somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

প্রদোষের ধার-গল্প

২৫ শে অক্টোবর, ২০১৮ রাত ৮:০৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

প্রদোষের ধার-গল্প
******************


আমি জীবনে কারো কাছ থেকে ব্যক্তিগতভাবে টাকা ধার করিনি।
এই লাইনটি লিখে একটা ভালো লাগার অনুভূতি কাজ করে। এটাকেই বুঝি বলে “হৃষ্টচিত্তানুভূতি”। ঠিক তার পরপরই ফেঁসে যাওয়া বেলুনের মতো চুপসে যাই। কথাটি একেবারেই সত্যি না। আমি জীবনের বিশেষ বিশেষ মুহূর্তে বিরাট বিরাট অঙ্কের টাকা ধার করেছি। আর তা ব্যক্তিগত পর্যায়েই করেছি। সেসব ঋণ-কর্মের আগে প্রতিবারই আমি ব্যাপক গবেষণা করেছি। ভেবে বের করার চেষ্টা করেছি কার কাছে টাকা ধার চাওয়া যায়। ধার চাওয়ার আগে অনুভূতি-সিক্ত আমার একেকটি গল্প তাদেরকে আর্দ্র করেছে। বলতে দ্বিধা নেই কখনো ব্যর্থ মনোরথে ফিরতে হয়নি। সেটা আমার গল্প বলার ধরণ নাকি উদ্ভূত পরিস্থিতির বিশ্বাসযোগ্যতা- তা বলা মুশকিল। কার কার থেকে কতো কতো ধার করেছি ( কখনো ক্যাশ কখনো কাইন্ড) সেটা বললে অনেকেই নিশ্চিত অস্বস্তিতে পড়বেন। কারণ এদের অনেকেই সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে আমার সাথে এখনো যুক্ত। তাই তাঁদের নাম এখানে না হয় না-ই বললাম। নাম না বলার পিছনে আরও একটি বিশেষ কারণ যদিও আছে। জনসমক্ষে নাম উচ্চারণে সমস্যা। শেষে না আবার খ্যাতির বিড়ম্বনায় পড়ে যায় সে ব্যক্তিকুল। যে কেউ তাঁদের হাজি মোহাম্মদ মহসিন ঠাওরে বসতে পারে। অনায়েশে এসে হাত পাততে পারে।

