somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কারো মৃত্যুর আগে কি শ্রদ্ধাঞ্জলি দেওয়া মানা আছে?

৩০ শে মার্চ, ২০১২ ভোর ৬:০৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বিখ্যাত কারো মৃত্যুর পর আমাদের টনক নড়ে। নানা শ্রদ্ধাঞ্জলি উৎসর্গিত হয় তার নামে। তার অন্তিম শয্যায় দিয়ে আসি নানান রঙের ফুল। যেন শুরু হয় স্মৃতিচারণের প্রতিযোগিতা। ঐ ভাইকে যেমন দেখেছি, মহান, প্রাণবন্ত..... কত বিশেষণ, কত হাহাকার। এগুলি খারাপ, তা বলছিনা। কিন্তু ভাবতে অবাক লাগে, ঐ মানুষটি যখন বেঁচে ছিলেন, কেউ হয়তো তার খোঁজও নেয়নি কোনদিন। বরং প্রয়োজনের সময় হয়তো সযত্নে এড়িয়ে গেছে। হয়তো ক্ষেত্র বিশেষে তাকে নানা গঞ্জনা-অপমানও সইতে হয়েছে। এমনটি আমরা দেখছি, বারবার, প্রতিনিয়ত। দেখেছি হুমায়ূন ফরিদী কে কেমন নিঃশব্দে চলে যেতে। দেখলাম মিনার মাহমুদ কে কত অভিমানে চলে গেলেন। এরকম শত শত গুণী মানুষকে হারানোর পর তাঁকে নিয়ে কিছুদিন আলোচনা, শোক প্রকাশ, স্মৃতিচারণ। এগুলির কি আসলেই কোন মূল্য আছে? বিশেষ করে যিনি চলে গেলেন, তার জন্য বা তার পরিবারের জন্য?

এমনি একজনের কথা আমার এই মুহূর্তে মনে পড়ছে। তাকে হয়তো আর খুব বেশিদিন আমরা কাছে পাবো না। তিনি একজন জীবন্ত কিংবদন্তী, আমাদের ফিরোজা বেগম। একজন সর্বজন শ্রদ্ধেয় কন্ঠশিল্পী। তাঁর কন্ঠেই নজরুল সঙ্গীত সেই ষাটের দশকে পেয়েছিল নতুন জীবন।



এই গুণী শিল্পী জন্মগ্রহণ করেন (সময়কাল ১৯২৮ থেকে ১৯৩৩ এর মধ্যে ) ফরিদপুরের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে। তিনি ছিলেন স্বভাব গায়িকা।ছোট বেলা থেকেই ছিল গানের প্রতি এক অকৃত্রিম ভালবাসা। সেই আমলের বাড়ীর ভাঙা রেকর্ড বাজিয়ে বাজিয়ে ওই সময়ের প্রতিষ্ঠিত শিল্পীদের (কাননবালা, ইন্দুবালা) গান নিজের কণ্ঠে তুলতেন। কোনরকম প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়াই, হারমোনিয়ামে ওঠাতেন সেই গানের সুর। মাত্র চতূর্থ শ্রেণীতে পড়ার সময়, গানের প্রতি তার আগ্রহ দেখে, তার মামা তাকে নিয়ে যান কলকাতায়, সেই সময়ের বাংলা সংস্কৃতি চর্চার প্রধান কেন্দ্র, বাংলা সংস্কৃতির রাজধানী। সেই ছোটবেলাতেই তার মামা তাকে নিয়ে যান কাজী নজরুল ইসলামের কাছে। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। ফিরোজা বেগম আমাদের মাঝে জীবিত সেই খুব কম ভাগ্যবতীদের একজন যিনি কাজী নজরুল ইসলামের সামনে বসে তাকে গান শুনিয়েছিলেন। কবি, রত্ন চিনতে ভুল করেন নি। বলেছিলেন, এই মেয়ে ঠিক মত গাইডেন্স পেলে অনেক বড় শিল্পী হবে।

