১ আগস্ট ১৯৭১,
ইতিহাস সৃষ্টি হয়েছিলো গানের পৃথিবীতে। ইতিহাসের প্রথম চ্যারিটি কনসার্ট অনুষ্ঠিত হয় এই দিনে। আজ ৪৪ বছর পূর্তি হলো বাংলাদেশের স্বাধীনতা'র পক্ষে, গণহত্যার প্রতিবাদে ও শরণার্থী'দের সহায়তার জন্য এই অবিস্মরণীয় আয়োজনের। পাক বাহিনী শুরু করে দিল ইতিহাসের সব চাইতে নিষ্ঠুর গন হত্যা। নির্মম নির্দয় পৈশাচিক সেই হত্যা। নারকীয় সেই হত্যাকাণ্ড সেই সময় যারা দেখেছে শুধু তারা ই কেবল বর্ণনা করতে পারবে। আমরা যারা নুতন প্রজন্ম বা জন্ম যাদের ৭১ এর পর, আমরা কেবল ভিডিও ফুটেজ আর মুক্তি যুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে রচিত বই পড়ে জানতে পারি সেই সব দিন গুলির কথা। যুদ্ধের ভয়াবহতা দেখে বিশ্ব বিবেক কেঁপে ওঠে। অনেকে কেঁদেছে আমাদের সেই জঘন্যতম হত্যা যজ্ঞ দেখে। তেমনি একজন
ভারতের বিখ্যাত “পণ্ডিত রবি শঙ্কর”। পণ্ডিত রবিশংকর মুক্তিযুদ্ধের প্রতি বিশ্বজনমত গড়ে তোলা এবং শরণার্থীদের আর্থিক সহায়তা দেওয়ার জন্য তাঁর শিষ্য-বন্ধু বিশ্বখ্যাত ব্যান্ড বিটলেসর শিল্পী George Harrison কে নিয়ে এক অবিস্মরণীয় কনসার্টের আয়োজন করেছিলেন। যার নাম “Concert For Bangladesh". মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে ১৯৭১ সালের ১ আগস্ট অনুষ্ঠিত হয়েছিল এই অবিস্মরণীয় কনসার্ট টি, যা আমদের মুক্তি যুদ্ধের ইতিহাসে কালের সাক্ষী হয়ে আছে মূলত এই কারনে দীর্ঘদিন ধরে এভাবেই পণ্ডিত রবি শংকর ও জর্জ হ্যারিসনের প্রতি এক গভীর ভালোবাসা তৈরি হয় আমাদের মধ্যে। জাতী হিসাবে দায়বদ্ধতা ও রয়েছে তাদের উপর।
‘১৯৬৫ সালে এক রাতে রবিশংকরের সঙ্গে পরিচয় হয় জর্জ হ্যারিসনের। জর্জ বছর তিনেক সেতার নিয়ে অনুশীলন করেছিল রবিশংকরের কাছে। রবি সংকরের মাধ্যমেই বাংলাদেশের সঙ্গে জর্জের আত্মিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। একাত্তরের উত্তাল দিনগুলোতে রবির যন্ত্রণার সঙ্গী হয়ে কনসার্টের দায়িত্ব কাঁধে নিয়েছিল জর্জ।জর্জ ও রবি বলেছিলেন বাংলাদেশের জন্য তাদের আরও কিছু করার ছিল। কনসার্টটির কাজ করতে গিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে একটা গভীর আত্মিক সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল জর্জ হ্যারিসনের। বাংলাদেশের মানুষের দুঃখ-দুর্দশা আর গণহত্যা তাঁর অন্তরকে গভীরভাবে স্পর্শ করে গিয়েছিল। এই প্রসঙ্গে হ্যারিসনের স্ত্রী অলিভিয়া বলেছিলেন, ‘জর্জের কাছে শুনেছি, একাত্তরে বাংলাদেশে গণহত্যা, ধ্বংস আর হানাহানি বিপর্যস্ত করে তুলেছিল রবি শংকরকে। এ নিয়ে মনঃকষ্টে ছিল সে। অন্যদিকে নিজের রেকর্ডিং নিয়ে ব্যস্ত ছিল জর্জ। সত্তরে বিটল্স ব্যান্ড ভেঙে যাওয়ায় নতুন করে ক্যারিয়ার গড়তে সে মনোযোগী হয়ে ওঠে। এ সময় রবিশংকর জানায়, বাংলাদেশের জন্য তহবিল সংগ্রহে একটি কনসার্ট করতে চায়। এ উদ্যোগে
সে জর্জকে পাশে পেতে চায়। জর্জেরও মনে হলো, এ কাজে তার নিযুক্ত হওয়া উচিত। তার ডাকে অনেকে সাড়া দেবে, একাত্তরের উত্তাল দিনগুলোর মাঝামাঝি সময়ে ওই কনসার্ট আয়োজন সময়োপযোগী ছিল। জর্জ তখন বব ডিলান, এরিক ক্ল্যাপটন, বিলি প্রেস্টন, রিঙ্গো স্টার, লিওন রাসেল, ওস্তাদ আলী আকবর, ওস্তাদ আল্লা রাখা ও রবি শংকরকে নিয়ে কনসার্ট আয়োজন করে। ওই কনসার্ট দিয়েই বাংলাদেশের সঙ্গে জর্জের বন্ধন শুরু।’