আজ অবশ্য কেবল নিজের ঋণ-গাঁথার কথা বলতে বসি নি। বলতে বসেছি, কি করে ‘ধার’ নামক বিষয়টির সাথে আমাদের পরিচয় ঘটলো। ‘আমাদের’ শব্দটি ব্যবহার করছি, কারণ পরিবারের প্রত্যেকেই এর নিরেট কষ্টবোধ থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। বলা যায় এটা আমাদের একটা পারিবারিক ঐতিহ্য।
৭৮-৭৯ সালের কোন এক অপরাহ্ণের কথা। আব্বা অফিস থেকে ফিরেই আবার বেরিয়েছেন। আমার জানা আছে আব্বা তখন দুয়েকটি ছাত্র পড়াতেন। তাই হুট করে তাঁর বাসা থেকে বের হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। আমরা ভাইবোনেরা সন্ধ্যায় যথারীতি পড়তে বসেছি। মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে তেলাওয়াতের কায়দায় আমরা পড়তে থাকি। আব্বা ফিরেন নি তখনো। ক্ষুধা লাগলে আম্মাকে বললাম, আম্মা ক্ষুধা পেয়েছে।
আম্মা বললেন, ভাত চড়িয়েছি। এখনই হয়ে যাবে।
আমরা অপেক্ষা করতে লাগলাম। কিছু পরে আবার বলি, আম্মা ক্ষুধা পেয়েছে।
আম্মার উত্তর, ভাত হচ্ছে।
আমি দেখি উনুনের আলোয় আম্মার মুখ রক্তিম। সেসময় কেরসিনের স্টোভে রান্না হতো আমাদের। গ্যাসের সংযোগ তখনো আসে নি। ভাত রান্না দীর্ঘায়িত হতে থাকে। এবার আমরা ভাইবোনেরা সমস্বরে বললাম, আম্মা ভা-ত?
আমাদের দিকে না তাকিয়ে আম্মা বললেন, ভাত হয়েছে। কিন্তু খাবি কি দিয়ে। বাসায় বাজার বলতে কিছু নেই। তোদের আব্বা বাজার করে আনলে তবেই তরকারি রান্না হবে।
ব্যস, আম্মা তাঁর অমোঘ বানী দিয়ে দিয়েছেন। আমরা বুঝলাম, চিল্লাচিল্লি করে আর লাভ নেই। ক্ষুধার্ত অবস্থায় কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি, টের পাই নি।মাঝ রাতে আম্মার ডাকাডাকিতে ঘুম ভাঙল। দেখি গরম গরম ভাত বাড়া হয়েছে। সাথে ট্যাংরার ঝোল, আলু ভর্তা এবং পটল ভাজি। অনেক আগের রান্না ভাত থেকে কেন তখনো ধোঁয়া উঠছে ঠিক বুঝি নি। অতটা বোঝার মতো ধৈর্য বা বোধ কোনটাই আমাদের তখনো হয়নি। গপাগপ খেয়ে আবার শুয়ে পড়লাম।
বিষয়টির নিগূঢ় রহস্যের ভেদ হয়েছিলো আরও পরে। সে রাতে আম্মা আমাদেরকে ফাঁকি দেবার জন্য জ্বলন্ত স্টোভে খালি খালি পানি ফুটাচ্ছিলেন। সেখানে কোন চাল ছিল না। বাসায় রান্নার মতো একফোঁটা দানাপানি ছিল না। বিষয়টি আব্বাকে আম্মা আগেই জানিয়েছিলেন। কিন্তু আব্বা বেমালুম ভুলে গিয়েছিলেন। কিম্বা হয়তো ভেবেছিলেন, অন্য সময়ের মতোই আম্মা সেবারও কিছু একটা ব্যবস্থা করে নিবেন। সদ্য কিশোরোত্তীর্ণ তরুনী আম্মা আমার সেদিন সেটি পারেননি। তাই জেনে আব্বা বের হয়ে পড়লেন ধারের উদ্দ্যেশে। পরপর দু জায়গায় চেষ্টা করে ব্যর্থ হলেন। ঢাকার তখনকার মধ্যবিত্ত পরিবারের প্রায় সবারই আসলে একই অবস্থা। কারো কাছেই ঠিক উদ্বৃত্ত টাকাপয়সা নেই। কি করবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না। প্রুফ রিডিং- এর টাকাটা পেলেও তো হতো। চিন্তাক্লিষ্ট আব্বা একমনে হাঁটছেন আর ভাবছেন বাসায় ফিরবেন কিনা। কে জানে, এর মাঝেই আম্মা হয়তো কিছু একটা ব্যবস্থা করে ফেলেছেন। কাল সকালে তিনি নাহয় একটা কিছু ব্যবস্থা করবেন। কিন্তু তাঁর মন সায় দেয় নি। একসময় আবিষ্কার করলেন তিনি সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে যেখানে প্রতিদিন ভোরবেলায় হাঁটেন। বৈকালিক হন্টন তাঁর হয়ে ওঠে না। নানা ব্যস্ততায় থাকেন। হঠাৎ শোনেন, হান্নান ভাই আপনি এখন এখানে? আপনি তো কখনোই সন্ধ্যায় হাঁটতে আসেন না! ভালো আছেন তো?
আব্বা দেখেন আনোয়ার সাহেব। ইনি একটি রেশন দোকানের ম্যানেজার। আব্বা আর আনোয়ার সাহেব প্রতিদিন সকালে একসাথে হাঁটেন। তাঁকে কি আর হুট করে বলা যায়, ভাই বাসায় টাকা পয়সা নাই, দানাপানি নাই। এখন বেড়িয়েছি টাকার জোগাড়ে। কোথাও পাই নি। কি করবো ভেবে পাচ্ছি না। তাই এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবছি।
আব্বা সে কথা না বলে উনার সাথে হাঁটতে লাগলেন। হাঁটার এক পর্যায়ে আনোয়ার চাচা ঠিকই কায়দা করে জেনে নিলেন আব্বার সেই সান্ধ্যকালীন আকস্মিক বিচিত্রতার হেতু।
আব্বা ফিরলেন বাজার করে। আনোয়ার চাচা তাঁকে নিয়ে বাজারে গেলেন। নিজেও বাসার জন্য বাজার করলেন, আমাদের জন্যও করলেন। আবার বিদায়ের সময় দু’শ টাকা আব্বার পকেটে গুঁজে দিয়ে বললেন, নিজেকে অতো একা ভাববেন না হান্নান ভাই। কাল সকালে হাঁটার সময় আপনার হাসিমাখা মুখটা দেখতে চাই।
পেট ভর্তি ভাতের কারণেই কিনা জানি না চোখের পাতা আবারও ভারি হয়ে আসে আমার। চোখ বন্ধ করেও শুনতে পাই আব্বা বলছেন, ভাগ্য ভালো আনোয়ার ভাই নিজে গিয়ে বাজারটা করে দিলেন। তা না হলে নির্ঘাত পচা মাছ গছিয়ে দিতো আমাকে। ট্যাংরা মাছগুলো কেমন তেলাল, দেখেছো? বাজারের পাশেই বসিলায় বিকেলের দিকে ওরা মাছ ধরে। সেই মাছই ওরা রায়ের বাজারে সন্ধ্যায় বিক্রি করে। আজ ওখানে না গেলে এ বিষয়ে কিছুই জানতাম না। অনেকদিন এমন সুস্বাদু টাটকা মাছ খাই না। দাও তো, আরও দুটো দাও আমাকে।
