somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ইসলামি ব্যাংকিং ব্যবস্থার সরল পাঠ- এক

২২ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ বিকাল ৩:২৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


ব্লগে প্রায়শই ইসলামী ব্যাংকিং নিয়ে পোস্ট আসে। আমাদের দেশে মূলধারার প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশুনায় ইসলামী ব্যাংকিং নিয়ে বিশদ পড়াশুনার সুযোগ নেই। পাশাপাশি, বাংলাদেশে কার্যরত ইসলামী ব্যাংকগুলোর পুরোমাত্রায় শরীয়াহ পরিপালনের চেয়ে ‘ধর্মীয় আবেগ’ কাজে লাগাতে বেশি উৎসাহী হওয়ার কারণে আখেরে ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থা সম্পর্কেই সাধারণ জনমানসে ভুল ধারণা তৈরী হচ্ছে। এ কারণে ব্লগে আসা পোস্টগুলোও সচরাচর ইসলামী ব্যাংকিং সম্পর্কে নেতিবাচক হয়।

শুরুতেই একটা বিষয় পরিষ্কার করা দরকার। ইসলামী ব্যাংকিংব্যবস্থা এবং বাংলাদেশে এই ব্যবস্থায় পরিচালিত ব্যাংক, এই দু’টি ভিন্ন আলোচনার বিষয়। কোন ব্যাংক যদি পুরোপুরিভাবে শরীয়াহ পরিপালন না করে বা করতে না চায়, সেটা তো আর ইসলামী ব্যাংকিংব্যবস্থার ভুল বা দুর্বলতা হতে পারে না। যেমনভাবে গণতান্ত্রিক কাঠামোতে চলা দেশ মানেই পুরোপুরি গণতন্ত্র মানা দেশ নয়। আমাদের দেশও গণতান্ত্রিক দেশ এবং বর্তমানে এই দেশ কিভাবে চলছে সেটাও সবাই জানে। তার মানেতো আর এই না যে ‘গণতন্ত্র’ বিষয়টাই ভুল।

আমার বক্তব্যটা এখানেই। আমাদের দেশে পরিচালিত ইসলামী ব্যাংকগুলোর ভুল, দুর্বলতা, ব্যর্থতাগুলোকেই অধিকাংশ মানুষ ইসলামী ব্যাংকিংব্যবস্থার দুর্বলতা বা ভুল বলে চালিয়ে দিতে চায়। আর বারাকাতীয় প্রপাগাণ্ডার ফলে সেই ভুল ধারণাগুলো ক্রমেই স্থায়ী বিশ্বাসে পরিণত হতে থাকে। একইসাথে আমাদের ঈর্ষাকাতর হুজুর সমাজও ইসলামী ব্যাংকিং নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্য করে থাকেন। তাঁদের অনেকের মন্তব্যে মনে হয়, ন্যূনতম ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থা যেখানে রয়েছে, তার চেয়ে পুরোমাত্রায় সুদভিত্তিক ব্যাংকিংই ভালো।

প্রচলিত ধারার ব্যাংকিং ব্যবস্থা শুরুর প্রায় সাড়ে ছয়শত বছর পর শরীয়াহভিত্তিক ব্যাংকিং ব্যবস্থার প্রাতিষ্ঠানিক ধারা শুরু হয়। ধারণা করা হয় যে ১৬ শতকে ইতালিতে প্রথম সনাতনী পদ্ধতির ব্যাংকিং ব্যবস্থা, যেটি প্রধানত সুদভিত্তিক, প্রাতিষ্ঠানিকভাবে তার উম্মেষ ঘটে। অন্যদিকে শরীয়াহ মূলনীতির ভিত্তিতে গত শতকের মাঝামাঝি সময়ে ইসলামি ব্যাংকিং ব্যবস্থা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করে। যার প্রথম দৃষ্টান্ত দেখা যায় ১৯৫০ এর শেষের দিকে পাকিস্থানের গ্রাম অঞ্চলে (রডনি উইলসন, ব্যাংকিং এন্ড ফিন্যান্স ইন দ্য এরাব মিডল ইস্ট- সেন্ট মার্টিনস প্রেস, নিউ ইয়র্ক- ১৯৮৩ এবং সেনজিজ ইরল ও রাদি আল বিদৌর, এটিচিউডস, বিহেভিয়র এন্ড প্যাট্রোনেজ ফ্যাকটরস অব ব্যাংক কাস্টমারস টুয়ার্ডস ইসলামিক ব্যাংকস- ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব ব্যাংক মার্কেটিং, ভলিউম ৭, ১৯৮৯)।