অলিভিয়া হ্যারিসন ‘জর্জ হ্যারিসন ফান্ড ফর ইউনিসেফ’-এর প্রতিষ্ঠাতা। গত বছর ফেব্রুয়ারিতে তিন দিনের জন্য ইউনিসেফের সহায়তায় বাংলাদেশে এই প্রতিষ্ঠানের কাজ দেখতেই এসেছিলেন ঢাকায়। তিনি ঢাকা ও ঢাকার বাইরে দরিদ্র শিশু ও কিশোরদের জন্য নির্দিষ্ট কিছু কাজ দেখেছেন। পার্বত্য চট্টগ্রামে শিশুদের জন্য কিছু কর্মসূচি চলে জর্জ হ্যারিসন ফান্ডের সহায়তায়। ভবিষ্যতে হাওর ও পার্বত্য চট্টগ্রামে শিশু-কিশোরদের নৌকা স্কুল কর্মসূচির জন্য সহায়তা নিয়ে অলিভিয়ার সঙ্গে কথা হয়েছে ইউনিসেফের। এটাই ছিল তাঁর প্রথম বাংলাদেশ সফর। বছরের পর বছর ধরে তিনি তাঁর প্রয়াত স্বামীর শুরু করা মানবিক কর্মকাণ্ড অব্যাহত রেখেছেন, যে কাজের সুফল পাবে বাংলাদেশের শিশুরা।
জর্জ হ্যারিসন যখন দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ আয়োজনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন, তখন বিটলেসর সহশিল্পীদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক স্বস্তিকর ছিল না। তা সত্ত্বেও তিনি আত্মাভিমান ত্যাগ করে সহশিল্পী ও বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ করে কনসার্টে অংশ নেওয়ার অনুরোধ জানান। বিটলেসর ড্রামার রিঙ্গো স্টার রাজি হয়েছিলেন এক কথায়। বিল প্রেস্টন, লিওন রাসেলও প্রথমবারেই রাজি হলেন। বব ডিলান ও এরিক ক্ল্যাপটনও প্রস্তাবটি বিবেচনার আশ্বাস দিলেন। কিছুটা অনিশ্চয়তার পর দুজনই অংশ নিয়েছিলেন। জর্জ হ্যারিসন অনুষ্ঠানে হাজার হাজার শ্রোতাকে ধন্যবাদ জানিয়ে শুরুতেই বলেন, ‘ভারতীয় সংগীত আমাদের চেয়ে অনেক গভীর।’ তারপর পণ্ডিত রবিশংকর ও ওস্তাদ আলী আকবর খান এবং সহশিল্পীদের পরিচয় করিয়ে দেন। কনসার্টটির শুরুতেই পণ্ডিত রবিশংকর এক সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে বলেন, ‘প্রথম ভাগে ভারতীয় সংগীত থাকবে। এর জন্য কিছু মনোনিবেশ দরকার। পরে আপনারা প্রিয় শিল্পীদের গান শুনবেন। আমাদের বাদন শুধুই সুর নয়, এতে বাণী আছে। আমরা শিল্পী, রাজনীতিক নই। বাংলাদেশে অত্যন্ত দুঃখজনক ঘটনা ঘটছে। বাংলাদেশের পল্লিগীতির সুরের ভিত্তিতে আমরা বাজাব “বাংলা ধুন”।’ তিনি ‘বাংলা ধুন’ নামের একটি নতুন সুর সৃষ্টি করেছিলেন। সেটি দিয়েই আলী আকবরের সঙ্গে যুগলবন্দীতে কনসার্ট শুরু হয়েছিল। তবলায় ছিলেন ওস্তাদ আল্লা রাখা এবং তানপুরায় ছিলেন কমলাচক্রবর্তী।
দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ-এর বড় আকর্ষণ ছিলেন বব ডিলান ও জর্জ হ্যারিসন। জর্জ হ্যারিসন ছিলেন সর্বকালের সেরা গীটারিস্টদের মধ্যে ২১ তম। অসাধারণ গিটার বাজিয়েছিলেন এরিক ক্ল্যাপটন। জর্জ হ্যারিসন আটটি গান গেয়েছিলেন। এর একটি ছিল বব ডিলানের সঙ্গে। বব ডিলান গেয়েছিলেন পাঁচটি গান (প্রথম লং প্লেতে পাঁচটি গান আছে, তবে ২০০৫ সালের ডিভিডিতে আছে চারটি গান)। রিঙ্গো স্টার ও বিলি প্রেস্টন একটি করে গান করেছিলেন। লিওন রাসেল একটি একক এবং ডন প্রেস্টনের সঙ্গে একটি গান করেছিলেন। অনুষ্ঠানের শেষ পরিবেশনা ছিল জর্জ হ্যারিসনের সেই অবিস্মরণীয় গান ‘বাংলাদেশ বাংলাদেশ’। প্রথমে পরিকল্পনা ছিল, একটি কনসার্ট হবে। কিন্তু সেদিন এত বিপুল সাড়া জাগিয়েছিল কনসার্টটি যে পরে অনুষ্ঠানসূচি ঠিক রেখে, একই দিনে আরও একটি অনুষ্ঠান করতে হয়েছিল দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ-এর।
