somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্প ঃ ড্রাইভারের বউ

২৫ শে জানুয়ারি, ২০১৮ দুপুর ১২:৩২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


শামচুল হক

রুমানা তার এগারো বছর বয়সের ছেলে এবং পাশের বাসার ভাবিকে সাথে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ছেলেটি ক্লাস ফাইভে পড়ে। সামনে ক্লাস ফাইভের সমাপনী সেন্টার পরীক্ষা। ভালো রেজাল্টের জন্য বিকাল বেলা কোচিংয়ে দিয়েছে। কোচিং শেষে ছেলেকে নিতে এসেছে। অনেকক্ষণ হলো দাঁড়িয়ে আছে। স্কুটার পাচ্ছে না। এমনি অবস্থায় একটি খালি স্কুটার সামনে দিয়ে যেতেই ছেলেটি ডাক দিল, এই স্কুটার, খিলগাঁও যাইবেন?
স্কুটার থামিয়ে ড্রাইভার বলল, যামু।
-- ভাড়া কত নিবেন?
ড্রাইভার ছেলেটির মুখের দিকে তাকিয়ে একটি হাসি দিয়ে বলল, যা ভাড়া তাই দিবেন।
-- না, আপনি বলে নেন, পরে ঝগড়া বাঁধবে।
-- না রে বাবা, ঝগড়া বাঁধবে না। উচিৎ ভাড়া দিলে ঝগড়া বাঁধবে কেন?
-- আমরা কিন্তু আশি টাকা দিব।
-- ঠিক আছে-- আশি টাকা ভাড়া হলে আশি টাকাই দিবেন, বলেই ড্রাইভার দরজা খুলে দিল।
রুমানা পাশের বাসার ভাবিকে নিয়ে ছেলের সাথে স্কুটারে উঠল। ড্রাইভার দরজা লাগিয়ে স্ট্রার্ট দিয়ে চলতে লাগল। কিছুদূর যাওয়ার পরেই ট্রাফিক জ্যামে আটকে গেলে ড্রাইভার গাড়ির স্টার্ট বন্ধ করে গুন্গুন্ করে গান গাইতে লাগল---

কত দিন হলো তোমায় দেখিনি আমি
বিরহের জ্বালা বুকে কাটাই রজনী
তুমি সখি বুঝোনা মোর প্রেমেরও জ্বালা
তোমার দেয়া ব্যাথা হলো গলারও মালা
এত ব্যাথা পাবো আমি আগে বুঝিনি
বিরহের জ্বালা বুকে কাটাই রজনী।

প্রথম দিকে রুমানা ড্রাইভারের গান খেয়াল করে নাই। পরের দু’টি চরণ ভালভাবে তার কানে এলো। মনে মনে ভাবল ড্রাইভারের হয়তো আজ ভালো ইনকাম হয়েছে তাই মনের আনন্দে গান গাইছে। জ্যাম ছেড়ে গেলে স্কুটার স্টার্ট দিয়ে চলতে লাগল। ফাঁকা রাস্তায় এসে হঠাৎ ড্রাইভার রাস্তার পাশে সাইড কেটে বাম পাশে থামিয়ে দিল। স্কুটার থেকে নেমে ইঞ্জিন কভার খুলে ছোটখাটো যান্ত্রিক ত্রুটি মেরামত করতে লাগল, এমন সময় রুমানার ছেলে সাগর বলল, আঙ্কেল--আমাকে একটা চিপস এনে দিবেন?

ড্রাইভার ছেলেটির কথায় সায় দিয়ে শুদ্ধ ভাষায় বলল, ঠিক আছে বাবা এনে দিচ্ছি। বলেই পাশের কনফেকশনারী দোকান থেকে একটি চিপসের প্যাকেট এনে দিল। রুমানার সকাল থেকেই মাথা ব্যাথা। মাথার যন্ত্রনায় স্কুটারের সিটে বসে পিছনে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে আছে। ড্রাইভার স্কুটার মেরামত শেষে স্টার্ট দিয়ে আবার চলতে লাগল। ফাঁকা রাস্তায় গিয়ে ড্রাইভার আবার গান ধরল---