তার গান শুনে মুগ্ধ কবি, তাকে পরিচয় করিয়ে দেন কলকাতার স্বনামধন্য মিউজিক কম্পানী এইচ এম ভীর সঙ্গীত পরিচালক কমল দাস গুপ্তের সাথে। তার কাছেই পরবর্তীতে ফিরোজা বেগমের সঙ্গীতের প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ শুরু। কমল দাস গুপ্তের কাছে প্রশিক্ষণ পেয়ে ফিরোজা বেগমের প্রতিভার বিচ্ছুরণ ঘটতে থাকে। একের পর এক তার গানের রেকর্ডিং বের হতে থাকে (বেশির ভাগ ই উর্দু গজল, হিন্দী গান ইত্যাদি)। চারদিকে তার নাম ছড়িয়ে পড়ে।

সেই সময়ের প্রেক্ষাপট মফস্বলের একটা মুসলিম পরিবারের মেয়ে যে এত দূর আসতে পারে, তা কারো ধারণাই ছিল না। তাঁর যখন বয়স ১২-১৩ তখনই তার পরিবার থেকেই আসে অনেক বাধা। পরিবারের চাওয়ায় সঙ্গীত জগত ছেড়ে তাকে চলে আসতে হয় ফরিদপুরে। কিন্তু গান তার রক্তে মিশে আছে।

তিনি গানের শোকে নাওয়া খাওয়া ছেড়ে দিলেন। অসুস্থ হয়ে পড়লেন। শেষে জীবনের বড় সিদ্ধান্ত নিলেন। ফরিদপুর ছেড়ে কলকাতায় ফিরে গেলেন। এক সময় বিয়ে করলেন কমল দাসগুপ্ত ( তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন) কে। শুরু হলো তাদের একসাথে পথ চলা। কমল দাস গুপ্তের সান্নিধ্যে তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ল। তার গাওয়া উর্দু গজল বা এই ঘরানার গানগুলো পুরোন দিনের মানুষের স্মৃতিকে আজো নাড়া দেয়। ততদিনে কাজী নজরুল ইসলাম মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।

৬০ এর দশকে খুব কম শিল্পীই ছিল নজরুল সঙ্গীত চর্চা করতেন। কারণ, সম্ভবতঃ নজরুল সঙ্গীতের বহুমাত্রিকতা, যেটা আয়ত্ব করতে শিল্পীর অনেক পরিশ্রমলব্ধ সাধনার প্রয়োজন হত। ৬০ এর দশকে নজরুল সঙ্গীতের প্রভাব ধীরে ধিরে কমতে থাকে। সেই সময়ে বাংলা গানের স্থান দখল করে থাকে আধুনিক গান। ঘরে ঘরে বাজত হেমন্ত, সতীনাথ, সন্ধ্যা, প্রতিমার গান। নজরুল সঙ্গীত কোনরকম করে টিকে ছিল কিছু শিল্পী (মানবেন্দ্র, অজয় চক্রবর্তী) দের সাধনায়। সাধারণ মানুষের কাছে সেটুকু যথেষ্ট ছিলনা।

ফিরোজা বেগম যে নজরুলের ভক্ত ছিলেন, তা না। তিনি নজরুল সঙ্গীত শিখতে চাইলেন অনেক টা শখের বশেই হয়তো। গেলেন চিত্তরঞ্জন দাসের কাছে। তিনি জানালেন, এটা অনেক কঠিন, এটা তুমি পারবে না। ফিরোজা বেগম মনঃক্ষুন্ন হলেন। তার জিদ চেপে গেল। তিনি শিখবেন ই নজরুল সঙ্গীত। শিখলেন, সাধনা করলেন। তারপর প্রথম যখন তার নজরুল সঙ্গীতের রেকর্ডিং বেরুলো, চারদিকে আলোড়ন পড়ে গেল। নজরুল সঙ্গীত কে সবাই নতুন ভাবে অনুভব করল। সেই ছোট্ট ফিরোজার কাছেই নজরুল নতুন জীবন লাভ করলেন। ফিরোজা বেগম ও যেন নজরুলের প্রেমে পড়ে গেলেন। নজরুলের গান কেই তিনি তার গন্তব্য করে নিলেন।

