somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ইস্ মাকে যদি আরেকবার ছুঁয়ে দেখতে পারতাম!

০৮ ই মে, ২০১১ সকাল ৯:৫৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ছাত্রজীবনে কিংবা কর্মজীবনে যখন গ্রামে যেতাম তখন মা কারো কাছে খবর পেয়ে ছুটে আসতেন বহিরাঙ্গিনায়। আঁচল দিয়ে আমার মুখের ঘাম মুছতে মুছতে বলতেন, এতো রোদে এলি কেন বাবা আরেকটু পরে আসতে পারলি না? কখনো মাথায় হাত বুলিয়ে বলতেন, কিরে বাবা এমন শুকিয়ে গেছিস কেন? সময় মতো কি খাওয়া-দাওয়া করিস না? নাকি হোস্টেলের খাবার ভালো না? ফল টল কিনে খেতে পারিস না? কখনো বা রেগে বলতেন, এবার এতো দেরীতে এলে কেন? পনের বিশ দিন পর পর আসতে পারিস না? তোকে দেখার জন্য মনটা ছটপট করে। খাওয়ার জন্য এটা সেটা দিতে দিতে মা বলতেন, মাথার চুল এতো বড় কেন? আহারে মাথায় তেল দিসনি কত দিন। চুল কি উষ্কখুষ্ক রে বাবা। আমি রেগে বলতাম, মা আজকাল ছেলেরা মাথায় তেল দেয় না সেকথা তোমাকে কতদিন বলবো? ঝাঁঝালো কন্ঠে 'এতো বাবুগিরি ভালো না' বলেই মা তার হাতের তালু থেকে আমার ব্রহ্মতালুতে তেল ঢেলে ঘষতে ঘষতে বলতেন, কিরে ঠাণ্ডা লাগছে না? হেসে বলতাম, মা তেলে কিছু হয়েছে কিনা জানি না তবে তোমার হাতের ছোঁয়ায় পুরো দুনিয়াটাই ঠাণ্ডা মনে হচ্ছে!

আমরা ছয় ভাই। অজ পাড়াগাঁয়ে বড় হয়েছি। আমাদের এলাকায় বিদু্যতের আলো গেল মাত্র সেদিন। শিক্ষার আলো তো ভাগ্যের ব্যাপার, কবে পৌঁছবে আল্লাহ মা'লুম। সভ্যতা-ভব্যতা এখনো সাত সমুদ্র তের নদীর ওপারেই রয়ে গেছে, মনে হয় না কখনো আমাদের তল্লাটে এসব প্রবেশ করবে। আমাদের এলাকায় মার-দাঙ্গা লেগেই থাকে। খুন-খারাবি তো পান্তাভাত। শুদ্ধ ভাষায় কথা বললে লোকজন হাসাহাসি করে। কাউকে শুদ্ধ নামে ডাকলে মনে করে শালা বলদ নাকি? সৌজন্যবোধ নেই বললেই চলে। পরিশীলিত আচার-আচরণ অকল্পনীয়। অল্পতেই বিশ্রী ভাষায় গালিগালাজ করা মামুলি ব্যাপার। এমন কি পিতা-মাতাকেও সন্তানরা অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে। পিতা-মাতার উপর হাত তোলার মতো নর পশুর অভাব নেই। এ যেন আরবের অন্ধকার যুগের বাংলা সংস্করণ। এমন এক অন্ধকার সমাজে বড় হলেও আমরা হয়েছি একটু অন্যরকম। অন্যরকম বলতে আহামরি কিছু না তবে সুশিক্ষা পেয়েছি। আলোকিত মানুষের সানি্নধ্য লাভ করার সৌভাগ্য হয়েছে। এজন্য আমাদের নিরক্ষর কৃষক বাবার কৃতিত্বকেই এলাকার সমঝদার লোকেরা বড় করে দেখে থাকেন। অথচ আমাদের শিক্ষা-দীক্ষার পিছনে মমতাময়ী মার অবদানই সবচেয়ে বেশী। ধৈর্য্যশীল মার সোহাগমাখা হাতের যাদুতেই তো আমরা একটু অন্যরকম হয়েছি।