এমনটি বহুবার ঘটেছে। প্রায়ই বাসায় টাকা পয়সা থাকতো না। আব্বা-আম্মা নিয়ম করে পরিচিত লোকজনের কাছ থেকে টাকা ধার করতেন। দোকানেও বাকির একটা খাতা খোলা হল। প্রতিদিনই কিছু না কিছু বাকিতে কেনা হয়। মাস শেষে তা আবার চুকিয়েও দেয়া হয়। মজার ব্যাপার হল, এই দোকানিরাই হয়ে যায় আমাদের পরম আত্মীয়ের মতো। ঈদে বা ছোটখাটো অনুষ্ঠানে আমাদের বাসায় তাঁদের দাওয়াত থাকে। এঁদের মাঝে কেউ আবাহনী, কেউ আবার মোহামেডান। চলে তুমুল তর্ক-বিতর্ক। রাজনীতি নিয়ে খুব একটা আলোচনা হতো না তখন। জিয়া সাহেব ততদিনে ‘প্রথম বাংলাদেশ আমার শেষ বাংলাদেশ’ চালু করে দিয়েছেন। অনেক আর্মি অফিসার প্রদোষে ধৃত হয়েছেন, আবার রাতের আঁধারে শেষও হয়ে গেছেন। আমাদের পরিবারের মতো, আমাদের দেশটিও তখন বিবিধ সমস্যায় নুহ্য। নানা কায়দায় ধারদেনা করে চলতে থাকে।
আমাদের পারিবারিক ধার-কল্প বন্ধ হয় না, চলতেই থাকে। কাছে- দূরের সবার কাছেই হাত পাতেন আব্বা-আম্মা। বাদ পড়ে না কেউ। কি করবে, উপায় কি? আব্বার অফিসের প্রভিডেন্ট ফান্ড থেকে প্রায়ই ঋণ নিতে হয়। ১০-১৫ তারিখের মাঝেই বেতনের টাকা হাপিস। প্রুফ-রিডিং আর সম্পাদনার টাকায় কোনমতে মাসের বাকিটুকু কাটাতে আম্মার সে কী প্রাণান্ত চেষ্টা। তাও কি হয়? আম্মার ধার চাওয়ার মানুষের লিস্ট থেকে আমাদের ভাইবোনদের বন্ধুরাও (যারা খানিকটা অবস্থা সম্পন্ন) বাদ যায় নি। একবার বাসা পাল্টাতে হবে। একটা বাড়তি ঘর দরকার। নতুন বাসায় ওঠার জন্য এক মাসের ভাড়ার টাকা অগ্রিম দিতে হবে। কিন্তু সে টাকা আমাদের হাতে নেই। সে টাকা জোগাড় করা হল আমার ছোটো ভাইয়ের এক বন্ধুর কাছ থেকে। আমার বোনের বিয়ের বয়স হল। আম্মা যত না পাত্র সন্ধান নিয়ে চিন্তিত তার চেয়েও বেশি উদ্বিগ্ন তার বিয়ের টাকা জোগাড় করা নিয়ে। শেষে সে টাকা নেওয়া হল আমারই এক বন্ধুর কাছ থেকে। সে বিদেশে থাকে। এমন আরও যে কতো উদাহরণ আছে।
আমার আজকের উদ্দেশ্য অবশ্য ধারের ফর্দ দেয়ার জন্য নয়। বরং, এই কথা বলার জন্য যে তখন আমরা কতো সহজেই একজন আরেকজনের কাছে টাকা-পয়সা ধার চাইতাম। এটা জেনেও যে ধার চাওয়ার মাঝে এক ধরণের লজ্জা রয়েছে, পরাস্ততা রয়েছে। ঠিক সময়ে সে ঋণ শোধ করা যাবে কিনা, নিশ্চিত নই। তবুও হাত পাততে হয়েছে আমাদের। আবার এটাও ভেবে অবাক হই, আমাদেরই কাছের মানুষগুলোও সাধ্যমতো ধার দিয়েছেনও। এটা জেনেও যে ঠিক সময়ে শোধ দেবার মতো অবস্থা আমাদের ছিল না। তবু দিতো। এমনই একটা বিশ্বাসের সময় ছিল তখন।
কেবল আমরাই যে ধারদেনা করতাম ঠিক তা নয়। মাঝে মাঝে আমাদের মতো মানুষের কাছেও কেউ কেউ আসতো টাকা চাইতে। রাজা চাচার সাথে সেই সুবাদেই আমার দেখা। রাজা চাচার গল্পটা এবার একটু বলি।
একদিন বিকেলে বাসার দরজায় টোকা। আমি বাসার বড় সন্তান। আব্বা বাসায় না থাকলে আমাকেই দরজা খুলতে হয়। দরজা খুলে আমি তো অবাক। তাকিয়ে দেখি, নায়ক রাজ রাজ্জাক দাঁড়িয়ে আছেন। আমি নিজের চোখকে ঠিক বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। ঢোক গিললাম। গলা শুকিয়ে কাঠ। রাজ্জাক সাহেবের চেহারার মাঝে কিঞ্চিৎ মালিন্য। মুখে দিন দুয়েকের না কাটা দাড়ি। একটা চেক সার্ট পরা। ইন করেন নি। দর্পচূর্ণের রাজ্জাক সামনে দাঁড়িয়ে আমার দর্প বাড়িয়ে দিলেন। কিছু না বলে আমি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলাম। নিজের কর্ণকে অবিশ্বাস করে শুনলাম নায়ক সাহেব কথা বলছেন। কথায় স্পষ্ট কিছুটা ময়মনসিংহের টান(নেত্রকোনা তখনো জেলা হয়নি)।
- তুমি হান্নানের চেলে (ছেলে)?
- জি।
- তুমার আব্বা কুতায় ( কোথায়)?
- আব্বা তো এখনো বাসায় ফিরেন নি।
- ও, তাইলে আমি যাই। তুমার আব্বারে বইলো আমি আসসিলাম। আমরা দুইজনই নেত্রকুনা( নেত্রকোনা) সরকারি কলেজে পড়তাম। বাইল্যবন্দু(বাল্যবন্ধু) আর কি।
নেত্রকোনার নায়ক রাজ রাজ্জাক সাহেব চলে গেলেন। কিন্তু উনার নাম কি, পরিচয় কি কিছুই বলে যাননি। আমিও ঘটনার আকস্মিকতায় তাঁকে জিজ্ঞেস করতে বেমালুম ভুলে গেছি। রাতে আব্বাকে বললাম, একজন তোমার সাথে দেখা করতে এসেছিলেন। দেখতে একদম নায়ক রাজ্জাকের মতো!
আব্বার মাঝে কোন কৌতুহল লক্ষ্য করলাম না। গায়ের পোশাক বদলাতে বদলাতে বললেন, কে, রাজা এসেছিলো নাকি?
- উনি নাম বলে যাননি।
- সে-ই হবে। হয়তো টাকা পয়সা ধার চাইতে এসেছিলো।
এর পর থেকে রাজা চাচা প্রায়ই আসতেন। বিশেষ করে মাসের প্রথম দিকে। তবে এসেই বাইরে থেকে চলে যেতেন না। আব্বার সাথে দেখা করে (হয়তো টাকা নিয়ে) তারপর যেতেন। পরে আব্বার কাছে শুনেছি, সে টাকা উনি কোনদিনও শোধ করতেন না।

