হাসপাতালের ছোট্ট একটি ঘর।চার দেয়ালের মাঝে বন্দী দুজন মুমুর্ষু রোগী।শুধু একটি জানালা। জানালার পাশের সীটে জরাজীর্ণ বৃদ্ধ। গবাক্ষ পানে চেয়ে আছেন।
অল্পদুরেই এক যুবা।মেরুদন্ড নিশ্চল।চলাফেরার কোনো সামর্থ্য নেই।সারাদিন বালিশে মাথা রেখে শুয়ে থাকেন। দীর্ঘদিন হাসপাতালে থাকতে থাকতে দু রোগীর মাঝে গড়ে উঠেছে নিবিড় সম্পর্ক। যুবা এক সময় ছবি আকঁতেন। প্রকৃতির ছবি,ঘাসে-ঘাসে ঘাস ফড়িং উড়ে বেড়ানোর ছবি।মৃদুমন্দ বাতাসে কাশফুল দোলে উঠার ছবি। মায়ের কোলে হাসিমাখা শিশুর ছবি।
যুবা-বৃদ্ধকে বলেন -চাচা , আজ কি দেখলে জানালা দিয়ে বলোনা।
ঐ যে, কী সুন্দর পরীর বাচ্ছার মতো খুকী-দৌড়ে যাচ্ছে,আবার মায়ের কাছে আসছে। পিছন পিছন আসছে এক ব্যান্ড পার্টি।
যুবা যদিও কিছু দেখছেনা,তবে চোখ বন্দ করে সব যেন অন্তর দিয়ে দেখে যাচ্ছে, ব্যান্ডের শব্দ ঘরের ভিতর না আসলেও যুবা যেন শব্দ শুনতে পাচ্ছে।
এভাবে প্রতিদিন,বৃদ্ধ চাচা-যুবাকে জানালার পানে চেয়ে-সমস্ত প্রকৃতি যুবার কাছে তুলে ধরেন।আকাশে গুচ্ছ,গুচ্ছ মেঘের ছবি,
খড়ের উপর বসা ঘাস ফড়িং,যে লোকটি প্রতিদিন ছোট মেয়ের হাত ধরে দিনের একটি সময় হেঁটে যায় এসব কিছুই যুবাকে বলে শুনান। আর যুবা আপন মনে সবকিছু মানসপটে এঁকে নেয়।
তুলি দিয়ে আঁকা হয়না,মন দিয়ে আকেঁন।ক্যানভাস এখন হৃদয়।আর প্রকৃতি হলো বৃদ্ধ চাচার বর্ণনা।
আজ যেন অন্য এক ভোর।যুবার মন ভারী,কেমন যেন মৌনতা আর বিষন্নতা। দৈনন্দিনের মতো আজও নার্স এলেন। যুবাকে হ্যালো বললেন-যুবাও প্রতিউত্তর দিলেন।এরপর নার্স গেলেন বৃদ্ধ চাচার পাশের সীটে। কোনো সারাশব্দ নেই।রাতের কোনো এক সময় চাচা শান্তিতে দেহ ত্যাগ করেছেন।
যুবা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন।চিরাচরিত নিয়ম,মেনে নিতেই হবে।অনেক দিনের বাঁধন আলগা হয়ে গেলো।
এবার যুবা নার্সকে বলেন-আচ্ছা দিদিমনি-আমি কি জানালার পাশের সীট টা পেতে পারি।
দিদি বলেন-কেন নয় দাদা।
যুবা জানালার পাশের সীটে এবার আসন পাতেন।
জানালার দিয়ে এবার বাইরে চোখ রাখেন। চোখ দিয়েই যুবা দারুন চমকে উঠেন, কিছুই দেখা যায়না। শুধু একটি বিশাল ধুসর দেয়াল,যার পলেস্তারা অবহেলায় খসে খসে পড়ছে।
যুবা এবার নার্সকে ডাকেন-আচ্ছা দিদি,
চাচা যে আমাকে কত সুন্দর বর্ণনা দিতেন ,জানালা দিয়ে চেয়ে চেয়ে।আমিতো এখন দেখি এসবের কিছুই দেখা যায়না।শুধু একটি ইট পাথরের দেয়াল ছাড়া।
দিদি বলেন-দাদা দেয়াল ছাড়া সব প্রকৃতি ও যদি এখান থেকে দেখা যেতো ,তাহলেও চাচা আপনাকে কিছুই বলতে পারতেন না। তিনি জন্ম থেকেই অন্ধ। আমার মনে হয়, আপনার সারা সময় নির্মল আনন্দে ভরিয়ে দিতে,এসব কিছুই তিনি আপন মন থেকেই বলতেন।আর সারাদিন নিজ বিছানায় না শুয়েও জানালার পাশে চেয়ে থাকতেন। তিনি জানতেন,আপনি এসব গল্প শুনতে ভালোবাসেন।
এই হলো মানুষে মানুষে প্রেম। বৃদ্ধ চলে গেলেন ,কিন্তু তাঁর এক অনাত্মিয় যুবার প্রতি অনুরাগ,মায়া,ভালোলাগা বেচেঁ রইলো। আমাদের সৌভাগ্য, আমরা সবাই এক মোহনায় এসেছি। আমরাও কি পারিনা, শুধু ভালোবাসা প্রকাশ করতে।
কি এমন পরিতৃপ্তি আসে -একজন আরেকজনের প্রতি বিরুপ হয়ে। আপনাদে কাউকে আমি চিনিনা, তারপরও মনে হয়,কত আপন। আজ যদি আমি চলে যাই, কেউ জানবেও না আমার কি হলো। শুধু আমার কথাগুলো রয়ে যাবে।
তারাশংকরের কবি উপন্যাসে পড়েছিলাম"জীবন এতো ছোট কেনে?"
এই ছোট জীবনকে আসুন আমরা ভালোবাসা দিয়ে আকাশের চেয়ে বড় করি।
কিছু প্রতিহিংসার লিখা পড়ে বড়বেশি আবেগ আপ্লুত হয়ে অনেক বেশী বলে ফেললে প্লিজ ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।
সবাইকে ঈদ মোবারক এবং শারদীয় পুজার শুভেচ্ছা।
উতস্বর্গঃ সকল ব্লগারদের।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই অক্টোবর, ২০০৭ রাত ৯:৫২