বিপ্লব শব্দটি সর্বপ্রথম কোথায় দেখেছি তা মনে পড়ে না। তবে নিশ্চিত হয় এটা বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়ালে কিংবা বামধারার/শিবিরের মিছিলে। বামদের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব আর শিবিরের ইসলামী বিপ্লব। ছাত্রদল ও লীগ বিপ্লবটিপ্লব নিয়ে মাথা ঘামায়- এমন দৃশ্য দেখিনি! তাদের বৃহদাংশ বরং নগদ নারায়ণ ও ডালতন্ত্রেই বিশ্বাসী! আমাদের শৌর্যবান পূর্বপুরুষরা (এমনকি মাতারাও!) বালাকোটের বিপ্লব, সিপাহী বিপ্লব, ফরায়েজী আন্দোলন, বাঁশের কেল্লা, ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রাম, ভাষা বিপ্লব, স্বাধীনতার জন্য বিপ্লব সর্বশেষ চুনোপুটি এরশাদকে খেদানোর জন্য স্বৈরাচার বিরোধী বিপ্লব করেছেন। এগুলোর আদ্যপান্ত সকলেই জানি। সীমানার বাইরে বেলুচিস্তানের মানুষের সংগ্রাম, সিংহলী যাঁতাকল থেকে মুক্তির জন্য তামিলরা, কাশ্মীরবাসী, আসাম-অরুনাচল-নাগাল্যান্ডের গণমানুষ, শাহের বিরুদ্ধে ইরানের গণমানুষ, জারের বিরুদ্ধে বলশেভিকরা ইত্যাদি ইতিহাস আমাদের জানা। তরতাজা বলতে গেলে তিউনিশিয়ার মানুষদের বেনআলী বিরোধী বিপ্লব, মিশরীয়দের মোবারক বিরোধী বা এখনো প্রতিদিন রক্ত ঝরছে সিরিয়ার কসাই আসাদের বিরুদ্ধে সেদেশের ব্যাপক সংখ্যক মানুষের সংগ্রামের কথা বলা যায়। এসব গণজাগরন কোনোটা সফল, কোনোটা বিফল; কোনোটা মুসলিমদের, কোনোটা বৌদ্ধদের, কোনোটা হিন্দুদের; কোনোটা আরবদের, কোনোটা অনারবদের; কোনোটা শিয়াদের কোনোটা সুন্নীদের। কিন্তু এতসব অমিলকে ছাড়িয়ে একটা মিল আকাশে জ্বলজ্বল করা মধ্যহ্নের সূর্যের ন্যায় জ্বলে উঠে- "এ সকল বিপ্লবই জালিমের বিরুদ্ধে, মজলুমের।" দীর্ঘদিন ধরে গণমানুষের টুঁটি চেপে ধরে রাখা ক্ষমতাসীন দৈত্যের বিরুদ্ধে কোনো এক শুভসময়ে একদল মানুষের গগণবিদারী চিৎকার- মানিনা, মানব না!
মানুষের স্বতর্স্ফুত বিদ্রোহের প্রত্যুত্তরে কোনো একটি বিপ্লব/গণজাগরন/ গণমঞ্চেই গদীনশীন মহল ফুলের মালা পাঠায়নি এমনকি নীরবও থাকেনি বরং অস্ত্র, অর্থ, অপপ্রচার, অপবাদ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে! বিপ্লবীর জীবনে খাদ্য, বিছানা, বিশ্রাম কল্পনার রূপকথা মাত্র! বিপ্লবী মাত্রই ফেরারী। পুলিশের, আর্মির, গুপ্তঘাতকের নিশানা তাকে তাক করে সারাক্ষন তাড়া করে। মিছিলে, সমাবেশে ট্যাংক উঠিয়ে প্রকৃত গণজাগরনকে বরন করেছে মানব সভ্যতার আনুমানিক ৭০হাজার বছরের সকল সরকার! হয়তো কোন কোন গণজাগরণ তাৎক্ষনিক সফলতা পায়নি তবে মানবেতিহাসে সেসব বীরদের বীরত্বগাঁথা স্বর্নাক্ষরে রচিত আছে।
২০১৩ সালের ঊষালগ্নে এসে বাংলাদেশ নামক দক্ষিন এশিয়ার বিপ্লব ইতিহাসের অগ্রগ্রামী দেশটি একটি হাস্যকর ও আরামদায়ক গণজাগরন দেখতে পেল। সমাজ/রাস্ট্রবিজ্ঞানের খতিয়ানে যাকে বড়জোর 'গৃহপালিত বিপ্লব' বলা যেতে পারে। ভবিষ্যতের সমাজবিজ্ঞানের ছাত্ররা সুন্দর একটি টপিকস পেল পি এইচ ডি করার জন্য! ggশাহবাগ কেন্দ্রীক ২০১৩ সালের গৃহপালিত গণজাগরন। তবে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাও পাশাপাশি একটি টপিকস বানাতে পারে- খাঁচায় বিপ্লব উৎপাদন, প্রজনন, চাষ ও বিপনন: লেসন ফ্রম শাহবাগ ইন ২০১৩!
