somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আকবর হোসেনঃ নিজ নামে গড়ে তুলেছিলেন মুক্তিবাহিনী>> অকুতোভয় এক মুক্তিসেনার অসামান্য বীরত্বের কাহিনী

১৬ ই ডিসেম্বর, ২০০৯ রাত ১২:৫৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আকবর হোসেন। খুব সাদাসিধে একজন মানুষ। লেখাপড়া মাত্র ম্যাট্রিক পর্যন্ত। কয়েকবছর ট্রেনিং ইন্সট্রাক্টর হিসাবে কাজ করেছিলেন পাকিস্থান বিমান বাহিনীতে। এই মামূলী প্রোফাইলের মানুষটি রীতিমত কিংবদন্তী সৃষ্টি করেন ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে। নিজ নামে গঠন করেন মুক্তিবাহিনী। এই বাহিনী দেশের অভ্যন্তরে অবস্থান নিয়ে যুদ্ধের প্রায় পুরোটা সময়জুড়ে মুক্ত করে রাখে একটা বিস্তীর্ণ অঞ্চল।
ঝিনাইদহের গাড়াগঞ্জ থেকে রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে বিস্তৃত ছিল এই বাহিনীর যুদ্ধসীমা। সেক্টরগুলোর বাইরে এই রকম মাত্র চারটি বাহিনীকে প্রবাসী সরকার স্বীকৃতি দেয়। ‘আকবর বাহিনী’-তে যোগ দেয় সামরিক বাহিনীর ১২৭ জন সদস্য। দুই হাজারের অধিক মুক্তিযোদ্ধা এই বাহিনীর হয়ে যুদ্ধ করেছেন। ডিসেম্বরের ৭ তারিখে মিত্র বাহিনীর সহযোগিতা ছাড়াই দেশের প্রথম জেলা হিসাবে (তৎকালীন মহকুমা)মাগুরাকে মুক্ত করেন। যদিও দাবী করা হয় যে যশোর হলো দেশের প্রথম মুক্ত জেলা। কিন্তু দেশের জেলার সংখ্যা ৬৪ ধরলে মাগুরাই প্রথম মুক্ত জেলা।
সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় এই বাহিনী কোন রাজনৈতিক বা সামরিক পরিকল্পনা অনুযায়ী তৈরী হয়নি। এই বাহিনী প্রধান যুদ্ধের জন্যে কোন নির্দেশ বা ভাষনের অপেক্ষা করেননি। এমনকি আকবর হোসেন যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে একবারের জন্যেও এলাকা ত্যাগ করেননি।

এই বাহিনী স্বল্প সময়ের ব্যবধানে দুইবার শ্রীপুর থানা দখল করে। প্রথমবার ৩৪টি ও দ্বিতীয়বার ৪৪টি অস্ত্র উদ্ধার করে। পরবর্তীতে এই বাহিনীর ভয়ে শ্রীপুর থানা নাকোলে স্থানান্তরিত হয়। কিন্তু তৃতীয়বারের হামলায় তারা নাকোল থানাও দখল করেন। প্রথমবার থানা দখল করতে এই বাহিনী অভিনব কৌশলের আশ্রয় নেয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী নিরস্ত্র তিন/চারশত লোকের একটা দল একদিন ভোরে একযোগে থানা ভবনে উঠে পড়ে। ঘটনার আকস্মিকতায় বিহ্বল পুলিশ সদস্যরা বিনা প্রতিরোধে তাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে। পাশ্ববর্তী ঝিনাইদহ জেলার শৈলকূপা থানা ও রাজবাড়ী জেলার পাংশা ও বালিয়াকান্দি থানা দখল করে এই বাহিনী।
রাতের বেলা এই বাহিনীর একটি অংশ ঢাকা-খুলনা সড়কের পাশে গুপ্ত অবস্থান নিত। এই অংশটি একটি মিলিটারি জীপে এ্যম্বুশ করে একবার পাক বাহিনীর একজন কর্নেলকে হত্যা করে।
শুধু পাকিস্থানী বাহিনী নয়, রাজাকারদের সাথেও বড় বড় বেশ কয়েকটি যুদ্ধে অংশ নিয়েছে এই বাহিনী। রাজাকাররা কেবল পাক বাহিনীকে যুদ্ধে সহযোগিতা দিত; এই ধারনাটি একেবারেই ভুল। তারা সশস্ত্র যুদ্ধে অংশ নিয়েছে। আকবর বাহিনীকে শায়েস্তা করতে ১০০ সদস্যের একটি সশস্ত্র ও প্রশিক্ষিত রাজাকারের দল মাগুরা থেকে শ্রীপুর অভিমূখে রওনা করলে পথিমধ্যে আকবর বাহিনীর সাথে যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে ২৭জন রাজাকার ঘটনাস্থলে নিহত হয়। ১১জন ধরা পড়ে এবং বাকীরা পালিয়ে যায়।

