গল্প: কলুষ
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
চোখ খুলে সুমগ্নের ধারণা ছিলো, সে দেখতে পাবে এক চিলতে জানালা, জানালায় পুরোনো সাদা রঙের একটা পর্দা থাকতে পারে,হয়ত দেখা যাবে পর্দা টা সুমগ্নের মতই শেষ বিকেলের বাতাসে আলতো দুলছে, কিন্তু ওপাশ থেকে আকাশের টুকরো হুড়মুড় কেবিনে ঢুকে পড়বে না বরং মুখ ব্যাদান করে রাখবে পলেস্তারা খসে যাওয়া কোন ইটের দেয়াল। অথবা সে এটাও ভাবে যে দেখা যাবে, বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে থাকা কোনো সেবিকা তার রক্তচাপ মাপছে কিংবা হাতের শিরায় ঢুকিয়ে রাখা সুঁচ বেয়ে প্রবেশ্যমান তরলের হার। এসবের সাথে নাকের ভেতর হাসপাতালের কড়া ন্যাফথলিনের ধাক্কার জন্যেও সে প্রস্তুত ছিলো কিন্তু সুমগ্ন অবাক হয়ে লক্ষ্য করে, তার চারপাশে হালকা একটা সুগন্ধের ঘুরপাক!
এই সুগন্ধী টা তার খুব চেনা। চোখ খুললেও সে আসলে ঝাপসা দেখছে চারপাশ কিন্তু তার বুঝতে কষ্ট হয় না যে মৌরি তার হাত ধরে বসে আছে।মৌরির কাছাকাছি যতবারই এসেছে, এই সুগন্ধটা পেয়েছে।
মৌরিকে সে হাসতে দেখে।ওকে প্রচন্ড সুখী দেখায়। সুমগ্নের মনে হয় যে এটাই তো স্বাভাবিক যেহেতু মৌরি তাকে অনেক ভালোবাসে আর সে নিশ্চয় অনেকদিন পর চোখ খুলেছে। কতদিন পর তা সুমগ্ন নির্ণয় করতে পারে না কিন্তু স্পষ্ট মনে আছে, মাথার পেছন দিকটায় আঘাত টা লাগার পরপরই সে কিছু দেখতে পাচ্ছিলো না, বুঝতে ও না।আর মনে আছে, একটা মুখের ছবি, যে আঘাত করেছিলো, যে সুমগ্নের অনেক রাতজাগা সিগারেটের ভাগ নিয়েছিলো, খোলা মাঠে চিত হয়ে পাশাপাশি শুয়ে দেখেছে জোছনাভাসা আকাশ!
সুমগ্নের হঠাৎ মনে হয় সে আসলে ভুল ধারণা করেছে যে মৌরি তাকে প্রচন্ড ভালোবাসে, আসলে মৌরি মোটেও বাসে না বরং সে নিজেই বলেছিলো যে ও ঘৃণা করে তাকে। যার জন্যে সুমগ্ন নিজেকে খুব নিঃসঙ্গ আর অসহায় রুপে আবিষ্কার করে। জোছনার বদলে মাদকজল গিলতে শুরু করে, স্বর্গপরিভ্রমণ শুরু করে শুকনো মাদকপাতার দলা পুড়িয়ে পুড়িয়ে। আর জড়িয়ে পড়ে অসুস্থ তাঁবেদারি আর ভোগদখলের দলাদলি তে,যার মুখোশনাম ছাত্ররাজনীতি, এতদিন শত আমন্ত্রণেও সুমগ্ন যা কেবল ঘৃণা করে এসেছে। দখলের নেশায় কিংবা ঘৃণাবমি পানজনিত অসুস্থতায় সে ও লোহার বাঁকানো রড নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে প্রতিপক্ষের উপর, যারা আসলে তারই সহপাঠি, পরিচিত, বন্ধু!