ক্ষণে ক্ষণে না দেখলে যে, ভাল লাগে না
এই জীবনে তোমায় ছাড়া জীবন বাঁচে না
এখন তুমি কোথায় আছ জানি না আমি
বিরহের জ্বালা বুকে কাটাই রজনী

এই জীবনে পাবো কি না মনের মাঝে ভয়
ভুলে যেতে চায়েও যেন ভোলা সহজ নয়
তোমার প্রেমে পাগল হয়ে উদাস হয়েছি
বিরহের জ্বালা বুকে কাটাই রজনী।

এই চরণটি গাওয়ার পরেই রুমানা চমকে উঠল। এই গান তো তার অনেক পরিচিত। কণ্ঠটিও তার খুব চেনা চেনা লাগছে। মনে পড়ে গেল তার অতীত জীবনের কথা। ড্রাইভার পরের চরণ গাওয়া শুরু করল---

সেই তো দেখা হয়েছিল নদীরও ঘাটে
কলসী কাঁখে ছিলে তুমি নিধুয়া মাঠে
ঠমকে ঠমকে চলন আজো ভুলিনি
বিরহের জ্বালা বুকে কাটাই রজনী।

চার চোখের হলো মিলন বাঁকা ঠোটের হাসি
বলেছিলাম লাজে লাজে তোমায় ভালবাসি
সেই দিনের ভালবাসা আজো ভুলিনি
বিরহের জ্বালা বুকে কাটাই রজনী।

শেষের চরণটি কানে আসতেই রুমানার টনক নড়ল। সন্দেহ হলো এটা কার স্কুটারে উঠেছে? আগে জানলে এই স্কুটারে উঠত না। তখনও ড্রাইভারের মুখ দেখে নাই। সন্ধ্যার আবছা আলোতে দূর থেকে মুখভর্তি দাড়িওয়ালা উসকোখুসকো হ্যাংলা পাতলা রোগাটে চেহারার ড্রাইভারকে দেখেছে। কিন্তু ভাল করে তাকিয়ে দেখেনি। মাথার যন্ত্রনায় কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। রুমানা ড্রাইভারকে কিছু না বললেও পাশে বসে থাকা ভাবি আগ বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, আপনার বাড়ি কোথায়?
-- আমার বাড়ি ঘর নাই।
-- কোথায় থাকেন?
-- ঢাকার রাস্তায়।
-- আগে কোথায় ছিল?
-- আগে তো ছিল রংপুরে।
-- এখন রংপুরে নাই?
-- আছে কিনা জানি না, তেরো বছর হলো বাড়ি যাই না তাই বলতে পারছি না।
-- কেন বাড়ি যান না কেন?
-- সে আমার কাপালের দোষ।
-- ছেলে মেয়ে নাই?
-- না।
-- বিয়ে করেন নাই?
-- করেছিলাম এখন নাই।
-- কেন?
-- সেই বউ তো আমাকে ঢাকার রাস্তায় নামিয়ে দিয়েছে।
-- কেমন করে?
-- সে অনেক কথা, বলতে গেলে দু’এক ঘন্টা লাগবে।
-- বউ কতদিন হলো চলে গেছে?
-- বারো বছর।
-- এর পরে আর বিয়ে করেন নাই?
-- বিয়ে করবো কি ভাবে? বারো বছর জেল খেটে গতকাল জেল থেকে বের হয়েছি।
-- কেন, জেলে গেলেন কেন?
-- সে আমার কপাল, আমার প্রেম করে বিয়ে করা বউকে জোর করে একজন ছিনিয়ে নিল। আমাকে মারধোর দিয়ে বাসা থেকে বের করে দিল। বউ হারিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতেছিলাম। তিনদিন পরে আমাকে রাস্তা থেকে ডেকে এনে হাতে পিস্তুল দিয়ে পুলিশে ধরিয়ে দিল। বিচারে জেল হলো। বারো বছর জেল খেটে গতকাল জেল থেকে ছাড়া পেয়েছি।
ড্রাইভারের কাহিনী শুনে রুমানার আর বুঝতে বাকি রইল না যে, ইনিই সেই লোক, যাকে বারো বছর আগে তার কারণেই বর্তমান স্বামী মারধোর দিয়ে বাসা থেকে বের করে দিয়েছিল।

