
রহমত বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। হোস্টেলে সিট না পেয়ে পেয়িং গেস্ট হিসাবে ইউনিভার্সিটির কাছেই বাসা নিয়েছে। তিন তলায় তিন রুমের বাসা। ভিতরের দু’রুমে বাড়িওয়ালা থাকে। গেষ্ট রুমের মত ছোট একটি রুমে রহমত থাকে। বাড়িওয়ালা ভদ্রলোকের নাম বিরু ভুইয়া। বিরু ভুঁইয়া আসলে বাড়িওয়ালা নন তিনিও ভাড়াটিয়া। সরকারী অফিসে এলডিএর চাকরী করেন। যা বেতন পান তা দিয়ে পুরো বাসার ভাড়া দিলে সংসার চালাতে কষ্ট হয়, তাই কিছুটা আর্থিক সচ্ছলতার জন্যই পেয়িং গেষ্টে লোক নেওয়া। মাসে থাকা খাওয়াসহ তিন হাজার টাকা, সস্তাই বটে। শুধু তিনবেলা ভাত খেতেই তো মাসে আড়াই তিনহাজার টাকা লাগে, সেখানে পুরো একটি রুমসহ থাকা খাওয়া তিনহাজার টাকা হওয়ায় আর্থিক সাশ্রয়ের দিক দিয়ে রহমতের জন্য খুব সুবিধাই হয়েছে।
রুম কিছুটা ছোট হলেও একজনের জন্যে যথেষ্ট। নিরিবিলি রুম হওয়ায় ইচ্ছা মত পড়তে পারে। শরীর ভাল থাকলে পড়ে, না থাকলে শুয়ে থাকে, কেউ ডিস্টার্ব করে না। লোকগুলোও ভাল। অমায়িক ব্যবহার। দু’টি বাচ্চা আছে, একটি ক্লাস সিক্সে আরেকটি ক্লাস ফোরে পড়ে। খাবার খারাপ নয়, তিন বেলাই মান সম্মত খাবার খায়। রহমত প্রায় একবছর হলো এদের সাথে আছে। উভয় পক্ষ থেকেই কারো কোন অভিযোগ নেই। এক বছরে রহমত তাদের অনেকটা আপনজনের মতই হয়েছে। ভদ্রলোক ভদ্রমহিলা দুইজনই রহমতকে ছোট ভাইয়ের মতই মনে করে। ভদ্রলোক না থাকলে মাঝে মাঝে বাজারও করে। বাজার করতে তার আপত্তি নেই, কারণ এই বাজার তো সে নিজেও খায়।
সেদিন হঠাৎ বাড়ি থেকে ফোন এসেছে, বিরু ভুঁইয়ার মা অসুস্থ্য। মরাণাপন্ন অবস্থা। তড়িঘড়ি ছুটি নিয়ে বউ বাচ্চাসহ বাড়ি চলে গেছে। যাওয়ার সময় বিরু ভুঁইয়ার স্ত্রী রহমতকে সব ঘরের চাবি দিয়ে গেছে। অনেক দিন হলো একই বাসায় থাকার কারণে রহমতের উপর তাদের অগাধ বিশ্বাস জন্ম নিয়েছে। আর এই বিশ্বাসের উপর ভর করেই রহমতকে সব ঘরের চাবি দিয়ে গেছে।
রহমত বাসায় একদম একা। একা একা বাসায় পড়াশুনার পাশাপাশি নিজেই রান্না করে খায়। শুয়ে বসে থাকে, ভাল না লাগলে বাইরে ঘুরে বেড়ায় অথবা ক্যাম্পাসে গিয়ে বন্ধু বান্ধবের সাথে আড্ডা দেয়।
এভাবে তিন চার দিন যেতে না যেতেই হঠাৎ রহমতের গায়ে জ্বর আসে। এরকম জ্বর এর আগেও অনেক হয়েছে। দুই একটা নাপা খেলেই সেরে যায়। সেই ভাবনা থেকে নিজে নিজেই নাপা কিনে খেয়েছে। কিন্তু জ্বর সারে না। আস্তে আস্তে জ্বর বাড়তেই থাকে। তিনদিনের জ্বরেই কাহিল। সকালে বমি করে আরো দুর্বল হয়েছে। উঠে দাঁড়াতে গেলে মাথা ঘোরে। সোজা হয়ে হাঁটতে কষ্ট হয়। রহমতের ভয় হলো এ অবস্থায় একা একা মরে পড়ে থাকলেও কেউ দেখার নেই। আশে পাশে কোন আত্মীয় স্বজনও নেই যে তাকে খবর দিয়ে আনবে। মরার আগে অন্তত বেঁচে থাকার সর্বোচ্চ চেষ্টা করা দরকার। দেয়াল ধরে হেঁটে হেঁটে পাসের ফ্লাটে গিয়ে কড়া নাড়ল। কড়া নাড়তেই ভিতর থেকে মহিলা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, কে?
