somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্পঃ হাইফেন ( পর্ব- তিন)

০৪ ঠা জুন, ২০১৬ রাত ২:২৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

৩.
‘হাইফেন’ চিহ্নটি কি আস্তে আস্তে বাংলাভাষা থেকে উঠে যাবে?

কথাটি ভাবায় ফিরোজকে। আকারে ‘ড্যাশ’-এর থেকে প্রায় তিনভাগের একভাগ। ছোট্ট এ যতি চিহ্নটি কেবল আমাদের বাংলাভাষাতেই যে আছে, তা কিন্তু নয়। প্রাচীনকাল থেকেই ইংরেজি ভাষাতেও প্রায় ষোল হাজার শব্দে হাইফেন ব্যবহৃত হয়ে আসছে। অথচ তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে তা আর টিকছে না। অক্সফোর্ড অভিধানের ক্ষুদে সংস্করণে ঐ সবের বালাই-ই থাকছে না। অনলাইনে এই খবরটি পড়ে ফিরোজের মন খারাপ হয়ে যায়। আমাদের ভাষা থেকেও ধীরে ধীরে তা বিলীন হয়ে যাচ্ছে। শব্দের মাঝে এই জিনিস নাকি মানুষজনের মনে অস্বস্তির বোধ জন্মায়। আশ্চর্য! সমাজের সাথে সাথে ভাষাও বদলে যায়, এটা সবাই মানে।সেটাই স্বাভাবিক। তবু ঐ ক্ষুদ্র বিরাম চিহ্নটির প্রতি কী কারণে যেন ওর বেশ মায়া কাজ করে। কেন করে? আমাদের অনুভূতির মাত্রা যে কোথায় কোন মন-গলিতে ধেয়ে বেড়ায় তা বলা মুশকিল। এই যেমন ‘হাইফেন’ বিষয়ক এই ব্যথা নিয়ে কারো না কারো সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু কার সাথে বলবে? দেশে থাকলে সে নিশ্চয়ই ইমরানকে ফোন করে বসতো। সে হয়তো তাকে খোঁচা মেরে বলতো, বুঝছি তোমার হালায় মালের নেশা চাপছে। তা আইসা পড় না কেন দোস্ত? আমার কাছে এখনো একটা টাটকা জিনিস আছে। শামসু গত সপ্তাহে সিঙ্গাপুর থাইকা আনছে। এখনো খুলি নাই। আসো এক সাথে মিইল্লা সেলিব্রেট করি।
- এতো রাতে!
- ধুর, ব্যাডা, এইটা কোন রাইত হইলো নাকি? তুমি মামা গৃহপালিত লেখক। হা হা হা।
- এটা কেন বলছিস?
- কারণ আছে। তুই সবসময় তোর চাইর পাশে একটা সফিস্টিকেশনের ওড়না পইরা থাকস। এইটা একটা আপদ। গলার ফাঁসের মতোই লাগে।
- কি যে বলিস না তুই, ইমরান!
- ঠিকই কই দোস্ত, এই যে নৃ-বিজ্ঞান নিয়া বড় বড় পুস্তিকা সাবাড় কইরা দ্যাস, তুই কি পারবি নৃ-গোষ্ঠীরই কারো লগে শুইতে? এক হাত কাপড় পইরা পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুইরা বেড়াইতে?

