somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্পঃ ময়না

১৩ ই আগস্ট, ২০১৭ সকাল ১১:২৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



আরে লও লও.. এত কষ্ট কইরা আইছো। খাও খাও। খাওনের সময় শরম পাইতে নেই মিয়া। এই কালো আঙ্গুরগুলা আইছে অস্ট্রেলিয়া থাইক্কা। লও মিয়া, লও। এতো শরম পাইলে অইবো !

রইছ মিয়া চিনামাটির পাত্রে রাখা আঙ্গুরের দিকে তাকিয়ে আছে। এই কালো আঙ্গুর ঠিক কবে পেটে পুরেছিল মনে পড়ছে না তার। আদৌ খেয়েছে কিনা তাও জানা নেই। শহরের গোল চত্বরে ফলের দোকানগুলোয় ঝুলিয়ে রাখা এমন আঙ্গুর প্রায়শই তার নজরে আসে। কিন্তু কেনা তো দূরে থাক দাম জিজ্ঞেস করারও সাহস পায় না সে। তাই একসাথে এতগুলো আঙ্গুর পেয়ে রইছ মিয়ার জিহ্বা টকটক করছে এখন।

পাশে তার বউ চুপচাপ বসে আছে। মুখে টু শব্দটিও নেই। নির্লুপ্ত। ভাবলেশহীন ভাবে তাকাচ্ছে ঘরের চার দেয়ালের দিকে। ফ্যানের শাঁ শাঁ বাতাসে দেয়ালে টাঙ্গানো ক্যালেন্ডারের পাতা তড়তড় করছে। দেয়ালে টাঙ্গানো একটা ছবিতে তীক্ষ্ণভাবে তাকিয়ে আছে সে। ফুঁটফুঁটে একটা বাচ্চার ছবি। নাদুসনুদুস মুখমন্ডলে টানাটানা চোখ। তার কুলের দেড় বছরের বাচ্চার সাথে কোনো মিল নেই। তার বুকের ঠিক মাঝখানটায় যেন কেউ পেরেক ঢুকিয়ে দিলো। শূন্যতার আগুনে দাউদাউ করে জ্বলে উঠলো তার বুক। তাদের একমাত্র বাচ্চাটার এমন দশা ! অসহায়ত্বের ছাপ যেনো মা-বাবার পর এখন একমাত্র সন্তানের শরীরেও ভর করেছে।

বুঝছো রইছ মিয়া, আজকের রাইতটা আমাগো বাসায় থাইকা যাও। রাইত পোয়াইলে সকাল সকাল চইলা যাইবা। তোমার লগে তো আমার সব কথাবার্তা পাকা হইগেছে।
- জ্বী স্যার।
-কাগজের মধ্যে সব লিখা আছে একটা স্বাক্ষর দিয়া দিও।
- স্যার, আমি তো স্বাক্ষর জানি না।
- অহ.. তাইলে টিপসই দিয়া দিবা।
- জ্বী স্যার।
- আরেকটা কথা, এই বাড়িতে কিন্তু তোমারে আর ভুলেও না দেখি। বুঝছো ?
- জ্বী স্যার।
সালেহার বুকটা ধড়পড় করে উঠে। তার নেশাগ্রস্ত স্বামী যে নেশা ধরেছে তা পূর্ণ করেই ছাড়বে। কারো বাপের সাধ্যি নাই তাকে বুঝানোর। সালেহা জানে, পাথর গলবে, তবুও রইছ মিয়ার মন গলবে না।

রাতে খাবারের টেবিলে হরেক রকম খাবরের আয়োজন করা হয়েছে। সালেহার মুখ দিয়ে কিছুই ঢুকছে না। একেকটা গ্রাস যেন নুড়ি পাথরের দলা। গত বছর সালেহা যখন একটা বাড়িতে তিন দিনের জন্য কাজ করতে গিয়েছিল তখন তাদের টেবিলেও এমন কয়েক পদের খাবারের আয়োজন দেখেছিল। ঐ বাড়ীর কর্ত্রী খুবই ভালো মনের মানুষ ছিলেন। তিনি একটু পরপরই সালেহাকে বলতেন, সালেহা, তোর যেটা খাইতে মন চায় খেয়ে নিবি, লজ্জা পাবি না। খাওয়ার বেলায় লজ্জা পাইতে নেই। তবুও সালেহার লজ্জা লাগতো। কোন কিছু খাওয়ার ইচ্ছা হলেও খেত না। ইচ্ছেটাকে বুকের মধ্যেই পোষে রেখে দিতো।
ঐ বাড়ীতে তার তিন দিনের বেশী একদিনও থাকা হয়নি। থাকার ইচ্ছা থাকলেও থাকতে পারেনি সে।

তাদেরকে যে ঘরে শুতে দেয়া হয়েছে সেটির বারান্দায় একটা লোহার পিঞ্জরাতে ময়না পাখি পোষছেন বাড়ীর মালিক। পাখিটা এই তিনজন আগন্তুককে দেখে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। এই ঘরের দেয়ালেও একটা বাচ্চার ছবি টাঙ্গানো। রইছ মিয়া সালেহাকে বলে- দ্যাখ, বড় লোকের কারবার-সারবার দ্যাখ। তারা ময়নারে নাকি দুধ কলা দিয়া পোষে। শালার বাইঞ্চত ! আমরা পাইনা একটা আলুর দলা আর তারা ময়নারে খাওয়ায় দুধভাত ! তুই চিন্তা করিসনা সালেহা, দেখিস, আমাদের ময়নাটা এইখানে দুধভাত খাইয়া বড় হইবো।
সালেহা তার কথায় সাড়া দেয় না। ময়না পাখির দিকে টলটল চোখে তাকিয়ে আছে সে।