অনেক ঘাত-প্রতিঘাত আর সুকঠিন সংগ্রামের ভেতর দিয়ে ফিরোজা বেগম হয়ে উঠলেন উপমহাদেশের কিংবদন্তী শিল্পী, বা নজরুল সঙ্গীত শিল্পী।

যতদূর জানি, আজও তিনি তার সাধনা অব্যাহত রেখেছেন। তার দুই ছেলে শাফিন আহমেদ আর হামীন আহমেদ বাংলাদেশের ব্যান্ড সঙ্গীত শীল্পের পথিকৃত।

জানি না তিনি কোন একুশে পদন বা স্বাধীনতা পদক পেয়েছেন কি না। আমরা কি পারিনা এই মহান কিংবদন্তী কে বেঁচে থাকা অবস্থায় ই যথাযথ সম্মান জানাতে?

তাঁর কিছু গান









তথ্যসূত্র



সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে মার্চ, ২০১২ রাত ১০:৪৯
৭টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কোরআন কী পোড়ানো যায়!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ২০ শে মে, ২০২৪ সকাল ১০:৩৮

আমি বেশ কয়েকজন আরবীভাষী সহপাঠি পেয়েছি । তাদের মধ্যে দু'এক জন আবার নাস্তিক। একজনের সাথে কোরআন নিয়ে কথা হয়েছিল। সে আমাকে জানালো, কোরআনে অনেক ভুল আছে। তাকে বললাম, দেখাও কোথায় কোথায় ভুল... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেঞ্চুরী’তম

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ২০ শে মে, ২০২৪ সকাল ১১:১৪


লাকী দার ৫০তম জন্মদিনের লাল গোপালের শুভেচ্ছা

দক্ষিণা জানালাটা খুলে গেছে আজ
৫০তম বছর উকি ঝুকি, যাকে বলে
হাফ সেঞ্চুরি-হাফ সেঞ্চুরি;
রোজ বট ছায়া তলে বসে থাকতাম
আর ভিন্ন বাতাসের গন্ধ
নাকের এক স্বাদে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরানের প্রেসিডেন্ট কি ইসরায়েলি হামলার শিকার? নাকি এর পিছে অতৃপ্ত আত্মা?

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ২০ শে মে, ২০২৪ সকাল ১১:৩৯


ইরানের প্রেসিডেন্ট হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হয়ে নিহত!?

বাঙালি মুমিনরা যেমন সারাদিন ইহুদিদের গালি দেয়, তাও আবার ইহুদির ফেসবুকে এসেই! ইসরায়েল আর।আমেরিকাকে হুমকি দেয়া ইরানের প্রেসিডেন্টও তেমন ৪৫+ বছরের পুরাতন আমেরিকান হেলিকপ্টারে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভণ্ড মুসলমান

লিখেছেন এম ডি মুসা, ২০ শে মে, ২০২৪ দুপুর ১:২৬

ওরে মুসলিম ধর্ম তোমার টুপি পাঞ্জাবী মাথার মুকুট,
মনের ভেতর শয়তানি এক নিজের স্বার্থে চলে খুটখাট।
সবই যখন খোদার হুকুম শয়তানি করে কে?
খোদার উপর চাপিয়ে দিতেই খোদা কি-বলছে?

মানুষ ঠকিয়ে খোদার হুকুম শয়তানি... ...বাকিটুকু পড়ুন

আসবে তুমি কবে ?

লিখেছেন সেলিম আনোয়ার, ২০ শে মে, ২০২৪ দুপুর ১:৪২



আজি আমার আঙিনায়
তোমার দেখা নাই,
কোথায় তোমায় পাই?
বিশ্ব বিবেকের কাছে
প্রশ্ন রেখে যাই।
তুমি থাকো যে দূরে
আমার স্পর্শের বাহিরে,
আমি থাকিগো অপেক্ষায়।
আসবে যে তুমি কবে ?
কবে হবেগো ঠাঁই আমার ?
... ...বাকিটুকু পড়ুন

×