এর পর এই ধারার উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয় মিশরে অর্থনীতিবিদ আহমেদ আল নাজ্জার এর হাত ধরে। ১৯৬৩ সালে তিনি মিটগামার শহরে ‘মিটগামার সেভিংস প্রজেক্ট’ চালু করেন, যা মূলত প্রাতিষ্ঠানিক ইসলামি ব্যাংকিংয়ের শক্ত ভিত্তি গড়ে দেয়। ১৯৬৮ সালে সরকারকর্তৃক এই প্রজেক্ট বন্ধ হয়ে গেলেও ততদিনে মিশরে আরো ৭টি একই ধরণের প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭৫ সালে আধুনিক ইসলামি ব্যাংক হিসেবে দুবাই ইসলামিক ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়।

ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থার মূল কথাটাই হলো আর্থিক লেনদেনে সুদ বর্জন করা। ইসলামী ব্যাংকগুলোও প্রচলিত ব্যাংকের মতই গ্রাহকের কাছ থেকে আমানত সংগ্রহ করে কিন্তু প্রচলিত ব্যাংকগুলোর মত লোন দেয় না। তারা বিনিয়োগ করে এবং এই বিনিয়োগ থেকে পাওয়া মুনাফার একটা অংশ চুক্তি অনুযায়ী গ্রাহককে ফেরত দেয়। এই লোন দেওয়া এবং বিনিয়োগের পার্থক্য কি, সেটা অন্য আলোচনায় বিস্তারিত বলবো।

প্রথমত আমাদেরকে জানতে হবে সুদ কি এবং কিভাবে কাজ করে। মূলত, নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকার উপরে পূর্বনির্ধারিত হারে যে অতিরিক্ত টাকা দেওয়া হয়, সেটিই সুদ। যে কোনো পরিস্থিতিতে এই সুদের হার নির্দিষ্ট থাকে। এই নীতি মেনে প্রচলিত ব্যাংকগুলো আপনার আমানতের বিপরীতে পূর্বনির্ধারিত হার, ধরুন সেটা ১০ শতাংশ, সে হিসেবে ১০ শতাংশ সুদ মূল টাকার উপরে অতিরিক্ত টাকা দেয়। এ ক্ষেত্রে ব্যাংক তার ব্যবসায় লাভ করুক বা লোকসান দিক, গ্রাহক তার মূল টাকার উপরে ১০ শতাংশ বেশি টাকা পাবেই।

অন্যদিকে ইসলামী ব্যাংকগুলো বলছে, না, আমি তোমার টাকার উপরে ১০ শতাংশ বেশি দিবই, এটা আমি নিশ্চিত করতে পারবো না। তবে হ্যাঁ, আমি তোমার টাকা দিয়ে ব্যবসা করবো, আমার ব্যাংকের এক্সপার্ট টিম গবেষণা করে দেখেছে যে, বাজারে এ মুহূর্তে আমার ব্যাংকের যে পরিমাণ টাকার বিনিয়োগ আছে, তাতে করে বছরর শেষে ১০ শতাংশের মত মুনাফা করা সম্ভব। সে হিসেবে আমরা বছর শেষে তোমাকে ১০ শতাংশ মুনাফা দিব। কিন্তু যদি আমরা ৯ শতাংশ মুনাফা করি, তবে তুমিও ৯ শতাংশ মুনাফা পাবে, আর যদি ১১ শতাংশ মুনাফা করি, তবে তুমিও ১১ শতাংশ মুনাফা পাবে। অথবা, আমি যদি কোন মুনাফা করতে না-ই পারি, তবে তুমিও কোন মুনাফা পাবে না।