ওখানেই মাথায় প্রচন্ড আঘাত পেয়ে সবুজ ঘাস লাল করে লুটিয়ে পড়ে সুমগ্ন।
এসব কিছুর জন্য মৌরি কে এই মুহুর্তে দায়ী মনে হয় কিন্তু সে মৌরির নির্মল হাসিতে বিভ্রান্ত হয়। মৌরি হয়তো ভুল বুঝতে পেরেছে তাই সুমগ্ন মনে মনে তাকে ক্ষমা করেও ফেলে।
মৌরির হাতে এক তোড়া ফুল দেখে সুমগ্নের মনে হয়, সে এই ফুলগুলো বহুবার দেখেছে অনেক ছাত্র নেতার হাতে, যা ওরা অঞ্জলি দিত শহীদ মিনারে কিংবা অন্যান্য সৃতিস্তম্ভ ও সমাধি তে, কিন্তু সে সব অঞ্জলি প্রকৃতপক্ষে কখনোই শ্রদ্ধাঞ্জলি হয়ে উঠে নি বরঙ লোক দেখানো আচার ছিলো মাত্র! কারণ, সুমগ্ন বহুবার দেখেছে, প্রতিপক্ষের আগে অঞ্জলি অর্পণের তীব্র প্রতিযোগিতা ছিলো সবসময় কিন্তু প্রকৃত শ্রদ্ধা নিশ্চয় প্রতিযোগিতা নয়!
ফুলগুলো কে অপবিত্র মনে হতে গিয়েও হয় না কেননা এগুলো মৌরি নিয়ে এসেছে এবঙ সুমগ্নের বিশ্বাস, মৌরি এসব অপবিত্রতার উর্ধ্বে আর তাই তার স্পর্শে এই ফুলগুলোও পবিত্র হয়ে গেছে।
একহাতে ফুল আর অন্য হাতে মৌরিকে জড়িয়ে ধরে উঠে দাঁড়ায় সুমগ্ন। হাসপাতালের এই সংকীর্ণ কেবিনের বদ্ধ বাতাসে তার দম আটকে আসছে তাই ওভাবেই বেরিয়ে আসে বাইরে।
মৌরির ইশারায় একটি রিকশা এগিয়ে এলে সুমগ্নের ভ্রান্তি হয় যে সে এই রিকশাঅলা কে চেনে। রিকশায় উঠে বসার পর কিংবা রিকশা চলতে শুরু করার পরও তার মনে হতে থাকে, এই রিকশাঅলাকেই দিনকয়েক আগে ছাত্রনেতা হবার সুবাদে এবঙ তার কাছে ভাড়া চাওয়ার অপরাধে চড় মেরেছে কিংবা সে অন্য কোন রিকশাঅলা। কিন্তু তার মনে হয়, এই রিকশাঅলার ভেতরে জগতের সব রিকশাঅলা ঢুকে গেছে আর তাকে ঘৃণার আগুনে ভস্ম করে দিতে চাচ্ছে!
ঘামতে ঘামতে সে মৌরির দিকে তাকায়। মৌরির চুল বাতাসে উড়ছে। তার খুব ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে করে। মৌরির চুল তার সবচেয়ে প্রিয় আর সে বিশ্বাস করে এরকম নরম কোমল চুল আর কারো নেই,আর কারো হতে পারে না।
সুমগ্ন রিকশা টা ছেড়ে দেয়ার প্রয়োজন অনুভব করে কিন্তু কিছু বলে না। আসলে সে চাচ্ছিলো না বাতাসে মৌরির চুল উড়াউড়ি বন্ধ হয়ে যাক কিন্তু মৌরি নিজেই রিকশা থামায়। তার হয়তো মনে হয়, সুমগ্ন অনেক দিন পর বাইরে এসেছে আর তরল ছাড়া আর কিছু খাওয়ানো যায় নি এতদিন তাই সুমগ্নের হয়তো অনেক ক্ষুধা লেগেছে। তাই সুমগ্নের অতিপ্রিয় কাবাবের দোকানটায় রিকশা থামিয়েছে কিন্তু সুমগ্ন কিছুতেই দোকানে ঢুকতে চায় না এমনকি মৌরির প্রিয় আইসক্রীমের দোকানটায় ও না কারণ সে এসব দোকানগুলোয় অনেকবার দলবেঁধে কাবাব খেয়ে গেছে, আইসক্রীম খেয়ে গেছে কিন্তু কখনো দাম দেবার প্রয়োজন বোধ করে নি বরঙ উল্টো চাঁদা তুলে নিয়েছে মোটা অংকের! দোকানদার রাও হাসিমুখে দিয়ে এসেছে কিন্তু সুমগ্ন ভালো করেই জানে, তারা ভয়ে ঘৃণা গোপন করে চাঁদা দেয় আর ভাবে যে আসলে কিছু টাকা ভিক্ষা দিয়েছে।
আজও হয়তো ওরা কোনভাবেই দাম নিতে চাইবে না কিন্তু সুমগ্ন আজ অন্তত ভিক্ষা টা নিয়ে মৌরি কে অপমানিত হতে দিতে চায় না।
সুমগ্ন ঘৃণা থেকে বাঁচতে চায় আর তার মনে হয় যে মোড় টা পেরিয়ে পার্ক নামের অপরিকল্পিত বৃক্ষরাজির কোন একটার শিকড়ে বসলে হয়তো দু'দন্ড শান্তি মিলতে পারে।
সুমগ্ন অনেক ক্লান্তি নিয়ে শিকড় জুড়ে শুয়ে পড়ে যেন মনে হয় সে আসলে গাছটার কাছে আশ্রয় চায়। সে বোধহয় গাছ ই হয়ে যেতে চায়!