নিজের ধার চাওয়ার অব্যর্থ কায়দার কথাটা একটু বলি এখন।
প্রতিবারই আমি কিছু তরিকা অনুসরণ করতাম। ভালো করে বোঝার চেষ্টা করতাম, যার কাছে ধার চাইবো আমার প্রতি তাঁর দৃষ্টি ভঙ্গি কেমন। সেটা অনুকুলে থাকলে, নিজের প্রয়োজনটি এমনভাবে বলতাম যেন আমার খুব একটা টাকা পয়সার দরকার নেই। অনেকেই বসে আছে আমাকে ধার দেবার জন্য। তোমার কাছে চাইছি, তাই তুমি অন্যের থেকে ভাগ্যবান। তোমার অসুবিধা হলে দরকার নেই। অমুক অবশ্য বলেছে নিজে বাসায় এসে টাকাটা দিয়ে যাবে। কিন্তু আমি তোমাকে কাছের মানুষ ভাবি। তাই অমুকের কাছ থেকে নিচ্ছি না। ইত্যাদি ইত্যাদি। তাতেই কাজ হয়ে যেতো। তৃপ্তচিত্তে পকেটে গরম গরম টাকা নিয়ে বাড়ি ফিরতাম। তবে বলার সময় একটা সূক্ষ্ম পরিমিতি বজায় রাখতাম।প্রকাশে থাকতো চিকণ এক ধরণের দম্ভ। মজার ব্যাপার হল, চাকরি জীবনে এসে অবিকল এমনটি দেখেছি। ব্যাংকার হবার সুবাদে ঋণ প্রত্যাশী অনেককেই খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে। আশ্চর্যের বিষয় হল, আমরা তাঁদেরকেই বৃহৎ সব ঋণ দিতাম যারা চমৎকার করে নিজেদের প্রয়োজনটি চাতুর্যের সাথে বলতে পারতো। হুবহু আমারই মতো তাঁদের প্রস্তাবনায় থাকতো দম্ভ, ঋণের প্রতি থাকতো কপট পরোক্ষ অনীহা। পাশাপাশি অন্য ব্যাংকগুলো মুদির দোকানের মতোই পসরা সাজিয়ে বসে আছে। আমরা খেদমত না করলেই চলে যাবেন অন্য বিতানে। আবার এই একই ব্যক্তি, কিছুকাল পর একদম ভিন্ন। ঋণের কিস্তি বাদ পড়েছে। আত্মপ্রত্যয়ে চিড় ধরেছে, পোষাকে এসেছে মালিন্য। পুনর্বিন্যাস করার জন্য উনি আবার ধার কিম্বা ঋণ চান। আমরা ততদিনে ছাতা বন্ধ করে দিয়েছি। উপরন্তু, এমন সব লোকদের দেখলেই আঁতকে উঠি। এদিক সেদিক উঠে গিয়ে এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করি।