আপনাদের যাদের ইসলামী ব্যাংকগুলোতে অ্যাকাউন্ট আছে, তাঁরা যদি অ্যাকাউন্টের দীর্ঘমেয়াদী স্টেটমেন্ট ফলো করেন, তাহলে দেখবেন সেখানে বছর শেষে একবার প্রভিশনাল মুনাফা হিসেবে ১০ শতাংশ মুনাফা যোগ হয় এবং কিছুদিন বাদে ব্যাংকের মোট মুনাফা হিসেব নিকেশ হওয়ার পর আবারো মুনাফা যোগ হয়।

এখন প্রশ্ন হলো, আমানতকারী হিসেবে আমি কি কোনসময় লোকসানের ভাগীদার আমি হয়েছি? উত্তর হলো, না। কারণ, ব্যাংকের মুনাফাটা হিসেব হয় মোট বিনিয়োগের বিপরীতে। যেখানে হয়তো ১০টা বিনিয়োগে ব্যাংক লস করেছে, কিন্তু ৯০টা বিনিয়োগে লাভ করেছে। তাই দিন শেষে ক্ষুদ্র আমানতকারী হিসেবে আমাকে কখনোই লোকসানের ভাগীদার হতে হয়নি।

ইসলামী ব্যাংকিংব্যবস্থায় আমানতকারীর আমানতের বিপরীতে মুনাফা দেওয়ার পদ্ধতি সরল বাংলায় এটাই। এখন কোন ইসলামী ব্যাংক এই মূলনীতি কতটুকু অনুসরণ করছে, আদৌও অনুসরণ করছে নাকি নির্দিষ্ট একটি উচ্চহার বলে বড় কোন কর্পোরেট ক্লায়েন্টকে আকৃষ্ট করছে, সেটা একান্তই ওই ব্যাংকের ব্যর্থতা। ইসলামী ব্যাংকিংব্যবস্থার কোন ভুল নয়।

আপাতত এটুকুই। পরের পর্বে বিনিয়োগ নিয়ে বলবো।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ বিকাল ৪:০৮
৭টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জামায়াত শিবির রাজাকারদের ফাসির প্রতিশোধ নিতে সামু ব্লগকে ব্লগার ও পাঠক শূন্য করার ষড়যন্ত্র করতে পারে।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৪৯


সামু ব্লগের সাথে রাজাকার এর সম্পর্ক বেজি আর সাপের মধ্যে। সামু ব্লগে রাজাকার জামায়াত শিবির নিষিদ্ধ। তাদের ছাগু নামকরণ করা হয় এই ব্লগ থেকেই। শুধু তাই নয় জারজ বেজন্মা... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাওরের রাস্তার সেই আলপনা ক্ষতিকর

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৫৯

বাংলা বর্ষবরণ উদযাপন উপলক্ষে দেশের ইতিহাসে দীর্ঘতম আলপনা আঁকা হয়েছে কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম হাওরের ‘অলওয়েদার’ রাস্তায়। মিঠামইন জিরো পয়েন্ট থেকে অষ্টগ্রাম জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এই আলপনার রং পানিতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছবির গল্প, গল্পের ছবি

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৩:১৫



সজিনা বিক্রি করছে ছোট্ট বিক্রেতা। এতো ছোট বিক্রেতা ও আমাদের ক্যামেরা দেখে যখন আশেপাশের মানুষ জমা হয়েছিল তখন বাচ্চাটি খুবই লজ্জায় পড়ে যায়। পরে আমরা তাকে আর বিরক্ত না করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×