somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বাঙ্গালীর বাউল দর্শন

১১ ই এপ্রিল, ২০১৪ বিকাল ৫:৪১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


মিলন হবে কত দিনে
আমার মনের মানুষের সনে।

বর্ষায় চাঁদনী রাতে পাল তোলা নৌকায় দখিনা শীতল বাতাস আপনার মন-প্রাণ যেভাবে শীতল করে ঠিক তেমনি উল্লেখিত গানটি শুনলেই মনের নরম শীতল কোনে এক ধরনের প্রশান্তির তীক্ষ্ণ ছোঁয়া অনুভব হয়। তবে আশ্চর্যের বিষয় এই যে, স্থান-কাল ভেদে গানটির মর্মার্থ ভিন্ন সময় ভিন্ন রূপ প্রকাশ করে। রসিক প্রেমিক হৃদয়ে গানটির যেমন আবেদন, সাধক বা বাউল সম্প্রদায়ের কাছে এর অর্থের গভীরতা ভিন্ন হতে পারে। এই হচ্ছে আমাদের প্রানের বাউলগান। আমাদের আবেগের শেষ আশ্রয়, ঐতিহ্যের শিকড়। আমরা বাঙ্গালীরা জন্মগত ভাবেই ভাবুক প্রকৃতির। আমরা অল্পতেই প্রান খোলে হাসি, আবার অল্পতেই অঝরে চোখের পানি ফেলে কাঁদতে জানি। প্রাচীন কাল থেকে আজ অবধি বাঙ্গালীদের মাঝে বিভিন্ন মত-পথ, জাতের উদ্ভব হয়েছে। সামাজিক-অর্থনৈতিক-ধার্মিক আধিপত্য বিস্তার নিয়ে লড়াই চলেছে যুগের পর যুগ যার ফলে সৃষ্টি হয়েছে নতুন ধর্মের, নতুন মতের, নতুন তত্ত্বের। আর এর মাঝেই শান্তিপ্রিয় মানুষ বেছে নিয়েছে সুফিবাদ, চৈতন্যবাদ, বৈষ্ণববাদ অথবা বাউল মতবাদ। তবে এর মধ্যে বাউলদের জীবন-দর্শন,চলন-বলন-মনন বড়ই রহস্যময়। ভিন্ন ধর্মের সাধকদের নিয়ে গড়ে উঠেছে এই বাউল স¤প্রদায়। তবে ভিন্ন জাত থেকে আগত হলেও ওদের মত-পথ বা দর্শন কিন্তু অভিন্ন।

‘বাউল’ নামের উৎপত্তি নিয়ে বিভিন্ন ধরনের মতাভেদ রয়েছে। আহমেদ শরীফ লিখেছেন- ‘পনেরো শতকের শেষপাদের শ্রীকৃষ্ণবিজয়ের এবং ষোল শতকের শেষপাদের চৈতন্যচরিতামৃতে ক্ষেপা ও বাহ্যজ্ঞানহীন অর্থে ‘বাউল’ শব্দের আদি প্রয়োগ পাওয়া যায়। (....) কেউ বলেন ‘বাউর’ [এলোমেলো,বিশৃঙ্খল, পাগল] থেকেই বাউল নামটির উৎপত্তি হয়েছে।’ বাংলাদেশে কুষ্টিয়া, রাজশাহী,যশোর, সিলেট,ময়মনসিংহ অঞ্চলে বাউল সম্প্রদায়ের বসবাসের সন্ধান পাওয়া যায়। তবে আমরা বাঙ্গালীরা বাউল বলতেই জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের আঁকা যার মুখচ্ছবি কল্পনা করি তিনি হচ্ছেন আমাদের প্রানের লালন। বাংলার লালনসাঁই। বাঙ্গালীর আবেগের নাম। যাঁর গান আমাদের মনকে আন্দোলিত করে, শিহরন জাগায় আর আকাশকে সাক্ষী রেখে সুখের খুজে ঘরত্যাগী হওয়ার প্রেরণা জাগায়।

বাউল পাঠে জানা যায়- মানবিকতা, অসাম্প্রদায়িকতা, আত্মশুদ্ধি, আত্মজ্ঞান লাভ, কঠোর সাধন-ভজন ইত্যাদি বাউলতত্ত্বের মূলধারা বা ভিত্তি। তাদের মতে- প্রথমে আত্মাকে জানতে হবে, চিনতে হবে। আত্মার মাঝেই পরমাত্মার সন্ধান পাওয়া যায়। নিজের আত্মাকে, মনকে শুদ্ধি করার মাঝেই সকল প্রকার মঙ্গল নিহীত। নিজের আত্মাকে জানা মানেই ঈশ্বরকে,আল্লাহকে জানা। এই আত্মাকে বাউলরা কখনও ‘মনের মানুষ’, কখনও ‘অচিন পাখি’, ‘রসের মানুষ’, কখনও বা ‘ভাবের মানুষ’ ইত্যাদি রূপক অর্থে ব্যবহার করেছেন। লালনসাঁইর সেই বিখ্যাত গানে আত্মাকে জানার আকাঙ্খা, বাসনা তীব্রভাবে ফুটে উঠেছে।
খাঁচার ভেতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়
ধরতে পারলে মন-বেড়ী দিতাম তাহার পায়।