ইমরান তাকে প্রায়ই এই কথাগুলো বলে ভাজার চেষ্টা করে। সে গা করে না তেমন। সে এবার সাহিত্য পুরষ্কার পেয়েছে। ফিরোজের নামও শোনা যাচ্ছিলো বেশ। তবে সে পায়নি। তা নিয়ে ওর তেমন আক্ষেপও নেই। ও হবে কখনো। তবে এটা সে নিজের মনেই শিকার করে, ইমরান তার থেকে অনেক জনপ্রিয়। আর তাছাড়া ওর মাঝে একটা বেপরোয়া ভাবও রয়েছে। এই শক্তিটার প্রতিই তার একধরণের সূক্ষ্ম ঈর্ষা কাজ করে, ওর লেখার প্রতি নয়। ওদের দুজনের লেখার ধরণ এবং উপজীব্য একদমই আলাদা। কিন্তু এখন কাকে বলবে আর এই সদ্য-অনুভূত বোধের কথা? দীপ্তিকে? মাথা খারাপ? শেষে না আবার কোন তির্যক কথা শুনতে হয় তাকে। ইদানীং তো তাদের মাঝে স্বাভাবিক কথাবার্তা হয় না বললেই চলে। অথচ একটা সময় গিয়েছে, যখন কথা যেন ফুরাতোই না। দীপ্তি ওকে বলতো, ‘উইজার্ড অফ ওয়ার্ডস’ - শব্দের যাদুকর। কি অপূর্ব প্রশংসা বাক্য। অথচ এখন ওদের কথাই যেন শত্রু বনে যাচ্ছে। সেসব কথা ভেবে ফিরোজ একটা লম্বা নিঃশ্বাস ছাড়ে। ওর কি খানিকটা মন খারাপ হল? মন খারাপ! ফু’। মোটেই না। কী সব ভাবছে সে!

আজ ধীমানের গ্রেজুয়েশন পার্টিটা হল না। সাধারণত সমাবর্তনের দিন বিকেলেই হয় এ ধরণের পার্টি। নাহিয়া আর ধীমান একসাথে তা উদযাপন করবে- সেটাই ওদের পরিকল্পনা। ফিরোজের ছোটো ভাই নওরোজ অরিগন থেকে এসে পৌঁছেছে বিকেল বেলায়। সেও একই হোটেলে উঠেছে। একাই এসেছে, বউকে আনে নি। এসেই বলে, নর্থ ক্যারলাইনার ওয়েদারের কোন তুলনা হয় না, দাদা। কেমন ঝলমলে রোদ্দুর। খুব একটা গরম নেই। আমাদের অরিগনে তো সবসময় বৃষ্টি লেগেই আছে। মাঝে মাঝে ভাবি এদিককার কোথাও মুভ করবো। কিন্তু শেষে গিয়ে আর হয়ে ওঠে না। বুঝি বয়স হয়ে যাচ্ছে। নাড়াচাড়া করতে ইচ্ছে করে না আজকাল।

দীপ্তির মেঝভাই অবশ্য বউবাচ্চা নিয়েই এসেছে। ওরা তো তেমন একটা দূরে থাকে না। মেরিল্যান্ড থেকে ড্রাইভ করেই এসেছে। কাছেই একটা হোটেলে আছে। সবাই একসাথে ডিনার করলো। মেলাক্ষণ বসে গল্প করে। রেস্টুরেন্টে বসে নওরোজ একটা কাণ্ড করলো । কথা নেই বার্তা নেই হুট করে ‘পুরনো সেই দিনের কথা’ গাইতে শুরু করে দিলো। কোন একজন এসে আবার ধীমানের হাতে একটা একুস্টিক গিটার ধরিয়ে দেয়। সে অনায়েশে বাজিয়ে চলে। দীপ্তি আজ সন্ধ্যায় তার ঝিম ধরানো সেই গলা নামিয়ে এনেছিল। অনেকদিন পর ওর গান শুনল ফিরোজ। ওদের সাথে আর সবাই যোগ দেয়। গান শেষে চারপাশে তালি আর হর্ষধ্বনি শুনতে পায়। অথচ এঁদের কেউই একবিন্দু বাংলা জানে না। তবে কি সুরের আলাদা কোন যাদু আছে? যা অন্যকেও ছুয়ে যায়? হবে হয়তো-কে জানে। যখন হোটেলের রুমে ফেরে তখন বেশ রাত হয়ে গেছে।