-- খালা আমি।
-- আমি কে?
-- রহমত।
দরজা খুলে গেল। দরজার ভিতরে মধ্য বয়স্ক মহিলা দাঁড়িয়ে আছে। রহমত কোন কথা না বলে মহিলার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। তার তাকানো দেখে মহিলা জিজ্ঞেস করল, কিছু বলবে রহমত?
অসুস্থ্য রহমত অসহায়ের মত কাতরাতে কাতরাতে মিন মিন করে বলল, খালা আমার খুব জ্বর। আমি দরজা খুলে রেখেছি। আপনি মাঝে মাঝে আমায় একটু খেয়াল রাখবেন।
-- কেন, বাসায় কেউ নেই?
-- না খালা, আমি একা।
-- গায়ে কি খুব জ্বর, বলেই মহিলা এগিয়ে এসে রহমতের কপালে হাত দিল। হাত দিয়েই চমকে উঠল। গা জ্বরে পুরে যাচ্ছে। আতংকিত হয়েই জিজ্ঞেস করল, মাথায় পানি ঢেলেছো?
রহমত কোকাতে কোকাতে বলল, না।
রহমাতের অসহায় অবস্থা দেখে মহিলার খুব মায়া লাগল। রহমতকে ধরে বাসায় নিয়ে বেসিনে অনেকক্ষণ মাথায় পানি ঢেলে দিল। গামছা দিয়ে মাথা মুছিয়ে দিতে দিতে বলল, তোমার আপনজন কাউকে ডেকে আন, এভাবে একলা একলা জ্বর নিয়ে থাকা উচিৎ নয়। আমার পক্ষে তো সবসময় তোমার রুমে আসা সম্ভব হবে না।
মহিলার কথা শুনে রহমত দুর্বল কণ্ঠে আস্তে আস্তে বলল, আমার ক্লাসের বন্ধুবান্ধবদের আসতে বলেছি। ওরা আসতে চেয়েছে, কিন্তু এখনও এলো না।
-- বন্ধু বান্ধব কেন, তোমার নিজের কেউ নেই?
-- না খালা, ঢাকায় আমার নিজের কেউ নেই।
-- তোমার বাড়ি কোথায়?
-- কুড়িগ্রাম।
-- তাহলে তোমার বন্ধুদের আসতে বল, তোমাকে তো এভাবে একা থাকা যাবে না। মহিলা তার কথা শেষ করতে না করতেই তিনটি মেয়ে খোলা দরজা দিয়ে রুমে চলে এলো। হাতে আঙুর, আপেল, পাউরুটি নিয়ে এসেছে।
মহিলা জিজ্ঞেস করল, এরা কারা?
-- আমার ক্লাসমেট। কাউকে খুঁজে না পেয়ে টেলিফোনে ওদেরকেই আসতে বলেছি।
-- তা ভালই করেছো, বলেই মহিলা মেয়েদের উদ্দেশ্য করে বলল, তোমরা থাক-- আমি একটু বাসায় যাই। আমার বাসায় অনেক কাজ।
রানু বলল, খালা যাবেন কেন? আমরা তো থাকবো না, এখনই চলে যাবো।
-- কেন, কোথায় যাবে?
-- আমাদের ক্লাস পরীক্ষা আছে, আমরা থাকতে পারবো না। টেলিফোনে ওর কাকুতি মিনতি শুনে ওকে দেখতে এসেছি।
রানুর কথা শুনে মহিলা বলল, ঠিক আছে, তোমরা ওর কাছে কিছুক্ষণ বস, আমি বাসার কাজগুলো গুছিয়েই আসতেছি। বলেই ভদ্র মহিলা চলে গেলেন।
রানু, মাহিয়া, বকুল। এদের তিনজনের মধ্যে রানুর সাথেই রহমতের সম্পর্ক ভাল। দুইজনের ঘনিষ্ঠতাও বেশি। বকুল ওদের বান্ধবী বটে তবে অন্য সাবজেক্টে পড়ে। রানু, মাহিয়া চলে যাওয়ার জন্য ব্যাস্ত। রহমতের গায়ে প্রচন্ড জ্বর থাকায় যেতে চেয়েও যেতে পারছে না। ভদ্র মহিলাও আসছে না। রানু রহমতকে জিজ্ঞেস করল, মহিলার বাসা কোথায় রে?