প্রাকৃতিক দূর্যোগ আর চোর-ডাকাতদের দুষ্ট চক্রের প্রভাবে হঠাৎ করে আমাদের সংসারে নেমে আসে দারিদ্রের ঘোর অমানিশা অন্ধকার। তখন বড় ভাই বিশ্ববিদ্যালয়ে, ছোট ভাইগুলো স্কুলে এবং আমি কলেজে পড়ছি। আচমকা দারিদ্রের কষাঘাত কতই না দূর্বিষহ! কতই না নির্মম! বাবার অসহায়ত্ব খুব কাছে থেকে দেখেছি। বাবার কঠিন ক্রান্তিকালে মা ছিলেন অশ্বথ বৃক্ষের মতো অটল সহযোদ্ধা। বাবাকে বুদ্ধি দিয়েছেন, সাহস যুগিয়েছেন, বাবার মনোবল অটুট রেখেছেন। অতন্দ্র প্রহরীর মতো আমাদেরকে হেফাজত করেছেন। গৃহস্থালী কাজে মা অমানুষিক পরিশ্রম করেছেন। শেষের দিকে মার ক্লান্ত-শ্রান্ত দেহটা যেন আর সোজা হয়ে চলতে পারছিল না। একটু নরম বিছানার অপেক্ষায় পরিশ্রান্ত দেহটা। একে একে আমাদেরকে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করতে দেখে মা হয়তো ভাবছেন এই বুঝি তার কঠোর পরিশ্রম আর কষ্টের দিন ফুরিয়ে এলো। কিন্তু মার ভাবনার ছেদ ঘটিয়ে নীরবে নিভৃতে অতিসন্তর্পণে মার দরজায় এসে হাজির হয় যমদূত। কবি ফররুখের ভাষায়, মৃতু্য আসে পায় পায়, মৃতু্য আসে নিভৃত গোপনে / মৃতু্য আসে অলক্ষিতে, মৃতু্য আসে হিমেল প্রশ্বাসে / ক্লেদ-ক্ষীণ জীবনের রুদ্ধ দ্বার কক্ষে মৃতু্য আসে / মৃতু্য আসে তিলে তিলে শ্রান্ত-ম্লান সুপ্তির বন্ধনে। ঢাকা মেডিকেলে দীর্ঘ ছয় মাস রেক্টাল ক্যান্সারের চিকিৎসার পর ডাক্তার বললেন, আর চিকিৎসা করে লাভ নেই বাড়ী নিয়ে যান। ডাক্তারের কথা শুনে ভিতরটা হাহাকার করে উঠে।

ডাক্তারের কথায় মার তিরোধানের ইঙ্গিত থাকায় অশ্রু ধরে রাখতে পারছিলাম না। মা বললেন, বাবা কাঁদিস কেন? ডাক্তার বলেছেন, আমার তেমন কিছু হয়নি, বাড়ীতে গিয়ে মাটিতে হাটা-হাটি করলে সুস্থ হয়ে উঠবো। এই না হলে কি মা? জীবনের অন্তিম সময়েও সন্তানের অশ্রু দেখে ব্যাকুল হয়ে উঠা, মা ছাড়া আর কার পক্ষে সম্ভব? মানুষের স্রষ্টা পবিত্র কোরআনে এরশাদ করেন, ''অতঃপর যখন কারও প্রাণ কণ্ঠাগত হয় এবং তোমরা তাকিয়ে থাক, তখন আমি তোমাদের অপেক্ষা অধিক নিকটে থাকি; কিন্তু তোমরা দেখ না। যদি তোমাদের হিসাব-কিতাব না হওয়াই ঠিক হয়, তবে তোমরা এই আত্মাকে ফিরাও না কেন যদি তোমরা সত্যবাদী হও?'' দুর্বল মানুষের পক্ষে কি করে সম্ভব কারো আত্মাকে এক মুহূর্তের জন্য ধরে রাখা? আমাদের সকল চেষ্টা-প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে গেল মার তিরোধানে। মাত্র একজন মানুষ 'মা' নেই তাতেই পৃথিবীটাকে অপাঙ্ক্তেয় মনে হলো। অথৈ সাগরের বুকে বিক্ষুব্ধ ঝড়ের কবলে পড়া মাঝি যেমন হতবিহ্বল হয়ে পড়ে তেমনি দশা হলো আমার। কষ্টের স্ফীত নীলদলা সুনামির মতো বুকের ভিতরটাকে তছনছ করে দিয়েছে। মনে হলো ব্রেইন কাজ করছে না। দু'হাত দিয়ে মার চিবুক জড়িয়ে ধরলাম। কি আশ্চর্য মুহূর্তের মধ্যেই আমার শিরায় শিরায় ঠাণ্ডা হওয়া বয়ে গেল! ঝাপসা চোখে মার মুখের উপর তাকালাম কিন্তু মা আমার দিকে একবারও তাকালো না। আমার অশ্রু মাকে ব্যাকুল করে তুললো না।