রাজবাড়ীর রামদিয়াতে রাজাকারদের সাথে এই বাহিনীর যুদ্ধ হয়। ঝিনাইদহের কামান্না, কালীগঞ্জ, রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দি, পাংশায় যুদ্ধ করেছে এই বাহিনী। যখনই যুদ্ধের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়েছে তখনই পাশ্ববর্তী জেলাগুলোতে যেয়ে যুদ্ধ করে ফিরে এসেছে এই বাহিনী। ফলে এই বাহিনী পাক বাহিনীর কাছে একটি আতঙ্কে পরিণত হয়। এলাকার শান্তি শৃংখলা বজায় রাখতে চোর-ডাকাতও মোকাবেলা করতে হয়েছে এই বাহিনীকে। রাজাকাররা তুলে এনেছে এমন একজন সুন্দরী নারীকে মুক্ত করে নিজের মেয়ে স্বীকৃতি দিয়ে মেয়েটির বিয়ের ব্যবস্থা করেছেন বাহিনী প্রধান আকবর হোসেন। এবং যুদ্ধের সেই প্রাণঘাতী সময়ে দুই হাজার কন্যাযাত্রী সহযোগে অনুষ্ঠান করে বিয়ে সম্পন্ন করেছে এই বাহিনী।

৭ ডিসেম্বর ২০০৯ মাগুরা মুক্ত দিবসে বক্তব্য দিচ্ছেন আকবর হোসেন
==========================================
ডেপুটি চীফ অব স্টাফের চিঠিঃ

==========================================
ডেপুটি চীফ অব স্টাফের নির্দেশে ৮নং সেক্টর কমান্ডার যে চিঠির মাধ্যমে আকবর বাহিনীকে সরকারী স্বীকৃতি দেন।


সনদ পত্র
জনাব আকবর হোসেন মিয়া, পিতা গোলাম কাদের মিয়া, গ্রামঃ টুপিপাড়া থানাঃ শ্রীপুর জিলাঃ যশোহর।
আপনার ও আপনার বাহিনীর উদ্যম, উৎসাহ ও বীরোচিত কার্য কলাপের পরিচয় পেয়ে আমি সানন্দে আপনার বাহিনীকে বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর অনুমোদিত শাখা বলে সনদ দান করলাম।
আজ থেকে মুক্তিবাহিনীর রেকর্ডে ও অত্র এলাকায় আপনার বাহিনী “শ্রীপুর বাহিনী” নামে পরিচিত হবে। আপনাকে উক্ত বাহিনীর অধিনায়কের পদে প্রতিষ্ঠিত করা হল।
আপনি ও আপনার বাহিনী প্রতিটি মুক্তি সংগ্রামীর সাথে সহযোগিতা করবেন। মুক্তি বাহিনীর হাই কমান্ডের পক্ষ থেকে আমার দ্বারা যে সকল কমান্ডার নিযুক্ত হবেন তাদের সাথে একযোগে আপনারা কাজ করবেন।