মৌরি তার কোলে সুমগ্নের মাথাটা তুলে নেয় আর পরম মমতায় এলোমেলো চুলে হাত বুলাতে থাকে। সুমগ্নের কাছে পুরোটায় পরম আরাধ্য শান্তি মনে হয়, পরম সুখ মনে হয়, তবুও সে নিজেকে মৌরির স্পর্শের মত পবিত্র কিংবা গাছটার মত মুক্ত ভাবতে পারে না। সে চেষ্টা করেও মৌরির পরশ মাখা বাতাস সমগ্র থেকে একটি মাত্র নিঃশ্বাস বুকের ভেতরে টেনে নিতে পারে না কারণ তার কাছে পার্কের এই গাছগুলোকে এই বাতাস কে দূষিত মনে হতে থাকে। মৌরি হয়তো জানে না কিন্তু সে ত জানে, চাঁদার টাকায় ঘন্টা ঘন্টা নেশাপাতা পুড়িয়ে আর বোতল বোতল মাদকজল সাবাড় করে আশপাশের নিশিকন্যাদের ভোগ করে পারিশ্রমিকের বদলে চড় মেরে মেরে কি পরিমাণ দূষিত করে ফেলেছে ওরা এই সবুজ কে, এই বাতাস কে!
সুমগ্নের মনে হয় আর কিছুক্ষণ থাকলে সে দমবন্ধ হয়েই মারা যাবে।তাই সে পালাতে চেষ্টা করে। মানুষের ঘৃণা আর এই সবুজের অভিশাপ থেকে বহুদূরে কোথাও মৌরির কোলে মাথা রেখে শুয়ে থাকতে চায় দীর্ঘকাল।
তার হঠাৎ সংশয় হয় মৌরি তার সাথে যাবে কি না! চোখ তুলে মৌরি কে দেখার চেষ্টা করে। সে মৌরি কে হাসতে দেখে অথবা কিছুই দেখতে পায় না। হয়ত মৌরি পরম মমতায় তার হাত ধরে আছে অথবা হয়ত সে আসলে বাস্তবতার মুখোশ আঁটা এক ভ্রান্তির মধ্য দিয়ে যাত্রা করছে। সে আশা করে যে মৌরি তাকে মুক্ত বাতাসে নিয়ে যাবে কিন্তু চারপাশে অসংখ্য ধূসররঙা পেঁজা তুলোর মত মেঘের স্পর্শ অনুভব করে যারা তাকে মৌরির কাছ থেকে আড়াল করে রেখেছে। সে দু'হাতে মেঘ গুলো সরাতে থাকে, সরাতে থাকে।এক সময় হয়ত সব মেঘ সরে গেলে মৌরিকে দেখতে পাবে!