চট্টগ্রামের জামালখানের ব্যস্ততম রাস্তার দু'প্রান্ত- চেরাগীপাহাড় মোড় ও খাস্তগীর স্কুলের মোড়ে পুলিশ বাঁশ দিয়ে ব্যারিকেড দিয়েছে, বসিয়েছে মেটাল ডিটেক্টর আর্চওয়ে। আর্চওয়ে পেরিয়ে আরো খানিকটা এগুলে প্রেসক্লাবের সামনে ২ বা ৩ টি গ্রুপের (প্রতিগ্রুপে ১০ থেকে ১৫ জন) মাইকে কোরাস গান ও কাদের মোল্লা গংদের ফাঁসি চাই শ্লোগান। বুট-বাদামওয়ালা, উৎসুক দর্শনার্থী, ডাক্তারদের চেম্বারে আগত রোগী/ সহযোগীদের সাময়িক ভীড়ভাট্টা- এ হল মোটাদাগে "গণজাগরন।" তবে কেউ যদি সরেজমিন তদন্ত না করে "গৃহপালিত" টেলিভিশন, বিশেষ করে একাত্তর, এটিএন, দেশ, ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইত্যাদি টিভি দেখেন তাহলে বিপ্লবের জ্বরে কাঁপতে কাঁপতে ঘরের খাট, চেয়ার, সোফা বা আস্ত ফ্ল্যাটবাড়ীটাই ভেঙ্গে ফেলতে পারেন!
আমাদের পূর্বপুরুষরা তাদের তরুন বয়সে পাকিস্তানী কূপমন্ডুকদের বন্দুকের নলের মুখে বাংলাকে এস্টাবলিশ করেছে, দালালি করেনি; সর্বদলীয় ছাত্রসংগ্রাম করে জীবনকে তুচ্ছ করে যুদ্ধ করে বাংলাদেশ কায়েম করেছে, রাজাকার হয়নি; স্বৈরাচার এরশাদকে টেনে হিচড়ে নামিয়েছে, ছাত্রসমাজের বরকন্দাজ হয়নি। এতে তাদের ক্যারিয়ার, সুখ, যৌবন এমনকি জীবনও ছারখার হয়ে গেছে, তবু তারা মাথা নত করেনি। আমাদের তারুণ্যে কোন 'অধীনের বিনীত সাংবাদিকতা' করেনি। এমনই নিখাদ খাটি বাংলা শব্দ 'বিপ্লব,' 'গণজাগরন।'
তীব্র দু:খের সাথে বলতে হয়, এহেন 'হিজড়া' তারুন্যের পুলিশি নিরাপত্তা বেস্টিত 'সরকারী হালুয়া রুটির অঢেল সরবরাহ সমৃদ্ধ গৃহপালিত বিপ্লব' জাতি আর দেখেনি। দু:খ সেসব সৎ তরুনদের জন্য, যেখানে তারুণ্যের মজ্জাগত স্পিরিটকে 'ব্ল্যাকমেইল' করা হয়েছে। মীরজাফর কোন খারাপ শব্দ নয়, তবে এক 'মীরজাফরের' দুস্কর্মে তা আজ বেঈমানি; রাজাকার ও খারাপ শব্দনা, একাত্তরের দালাল গোস্টি তাকে ঘৃণার প্রতিশব্দ বানিয়েছে। আশংকা হয়- গণজাগরন, বিপ্লব ইত্যাদি শব্দ ও না বাংলায় কলুষিত হয়ে যায়! সেদিন না লোকেরা শ্লোগান তোলে- "শ" তে শাহবাগি, তুই রাজাকার, তুই রাজাকার!!
তরুণদের বলি মৃত, পরাজিত, আদালতে অপরাধী সাব্যস্ত, পলাতক, সরকারী পুলিশের দাবড়ানিতে দৌড়ের উপর থাকা একটি সংখ্যালঘু জনগোস্ঠির বিরুদ্ধে বিপ্লব হয়না! গণ জাগরণতো নয়ই!! ধৃত চোরকে বাড়তি ঘুষি দেয়ায় কোন পৌরুষত্ব নেই; মৃতের লাশের উপর লাফাতে নেই। বিপ্লব হয় শক্তিমানের বিরুদ্ধে!
গণজাগরন হয় বিপুলসংখ্যক, সংখ্যাগরিস্ট মানুষের আত্নঅধিকার, আত্নসম্মান, ন্যায়বিচার, কর্মসংস্থান, বাকস্বাধীনতা কেড়ে নেয়া জালেমের বিরুদ্ধে। মুরুদ থাকেতো সংখ্যাগরিস্ট ভোটের লাইসেন্সে আকন্ঠ দুর্নীতি, ব্যর্থতায় নিমজ্জিত ২০১৩ সালের কায়েমী স্বার্থবাজ আধুনিক হানাদারদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান! যে যেখানে যেভাবে পারেন!! এটাই এ মুহুর্তের প্রকৃত গণজাগরন! আসল বিপ্লব!!
মেটাল ডিকেক্টিং আর্চওয়ে, সরকারী হালুয়া তবারুক, তথাকথিত গণজাগরন বা গৃহপালিত হিজড়া বিপ্লব: আধুনিক তারুন্যের সর্বশেষ লজ্জা! ছি!! ছি!!!
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
২০টি মন্তব্য ১৯টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
হাদিকে shoot করে লাভবান হলো কে?