সাম্প্রতিক একটা উপলব্ধির কথা বলেই আজকের লেখাটা শেষ করবো।
বিদেশে মানুষ আসে নাকি অর্থবান হবার জন্য। আমার ক্ষেত্রে ঘটেছে ঠিক উল্টো। দিনে দিনে আরও নাজুক হয়ে উঠছে পরিস্থিতি। তবে আগের সাথে পার্থক্য হল, দীনতার বিষয়টি আমি তেমন একটা বুঝি না আজকাল। গড্ডালিকায় ভাসছি। যেমন চলছে চলুক। তবে আমার পারিপার্শ্ব হয়তো ঠিকই টের পায়। সময় বদলে গেছে। আমাদের সময়টাই গোলমেলে। বাবার বন্ধু আনোয়ার চাচার মতো মানুষের সাথে তেমন একটা সংযোগ ঘটে না আমাদের। সবসময় একটা অনাস্থা কিম্বা অবিশ্বাসের মাঝে থাকি। আমার অবস্থা যে খুবই সঙ্গিন সেটা পরিচিত কাউকে ফোন করলেই বুঝতে পারি। সে হতে পারে নিকট বন্ধু, কিম্বা পরম আত্মীয়। আমার ফোন পেলেই তারা চমকে যায়। ওপর প্রান্তের শঙ্কা মিশ্রিত অস্বস্তি টের পাই, যেমনটা দেউলিয়া হওয়া লোকদের দেখলে আমাদের হতো। অবস্থা এমন, যেন আমি কতক্ষনে ফোনটা রাখবো, আর ওপর প্রান্তের মানুষটি স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়বে। হয়তো মনে মনে ভাববে, যাক বাবা এইবার তো অন্তত নিস্তার পাওয়া গেলো। ভাগ্যিস ফোন ছাড়ার আগে আমি টাকা পয়সা ধার চাইনি। তবে কি আমার আচরনেও সে প্রত্যয়হীনতা রয়েছে? অভিনয় শৈলীতে ভাটা পড়েছে? কে জানে। ধরনী দ্বিধা হও।