-- পাসের ফ্লাটে, কেন?
-- মহিলা এলেই চলে যাবো রে।
-- চলে যাবি, আমার কাছে থাকবে কে রে?
-- ওই মহিলা তো আছে?
-- মহিলা তো আমার ঘনিষ্ঠ কেউ নয়। তাছাড়া তার সাথে কোনদিন কথাও বলিনি। জ্বরের তাপ সহ্য করতে না পেরে কিছুক্ষণ আগে ডেকে এনেছি।
-- তোর বাসায় কেউ নেই?
-- না।
-- বাসার সবাই গেছে কোথায়?
-- বাসাওয়ালা ভদ্রলোকের মা অসুস্থ্য, তাই আমাকে বাসায় রেখে সবাই গ্রামের বাড়ি চলে গেছে।
-- আমাদের ক্লাস পরীক্ষা আছে, আমরা তো থাকতে পারবো না রে।
-- তাহলে পাসের ফ্লাটে গিয়ে কড়া নাড়লেই খালা চলে আসবে।
-- খালার বাসায় আর কে কে আছে?
-- এখন কেউ নেই, খালা একা।
-- কেন, ছেলে মেয়ে নেই?
-- যতটুকু জানি দুই মেয়ের বিয়ে হয়েছে। একটি ছেলে আছে ঢাকা ভার্সিটিতে পড়ে।
-- খালার স্বামী কি করে?
-- সরকারী চাকুরী করে।
রানু রহমতকে আর কিছু জিজ্ঞাসা না করে দরজা খুলে পাসের ফ্লাটে গিয়ে কড়া নাড়ল। ভিতর থেকে জবাব এলো, কে?
রানু জবাব দিল, খালা আমি।
মহিলা দরজা খুলে দিল, রানুকে দেখে জিজ্ঞেস করল, ওর জ্বর কি আরো বেশি হয়েছে?
রানু বলল, না খালা। আপনি এলেই আমরা চলে যাবো, আমাদের দুইটা থেকে পরীক্ষা আছে, আমরা থাকতে পারবো না।
-- তোমরা চলে গেলে ওকে দেখবে কে? আমি তো সব সময় ওর কাছে থাকতে পারবো না। আমার সংসার আছে না? আমি একা মানুষ, আমার অনেক কাজ। তোমরা কেউ থাক।
-- কে থাকবে খালা? তাছাড়া এরকম খালি বাসায় আমাদের মতো মেয়েদের থাকা কি সম্ভব?
ভদ্র মহিলা চিন্তা করলেন, ছেলেটাকে এই অবস্থায় কোনভাবেই একা রাখা ঠিক হবে না, আবার নিজের থেকে কাউকে খবর দিয়ে আনবে এধরনের কেউ এই মুহুর্তে তার হাতের কাছে নেই, কাজেই এই মেয়েদেরকেই রাখা দরকার, তবে ভার্সিটি পড়ুয়া এসব অবিবাহিতা মেয়েদের উৎসাহ না দিলে রাখা যাবে না। ওরা থাকলে তিনিও সবসময় তাদের সাথে থাকবে এমন উৎসাহমূলক আশ্বাস দিয়েই বলল, আরে মেয়ে তোমরা ভয় পাচ্ছ কেন? তোমাদের পাশে আমি তো আছি। তোমরা থাকলে আমিও কাজের ফাঁকে ফাঁকে এসে দেখে যাবো।
রানুর সাথে কথা বলতে বলতে মহিলা রহমতের বিছানার কাছে চলে এলো। রহমত তখনও জ্বরে লেপসহ কাঁপছে। তার এ অবস্থা দেখে মহিলা বলল, তোমাদের মধ্যে পরীক্ষা নেই কার, সে আপাতত থাক। ছেলেটার গায়ে যেভাবে জ্বর এসেছে ওকে একা রাখা ঠিক হবে না।
রানু মাথাটা কাত করে ভদ্রমহিলার দিকে তাকিয়ে প্রশ্নসূচক ভঙ্গিতে বলল, খালা-- তাহলে এক কাজ করলে হয় না?
-- কি কাজ?
-- ওকে হাসপাতালে পাঠালে হয় না।
মহিলা একটু চিন্তা করে বলল, কথা মন্দ বলো নাই, ছেলেটার গায়ে যেভাবে জ্বর এসেছে তাতে হাসপাতালেই পাঠানো দরকার, কিন্তু হাসপাতালে পাঠালেও তো সাথে একজন থাকতে হবে, কে থাকবে?
