somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্প ঃ দিপালী (২)

০৯ ই এপ্রিল, ২০১৮ সকাল ১১:০৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


শামচুল হক

স্যারের পেটন খাওয়ার পরে ওর সাথে যে দু’দিন কথা বলেছি তাতেই ওর প্রতি আমার একটা আন্তরিকতা এসে গেছে। তবে সে আন্তরিকতায় অন্য কোন দুর্বলতা ছিল না, স্কুলের সহপাঠি হিসাবে কথার খুনসুটির মাধ্যমে যতটুকু পরস্পরের মধ্যে আন্তরিকতা হওয়া দরকার তাই। ঐ বয়সে দুষ্টুমী করতে গিয়ে ঝগড়া শুধু দিপালীর সাথেই নয় এরকম ঝাগড়া অন্য মেয়েদের সাথেও হয়েছে। মুখে কুলোতে না পারলে দূরে থেকে হাত তুলে কিল দেখাতাম। তাতে ওরা আরো ক্ষেপে যেত। ওরা ক্ষেপে গেলে নিজের কাছে খুব খুশি খুশি লাগত। সবার চক্ষু ফাঁকি দিয়ে আড়ালে আবডালে কিল দেখানোর কারণে জোরে চিল্লাতেও পারতো না, আবার অপমানবোধ করে স্যারের কাছে বিচারও দিতে পারতো না। ঝগড়া এমনি এমনি বাঁধলেও দোষ ত্রুটি ওদেরও থাকতো। ওরা এর প্রতিশোধ নেয়ার জন্য চেষ্টা করতো, অনেক সময় সুযোগ পেত অনেক সময় সুযোগ পেত না। সে সব কথা মনে হওয়ায় ইচ্ছা ছিল স্কুলের মাঠে বা ক্লাসে আমার দিকে তাকালে আমি দিপালীকে কিল দেখাবো। এতে ও হয়তো আরো ক্ষেপে যাবে। কিল দেখে ক্ষেপে গেলে আমার কাছে খুব আনন্দ লাগবে। কিন্তু স্কুলের মাঠে ওকে পেলাম না, ক্লাসে বসে ওর দিকে দু’তিনবার তাকালাম ও আমার দিকে একবারও তাকালো না। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম ও যখন সামান্য বড়ই নিয়ে ঝগড়া করে আমার সাথে কথা বলছে না আমিও আর ওর সাথে কথা বলবো না। কিন্তু ওই দিনের পর থেকে দিপালী অনেকদিন স্কুলেই আসল না। অন্য মেয়েরা সবাই আসতো শুধু দিপালী আসতো না। ওকে খ্যাপনোর জন্য মনে মনে যে পরিকল্পনা করেছিলাম তা কোন কাজেই লাগাল না।

গ্রীষ্মের ছুটি তখনও শুরু হয়নি। মর্নিং ক্লাস চলছে। এগারোটার দিকে ক্লাস শেষ করে আমি স্কুলের পূর্বদিকে নদীর তীরে বেড়াতে গিয়েছি। নদীর পাড় থেকে মেয়েলী কণ্ঠে গানের কলি ভেসে এল।

মনের ভুলে নদীর কুলে হাটছি একা একা
এদিক ওদিক বৃথাই খুঁজি নাই তো বন্ধুর দেখা
কৃষ্ণ হেথায় নাইরে কোথাও আছে শুধু রাধে
কোন বিরহে দক্ষিণ বাতাস হুহু করে কাঁদে
এই ছিল কি বিরহিনীর কপালে গো লেখা
এদিক ওদিক বৃথাই খুঁজি নাই তো বন্ধুর দেখা।

দুপুর রোদে তমাল তলে কে বাজায় গো বাঁশি
বাঁশির সুরে টিকতে নারি মন হয় উদাসী
বুকের মাঝে বাড়ায় জ্বালা-- কপাল জুড়ে রেখা
এদিক ওদিক বৃথাই খুঁজি নাই তো বন্ধুর দেখা।
(সংক্ষিপ্ত গান)