জর্জ হ্যারিসন তার বিবেকী শিল্পী সত্তাকে মানবতার কল্যাণে, মুক্তিসংগ্রামের স্বপক্ষে নিবেদিত করেছিলেন সকল রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে। স্বয়ং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসন সেদিন বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের বিপক্ষে ছিল, সেখানে বিশ্ববরেণ্য সঙ্গীতজ্ঞ পন্ডিত রবি শংকরের পৃষ্ঠপোষকতায় জর্জ হ্যারিসন এগিয়ে এসেছিলেন যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের সাহায্যার্থে। আয়োজন করেন বিশ্ব ইতিহাসের প্রথম চ্যারিটি কনসার্ট। ১লা আগস্ট, নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ারে সেদিন এই কনসার্টের মাধ্যমে জানতে পেরেছিল পাক পশুদের নৃশংস হত্যাযজ্ঞের কথা।
একটি দেশকে না দেখেই সে দেশের মানুষের প্রতি ভালোবাসার হাত প্রশস্ত করেছিলেন জর্জ হ্যারিসন। বাংলাদেশের এই স্বার্থহীন বন্ধু ২৯ নভেম্বর ২০০১ চলে যান পরপারে। তিনি মিশে গেছেন পরম সত্ত্বার সঙ্গে। মর্মান্তিক কথা হচ্ছে, যে জর্জ হ্যারিসন একটি দেশ, একটি জাতির অভ্যুদ্বয়ের জন্য নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে ছিলেন, সেই জর্জ হ্যারিসনের বাঙলাদেশ সফরের সৌভাগ্যটুকু হয়নি। আমরা জানি এবং দেখেছি, বাংলাদেশে অনেক রাজাকার, শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান, মৌলবাদী দালালরা স্বাধীনতা পদক, একুশে পদক পেয়েছে। কিন্তু জীবদ্দশায় জর্জ হ্যারিসন, পন্ডিত রবি শংকরকে সম্মানিত করতে না পারার দুঃখ এবং ক্ষোভ আমরা ঢাকবো কিভাবে ?
জর্জ হ্যারিসনকে রাষ্ট্রীয় খরচে বাংলাদেশে নিয়ে আসতে কত খরচ হতো? বড়জোর দশ হাজার ডলার। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি কেন এই বদান্যতাটুকু দেখাতে পারলো না? বাঙালি কি শুধু পেতে জানে- দিতে জানে না?
হ্যাঁ, আমরা সম্মাননা দিয়েছিলাম, সাম্প্রতিক সময়ে আমরা শতাধিক দেশ হিতৈষীকে সম্মাননা দিয়েছি, কিন্তু তাঁদের জন্য বানানো স্মারকে ভেজাল দিয়ে নিজেদের আরও খাটো করেছি মাত্র। তাঁরা বিশাল মনের মানুষ নিঃসন্দেহে, তাই ঐ স্মারকের সোনার পরিমান নিয়ে চিন্তা করেননি। সম্মানটাকেই মুখ্য করে দেখেছেন। কিন্তু যে কালিমা আমরা নিজ মুখে মাখলাম তার কি হবে ? আমরা কবে সাবালক হবো ?
** আজ শ্রদ্ধেয় রবি শঙ্কর এবং শ্রদ্ধেয় জর্জ হ্যারিসন নেই। কিন্তু তাঁরা আছেন আমাদের হৃদয়ে, বাংলাদেশ রাষ্ট্রটির অস্তিত্ব যতদিন থাকবে, তাঁদের অবদান এবং ভালবাসো আমরা পরম শ্রদ্ধায় স্মরণ করবো। বাঙালী তাঁদের ভুলে যায়নি, যাবেনা। আমাদের হৃদয়
নিঙড়ানো ভালবাসা এবং একি সাথে সেই পরম সত্ত্বার কাছে প্রার্থনা আমাদের দেশের প্রতি যে মমতা তাঁরা দেখিয়েছেন, তিনি যেন তার থেকে কোটি কোটি গুন বেশী মমতা তাঁদের প্রতি দেখান। স্রষ্টা তাঁদের চির শান্তিময় স্থানে যেন আসীন করেন।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে আগস্ট, ২০১৫ বিকাল ৩:০৯