লাত্থি দেওয়া ছাড়া ফুটবলের যে আর কোন কাজ থাকতে পারে, সেটাই যখন বুঝতাম না ঠিকমত, সেরম এক সময়ে ম্যারাডোনার নামের সাথে আমার পরিচয়। নব্বুইয়ের এক অন্ধকার ভোরে ঢাকা থেকে বাড়ির পথে রওনা হওয়ার জন্য হোস্টেল থেকে বেরিয়ে গলির মুখে এক দোকানে দেখি মানুষের জটলা। ঝিরঝিরে বৃষ্টি হচ্ছিল সম্ভবত। ভাইয়ের সাথে আমিও জটলায় দাড়িয়ে গেলাম। সাদাকালো টিভিতে দেখলাম খাটো মত এক প্লেয়ার বল নিয়ে দৌড়াচ্ছে। জটলা থেকে গর্জন উঠলো, ম্যারাডোনা!!
হ্যাঁ, ইনিই ম্যারাডোনা; যিনি নিজ দেশের ঠিক উল্টো গোলার্ধে ছোট্ট এক দেশের তাবৎ মানুষকে এমনই আবেগে ভাসিয়েছিলেন যে, যেদিন ম্যারাডোনাকে কোকেন নেওয়ার অপরাধে বহিষ্কার করা হলো, সেদিন ময়মনসিংহের এক অজ-পাড়ায়ও বিশাল মিছিলে শ্লোগান উঠেছিল ‘ম্যারাডোনার কিছু হলে-জ্বলবে আগুন ঘরে ঘরে’.. .. (সম্ভবত ‘এলেবেলে’-হুমায়ুন আহমেদ)
আর্জেন্টিনার নাম জানতাম ওদের ডাকটিকেটের সৌজন্যে। ডাকটিকেট জমানোর শখ ছিলো তখন আমার। কিন্তু ম্যারাডোনা বোঝার বয়স তখনও হয়নি। তবুও মনের মধ্যে গেঁথে গেল ওই নাম। এরপর ঝিকরগাছায় পাড়ায় একদিন বড়দের ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা ফুটবল খেলায় গোলকিপারের অভাবে আমাকে ধরে আর্জেন্টিনা দলের গোলপোস্টে দাড়া করিয়ে দিল।
আর কোন কিছু আমার কিশোর মনে দাগ কেটেছিল কিনা আজ আর মনে নেই, কিন্তু তখন থেকেই আমিও আর্জেন্টিনার হয়ে গেলাম মনে প্রাণে। আকাশী নীল-সাদার প্রতি যে ভালোবাসা সেই কৈশোরে শুরু হয়েছিলো, আজ অব্দি তার কোন কমতি হয়নি।
যখন থেকে ফুটবল বুঝতে শিখলাম, তখন থেকে দেখছি আর্জেন্টিনা হারছে, বড় কোন টুর্নামেন্টই জিতলোই না এদ্দিনে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো এই, প্রতিবার আর্জেন্টিনা হারার পর ভালোবাসাটা যেনো আরো জোরালো হয়। কেন হয়, নিজেও জানিনা।
চার বছর পরপর বিশ্বকাপ আসে, আর আমার স্বপ্নের সারথী হয়ে নতুন নতুন নায়ক সৃষ্টি হয়। কিন্তু প্রতিবারই সেই একই গল্প। চুরানব্বুইয়ে ম্যারাডোনার কোকেন কাহিনী শেষ করে দিলো আমার স্বপ্ন। এর পর একে একে বাতিস্তুতা, ওর্তেগা, ভেরন, ক্রেসপো, রিকুয়েমে (এই লোকটাকে আমার খুব পছন্দ), স্যাভিওলা, তেভেজ তারপর রোমেরো (এই গোলকিপারকেও আমার জোস লাগে), ডি মারিয়া, হিগুয়াইন, মাচোরানো এবং দ্য লিওনেল মেসি। প্রতিবারই হতাশাই আমরা পেয়েছি। তবুও কেন যেন আর্জেন্টিনা ছাড়া কিছুই ভালো লাগে না।
দুই হাজার ছয়ের বিশ্বকাপে যেদিন আর্জেন্টিনা হারলো, তারপর দিন হলে রুমের দরজায় বড় করে আর্জেন্টিনার পতাকা লাগিয়ে নিচে লিখে দিলাম, ‘তবুও আর্জেন্টিনার সাথেই আছি’.... বন্ধুরা খুব হাসলো, কিন্তু কি যেয়ে আসে তাতে! দু’হাজার দশে আর্জেন্টিনা হারার পরদিন জার্সি গায়ে দিয়ে অফিসে গেলাম প্রথমবারের মত, সবাই আড়চোখে তাকাতে লাগলো, তাকাক না, হু কেয়ার্স?
এ সবই পাগলামী, তবুও কেন যেন বয়স বাড়ে তবু আর্জেন্টিনা ছাড়ে না।
এবার যখন আরেকটি বিশ্বকাপ দোড়গোড়ায়, প্রথমবারের মত আর্জেন্টিনার পতাকা টানিয়ে দিয়েছি বাসার বারান্দায়। ক’দিন আগে সাম্পাওলি বলেছেন ‘ফুটবলের কাছে মেসির একটা বিশ্বকাপ পাওনা’। আসলেই এই ছেলেটা এতটাই ভালো খেলে যে বিশ্বকাপটা তার পাওনাই বলতে হবে।
তাই এবার হয়তো মেসির নেতৃত্বে আর্জেন্টিনা বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হবে। অবশ্য চ্যাম্পিয়ন না হলেই বা কি আসে যায়, আর্জেন্টিনা আমাদের কাছে আর্জেন্টিনাই। জয় পরাজয়ের হিসাব মেনে তো আর ভালোবাসা আসে না। তাই যদি হতো, তবে তো আকাশে শুধুই সবুজ-হলুদ বা লাল-হলুদ-কালোই মেরুনই উড়তো।
শুভ কামনা আর্জেন্টিনার জন্য। ভামোস আর্খেনটিনা!!!
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই জুন, ২০১৮ সকাল ৯:৫১