শরিফ ওসমান হাদি যিনি সাধারণত ওসমান হাদি নামে পরিচিত একজন বাংলাদেশি রাজনৈতিক কর্মী ও বক্তা, যিনি জুলাই গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে গঠিত রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র হিসেবে পরিচিত। তিনি ত্রয়োদশ... ...বাকিটুকু পড়ুন
আধা রাজাকারি পোষ্ট ......

আমি স্বাধীন বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করেছি। আমার কাছে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা, বা পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে আজকের বাংলাদেশের তুলনা—এসব নিয়ে কোনো আবেগ বা নস্টালজিয়া নেই। আমি জন্মগতভাবেই স্বাধীন দেশের নাগরিক, কিন্তু... ...বাকিটুকু পড়ুন
ইন্দিরা কেন ভারতীয় বাহিনীকে বাংলাদেশে দীর্ঘদিন রাখেনি?

কারণ, কোল্ডওয়ারের সেই যুগে (১৯৭১সাল ), আমেরিকা ও চীন পাকিস্তানের পক্ষে ছিলো; ইন্দিরা বাংলাদেশে সৈন্য রেখে বিশ্বের বড় শক্তিগুলোর সাথে বিতন্ডায় জড়াতে চাহেনি।
ব্লগে নতুন পাগলের উদ্ভব ঘটেছে;... ...বাকিটুকু পড়ুন
বন্ডাইর মত হত্যাকাণ্ড বন্ধে নেতানিয়াহুদের থামানো জরুরি...
বন্ডাইর মত হত্যাকাণ্ড বন্ধে নেতানিয়াহুদের থামানো জরুরি...

অস্ট্রেলিয়ার সিডনির বন্ডাই সৈকত এলাকায় ইহুদিদের একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানে সমবেত মানুষের ওপর দুই অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী অতর্কিতে গুলি চালিয়েছে। এতে... ...বাকিটুকু পড়ুন
আল্লাহ সর্বত্র বিরাজমাণ নন বলা কুফুরী

সূরাঃ ২ বাকারা, ২৫৫ নং আয়াতের অনুবাদ-
২৫৫। আল্লাহ, তিনি ব্যতীত কোন ইলাহ নেই।তিনি চিরঞ্জীব চির বিদ্যমাণ।তাঁকে তন্দ্রা অথবা নিদ্রা স্পর্শ করে না।আকাশ ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে সমস্তই... ...বাকিটুকু পড়ুন

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।