কণ্ঠটি চেনা চেনা মনে হলো। চোখ তুলে তাকিয়ে দেখি নদীর দিক থেকে দিপালী ভিজা কাপড়ে গুন গুন করে গান গাইতে গাইতে আসতেছে। পিছনে আরেকজন মাঝবয়েসি মহিলা ভিজা সাদা শাড়ী পরনে। দিপালী প্রথমে আমাকে লক্ষ্য করে নাই। যখন আমাকে দেখতে পেল তখন সে গান গাওয়া বন্ধ করে দিল। আমার কাছাকাছি এসে বলল, কিরে তোর ক্লাস নাই?
--- ক্লাস শেষ করেই তো আসলাম।
--- এগারোটার সময় ক্লাস শুরু হয়, তোর আবার ক্লাস শেষ হলো কেমনে রে?
--- আজ থেকে যে মর্নিং ক্লাস শুরু হয়েছে তুই জানিস না?
--- জানবো কি করে রে, আমি তো অনেক দিন হলো স্কুলে যাই না।
--- কেন, যাচ্ছিস না কেন?
দিপালী কি যেন বলতে যাচ্ছিল, এমন সময় পিছন থেকে মহিলাটি এসে বলল, এ দিপালী, এ ছেলেটা কে রে?
দিপালী মহিলার দিকে মুখ ফিরিয়ে বলল, ও আমাদের সাথে পড়ে মা।
দিপালী আমার সাথে ওর মাকে পরিচয় করে দিল, ইনি আমার মা হয়।
আমি দিপালীর মাকে নমষ্কার দিয়ে বললাম, কাকী, ওকে স্কুলে পাঠান না কেন?
দিপালীর মা একটি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল, বাবা-- স্কুলে তো পাঠাতে চাই, কিন্তু আমার তো স্কুলে পাঠাবার সামার্থ নাই।
-- কেন, কাকা কি করেন?
দিপালীর মা আরেকটি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল, তোমার কাকা থাকলে কি আর ওর লেখা পড়া বন্ধ হয় বাবা!
-- কেন কাকী, কাকা কোথায় গেছে?
-- তোমার কাকাকে একাত্তরের যুদ্ধে পাক সেনারা বাসা থেকে ধরে নিয়ে গুলি করে মেরেছে বাবা।
এ কথা শোনার পর আমি চুপ হয়ে গেলাম। দিপালীর বাবা সম্পর্কে না জেনে প্রশ্ন করায় নিজেকে অপরাধী মনে হলো। আমার মুখ দিয়ে আর কোন কথা বের হলো না। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলাম। হঠাৎ করেই পুরো পরিবেশটা বিষাদে ভরে গেল। কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর দিপালীর মা কান্না ভেজা কণ্ঠে বলল, তুমি ওর বইগুলো বিক্রি করে দিতে পারবে বাবা--?
দিপালীর মায়ের কথা শুনে দিপালীর মুখের দিকে তাকালাম, ওর চোখ দিয়ে তখন টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়ছে। স্বামীহারা স্ত্রীর কান্না আর বাপ হারা মেয়ের চোখের জল দেখে ব্যথিত হলাম। নিজের ভিতেরও কেমন কান্নার আবেগ চলে এলো। নিজেকে সামাল দিতে পারছিলাম না। আমার চোখে জল আসার আগেই সরে যেতে ইচ্ছে হলো। মাথা নিচু করে বললাম, ঠিক আছে কাকী, আমি চেষ্টা করে দেখব। চেষ্টা করে দেখব কথাটি বলেই বললাম, তাহলে কাকী আমি এখন যাই।
দিপালীর মা মুখে ভেজা আঁচল গুজে কান্না জড়িত কণ্ঠে বলল, ঠিক আছে বাবা যাও, আশির্বাদ করি বাবা, তোমরা ভাল ভাবে লেখাপড়া কর।
কিছুদূর যাওয়ার পরে পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখি তখনও দু’জন মুখে কাপড় গুঁজে নিচের দিকে মাথা দিয়ে আস্তে আস্তে যাচ্ছে। বাবা হারা দিপালীর দুরাবস্থা আমার কাছে খুব খারাপ লাগল। মনে পড়ে গেল ২৬শে মার্চের গাওয়া দিপালীর সেই গান। গান গাওয়ার সময় দিপালী কাঁদলো কেন সেদিন না বুঝলেও আজকে বুঝতে পেলাম। সেই দিনের কান্না জড়িত কন্ঠে গান গাওয়ার দৃশ্যটি বার বার চোখে ভাসতে লাগল। মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে গেলাম। আমি আর নদীর দিকে না গিয়ে বাড়ির দিকে রওনা হলাম। এই দিনের পর থেকে দিপালীর সাথে অনেক দিন আর দেখা হয়নি।