বিচার দিনের মালিক মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনে এরশাদ করেন, ''যদি সে নৈকট্যশীলদের একজন হয়; তবে তার জন্য আছে সুখ, উত্তম রিযিক এবং নেয়ামতে ভরা উদ্যান। আর যদি ডানপাশর্্বস্থদের একজন হয়, তবে তাকে বলা হবে, তোমার জন্য ডানপাশর্্বস্থদের পক্ষ থেকে সালাম। আর যদি সে পথভ্রষ্ট মিথ্যারোকারীদের একজন হয়, তবে তার আপ্যায়ন হবে উত্তপ্ত পানি দ্বারা। এবং সে নিক্ষিপ্ত হবে অগি্নতে। এটা ধ্রুব সত্য। অতএব আপনি আপনার মহান পালনকর্তার নামে পবিত্রতা ঘোষনা করুন।'' আমার বিশ্বাস আমার মা আছেন সুখ, উত্তম রিযিক এবং নেয়ামতে ভরা উদ্যানে। মা বেঁচে নেই প্রায় ছয় বছর তারপরও মাঝে মাঝে মনে হয় মা বেঁচে আছেন। আমার জন্য বাড়ীতে অপেক্ষা করছেন। পরক্ষণেই চৈতন্য ফিরে এলে ভাবি মাকে তো মানি নিজেই কবরে রেখে এলাম। যত আশা, যত কামনাই করি না কেন মা তোর আর এক মুহূর্তের জন্যও ফিরে আসবে না। মার প্রয়াণের পর থেকে ভয়ঙ্কর এক শূণ্যতা আমাকে তাড়া করে ফিরছে। মাঝে মাঝে ভাবি সেদিন কেন বার বার মার চিবুক জড়িয়ে ধরলাম না? কেন বার বার মার কপালে-কপোলে চুমুখেয়ে আমার কলিজাটা ঠাণ্ডা করে নিলাম না? ইস্ মাকে যদি আরেকবার ছুঁয়ে দেখতে পারতাম! আজ ৮ মে ২০১১ বিশ্ব মা দিবসে পৃথিবীর সকল মায়ের পবিত্র চরণে ভক্তিপূর্ণ সালাম।
৯টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মব সন্ত্রাস, আগুন ও ব্লাসফেমি: হেরে যাচ্ছে বাংলাদেশ?

লিখেছেন শ্রাবণধারা, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৩:৫২


ময়মনসিংহে হিন্দু সম্প্রদায়ের একজন মানুষকে ধর্মীয় কটূক্তির অভিযোগে পুড়িয়ে মারা হয়েছে। মধ্যযুগীয় এই ঘটনা এই বার্তা দেয় যে, জঙ্গিরা মবতন্ত্রের মাধ্যমে ব্লাসফেমি ও শরিয়া কার্যকর করে ফেলেছে। এখন তারই... ...বাকিটুকু পড়ুন

আরো একটি সফলতা যুক্ত হোলো আধা নোবেল জয়ীর একাউন্টে‼️

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৮:৪০



সেদিন প্রথম আলো-র সম্পাদক বলেছিলেন—
“আজ শেখ হাসিনা পালিয়েছে, প্রথম আলো এখনো আছে।”

একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে আজ আমি পাল্টা প্রশ্ন রাখতে চাই—
প্রথম আলোর সম্পাদক সাহেব, আপনারা কি সত্যিই আছেন?

যেদিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

হামলা ভাংচুর অগ্নিসংযোগ নয়, আমরা শান্তি চাই

লিখেছেন নতুন নকিব, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:১১

হামলা ভাংচুর অগ্নিসংযোগ নয়, আমরা শান্তি চাই

ছবি এআই জেনারেটেড

হামলা ভাংচুর অগ্নিসংযোগ প্রতিবাদের ভাষা নয় কখনোই
আমরা এসব আর দেখতে চাই না কোনভাবেই

আততায়ীর বুলেট কেড়ে নিয়েছে আমাদের হাদিকে
হাদিকে ফিরে পাব না... ...বাকিটুকু পড়ুন

তৌহিদি জনতার নামে মব সন্ত্রাস

লিখেছেন কিরকুট, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১১:৫৪




ছবিঃ অনলাইন থেকে সংগৃহীত।


দেশের বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রতিক সময়ে ধর্মের নাম ব্যবহার করে সংঘটিত দলবদ্ধ সহিংসতার ঘটনা নতুন করে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে তৌহিদি জনতা পরিচয়ে সংঘবদ্ধ হয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুখ গুজে রাখা সুশীল সমাজের তরে ,,,,,,,,

লিখেছেন ডঃ এম এ আলী, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:০৫


দুর্যোগ যখন নামে আকাশে বাতাশে আগুনের ধোঁয়া জমে
রাস্তা জুড়ে কখনো নীরবতা কখনো উত্তাল প্রতিবাদের ঢেউ
এই শহরের শিক্ষিত হৃদয়গুলো কি তখনও নিশ্চুপ থাকে
নাকি জ্বলে ওঠে তাদের চোখের ভেতর নাগরিক বজ্র
কেউ কেও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×