somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

নিষিদ্ধ বইয়ের গল্প

১৩ ই এপ্রিল, ২০১১ রাত ১১:৩৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ভাব প্রকাশের আকাক্সক্ষা মানুষের চিরন্তন। ইতিহাসের আদি পর্ব থেকেই মানুষ নিজেকে প্রকাশ করার জন্য নানা মাধ্যম বেছে নিয়েছে। সঙ্গীত, চিত্রকলা, প্রস্তরলিপি যার অন্যতম। তবে যেদিন থেকে মানুষ পাথরে লেখা চিত্রলিপিকে ভূর্জ পাতায় ধরতে চেয়েছে সেই দিনটিকে বইয়ের পত্র সংস্করণ বললে ভুল বলা হবে না। তখন থেকেই বই হয়েছে মানুষের চিন্তা প্রকাশের প্রধানতম মাধ্যম। কিন্তু কবে থেকে মানুষের চিন্তা প্রকাশের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হলো, কে প্রথম বইয়ের মাধ্যমে মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করেছিলেন? প্রশ্নগুলোর উত্তর পেতে তাকাতে হবে প্রাচীন গ্রিসের দিকে।
সক্রেটিসের মৃত্যুদণ্ড হয়েছিল ব্লাসফেমির অভিযোগে। সম্ভবত এই ঘটনার মাধ্যমেই মুক্ত চিন্তায় লাগাম পরানো শুরু হয়। ভাবতে অবাক লাগে প্লেটোর মতো বিদগ্ধ মানুষও শিশু-কিশোরদের জন্য ‘ইলিয়ট’ না পড়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। এটা যদিও নিষিদ্ধকরণ নয়, তবে পাঠক স্বাধীনতায় প্রথম হস্তক্ষেপের উদাহরণ। কিন্তু ৫৫৩ খ্রিস্টাব্দে গ্রিক ও লাতিনদের জন্য ‘বাইবেল’ নিষিদ্ধকরণের মাধ্যমে সম্রাট জাস্টানিয়ান বই নিষিদ্ধকরণ শুরু করেন। এটাই সম্ভবত বইয়ের ওপর প্রথম রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ।
১২৪৪ সালে ‘তালমুদ’ পোড়ানোর মাধ্যমে খ্রিস্টানরাই প্রথম বই পোড়ানো শুরু করে।
মধ্যযুগ থেকে আধুনিক যুগের দিকে তাকালে দেখা যাবে, শিল্পসংস্কৃতির ক্ষেত্রে যাদের মুক্ত চিন্তার প্রতীক ভাবা হয় সেই ফ্রান্সেই বই নিষিদ্ধ হয়েছে সবচেয়ে বেশি। ১৫৩৫ সালে রাজা প্রথম ফ্রান্সিস ক্ষমতায় এসেই বই প্রকাশ নিষিদ্ধ করে দিয়েছিলেন। তারপর থেকে বহুবার রাজদণ্ড নেমে এসেছে বই প্রকাশের স্বাধীনতার ওপর। পোড়ানো হয়েছে দান্তের ‘ডি মনার্কিয়া’। নিষিদ্ধ করা হয়েছে ‘ডিভাইন কমেডি।’
নিষিদ্ধ আগুনে পুড়েছে রুশোর বই। আধুনিককালের সব থেকে প্রভাবশালী চিন্তাবিদ সাঁত্রেকে কমিউনিস্টপ্রীতির জন্য অভিযুক্ত করা হয়েছিল। রাজরোষে পড়ে নিষিদ্ধ হন বালজাক ও এমিল জোলার মতো লেখকরা। ১৮৫০ সালে জার প্রথম নিকোলাস নিষিদ্ধ করেন ভিক্টর হুগোর সমুদয় রচনা।
আধুনিক ফ্রান্সের সবচেয়ে প্রভাবশালী কবি বদলেয়ারও নিষিদ্ধ আওতার বাইরে যেতে পারেননি। ‘লে ফ্লর দ্য মল’ প্রকাশিত হওয়ার পর তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল।
ইংরেজরা, সভ্যতা বোধ নিয়ে যাদের গর্বের শেষ নেই, তারাও শেক্সপিয়ারের নাটকে ছুরি চালিয়েছিল। রানী এলিজাবেথ-এর পরামর্শে ‘দ্য ট্রাজেডি অব কিং রিচার্ড দ্য সেকেন্ড’ নাটকের একটি দৃশ্য কেটে ফেলা হয়। যে রোমান্টিক কবিকে নিয়ে ইংরেজদের গর্বের শেষ নেই সেই শেলীকেও ‘দ্য নেসেসিটি অফ এথিসম’ বইটির জন্য আধুনিক জ্ঞানের পীঠস্থান অক্সফোর্ড থেকে বের করে দেয়া হয়েছিল।
মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় যুগান্তর এসেছে। মানুষ ক্রমশ নিজেকে অধিকতর সভ্য দাবি করছে। তবু বই নিষিদ্ধ হওয়া কমেনি, থামেনি।
১৯২৯ সালে চীন তার সেনাবাহিনীকে নিয়োগ করেছিল কাল মার্কস-এর ‘কমিউনিস্ট মেনিফেস্টো’ ও ‘দাস ক্যাপিটাল’ যেন পাঠকের কাছে পৌঁছতে না পারে।
আমেরিকান লেখক আর্নেস্ট হেমিংওয়ের ‘দি সান অলসো রাইজেস’ বইটিও নিষিদ্ধ করা হয়।
এই শতকের সব থেকে আলোড়ন সৃষ্টিকারী নিষিদ্ধ বইগুলোর অন্যতম ডি এইচ লরেন্স-এর ‘লেডি চ্যার্টলিজ লাভার’। ১৯৫৯ সালে বইটি সুপ্রিম কোর্টের ছাড়পত্র পাওয়ার পর এক বছরেই দুই মিলিয়ন কপি বিক্রি হয়েছিল।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বলা হয় মুক্তবুদ্ধি চর্চার আদর্শ স্থান। ১৯৭১ সালে সংবিধানে প্রথম সংশোধনীতে মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে নিশ্চিত করে বিশ্ববাসীকে তারা সে কথাই জানান দেয় সগৌরবে। আইন করা হয়, কংগ্রেস কখনো মত প্রকাশ কিংবা প্রেসের স্বাধীনতাকে খর্ব করে এমন কোনো আইন করবে না। কিন্তু বাস্তবে দেশটিতে বিভিন্ন সময়ের বই নিষিদ্ধকরণের ঘটনাগুলো দেখলে লেখকের স্বাধীনতা নিয়ে সংশয় দেখা দেয়। স্পষ্টভাবে বোঝা যায় সংবিধানে স্থান দিতে পারলেও মুক্তচিন্তার চর্চাকে মনে স্থান দিতে পারেনি দেশটির ক্ষমতাসীনরা।
১৮৭৩ সালে কমস্টক আইনের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রে অনেক গ্রন্থ দীর্ঘদিন নিষিদ্ধ ছিল। ঐ আইনের আওতায় গ্রন্থগুলোর বিরুদ্ধে অশ্লীলতার অভিযোগ আনা হয়। এ প্রক্রিয়ায় যেসব বই তখন নিষিদ্ধ করা হয়েছিল সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হচ্ছে, এ্যারিস্টোফেনিসÑএর ‘লিসিস্ট্রাটা’, চসারÑএর ‘ক্যান্টারবেরি টেলস’ এবং বোকাচিও-এর ‘ডেকামেরন’।
মার্ক টোয়েন রচিত ‘হাকলবেরি ফিন’ গ্রন্থটি আমেরিকার কয়েকটি অঙ্গরাজ্যে নিষিদ্ধ করা হয়। ১৯৮৯ সালে নিষিদ্ধ করা হয় উইলিয়াম ফকনারের ‘এ্যাজ আই লে ডাইনিং’ বইটি।
জেমস জয়েসের বিশ্ববিখ্যাত উপন্যাস ‘ইউলিসিস’ ১৯১৮ থেকে ১৯৩০ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে নিষিদ্ধ ছিল। দীর্ঘ ১২ বছর নিষিদ্ধ থাকার পর ১৯৩৩ সালে আইনি লড়াইয়ের পর ‘ইউলিসিস’ যুক্তরাষ্ট্রে বই আকারে প্রকাশের অনুমতি পায়।
ফরাসি দার্শনিক ভলতেয়ার এর বিখ্যাত বই ‘কাঁদিদ’-এর একটি চালান ১৯৩০ সালে আটক করে যুক্তরাষ্ট্র শুল্ক বিভাগ। যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক বিভাগের মতে, ‘কাঁদিদ’ অশ্লীল বই। ফ্রান্স থেকে গ্রন্থগুলো হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য আনা হচ্ছিল। পরবর্তীতে ‘কাঁদিদ’ বইটির কিছু পৃষ্ঠা বাদ দিয়ে তারপর শুল্ক বিভাগের হাত থেকে ছাড়াতে হয়।
