somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সর্ষের তেল এবং বাঙ্গালীর আত্মহননের গল্প

২৭ শে অক্টোবর, ২০১২ বিকাল ৩:২৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ছেলেবেলায় আমরা যারা মফস্বলে বা গ্রামে বড় হয়েছি সম্ভবত তাঁদের সবার মুরগী পালার অভিজ্ঞতা আছে। খাওয়ার ডিম আলাদা রেখে বাচ্চা ফুটানোর জন্য ডিম রেখে দেয়া, তারপর সেই ডিমে তা দিয়ে ডিম ফুটানো। মাখনের মতো নরম তুলতুলে বলের মতো শরীর নিয়ে মা মুরগীর পিছনে কিচ মিচ করতে করতে এক দঙ্গল বাচ্চার ছুটে চলা। সে এক অপরূপ দৃশ্য। মুরগী আজো ডিম পাড়ে, তবে সেটা খাবার ডিম; এই ডিম ১০০০ দিন তা দিলেও তা থেকে বাচ্চা বেরুবেনা। এই ডিমে পুষ্টি হয়তো আছে কিন্তু প্রান নেই। রূপকথার গল্পের মতো এর প্রান ভোমরা আছে বহুজাতিকের কাছে সুরক্ষিত। বহুজাতিকরা আমাদের মুরগীর বাচ্চা দেবে যেন আমরা পেলে পুষে বড় করতে পারি কিন্তু ডিম ফোটানর বাচ্চা দেবেনা। একইভাবে কৃষক ফসল ফলাবে, কিন্তু সেই ফসল থেকে বীজ হবেনা। বীজ কিনতে হবে আবার সেই বহুজাতিকের কাছে থেকে। এইভাবে আমাদের ফসলের প্রান বৈচিত্র্য ধীরে ধীরে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। এখনো যেটুকু বীজ আমাদের সংগ্রহে আছে তাও ধীরে ধীরে চলে যাচ্ছে বিদেশে। বিদেশে কোথায়? ফোর্ট কলিন্সে। এটা একটা মিলিটারি বেজ। পৃথিবী জুড়েই প্রান বৈচিত্র্য দখলের যুদ্ধ চলছে, আর এই যুদ্ধে আমরা আগেই হেরে বসে আছি। এখন যদি বহুজাতিকরা বলে আমাদের বীজ আমরা দেবনা? বা যদি বলে বীজ দেব কিন্তু তেল দাও? আমাদের হাত পা বাঁধা। ১৬ কোটি মানুষের দেশের খাদ্যের বাজার বিশাল, আর আমরা কৃষিভিত্তিক দেশ হয়েও খাবারের বাজারের নিয়ন্ত্রন বুঝে বা না বুঝে আস্তে আস্তে তুলে দিচ্ছি বহুজাতিকের হাতে। আসুন দেখি ভোজ্য তেলের বাজার কিভাবে আমাদের হাতছাড়া হোল।