সুমগ্নের এক বন্ধু মৌরি কে ফোন করে জানায় যে সে সুমগ্ন কে হাসপাতালে দেখতে যাচ্ছে আর চাইলে মৌরিও তার সাথে যেতে পারে যেহেতু জীবিত সুমগ্ন কে এটাই হবে শেষ দেখা কারণ তার মধ্যবিত্ত পরিবার আর্থিক অসঙ্গতি হেতু বুকে পাষাণ বেঁধে দীর্ঘ সাত মাসেও সুমগ্নের কোমা থেকে ফিরে আসার কোনরকম সম্ভাবনা দেখতে না পেয়ে আর কৃত্রিমভাবে বাঁচিয়ে রাখতে চাচ্ছে না কিন্তু মৌরি জানিয়ে দেয় যে সে যাবে না।মৌরির হয়তো যাওয়ার ইচ্ছা হয় কারণ এতে অন্তত সুমগ্নের বন্ধুরা তাকে আর অতটা পাষাণ ভাবতে পারতো না কিন্তু সে একহাতে ফোনসেট আর অন্যহাতে লিপিস্টিক নামিয়ে রাখে। কারণ মৌরির হঠাৎ মনে পড়ে যে ড্রয়িঙ রুমে বসে থাকা মানুষটা, যে হপ্তাখানেক পরে তার স্বামী হতে যাচ্ছে আর এখন তাকে লঙড্রাইভে নিয়ে যেতে বসে আছে, সে লিপিস্টিকের গন্ধ সহ্য করতে পারে না।
মৌরি মানুষটার দুষ্টুমির কথা ভেবে লজ্জিত হয়ে উঠে।সে আড়চোখে আয়নায় তাকিয়ে দেখতে পায় যে প্রচন্ড সুখী একজোড়া চোখ আয়নার ভেতর থেকে তাকিয়ে আছে।
===========================================
উৎসর্গ: সমুদ্রকন্যা'পু ও রাজসোহানের মত ব্লগারদের যারা হ্যাপি এন্ড পছন্দ করেন।
===========================================
ছবি :খোমাখাতার বন্ধুপাতা হইতে টুকলিফায়েড।
===========================================
৩০টি মন্তব্য ১০টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
চাঁদগাজীর মত শিম্পাঞ্জিদের পোস্টে আটকে থাকবেন নাকি মাথাটা খাটাবেন?

আমাদের ব্রেইন বা মস্তিষ্ক কিভাবে কাজ করে লেখাটি সে বিষয়ে। এখানে এক শিম্পাঞ্জির কথা উদাহরণ হিসেবে টেনেছি মাত্র।
ধরুন ব্লগে ঢুকে আপনি দেখলেন, আপনার পোস্টে মন্তব্যকারীর নামের মধ্যে "জেন একাত্তর" ওরফে... ...বাকিটুকু পড়ুন
ধর্মীয় উগ্রবাদ ও জঙ্গী সৃষ্টি দিল্লী থেকে।

((গত ১১ ডিসেম্বর ধর্মীয় উগ্রবাদ ও জঙ্গী সৃষ্টির ইতিবৃত্ত ১ শিরোনামে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম। সেটা নাকি ব্লগ রুলসের ধারা ৩ঘ. violation হয়েছে। ধারা ৩ঘ. এ বলা আছে "যেকোন ধরণের... ...বাকিটুকু পড়ুন
=আকাশে তাকিয়ে ডাকি আল্লাহকে=

জীবনে দুঃখ... আসলে নেমে
শান্তি গেলে থেমে;
আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে হই উর্ধ্বমুখী,
আল্লাহকে বলি সব খুলে, কমে যায় কষ্টের ঝুঁকি।
আমি আল্লাহকে বলি আকাশে চেয়ে,
জীবন নাজেহাল প্রভু দুনিয়ায় কিঞ্চিত কষ্ট পেয়ে;
দূর করে দাও সব... ...বাকিটুকু পড়ুন
আমাদের হাদিকে গুলি করা, আর আওয়ামী শুয়োরদের উল্লাস। আমাদের ভুল কোথায়?


৩০ জনের একটা হিটলিস্ট দেখলাম। সেখানে আমার ও আমার স্নেহের-পরিচিত অনেকের নাম আছে। খুব বিশ্বাস করেছি তা না, আবার খুব অবিশ্বাস করারও সুযোগ নাই। এটাই আমার প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন
এ যুগের বুদ্ধিজীবীরা !

ডিসেম্বর মাসের চৌদ্দ তারিখ বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবী দিবস পালন করা হয়। পাকিস্তান মিলিটারী ও তাদের সহযোগীরা মিলে ঘর থেকে ডেকে নিয়ে হত্যা করেন লেখক, ডাক্তার, চিকিৎসক সহ নানান পেশার বাংলাদেশপন্থী বুদ্ধিজীবীদের!... ...বাকিটুকু পড়ুন

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।