এই তুই হুন, কালকে যাওয়ার সময় কইলাম ঘাড় ত্যারামি করিছ না। কান্দাকাটি করলে কইলাম গলায় টিপা দিয়া জায়গায় শেষ কইরা ফালামু, বুঝচ্ছস।
বোবা সালেহা স্বামীর কথা শুনে ফ্যালফ্যাল করে তাকায়। চোখদুটিতে পানি টলটল করছে তার। বিয়ের পর থেকে সে তার স্বামীর কথা শুনেই যাচ্ছে। এবং এটাও জানে, আমৃত্যু শুনতেই থাকবে। কথার পিঠে কথা বলার স্পর্দা তার নেই।
সালেহা এবার রইছ মিয়ার পা'দুটি জড়িয়ে ধরে আছে । আকার ইঙ্গিতে অনুনয়-বিনয় করে সে। কষ্টে বুক ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে। পানির অভাবে মাটি যেমন ফেটে যায় তার চেয়েও বেশী। তার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে, ওগো, আমি আমার সন্তানটারে এই ভাবে বিক্রি করতে চাই না। তুমি যা কইবা তাই হইবো। আমারে তুমি শেষ কইরা দাও। তবুও...
কিন্তু সৃষ্টিকর্তা তাকে কথা বলার শক্তি দেন নি। আজন্ম কন্ঠ রোধ করে রেখেছেন তিনি।

রইছ মিয়া সালেহার জড়ানো হাত ছাড়ানোর জন্য এক পা দিয়ে সজোরে লাথি মারছে। এক হাত দিয়ে চুলের গোছা ধরে অন্য হাত দিয়ে গলায় চেপে ধরেছে। ডাকাতি করতে গিয়ে রইছ মিয়ার কাটা পড়া পায়ের ক্ষত থেকে সালেহার হাতের স্পর্শে রক্ত ঝড়তে থাকে। তাতে তার মাথা আরো বিগড়ে যায়।
মাগী, তুই আমার রক্ত লইয়া খেলছ ! আইজ তোরে আমি শেষ কইরা ফালামু। শেষ কইরা ফালামু । তরে আমি তালাক দিমু, তালাক।

একসময় নিস্তেজ হয়ে আসে সালেহার দুর্বল শরীর। ফ্লোরের মধ্যে সটান হয়ে শুয়ে থাকে সে। চোখদুটিতে ঝাঁপসা লাগছে তার। পৃথিবীটা যেন আস্তেআস্তে অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছে। সে ডুবে যাচ্ছে যেন গহীন কোনো অন্ধকারে। তার চোখে ভেঁসে উঠছে মৃত মায়ের মুখ, বাবার মুখ, একমাত্র সন্তানের মুখ।
খাচায় পোষা ময়না পাখিটার আজ ঘুম নেই। তিড়বিড় করে তাকিয়ে আছে মধ্যরাতের এক জঘন্যতম দৃশ্যের দিকে। দেখে মনে হচ্ছে এতদিনের মায়া মহব্বত পায়ে ঠেলে সে উড়াল দিতে চায় স্বাধীন আকাশে। এই মানব জাতিকে তার অসহ্য লাগছে আজ। বড়ই অসহ্য।

সালেহাকে কামুকভাবে জড়িয়ে ধরেছে রইছ মিয়া। কানের কাছে ফিসফিস করে বলে, হুন সালেহা, তুই আজাইরা চিন্তা করিস না। সামনের বছর আমরা আরেকটা সন্তান নিমু। আরেকটা পোলা অইবো আমাগো। তার নাম দিমু বাদশা। বাদশা মিয়া !

ফজরের আজানের ধ্বনিতে চৈতন্য ফিরে আসে সালেহার। পৃথিবীটা একটু পরই চঞ্চল হয়ে উঠবে। রাতের বৃষ্টিতে গাছের সবুজ পাতা চিকচিক করবে। পাখিদের কলরব প্রকম্পিত হয়ে ধরা দিবে নিস্পাপ শিশুদের কানে। তাদের তুলতুলে পায়ের ছন্দে মুখরিত হবে পৃথিবীপৃষ্ঠ। শুধু মা হারানো ময়না পাখিটা আমৃত্যু খুঁজে ফিরবে তার জন্মদাত্রীকে।

সালেহার পানির তেষ্টা চেপেছে খুব। হাতে আর বেশি সময়ও নেই। রাত পোহালেই সন্তানকে তুলে দিতে হবে বাড়ীর নিঃসন্তান মালিকের হাতে। আগত ভোরে একটা অমানুষ একটা মানুষকে বিক্রি করবে। সালেহা ধীর পায়ে পিঞ্জরার কাছে আসে। ময়না পাখিটাকে মুক্ত করে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে সে। তবে ইট পাথরের নাগরিক জীবনে এই ক্রন্দনের কোনো মূল্য নেই, তা শুধু চার দেয়ালেই প্রতিধ্বনিত হতে থাকে ।

ছবি- গুগল
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই আগস্ট, ২০১৭ সকাল ১১:২৫
৩টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছবির গল্প, গল্পের ছবি

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৩:১৫



সজিনা বিক্রি করছে ছোট্ট বিক্রেতা। এতো ছোট বিক্রেতা ও আমাদের ক্যামেরা দেখে যখন আশেপাশের মানুষ জমা হয়েছিল তখন বাচ্চাটি খুবই লজ্জায় পড়ে যায়। পরে আমরা তাকে আর বিরক্ত না করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে লীগ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে জামাত

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৪৬


বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪৩

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

চা বাগানের ছবি কৃতজ্ঞতা: http://www.peakpx.com এর প্রতি।

আমাদের সময় একাডেমিক পড়াশোনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চয়নিকা বইয়ের গল্পগুলো বেশ আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, চাষীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×