৮০ র দশক পর্যন্ত আমাদের মুল ভোজ্য তেল ছিল সর্ষের তেল। তারপর কম দামে রেশনে দেয়া শুরু হোল পাম ওয়েল। কোথায় থেকে যেন সবার মুখে মুখে ছড়িয়ে গেল, পাম ওয়েল স্বাস্থ্যের জন্য খুব খারাপ। তখনও বাজারে সয়াবিন তেল পাওয়া যেত, কিন্তু খুব একটা বিক্রি হত না। রেশনে এর পর দেয়া শুরু হোল সয়াবিন তেল। তারপর যেন কীভাবে সর্ষের তেল খাওয়া বন্ধ হয়ে গেলো, আমাদের রান্না ঘরের শেলফ দখল করলো সয়াবিন তেল। এখন চলছে সয়াবিন তেলের দুর্দান্ত দাপট। আমরা জাহাজ ভর্তি করে সয়াবিন তেল আনি আর তেলের দাম বাড়ল বলে হা পিত্যেশ করি। সর্ষের তেল আমাদের খাদ্য তালিকা থেকে উধাও হয়ে গেলো, আর উধাও হোল এই শিল্পের সাথে জড়িত লক্ষ মানুষ। সর্ষের তেল এই উধাও হয়ে যাওয়ার সময়ের সাথে আমেরিকার তিনটি গবেষণার যোগসূত্র আছে গবেষনা গুলো হয়েছিল পর পর ১৯৭৬ থেকে ১৯৮৪ পর্যন্ত। এই গবেষণায় দেখা হয়েছিল ইদুরের উপর সর্ষের তেলের অন্যতম উপাদান ইউরেসিক অ্যাসিড (একটি ফ্যাটি অ্যাসিড) এর ক্ষতিকর প্রভাব আছে কিনা? ফলা আসলো হ্যাঁ আছে। এই গবেষণার ফলাফলের পর আমেরিকা, কানাডা এবং ইউরপিয়ান ইউনিয়নে সর্ষের তেল মানুষের খাবার অনুপযোগী ঘোষণা করে। ধারণা করা হয় গবেষকরা অসৎ উদ্দেশ্যে ইঁদুরের উপর সর্ষের তেলের প্রভাব নিয়ে গবেষণা গুলি করেন। কারণ ইদুর কোন উদ্ভিতজাত তেল হজম করতে পারেনা, সেই ভোজ্য তেলে ইউরেসিক অ্যাসিড থাকুক আর না থাকুক। সয়াবিন তেল বা অলিভ ওয়েল দিয়ে এই গবেষণা করলেও একই ফলাফল পাওয়া যেত। পরবর্তীতে মানুষের উপর ইউরেসিক অ্যাসিডের প্রভাব নিয়ে গবেষণায় কোন ক্ষতিকর প্রভাব দেখা যায়নি। কিন্তু এখনো আমেরিকায় বিক্রীত সরিষার তেলের গায়ে লেখা থাকে “ফর এক্সটারনাল ইউজ অনলি”। কেন? কারণ ভারত ও বাংলাদেশে সর্ষের তেল খেকো এই বিপুল জনগোষ্ঠীর বাজার পশ্চিমের সয়াবিন বিক্রেতাদের হাত থেকে যেন ছুটে না যায়।
কিন্তু সর্ষের তেল কতটুকু স্বাস্থ্য সম্মত? নিক্তির বিচারে বিভিন্ন খাদ্যের পুষ্টিগুন মেপে তুলনা করা কঠিন। এটা বলা মুস্কিল আম ভালো না কাঁঠাল ভালো। তবে সর্ষের তেলে কোন স্বাস্থ্য ঝুকি নেই; এটা বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমানিত। অনেক ক্ষেত্রে সর্ষের তেলের পুষ্টিমান অন্য অনেক আমদানিকৃত ভোজ্য তেলের চাইতে বেশী। হৃদপিণ্ডের জন্য ক্ষতিকর স্যাচুরেটেড ফ্যাট সয়াবিন তেলে ১৫% আর সর্ষের তেলে মাত্র ১২%। হৃদ বান্ধব মনো আন স্যাচুরেটেড ফ্যাট সর্ষের তেলে ৬০% আর পলি আন স্যাচুরেটেড ফ্যাট ২১%। আমরা নিশ্চয় ওমেগা ৩ বা ওমেগা ৬ এর হৃদরোগ প্রতিরোধী ভুমিকার কথা শুনেছি। সর্ষের তেলের এই পলি আন স্যাচুরেটেড ফ্যাটের ২৫ ভাগ ওমেগা ৩ এবং ৭৫ ভাগ ওমেগা ৬। আমেরিকান জার্নাল অব ক্লিনিক্যাল নিউট্রিসনে ২০০৪ সালে প্রকাশিত গবেষণায় দেখা গেছে যারা ভোজ্য তেল হিসেবে সর্ষের তেল খায় তাঁদের হার্ট অ্যাটাকের সম্ভাবনা অন্যদের চাইতে কম। আমরা কী এখনে সেই বিজ্ঞাপনের ভাষায় বলবো, “আমি সর্ষের তেল খুব একটা খাইনা।“!!
আমাদের ছোটবেলায় রূপকথা পড়তাম; ঘুমন্ত রাজকন্যাকে জাগানোর জন্য রাজপুত্রের অভিযান, আর রাক্ষসের প্রান ভোমরা এক ডুবে পাতাল থেকে তুলে এনে পিষে মারার গল্প। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বাঙ্গালী টিকে থাকার সেই অভিযানে নেমেছে। আমাদের পূর্বপুরুষেরা মিথের মধ্যে দিয়ে সংগ্রামের চেতনা আমাদের মধ্যে প্রথিত করে দেবার চেষ্টা করেছেন। আজ আমাদের ছেলে মেয়েরা ঠাকুরমার ঝুলি পড়েনা, পড়ে “চকলেট ফ্যাক্টরি”। মুল থেকে উপড়ে ফেলে বিদ্রোহের বীজকে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের মনোজগত থেকে মুছে দেয়া হচ্ছে। বাঙ্গালী বীজের অধিকার হারা এক নিস্ফলা জাতি, আর এখন মনোজগতে উন্মুল হয়ে আরেক নিস্ফল ভবিষ্যতের দিকে যাচ্ছে কি? বাঙ্গালীর চাইতে বড় আত্মঘাতী জাতি বোধ হয় আর পৃথিবীতে নেই।
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে জুলাই, ২০১৫ দুপুর ২:৪৫
১২টি মন্তব্য ৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