এটা একটা ডিলাক্স হানিমুন সুইট। পাশাপাশি দুটো ঢাউস ঘর, লিভিং স্পেস, আর্টিফিশিয়াল ফায়ার প্লেস, পঞ্চান্ন ইঞ্চি ফ্ল্যাট স্ক্রিন চকচকে এলইডি টিভি। রাজ্যের ড্রিঙ্কে ফ্রিজ একেবারে ঠাসা । এটা ধীমানেরই কাণ্ড। ওদের সবাই মজুদ থাকলেও নাহিয়ার কোন এক আত্মীয় নাকি এসে পৌঁছে নি। তাই সেলিব্রেশনের এই বিলম্ব। তাতে অবশ্য ওদের তেমন সমস্যা নেই। আজ না হয়ে কাল কিম্বা পরশু হলে পৃথিবীর কারো কোন ক্ষতি হবে না। আমাদের পরিপার্শ্ব আমাদের সহনশীল হতে শেখায়। নাহিয়ার বাবা-মা কিন্তু ঠিকই এসেছেন। সকালের ইভেন্টে তো কথাও হল। চমৎকার মানুষ ওরা। নাহিয়ার মা দীপ্তির সাথে এমন ভাবে কথা বলল যেন দুইজন কতদিনের চেনা! মেয়েরা কতো জলদি মিশে যেতে পারে। শিশুরাও পারে তা। তবে কি শিশু আর নারীর সরলতা একই মাত্রায় চলে? - ফিরোজ ভেবেছিলো।

সোমবার ওরা সবাই মিলে যাবে 'নান্তাহ্যালা হোয়াইট ওয়াটার র‍্যাফটিং'-এ। আঠারো জনের একটা বিশাল কটেজ ভাড়া করা হয়েছে। সবাই মিলে ওখানেই হবে মচ্ছব। ওখানেই রান্না, তারপর খাওয়া। প্রকৃতির কাছাকাছি পারিবারিক নিবিড়তায় কিছুটা সময় কাটাতে চায় ওরা। দুটো পরিবারের একে অপরকে জানার এর চেয়ে ভালো উপায় আর কিই বা হতে পারে? একেবারে নিপুণ কর্ম-পরিকল্পনা। ফিরোজের ভেবে বেশ অবাক লাগে, এই সেদিনের বাচ্চা ছেলেটা কি করে অমন সুশীল হয়ে উঠেছে! সে কি ওর মায়ের জীনের প্রভাব? নাকি নাহিয়াই এতে আলাদা ভূমিকা রেখেছে? এই জায়গায় এসে ওর ভাবনাটা একটু হোঁচট খায়। আচ্ছা, সব ভালোর উপযোগ কি অন্যরা, তার কি কিছুই নেই সেখানে? ভাবনাটাকে আর বাড়তে দেয় না সে। নাহিয়ার কথা ভাবে।

ওরা লাক্ষনৌ-এর মানুষ। গোমতী নদীর পাশেই নিশাতগঞ্জে ওদের পৈত্রিক বাড়ি। ওর পরিবার মূলত ডিস্টিলারি কেমিক্যালের ব্যবসা করে। তবে ইদানীং ওরা মূল্যবান পাথর রপ্তানিতেও বিনিয়োগ করছে। সে বাণিজ্যের রমরমা অবস্থার কারণে মুনাফার উদ্বৃত্ত ওরা আইটি সেক্টরে ঢালছে। তথ্যপ্রযুক্তির ক্রম বর্ধমান ব্যাপ্তি ওদের কারবারেও প্রসার ঘটাচ্ছে- এটা নিশ্চিত। শুধু এটুকু শুনেই বলে দেওয়া যায়, নাহিয়ার পরিবার অত্যন্ত ধনাঢ্য। নাহিয়াই ওদের পরিবারের প্রথম মেয়ে যে কিনা একা একা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পড়তে এসেছে। ওদের পরিবার আরও বেশি খুশি দুটো কারণে। একটি হল, নাহিয়া কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ে পূর্ণ স্কলারশিপ পেয়েছে। সে ওখানে যাচ্ছে তার স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিতে। তার ইচ্ছে পরবর্তীতে পিএইচডি প্রোগ্রামও শেষ করার। ‘বৃহৎ অর্থনীতির দেশগুলোর অর্থনৈতিক উৎকর্ষের প্রধান শক্তি বৃহৎ জনশক্তির দেশের সাথে সহাবস্থান’ - এই বিষয়ের উপর পড়াশোনা করা। দ্বিতীয় আনন্দের কারণ হল, নাহিয়া যে ছেলেটিকে তার চলার সাথী হিসেবে বেছে নিয়েছে, সে মোটেই অ্যামেরিকান নয়। ও দিককারই একজন এবং সে মুসলমান।