জয় বাংলা
মো. আবুল মঞ্জুর
সেনা নায়ক
বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনী
দক্ষিন-পশ্চিম অঞ্চল
==========================================
যুদ্ধের সময় তোফায়েল আহমেদের লেখা একটা চিঠিঃ
আকবর ভাই,
আপনি দেশের জন্য যে অবদান রেখে যাচ্ছেন তা অতুলনীয়। মুজিব বাহিনীর ছেলেদেরকে আপনার অধীনে রাখবেন এবং আপনাকে থানা প্রধান হিসেবে কাজ করে যাবার জন্য ছেলেদের নির্দেশ দিয়েছি।
তোফায়েল আহমদ

==========================================
সাব-সেক্টর কমান্ডারের মূল্যায়ন


“আকবর হোসেন মাগুরার সিংহপুরুষ ও শ্রেষ্ঠ মুক্তিযোদ্ধা। দূঃখজনক হলেও সত্যি, তিনি মুক্তিযুদ্ধে কোন খেতাব পাননি।কমপক্ষে তারবীরত্বের জন্য তিনি বীর উত্তম খেতাব পাওয়ার যোগ্য ছিলেন”।

মেজর জেনারেল (একাত্তরে ক্যাপ্টেন)এটিএম আব্দুল ওয়াহ্হাব (অবঃ)
সাব-সেক্টর কমান্ডার
৮ নং সেক্টর
==========================================
চ্যানেল আইয়ে প্রচারিত আকবর হোসেনের সাক্ষাতকারের অংশবিশেষ ইউটিউবে
========================================== আকবর হোসেনের একান্ত সাক্ষাতকার
==========================================
দৈনিক সমকালে প্রকাশিত আকবর হোসেনের একটি লেখা।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই মার্চ, ২০১০ রাত ৯:২৭
১৫৯টি মন্তব্য ১৫৭টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। মুক্তিযোদ্ধা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১



মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি রয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে যাচাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় রাজাকাররা বাংলাদেশর উৎসব গুলোকে সনাতানাইজেশনের চেষ্টা করছে কেন?

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৪৯



সম্প্রতি প্রতিবছর ঈদ, ১লা বৈশাখ, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, শহীদ দিবস এলে জঙ্গি রাজাকাররা হাউকাউ করে কেন? শিরোনামে মোহাম্মদ গোফরানের একটি লেখা চোখে পড়েছে, যে পোস্টে তিনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি করাটা প্রফেসরদেরই ভালো মানায়

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৩


অত্র অঞ্চলে প্রতিটা সিভিতে আপনারা একটা কথা লেখা দেখবেন, যে আবেদনকারী ব্যক্তির বিশেষ গুণ হলো “সততা ও কঠোর পরিশ্রম”। এর মানে তারা বুঝাতে চায় যে তারা টাকা পয়সা চুরি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঘুষের ধর্ম নাই

লিখেছেন প্রামানিক, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫৫


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

মুসলমানে শুকর খায় না
হিন্দু খায় না গাই
সবাই মিলেই সুদ, ঘুষ খায়
সেথায় বিভেদ নাই।

হিন্দু বলে জয় শ্র্রীরাম
মুসলিম আল্লাহ রসুল
হারাম খেয়েই ধর্ম করে
অন্যের ধরে ভুল।

পানি বললে জাত থাকে না
ঘুষ... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরান-ইজরায়েল দ্বৈরথঃ পানি কতোদূর গড়াবে??

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:২৬



সারা বিশ্বের খবরাখবর যারা রাখে, তাদের সবাই মোটামুটি জানে যে গত পহেলা এপ্রিল ইজরায়েল ইরানকে ''এপ্রিল ফুল'' দিবসের উপহার দেয়ার নিমিত্তে সিরিয়ায় অবস্থিত ইরানের কনস্যুলেট ভবনে বিমান হামলা চালায়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×