আগেই বলেছি, যেহেতু হিন্দু-মুসলমানদের মিলনে বাউলমত গড়ে উঠেছে তাই বাউলগানে একদিকে যেমন রাধাকৃষ্ণ, বিষ্ণু-লক্ষী, মায়া-ব্রহ্ম মুর্ত হয়ে উঠেছে ঠিক অন্যদিকে মুসলিম বাউলদের প্রভাবে আল্লাহ, গনি, রাসুল, আদম-হাওয়া বিশেষভাবে লক্ষণীয়। তারা সবাই বাউলদর্শন মর্মে ধারন করে বাংলার হাজার মাইল মেটোপথ পাড়ি দিয়ে মানুষের দ্বারে দ্বারে অসা¤প্রদায়িকতার বানী পৌছে দিয়েছেন। তাইতো বাউল মতে- মানবতাই মুখ্য,জাত গৌণ। একই সুরে লালন বলেছেন-
সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে,
লালন বলে জাতের কিরূপ দেখলাম না এ নজরে।

বিশেষজ্ঞদের মতে সতেরো শতকে বাউল মতবাদের উন্মেষ ঘটলেও বাংলা সাহিত্যের আধুনিক যুগে জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারেই প্রথম লালনচর্চা শুরু হয়। আর তার প্রভাবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বেশ কিছু বাউল ধারার গান রচনা করেছেন। তিনি বাউল তত্ত্বের মতাদর্শন অনুসারে তার গানে আত্মাকে খুজেছেন এভাবেই-

আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়েছিলে
দেখতে আমি পাইনি,
বাহির পানে ছোখ মেলেছি হৃদয় পানে চাইনি ।

আজ একবিংশ শতাব্দীতেও নীরবে-নিভৃতিতে বসবাস করে অনেক সাধক বাউল ধারার গান রচনা করে বাংলা লোকসাহিত্যকে সুসম্বৃদ্ধ করেছেন। তাদের সহজ-সরল জীবন-যাপন যেন বাউল মতাদর্শনেরই প্রকৃত রূপ। বাইরের চাকচিক্যময় দুনিয়া থেকে তারা এখনও বিচ্ছিন্ন। তবে বর্তমানে বাউলতত্ত্ব প্রানে ধারন না করে অদ্ভুত পোশাকী বাউলদের সংখ্যাও কিন্তু নেহাত কম নয়। তাদের ধরনে বাউলমত প্রদর্শিত হলেও মননে আছে কি না তা সন্দিহান।

যে সুখ লাভের আশায় দলে দলে বাউলরা অজানার উদ্দেশ্যে ঘরত্যাগী হয়েছেন সেই সুখের সংজ্ঞার পরিবর্তন এসেছে দিন বদলের সাথে সাথে। নীতিহীন রাজনীতির আগ্রাসন, সামাজিক মূল্যবোধের অভাব, সম্পদের প্রতি সীমাহীন লোভ-লালসা ভাবিয়ে তুলছে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের, সমাজ বিজ্ঞানীদের। যে ঘর ছেড়ে বাউলরা সুখের খুজে বের হয়েছেন সেই ঘরের জন্যই আজ আমদের আগ্রাসী মনোভাব। তাই মনে প্রশ্ন- এই আগ্রাসনের শেষ কোথায়, কিভাবে ? আর এর উত্তরও পাওয়া যাবে লালনের সেই বিখ্যাত গানে-
সত্য বল সুপথে চল,ওরে আমার মন।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই এপ্রিল, ২০১৪ রাত ১১:৫৭
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমরা কেন এমন হলাম না!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৪ ই মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪১


জাপানের আইচি প্রদেশের নাগোইয়া শহর থেকে ফিরছি৷ গন্তব্য হোক্কাইদো প্রদেশের সাপ্পোরো৷ সাপ্পোরো থেকেই নাগোইয়া এসেছিলাম৷ দুইটা কারণে নাগোইয়া ভালো লেগেছিল৷ সাপ্পোরোতে তখন বিশ ফুটের বেশি পুরু বরফের ম্তুপ৷ পৃথিবীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অভিমানের দেয়াল

লিখেছেন মোঃ মাইদুল সরকার, ১৪ ই মে, ২০২৪ সকাল ১১:২৪




অভিমানের পাহাড় জমেছে তোমার বুকে, বলোনিতো আগে
হাসিমুখ দিয়ে যতনে লুকিয়ে রেখেছো সব বিষাদ, বুঝিনি তা
একবার যদি জানতাম তোমার অন্তরটাকে ভুল দূর হতো চোখের পলকে
দিলেনা সুযোগ, জ্বলে পুড়ে বুক, জড়িয়ে ধরেছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের গ্রামে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি

লিখেছেন প্রামানিক, ১৪ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৩১



২৬শে মার্চের পরে গাইবান্ধা কলেজ মাঠে মুক্তিযুদ্ধের উপর ট্রেনিং শুরু হয়। আমার বড় ভাই তখন ওই কলেজের বিএসসি সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্র ছিলেন। কলেজে থাকা অবস্থায় তিনি রোভার স্কাউটে নাম... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিকেল বেলা লাস ভেগাস – ছবি ব্লগ ১

লিখেছেন শোভন শামস, ১৪ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৪৫


তিনটার সময় হোটেল সার্কাস সার্কাসের রিসিপশনে আসলাম, ১৬ তালায় আমাদের হোটেল রুম। বিকেলে গাড়িতে করে শহর দেখতে রওয়ানা হলাম, এম জি এম হোটেলের পার্কিং এ গাড়ি রেখে হেঁটে শহরটা ঘুরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

One lost eye will open thousands of Muslims' blind eyes

লিখেছেন জ্যাক স্মিথ, ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ২:২৭



শিরোনাম'টি একজনের কমেন্ট থেকে ধার করা। Mar Mari Emmanuel যিনি অস্ট্রেলীয়ার নিউ সাউথ ওয়েলসের একটি চার্চের একজন যাজক; খুবই নিরীহ এবং গোবেচারা টাইপের বয়স্ক এই লোকটি যে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×