রাষ্ট্র এবং বন্ধুত্ত্ব - ধারণা প্রসঙ্গে সমাজে কিছু মৌলিক মিস-কনসেপশন আছে; আমাদের পপুলার ধারণাতেও অবশ্য এই ভুল ধারণা আছে। এই বিষয়টার কিছু পরিস্কার করা যায় কী না সেই কথা ভেবে এই পোষ্ট।
যেদিন থেকে যে কোন নতুন রাষ্ট্রের অভ্যুদ্বয় ঘটে সেইদিন থেকে সেই রাষ্ট্র বাকি আগে থেকে থাকা সব রাষ্ট্রের কাছে শত্রু; রাষ্ট্রের বাই ডেফিনেশন ও বাই ডিফল্ট এই বৈশিষ্ট থাকতে বাধ্য; কারণ রাষ্ট্র মানে শত্রু-মিত্রের ভেদাভেদ - মিত্রদের সাথে মিলে এক হয়ে নতুন রাষ্ট্র গঠন, তার নাগরিক হওয়া আর বাকি সবাই - আগে থেকে উপস্হিত রাষ্ট্র বা না-রাষ্ট্র তখন থেকে এর শত্রু হয়ে যায়। এই মৌলিক সংজ্ঞার বাইরে কাউকে যখন বন্ধুরাষ্ট্র বলতে শুনব তখন বুঝতে হবে এটা একটা না-বুঝে বলা বাকোয়াজ শব্দ অথবা নেহায়তই একটা ডিপলোম্যাটিক শব্দ। রাষ্ট্রের একদিকে, জন্মগত এই শত্রু বিষয়ক গুরুত্ত্বপূর্ণ উপাদান খেয়াল থাকে আবার অন্যদিকে, অন্য রাষ্ট্রের সাথে ব্যবসা বাণিজ্যের স্বার্থও থাকে বলে - ডিপলোমেটিক ভাষা নামে এক নতুন ভাষার প্রকারভেদ চালু হয়েছে। ডিপলোমেটিক ভাষার মৌলিক ভিত্তি হলো - রাষ্ট্রের জন্মগত শত্রু বিষয়ক গুরুত্ত্বপূর্ণ উপাদান সে অস্বীকার করে না, করলে রাষ্ট্রই থাকে না, আবার অন্য রাষ্ট্রের সাথে নিজ রাষ্ট্রস্বার্থে কথাও বলা দরকার - অতএব কথা বলার সময় একটা ভান সবসময় সামনে ঝুলিয়ে রাখতে হবে - মনে করিয়ে দেয়া যাবে না যে আমরা পরস্পর শত্রু কথা বলতে বসেছি কিন্তু মনের ভিতরে ভুলাও যাবে না যে আমরা আসলেই পরস্পরের শত্রু; অতএব একটা ক্যামোফেল্কস লাগবে। ফলে ভাষার চাতুরিই ভরসা - ডিপলোমেটিক ভাষার জন্ম। তাই একমাত্র ডিপলোমেটিক ভাষাতেই বন্ধুরাষ্ট্র বলে কোন শব্দ চালু থাকে, অর্থও ডিপলোমেটিক; অর্থাৎ আসলে কথা সত্যি না বরং উল্টা; এই সত্য লুকাতে ডিপলোমেটিক মুখোশ পরে উভয় রাষ্ট্রই বন্ধু বন্ধু ভাব ধরি কেবলমাত্র কথা বলার সুবিধা নেবার জন্য।
রাষ্ট্রের শত্রুতা বিষয়ক জন্মগত উপাদান - এই ভাব, টেনশন আরও ভাল বুঝা যায় "প্রটোকল" বা "ডিপলোমেটিক প্রটোকল" বলে শব্দে। একজন আর একজনের সাথে কথা সরাসরি বললে কী সমস্যা হবে? সমস্যা হলো, রাষ্ট্রপ্রধান বা রাষ্ট্রের প্রতিনিধি স্রেফ একজন ব্যক্তি নয় সমগ্র রাষ্ট্রের সব নাগরিকের প্রতিনিধি, সিম্বল, প্রতীক। ফলে দুই রাষ্ট্র কথা বলতে পারে একমাত্র সেয়ানে সেয়ানে - পরস্পর পরস্পরকে সমান গণ্য করে তবেই, এতে কোন রাষ্ট্র আকারে, অর্থনীতিতে ছোটবড় এতে কিছু যায় আসে না।
ধরা যাক, ১৯৭১ সালে আমরা কিছু করি নাই। ভারত আমাদেরকে একটা রাষ্ট্র বানিয়ে দিয়ে গেছে। এই পরিস্হিতি রাষ্ট্রের শত্রুতা তত্ত্ব কোথায় যাবে?