ঠিক এখানে এসে ফিরোজের ভাবনাটা বিগড়ে যায়। সম্পর্কের ক্ষেত্রে এই ব্যাপারটা সে মেনে নিতে পারে না। মানুষ কাছে আসবে তার ভালো লাগা, মূল্যবোধ কিম্বা আনন্দের কারণ দেখে। সেখানে ধর্মের অবস্থানটা কতো টুকু? এটাও ভাবে, ধীমান-নাহিয়া হয়তো এমনিতেই কাছে এসেছে। ওদের মাঝে ও সব কাজ করে নি। তবে আনন্দের বিষয় হল, নাহিয়া একটি বিশেষ দেশের নয়। আর যাই মেনে সেদেশের কাউকে নিজ পরিবারে আনা যায় না। সেটা কি ব্রিটিশদের বেলাতেও খানিকটা খাটে না?- সে ভাবে। ওর চাচাতো ভাই আরমান একজন স্কটিশ মেয়েকে বিয়ে করেছিলো। যদিও স্কটিশ আর ব্রিটিশদের মাঝে বিস্তর ফারাক। একে ওপরের চোখের বালি। অনেকটা আমাদের দেশের নোয়াখালী- চট্টগ্রামের মানুষের সম্পর্কের মতোই। তবুও আরমান ধীরে ধীরে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। পরস্পর জেনেছে সে এখন একা একাই থাকে। ওর স্কটিশ বউ অনেক আগেই ছেড়ে গেছে তাকে। ওদের একটি মেয়েও আছে। দোষ আরমানেরই বেশি, ওর যকৃতে সমস্যা ধরা পড়েছে। অনিয়মই তার মূল কারণ। তবু ওদের বলয়ে আর ফেরা হয়নি তার। ওদের পরিবারের একটা গল্পও আছে।

ওর বাবা-চাচা দুই ভাই-ই বাহান্নর ভাষা আন্দোলনে ছিলেন। ময়েজ-ফয়েজ দুই রহমান পথেই সক্রিয় ছিলেন বেশি। পুলিশের গুলিতে ওর চাচা ময়েজুর রহমান খোঁড়া হয়ে যান। সে পা নিয়েই তিনি বাংলাদেশ উত্থানের সব আন্দোলনে ছিলেন। তাজউদ্দীন সাহেব ঢাকার একটি বিশেষ জায়গায় তাঁর সাইকেলের কাজ করাতেন। ময়েজ চাচা প্রায়ই ওখানে গিয়ে তাঁর সাথে দেখা করতেন। ওখানকার একটা টুলে বসা অবস্থায় একটা ছবিও আছে। মলিন সে ছবি তাদের পরিবারের ঐশ্বর্য হয়ে আজও দেয়ালে ঝুলছে। সেই তাজউদ্দীন সাহেবই যখন ডেকে পাঠালেন, খুড়িয়ে খুড়িয়েই তিনি মুক্তিযুদ্ধে চলে গেলেন। ঢাকা থেকে কোলকাতা যাবার পথটা তখন নেহাতই কম বিপদসংকুল ছিল না। শারীরিক অমন প্রতিকূলতা থাকা সত্যেও তিনি থামেননি। ভিতর ভিতর অদম্য দেশপ্রেম না থাকলে তা সম্ভব হতো না। পুরো পরিবারকে গ্রামের বাড়ি পাঠিয়ে দু-ভাই চলে গেলেন যুদ্ধে। ফিরোজের বয়স তখন নয় আর নওরোজের ছয়।
ফিরে এসে ছোটো ভাই হয়েও ওর বাবা, ফয়েজুর রহমান, ধরলেন পরিবারের হাল। চাকরির দিকে গেলেন না তিনি। শুরু করলেন ব্যবসা। যুদ্ধের পর শেখ মুজিবের মন্ত্রিসভায় থাকার সম্ভাবনা থাকলেও চাচা বিনয়ের সাথে তা এড়িয়ে গেলেন। তাজউদ্দীনের বিশেষ পছন্দের লোক ছিলেন তিনি। তাঁরই পীড়াপীড়িতেই বিয়াল্লিশ বছর বয়সে বিয়েও করেন। আরমান বয়সে ফিরোজের প্রায় বারো বছরের ছোটো। পচাত্তুরের ডিসেম্বরে ময়েজ চাচা চলে যান লন্ডনে। আর ফেরেন নি।

উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফলের পর ফিরোজকে তার বাবা জিজ্ঞেস করেছিলেন, কি পড়বি রে ব্যাটা? সব জায়গাতেই তো চান্স পাবি?
- আমি অ্যানথ্রপলজি পড়তে চাই, আব্বা। আর লেখক হতে চাই।
বাবা বকেন নি তাকে। সংগ্রামী বাবাও সেদিন বলেছিলেন, তাতে কি তোর সংসার চলবে? ভাত জুটবে কপালে? তার চেয়ে বরং এমন কিছু কর যাতে পকেটে দুপয়সা আসে। ইঞ্জিনিয়ারিং কর গে যা।
বুয়েটে পড়েছে ঠিকই কিন্তু ওর মন সবসময় পড়ে থাকতো শূন্য দিগন্তে। হাওয়ার গেরো দিতে দিতেই তার বেলা যেতো। বাস্তুবিদ্যার কোন কৌশলই সে ঠিক মতো ধরতে পারতো না।তার উপর এরশাদ সরকারের ঠেঙানিতে ঢাকা ছাড়া। কদিন বন্ধুর বাড়ি চিটাগাঙে আত্মগোপন। সেখানেই দীপ্তির সাথে পরিচয়। আর তাতেই তখনকার বিকেল গুলোকে মোটেই অবসন্ন মনে হতো না তার। সোলসের ‘ফরেস্ট হিলে’ গানটা তখন খুব শুনত সে । সময়টা অন্যরকম ছিল। দীপ্তির দাদা সূর্য সেনের ‘অনুশীলন সমিতি’র একজন পাণ্ডা ছিলেন। এ ব্যাপারটিও তাকে পরিনতির দিকে ধাবিত করেছিলো। তারপর কোন মতে পাশ করে রোডস এন্ড হাই ওয়েজের চাকরি নিয়ে সোজা হালি শহর। ওদের ছোট্ট সংসার। ধীমান চলে এলো চট করে। দুজন মানুষের মাঝে সে হয়ে গেল যেন যোগসূত্র, ‘হাইফেন’।

দীপ্তির এফসিপিএস পরীক্ষা দেবার দরকার হয়ে পড়লো। গাট্টি বোঁচকা বেঁধে আবার ঢাকায়। ঢাকায় ফিরেই যে কাজটি ফিরোজ করেছিলো, চাকরি ছেড়ে কনসালটেন্সি আর ডিজাইনিং-এর কাজ শুরু করে দেয়। পাশপাশি লেখালিখি। শব্দের পাখি অভিমান করে নি। বরং মেলে দিয়েছিলো তার স্বপ্নের ডানা। দীপ্তির একের পর এক পরীক্ষায় পাশ। এমডি, এফসিসি, এফআরসিপি ইত্যাদি ইত্যাদি।ওর কথা শোনার বা বলার মতো ফুরসৎ কই। তারই কি ছিল? শুধু কি কথার অব্যাহতি? শরীরেও কি অমোঘ এক নিয়মে শুষ্কতা এসে যায়নি? মনেও কি এসেছিলো সে অবসাদ? তারই মৌন এক কথোপকথনে দুজন মানুষের মাঝে যোজন যোজন দূরত্ব! হয়তো সে কারণেই কিনা সে খুঁজে নিয়েছে নিকটবর্তী কোন তীর। তাই কি? কে জানে?