মুহুর্তেই তার অতীত জীবনের কথা মনে পড়ে গেল। এই ড্রাইভারের নাম মিন্টু। বাড়ি থেকে পালিয়ে এসে রুমানা তাকে ভালোবেসেই বিয়ে করেছিল। মিন্টু অবস্থাপন্ন ঘরের আদরের সন্তান। ওদের তুলনায় রুমানার বাবার আর্থিক অবস্থা খুবই দুর্বল। আর্থিক দুর্বলতার কারণে মিন্টুর পরিবার রুমানাকে তাদের বাড়ির বউ করতে রাজী হলো না। কিন্তু মিন্টু তখন রুমানার প্রেমে অন্ধ। প্রেমে অন্ধ হয়েই সে পরিবার ছেড়ে রুমানার হাত ধরে ঢাকায় চলে আসে। জীবন ধারনের জন্য স্কুটারের ড্রাইভারী পেশা বেছে নেয়। ড্রাইভারী করে আর্থিকভাবে খুব একটা সচ্ছল ছিল না। তারপরেও দু’জনের সংসার ভালই চলছিল। অভাবের মাঝেও সুখেই ছিল। কিন্তু তাদের এই ভালো চলাটা বেশিদিন টিকল না।

ভাড়া থাকতো আরামবাগের রতনদের বাসায়। রুমানা সুন্দরী হওয়ায় তার উপরে নজর পড়ল রতনের। রতন বাড়িওয়ালার ছোট ছেলে। অসম্ভব বদ চরিত্রের লোক। এলাকায় এমন কোন অপকর্ম নেই যা সে করে না। একদিন সুযোগ বুঝে রুমানাকে কুপ্রস্তাব দিয়ে বসে। রুমানা রতনের কুপ্রস্তাবে চটে যায়। রতনের বদ চরিত্রের কথা মিন্টুকে জানিয়ে দিলে মিন্টু ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে। বাড়িওয়ালার ছেলে হওয়া সত্বেও রতনের মাথার চুল খামছে ধরে দুই গালে চর বসিয়ে দেয়। মার খেয়ে সেই সময় বিড়ালের মত চলে গেলেও মারের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য রতন মরিয়া হয়ে ওঠে। দু’দিন পরেই বন্ধুদের সাথে নিয়ে মিন্টুর উপরে চড়াও হয়। ঘরের ভিতর আটকিয়ে নিষ্ঠুরভাবে পিটাতে থাকে। মারধোরের সময় রুমানা মিন্টুকে রক্ষা করার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করে, কিন্তু সংঘবদ্ধ কয়েকজনের সাথে কুলোতে পারে না। অমানুষিক নির্যাতনে মিন্টু জ্ঞান হারায়। আধমরা অবস্থায় রাতের অন্ধকারে রাস্তায় ফেলে দিয়ে আসে।

মিন্টুকে মারধোর করে রাস্তায় ফেলে দিলেও রুমানাকে আটকিয়ে রাখে। মিন্টুকে তালাক দেয়ার জন্য বারবার চাপ দিতে থাকে, হাজার চাপেও রুমানা রাজী হয় না। তার উপরেও চলতে থাকে অকথ্য অত্যাচার। তালাবদ্ধ ঘরে হাত পা বেঁধে রাখে। এভাবেই কিছুদিন রুমানার বন্দী জীবন কাটে। এরপর হাত পা বাঁধা অবস্থায় সম্ভ্রমহানী ঘটালে রুমানা মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে। জীবনের সব কিছু হারিয়ে দিশেহারা হয়ে যায়। এত কিছু হারানোর পরও রতনের বন্দীশালা থেকে মুক্ত হতে পারে না। অবশেষে আত্মসমার্পন করতে বাধ্য হয়। সেই থেকে মিন্টু নিখোঁজ।