জবাব সহজ। ১৯৭১ সালে স্বীকৃত থাক না থাক, যতক্ষণ বাংলাদেশ রাষ্ট্রের নাগরিক একে রাষ্ট্র বলে ধরে নিবে মানবে - তাঁদের স্বার্থের প্রতিভু হয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্র দাড়িয়ে যাবে। কারণ, সত্য-মিথ্যা, দূর্বল-সবল যাই হোক বাংলাদেশ রাষ্ট্র হয়ে আছে ফলে এই রাষ্ট্রকে ঘিরেই এর নাগরিকের আশা আকাঙ্খা স্বার্থ প্রকাশের কেন্দ্র হয়ে দাঁড়াতে সে বাধ্য। এই স্বার্থ মানে, বাংলাদেশ রাষ্ট্র নামে যা খাড়া হয়ে আছে, তা ভারত রাষ্ট্রের স্বার্থের সাথে সংঘাত শত্রুতা উপাদান নিয়ে হাজির হতে বাধ্য।
কাজেই সোনার পাথরের বাটি বললে যেমন কথার মানে হয় না - বুঝা যায় না এটা সোনার না পাথরের, ঠিক তেমনি বন্ধুরাষ্ট্র মানেও তাই। কথার একটাই মানে - পুরানো দুই রাষ্ট্রই ভেঙ্গে নতুন রাষ্ট্র গঠন অথবা চুপচাপ কিছু না বলে অন্যরাষ্ট্র-স্বার্থ তা নিজের স্বার্থ হয়ে গেছে ফলে অন্যরাষ্ট্রে অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাওয়া - যেটা এক রাষ্ট্র বলে ঘোষণার কেবলমাত্র কিছু ফর্মালিটি বাকি থেকে গেছে তাই সাময়িক বন্ধুরাষ্ট্র বলা হয়ত; দুচার মাসের মধ্যেই সেটা বলার আর দরকার থাকবে না।
যে বন্ধু সে আর রাষ্ট্রের বাইরে থাকবে কেন? তার জায়গা তো ভিতরে। ভিতরে এক সাথে মিলে রাষ্ট্র গড়ব তাঁর সাথে। মানেই কেউই আর রাষ্ট্রের বাইরে থাকবে না। একই রাষ্ট্রের ভিতরে ফলে আলাদা করে আর বন্ধু শব্দ ব্যবহারের দরকার নাই, ফুরিয়ে গেছে। কিন্তু যদি মিলে যাওয়া অসম্ভব মনে হয় তাহলে বুঝতে হবে সে বন্ধু নয়, তার জায়গা রাষ্ট্রের বাইরে।
রাষ্ট্রে, বন্ধুত্ত্ব হতে পারে একমাত্র রাষ্ট্রের ভিতরে, শত্রুর জায়গা বাইরে। কারণ, রাষ্ট্র মানেই শত্রু আর মিত্রের ভেদাভেদের সীমানা।
ফলে ১৯৭১ সালে আমাদের জন্মগত দূর্বলতা সবলতা যাই থাক, কিছুই যাই আসে না তাতে - আমার কথা সত্য।
এই লেখাটা মন্তব্য আকারে একটু অদলবদল করে এই পোষ্টে Click This Link লিখেছিলাম।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