তবে সে ধীমানকে মনের মতো করে তৈরি করার চেষ্টা করেছে। বিশেষ করে যে সময়টা দীপ্তি ওর পড়াশোনার জন্য বিদেশে যেতো, তখন। ওদের বাপ-ব্যাটায় নানা ধরণের অ্যাডভেঞ্চার হতো। প্রায়ই ওরা সিলেট কিম্বা চট্টগ্রামে ঘুরতে যেতো। সে চিনিয়েছে কোনটা বাগান বিলাস, কোনটি বকুল। কখন শুক্লপক্ষ কিম্বা কখন কৃষ্ণপক্ষ। ইংরেজি মাধ্যমে পড়েও বাংলাটা ধী শিখেছে দারুণ। উচ্চারণে কোথাও কোন আড় নেই। বানানে ভুল হতো না তেমন। এমনকি শব্দের মাঝে ছোট্ট যে ‘হাইফেন’, তাও বসাতেও ভুলতো না! আবার যখন জেনেছে ফিরোজ ওকে হাইফেন নামে ডাকে, তখন এর যথার্থ প্রয়োগ বিষয়ে আরো সজাগ হয়ে ওঠে। এটা নিয়ে দুজনের মাঝে অনেক মজা হতো। প্রতিটি পরীক্ষায় যখন সে ফার্স্ট হতো মনে মনে সে স্বপ্ন দেখতো। একদিন ধী’ সবচেয়ে ভালো রেজাল্ট করে সবাইকে চমকে দেবে। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে উচ্চশিক্ষা নিয়ে দেশে ফিরবে। তারপর গবেষণার কাজ করবে। কিন্তু সেই ধীমানই যখন ধীরে ধীরে ইনভেস্টমেন্ট ব্যাঙ্কিং-এ ঝুকে পড়ে, সে টের পায় গিঁঠটা আলগা হয়ে যাচ্ছে। ‘গোল্ডম্যান স্যাক্স’-এ ইন্টার্ন করবে সে। তার এবারের অভিসন্দর্ভে সে বলার চেষ্টা করেছে, ‘অর্থনৈতিক মন্দার পরবর্তী সময়ের প্রেক্ষিতে আর্থিক অমৌলিক উপাদান(ফিনান্সিয়াল ডেরিভেটিভস) গুলোকে কিভাবে আরো উদ্ভাবনী কায়দায় কাজে লাগানো যায়, রক্ষনশীল পন্থায় নয় মোটেই’। সে তো আসলে পুঁজিবাদী অ্যামেরিকার অর্থনৈতিক ঊর্ধ্বগতিকেই জোরদার করবে। তারপর হয়তো একদিন ওয়াল-স্ট্রিটেরই কোন এক বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানে পাকাপাকি হয়ে যাবে। খুব সহজেই তখন এই যুক্তিই আলাদা এক শক্ত অভিব্যক্তি পাবে যে ‘বাংলাদেশে কি আর অমন বাজার আছে যাতে কিনা তার এই লব্ধজ্ঞান কাজে লাগানো যাবে?’ বাজার, হ্যাঁ বাজারই তো সব।

ঠিক এই জায়গায় এসে ফিরোজ তার চিন্তার স্রোত থামিয়ে দেয়। কি সব ভাবছে সে? তাহলে ওর নিজের বাবার সাথে তার পার্থক্যটা থাকলো কই? সেও তো তার ভাবনার বীজ ধীমানের মাথায় ঢুকিয়ে দিতে চাইছে। এ রীতিমতো অনাচার। তবে কি আমরা আমাদের বলয় থেকে মুক্ত হতে পারি না? উত্তরাধিকারের সাফল্যে কেন আমরা বারবার নিজের মাত্রা যোগ করতে চাই? কেন নিজের পরিধিতেই সকিছুকে দেখতে চাই? কই দীপ্তির তো সমস্যা হচ্ছে না! সে তো বেজায় খুশি। তারও হওয়া উচিৎ। তা কি হতে পারছে? সে তার মনোযোগ সরিয়ে শোনে দীপ্তি কি করছে। ও ঘরে এই মুহূর্তে সে তার বোন সুপ্তির সাথে কথা বলছে। সুপ্তি সিডনির বাসিন্দা। ফিরোজ শোনে দীপ্তির আনন্দিত কণ্ঠস্বর,
... জানিস না তো ধী কেমন একটা মেয়ের সাথে প্রেম করছে! একদম নায়িকা। সে অবশ্যি বাংলাদেশি না। লাক্ষনৌ-এর। তাতে কি? একটা সম্পর্ক যে গড়ে উঠেছে আমি তাতেই খুশি। আমি ভাবতাম, বাব-মায়ের এমন বেহাল অবস্থা দেখে হয়তো পারিবারিক সম্পর্ক থেকেই ওর আগ্রহ উবে যাবে। নাহিয়া কিন্তু ধী’র চেয়েও ব্রিলিয়ান্ট। কর্নেলে মাস্টার্সের অফার পেয়েছে। ফুল স্কলারশিপ।... না না, ধী এখন কিছুদিন একটা কোম্পানিতে ইন্টার্নশিপ করবে। তারপর দেখবে কি করা যায়। ওরা নিউ-ইয়র্কে মুভ করবে। ... নাহ, ওদের গ্রেজুয়েশন পার্টি আজ হয়নি। ওরা এক সাথে করতে চেয়েছে। মেয়ের এক দাদা নাকি কাল এসে পৌঁছে নি। কি এক ভেজাল হয়েছে। একটু আগে ধী ফোন করে জানালো উনি এসে পৌঁছেছেন। সুতরাং, কাল হবে পার্টিটা। ফিরে এসে জানাবো তোকে, কেমন?...