দীর্ঘ বারো বছর হলো মিন্টুর খোঁজ নেই। রুমানা মনে করেছিল মিন্টুকে হয়তো ওরা মেরে ফেলেছে। কিন্তু আজকে তার গান শুনে এবং জেল খাটার কাহিনী শুনে ভুল ভাঙল। বুঝতে পারল, এটা রতনের কাজ। রতন মিথ্যা অস্ত্র মামলায় মিন্টুকে জেলে ঢুকিয়ে নিজেকে নিরাপদ করেছিল।

রুমানা মিন্টুর দুর্দশার কথা শুনে চোখের পানি আটকাতে পারল না। জলে দু’চোখ ভিজে গেলেও মুখে কিছু বলল না। কারণ, রতন যদি জানতে পারে মিন্টু জেলখানা থেকে ছাড়া পেয়েছে এবং রুমানার সাথে দেখা হয়েছে, তাহলে সে মিন্টুকে তো মেরে ফেলবেই তার সাথে তাকেও মেরে ফেলবে। সেই আশঙ্কা করেই রুমানা ওড়না দিয়ে আরো ভালভাবে নিজের মুখ ঢেকে নিল, যাতে মিন্টু তাকে কোনভাবেই চিনতে না পারে।
রুমানা দু’চোখ বন্ধ করে যখন এসব নিয়ে ভাবছে ঠিক তখনই ছেলে বলে উঠল, মা নামবে না?

(চলবে)

(ছবি ঃ গোগুল)
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে জানুয়ারি, ২০১৮ রাত ৯:২৭
২৮টি মন্তব্য ২৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

চাঁদগাজীর মত শিম্পাঞ্জিদের পোস্টে আটকে থাকবেন নাকি মাথাটা খাটাবেন?

লিখেছেন শ্রাবণধারা, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:৫৭



আমাদের ব্রেইন বা মস্তিষ্ক কিভাবে কাজ করে লেখাটি সে বিষয়ে। এখানে এক শিম্পাঞ্জির কথা উদাহরণ হিসেবে টেনেছি মাত্র।

ধরুন ব্লগে ঢুকে আপনি দেখলেন, আপনার পোস্টে মন্তব্যকারীর নামের মধ্যে "জেন একাত্তর" ওরফে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্মীয় উগ্রবাদ ও জঙ্গী সৃষ্টি দিল্লী থেকে।

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:১৫


((গত ১১ ডিসেম্বর ধর্মীয় উগ্রবাদ ও জঙ্গী সৃষ্টির ইতিবৃত্ত ১ শিরোনামে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম। সেটা নাকি ব্লগ রুলসের ধারা ৩ঘ. violation হয়েছে। ধারা ৩ঘ. এ বলা আছে "যেকোন ধরণের... ...বাকিটুকু পড়ুন

=আকাশে তাকিয়ে ডাকি আল্লাহকে=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:০১


জীবনে দুঃখ... আসলে নেমে
শান্তি গেলে থেমে;
আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে হই উর্ধ্বমুখী,
আল্লাহকে বলি সব খুলে, কমে যায় কষ্টের ঝুঁকি।

আমি আল্লাহকে বলি আকাশে চেয়ে,
জীবন নাজেহাল প্রভু দুনিয়ায় কিঞ্চিত কষ্ট পেয়ে;
দূর করে দাও সব... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের হাদিকে গুলি করা, আর আওয়ামী শুয়োরদের উল্লাস। আমাদের ভুল কোথায়?

লিখেছেন তানভির জুমার, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:৫৩



৩০ জনের একটা হিটলিস্ট দেখলাম। সেখানে আমার ও আমার স্নেহের-পরিচিত অনেকের নাম আছে। খুব বিশ্বাস করেছি তা না, আবার খুব অবিশ্বাস করারও সুযোগ নাই। এটাই আমার প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

এ যুগের বুদ্ধিজীবীরা !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১:৪০


ডিসেম্বর মাসের চৌদ্দ তারিখ বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবী দিবস পালন করা হয়। পাকিস্তান মিলিটারী ও তাদের সহযোগীরা মিলে ঘর থেকে ডেকে নিয়ে হত্যা করেন লেখক, ডাক্তার, চিকিৎসক সহ নানান পেশার বাংলাদেশপন্থী বুদ্ধিজীবীদের!... ...বাকিটুকু পড়ুন

×