******************



আসাদুজ্জামান পাভেল
অরেঞ্জবার্গ, সাউথ ক্যারোলাইনা থেকে
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে অক্টোবর, ২০১৮ সন্ধ্যা ৭:৪২
২টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সভ্য জাপানীদের তিমি শিকার!!

লিখেছেন শেরজা তপন, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০৫

~ স্পার্ম হোয়েল
প্রথমে আমরা এই নীল গ্রহের অন্যতম বৃহৎ স্তন্যপায়ী প্রাণীটির এই ভিডিওটা একটু দেখে আসি;
হাম্পব্যাক হোয়েল'স
ধারনা করা হয় যে, বিগত শতাব্দীতে সারা পৃথিবীতে মানুষ প্রায় ৩ মিলিয়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

রূপকথা নয়, জীবনের গল্প বলো

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:৩২


রূপকথার কাহিনী শুনেছি অনেক,
সেসবে এখন আর কৌতূহল নাই;
জীবন কণ্টকশয্যা- কেড়েছে আবেগ;
ভাই শত্রু, শত্রু এখন আপন ভাই।
ফুলবন জ্বলেপুড়ে হয়ে গেছে ছাই,
সুনীল আকাশে সহসা জমেছে মেঘ-
বৃষ্টি হয়ে নামবে সে; এও টের... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে ভ্রমণটি ইতিহাস হয়ে আছে

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১:০৮

ঘটনাটি বেশ পুরনো। কোরিয়া থেকে পড়াশুনা শেষ করে দেশে ফিরেছি খুব বেশী দিন হয়নি! আমি অবিবাহিত থেকে উজ্জীবিত (বিবাহিত) হয়েছি সবে, দেশে থিতু হবার চেষ্টা করছি। হঠাৎ মুঠোফোনটা বেশ কিছুক্ষণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ১৮ ই মে, ২০২৪ ভোর ৬:২৬

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।
প্রথমত বলে দেই, না আমি তার ভক্ত, না ফলোয়ার, না মুরিদ, না হেটার। দেশি ফুড রিভিউয়ারদের ঘোড়ার আন্ডা রিভিউ দেখতে ভাল লাগেনা। তারপরে যখন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মসজিদ না কী মার্কেট!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৮ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৩৯

চলুন প্রথমেই মেশকাত শরীফের একটা হাদীস শুনি৷

আবু উমামাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, ইহুদীদের একজন বুদ্ধিজীবী রাসুল দ. -কে জিজ্ঞেস করলেন, কোন জায়গা সবচেয়ে উত্তম? রাসুল দ. নীরব রইলেন। বললেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

×