রহস্যময় প্রকৃতি আমাদের নিয়ে নিরন্তর খেলা করে। আমরা তার কতোটুকুই বা জানি। এ দুজনের কেউই জানে না তাদের জন্য কী অভিজ্ঞতা অপেক্ষা করছে।

(চলবে,পরের পর্বে শেষ)

আগের পর্ব পড়তে:
পর্ব -১ঃ Click This Link
পর্ব -২ঃ Click This Link

পরের পর্ব পরতেঃ
পর্ব-৪। Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই জুন, ২০১৬ রাত ২:৫৩
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আজ রমনায় ঘুড়ির 'কৃষ্ণচূড়া আড্ডা'

লিখেছেন নীলসাধু, ১৮ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:২৬




আজ বিকাল ৪টার পর হতে আমরা ঘুড়ি রা আছি রমনায়, ঢাকা ক্লাবের পর যে রমনার গেট সেটা দিয়ে প্রবেশ করলেই আমাদের পাওয়া যাবে।
নিমন্ত্রণ রইলো সবার।
এলে দেখা... ...বাকিটুকু পড়ুন

আকুতি

লিখেছেন অধীতি, ১৮ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৩০

দেবোলীনা!
হাত রাখো হাতে।
আঙ্গুলে আঙ্গুল ছুঁয়ে বিষাদ নেমে আসুক।
ঝড়াপাতার গন্ধে বসন্ত পাখি ডেকে উঠুক।
বিকেলের কমলা রঙের রোদ তুলে নাও আঁচল জুড়ে।
সন্ধেবেলা শুকতারার সাথে কথা বলো,
অকৃত্রিম আলোয় মেশাও দেহ,
উষ্ণতা ছড়াও কোমল শরীরে,
বহুদিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

ক- এর নুডুলস

লিখেছেন করুণাধারা, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৫২



অনেকেই জানেন, তবু ক এর গল্পটা দিয়ে শুরু করলাম, কারণ আমার আজকের পোস্ট পুরোটাই ক বিষয়ক।


একজন পরীক্ষক এসএসসি পরীক্ষার অংক খাতা দেখতে গিয়ে একটা মোটাসোটা খাতা পেলেন । খুলে দেখলেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

কারবারটা যেমন তেমন : ব্যাপারটা হইলো কি ???

লিখেছেন স্বপ্নের শঙ্খচিল, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০২

কারবারটা যেমন তেমন : ব্যাপারটা হইলো কি ???



আপনারা যারা আখাউড়ার কাছাকাছি বসবাস করে থাকেন
তবে এই কথাটা শুনেও থাকতে পারেন ।
আজকে তেমন একটি বাস্তব ঘটনা বলব !
আমরা সবাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্প্রিং মোল্লার কোরআন পাঠ : সূরা নং - ২ : আল-বাকারা : আয়াত নং - ১

লিখেছেন মরুভূমির জলদস্যু, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:১৬

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
আল্লাহর নামের সাথে যিনি একমাত্র দাতা একমাত্র দয়ালু

২-১ : আলিফ-লাম-মীম


আল-বাকারা (গাভী) সূরাটি কোরআনের দ্বিতীয় এবং বৃহত্তম সূরা। সূরাটি শুরু হয়েছে আলিফ, লাম, মীম হরফ তিনটি দিয়ে।
... ...বাকিটুকু পড়ুন

×