(ছবি ঃ ইন্টারনেট)
আগের পর্ব পড়ার জন্য নিচের লিংকে ক্লিক করুন- - -- - -
গল্প ঃ দিপালী
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই নভেম্বর, ২০১৮ রাত ১২:৫৫
৭টি মন্তব্য ৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমি আর এমন কে

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:১৩


যখন আমি থাকব না কী হবে আর?
থামবে মুহূর্তকাল কিছু দুনিয়ার?
আলো-বাতাস থাকবে এখন যেমন
তুষ্ট করছে গৌরবে সকলের মন।
নদী বয়ে যাবে চিরদিনের মতন,
জোয়ার-ভাটা চলবে সময় যখন।
দিনে সূর্য, আর রাতের আকাশে চাঁদ-
জোছনা ভোলাবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

২০২৪ সালের জুলাই মাস থেকে যেই হত্যাকান্ড শুরু হয়েছে, ইহা কয়েক বছর চলবে।

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সন্ধ্যা ৬:৪৭



সামুর সামনের পাতায় এখন মহামতি ব্লগার শ্রাবনধারার ১ খানা পোষ্ট ঝুলছে; উহাতে তিনি "জুলাই বেপ্লবের" ১ জল্লাদ বেপ্লবীকে কে বা কাহারা গুলি করতে পারে, সেটার উপর উনার অনুসন্ধানী... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাজাকার হিসাবেই গর্ববোধ করবেন মুক্তিযোদ্ধা আখতারুজ্জামান !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১১:১৮


একজন রাজাকার চিরকাল রাজাকার কিন্তু একবার মুক্তিযোদ্ধা আজীবন মুক্তিযোদ্ধা নয় - হুমায়ুন আজাদের ভবিষ্যৎ বাণী সত্যি হতে চলেছে। বিএনপি থেকে ৫ বার বহিস্কৃত নেতা মেজর আখতারুজ্জামান। আপাদমস্তক টাউট বাটপার একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

চাঁদগাজীর মত শিম্পাঞ্জিদের পোস্টে আটকে থাকবেন নাকি মাথাটা খাটাবেন?

লিখেছেন শ্রাবণধারা, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:৫৭


ধরুন ব্লগে ঢুকে আপনি দেখলেন, আপনার পোস্টে মন্তব্যকারীর নামের মধ্যে "জেন একাত্তর" ওরফে চাঁদগাজীর নাম দেখাচ্ছে। মুহূর্তেই আপনার দাঁত-মুখ শক্ত হয়ে গেল। তার মন্তব্য পড়ার আগেই আপনার মস্তিষ্ক সংকেত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্মীয় উগ্রবাদ ও জঙ্গী সৃষ্টি দিল্লী থেকে।

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:১৫


((গত ১১ ডিসেম্বর ধর্মীয় উগ্রবাদ ও জঙ্গী সৃষ্টির ইতিবৃত্ত ১ শিরোনামে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম। সেটা নাকি ব্লগ রুলসের ধারা ৩ঘ. violation হয়েছে। ধারা ৩ঘ. এ বলা আছে "যেকোন ধরণের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×