অল্প পুঁজিতে অত্যন্ত লাভজনক একটি ব্যবসার সন্ধান, যে কেউ চাইলে শুরু করতে পারে

লিখেছেন জ্যাক স্মিথ, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:৩৫



কেউ একজন জানতে চেয়েছেন ১০/১২ লাখ টাকা বিনিয়োগ করে কিভাবে মাসে ১/২ লাখ টাকা ইনকাম করা যায়? বিষয়টা নিয়ে চিন্তা করে দেখলাম বাংলাদেশে ১০/১২ লাখ টাকা বিনিয়োগ করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সাজানো ভোটে বিএনপিকে সেনাবাহিনী আর আমলারা ক্ষমতায় আনতেছে। ভোট তো কেবল লোক দেখানো আনুষ্ঠানিকতা মাত্র।

লিখেছেন তানভির জুমার, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৮:২২



১০০% নিশ্চিত বিএনপি ক্ষমতায় আসছে, এবং আওয়ামী স্টাইলে ক্ষমতা চালাবে। সন্ত্রাসী লীগকে এই বিএনপিই আবার ফিরিয়ে আনবে।সেনাবাহিনী আর আমলাদের সাথে ডিল কমপ্লিট। সহসাই এই দেশে ন্যায়-ইনসাফ ফিরবে না। লুটপাট... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাজনীতির পন্ডিত, ব্লগার তানভীর জুমারের পোষ্টটি পড়েন, জল্লাদ আসিফ মাহমুদ কি কি জানে!

লিখেছেন জেন একাত্তর, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৮:৪৯



সামুর রাজনীতির ডোডো পন্ডিত, ব্লগার তানভীর ১ খানা পোষ্ট প্রসব করেছেন; পোষ্টে বলছেন, ইউনুস ও পাকিসতানীদের জল্লাদ আসিফ মাহমুদ ধরণা করছে, "সেনাবাহিনী ও ব্যুরোক্রেটরা বিএনপি'কে... ...বাকিটুকু পড়ুন

নীল নকশার অন্ধকার রাত

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১০:১৬


কায়রোর রাস্তায় তখন শীতের হিম হাওয়া বইছিল। রাত প্রায় সাড়ে এগারোটা। দুইটা বড় সংবাদপত্র অফিস: আল-আহরাম এবং আল-মাসরি আল-ইয়াউম—হঠাৎ করেই আগুনে জ্বলে উঠলো। কিন্তু এই আগুন কোনো সাধারণ দুর্ঘটনা... ...বাকিটুকু পড়ুন

আগুন যখন প্রশ্নকে পোড়াতে আসে

লিখেছেন এস.এম. আজাদ রহমান, ২২ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:৩২

আগুন যখন প্রশ্নকে পোড়াতে আসে[

স্বাধীন সাংবাদিকতার কণ্ঠরোধে রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতা, মব-রাজনীতি ও এক ভয়ংকর নীরবতার ইতিহাস
চরম স্বৈরশাসন বা ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রেও সাধারণত সংবাদমাধ্যমের কার্যালয়ে আগুন দেওয়ার সাহস কেউ করে না। কারণ ক্ষমতা... ...বাকিটুকু পড়ুন

×