-- আমরা তো কেউ থাকতে পারবো না।
-- তোমরা কেউ থাকতে না পারলেও ওকে অন্তত হাসপাতালে পৌঁছে দিতে হলেও তো সাথে কাউকে না কাউকে যেতে হবে?
-- খালা এই মুহুর্তে আমরা যেতে পরবো না, আমাদের হাতে সময় নেই।
-- তোমাদের মধ্যে যার পরীক্ষা নেই সে আপাতত থাকো, তোমরা পরীক্ষা দিয়ে ফিরে এলে না হয় হাসপাতালে পাঠানোর চিন্তা করা যাবে।
রানু বকুলের দিকে তাকিয়ে বলল, বকুল তুই থাক, তোর তো পরীক্ষা নাই।
বকুল বলল, ধ্যেৎ-- তোরা পাগোল হয়েছিস নাকি, আমার পক্ষে থাকা সম্ভব?
-- তুই আপাতত থাক, আমরা দুইজন পরীক্ষা দিয়েই বিকালে চলে আসবো।
মহিলা বকুলকে উদ্দেশ্য করে কিছুটা আদর মাখা ভঙ্গিতে বলল, মা বকুল, তুমি থাক, ছেলেটা এই মুহুর্তে অসহায়। ওর কাছে না থাকলে যে কোন অঘটন ঘটার সম্ভাবনা আছে, তাছাড়া আমি তো তোমার সাথেই আছি।
রানু বকুলের একটি হাত তার দুই হাতের মুঠির মধ্যে নিয়ে চেপে ধরে বলল, বকুল, আমি তোকে জোর হাত করে অনুরোধ করছি রে, তুই থাক।
বকুল রানুর কাথায় না থাকার অজুহাত তুলে বলল, আরে আমি থাকবো কিভাবে? আমি তো কোন প্রস্তুতি নিয়ে আসি নি, এক কাপড় পড়ে থাকা যায়?
রানু বকুলের হাত ধরে অনুরোধের সুরে বলল, বকুল-- আমি তোর দুই হাত ধরে রিকোয়েস্ট করছি রে, তুই আর না করিস না, দয়া করে এই তিন চার ঘন্টা কষ্ট করে থাক, আমরা দুইজন পরীক্ষা দিয়েই তোর কাপড়-চোপড় নিয়ে চলে আসব।
তাদের চাপাচাপিতে বকুল আর না করতে পারল না। বকুলকে রেখে রানু আর মাহিয়া চলে গেল। দুপুরে বকুলের খাবার মহিলা নিজেই বাসা থেকে এনে দিল। বকুল রান্না করতে চেয়েছিল কিন্তু মহিলা রান্না করতে দিল না।
বকুল মফস্বলের মেয়ে। অনেকটা শান্তশিষ্ট ধৈর্যশীলা। কিন্তু ধৈর্যশীলা হলে কি হবে-- বাবা মায়ের আদরের দুলালী হওয়ায় জীবনে কোন দিন রুগীর সেবা করা তো দূরের কথা কখনও রান্না পর্যন্ত করেনি।
রানুরা চলে যাওয়ার ঘন্টাখানেক পরেই রহমত ফ্লোর ভরে বমি করে দিল। রহমতের বমি দেখে বকুল দৌড়ে মহিলাকে ডেকে আনল। মহিলা বমি দেখে বলল, এক কাজ কর বকুল, একটা ন্যাকড়া নিয়ে এসো-- এগুলো পরিস্কার করতে হবে। নোংরা নিয়ে বসে থাকা যাবে না।
ভদ্রমহিলা ভেবেছিল বকুল নোংরা পরিস্কার করার কাজে সহযোগীতা করবে। কিন্তু বমি পরিস্কার করা তো দূরের কথা, ঘরের কোনায় গিয়ে নাক চিপে ধরে দাঁড়িয়ে রইল।
(চলবে- --)
(বিঃদ্রঃ গল্পটি আগে একবার পোষ্ট করার পর কিছু সংযোজন সংশোধের নিমিত্তে ড্রাফটে নেয়া হয়েছিল, এখন আবার পোষ্ট করা হলো। পোষ্টে যারা মন্তব্য করেছিলেন তারা হলেনঃ ব্লগার সালাউদ্দীন খালেদ, জাহিদ অনিক, আটলান্টিক, রাজীব নুর, চাঁদগাজী এবং নূর মোহাম্মদ নূরু ভাই। অফটপিকে নুরু ভাই একটি প্রশ্ন করেছিলেন টেলিফোনে এব্যাপারে আপনার সাথে কথা হবে।)
(ছবি গোগুল)
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা মে, ২০১৮ দুপুর ১২:২৭

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।





