০২৪ সালের পহেলা জুলাই "ছাত্র-জনতার বেপ্লব শুরু হয়, "৩৬শে জুলাই" উহা বাংলাদেশে "নতুন বাংলাদেশ" আনে; তখন আপনি ইহাকে ব্যাখ্যা করেছেন, ইহার উপর পোষ্ট লিখেছেন, কমেন্ট করেছেন; আপনার... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের হাদিকে গুলি করা, আর আওয়ামী শুয়োরদের উল্লাস। আমাদের ভুল কোথায়?

লিখেছেন তানভির জুমার, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:৫৩



৩০ জনের একটা হিটলিস্ট দেখলাম। সেখানে আমার ও আমার স্নেহের-পরিচিত অনেকের নাম আছে। খুব বিশ্বাস করেছি তা না, আবার খুব অবিশ্বাস করারও সুযোগ নাই। এটাই আমার প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

×