১৯৫৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ডাকবিভাগ লেনিনের ‘রাষ্ট্র ও বিপ্লব’ গ্রন্থটি বাজেয়াপ্ত করে।
এর তিন বছর পর অর্থাৎ ১৯৫৭ সালে কবি এ্যালেন গিন্সবার্গের ‘হাউল’ বইটি বাজেয়াপ্ত করে সানফ্রান্সিস্কোর শুল্ক বিভাগ।
ড্যানিয়েল ডিফো রচিত ‘মল ফ্ল্যান্ডার্স’ ও জন ক্লেল্যান্ড রচিত ‘ফ্যানি হিল’ বহু দিন ধরে যুক্তরাষ্ট্রে নিষিদ্ধ ছিল। ১৯৬৬ সালে মার্কিন সুপ্রিম কোর্টের রায়ে গ্রন্থ দুটি নিষেধাজ্ঞা থেকে মুক্তি পায়।
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে বিখ্যাত মার্কিন কবি ওয়াল্ট হুইটম্যানের কাব্যগ্রন্থ ‘লিভস অফ গ্রাস’ যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টনে প্রকাশের জন্য অনুমতি পায়নি। এই কাব্যগ্রন্থের কয়েকটি কবিতার জন্য সরকারি আইনজীবী কবির বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা দায়েরের হুমকি পর্যন্ত দিয়েছিলেন।
অষ্টাদশ শতাব্দীতে ক্যাথলিক চার্চগুলোর নিষিদ্ধ গ্রন্থের তালিকায় জঁ-জাক রুশো রচিত সকল বই ছিল। এ কারণে ইউরোপের অনেক দেশেই রুশো ও তার গ্রন্থগুলো নিষিদ্ধ ছিল। ১৯৬৬ সালে চার্চের এই নিষেধাজ্ঞা বিলুপ্ত হয়।
১৯২৯ সালে যুক্তরাষ্ট্র শুল্কবিভাগ জঁ-জাক রুশোর আত্মজীবনী ‘কনফেশনস’ কে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। নিষিদ্ধ করার পেছনে অভিযোগ দেয়া হয় বইটি নৈতিক মানদণ্ডে ক্ষতিকর। এর ঠিক ছয় বছর পর অর্থাৎ ১৯৩৫ সালে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নে রুশোর সব দার্শনিক রচনা নিষিদ্ধ করা হয়।
১৯৮৮ সালে প্রকাশিত হয় সালমান রুশদী’র উপন্যাস ‘দ্য স্যাটানিক ভার্সেস’। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার অভিযোগে এক বছর পরই বইটি নিষিদ্ধ হয়।

কেন নিষিদ্ধ
বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন সামাজিক প্রেক্ষাপটে, বিভিন্ন কারণে বই নিষিদ্ধ হয়েছে, হয়ে আসছে। বই নিষিদ্ধ করা হয় ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও সামাজিক মানদণ্ডে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই যেটা দেখা হয় তা হচ্ছে, বইটি কোনোভাবেই যেন প্রচলিত সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রচলিত ধ্যানধারণাকে প্রশ্ন করতে না পারে। আঙ্গুল তুলে কথা বলতে না পারে ক্ষমতাসীনদের দিকে। গ্রন্থে শ্লীলতা-অশ্লীলতার বিষয়টিও বিবেচনায় আনা হয়। তবে সব সময় যে নীতি-নিয়ম মেনে গ্রন্থ নিষিদ্ধ করা হয় তাও নয়। বরং অনিয়মই হয়েছে যুগে যুগে। কর্তৃপক্ষের ইচ্ছা অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।

ব্রিটিশ শাসিত ভারতীয় সাহিত্য
ভারতীয় উপমহাদেশে গ্রন্থ নিষিদ্ধকরণ শুরু হয় ব্রিটিশ আমলে। সে সময় গ্রন্থগুলোকে নিষিদ্ধ করা হতো রাজনৈতিক কারণে। ১৯০৯ সালে পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায়-এর ‘সিপাহী যুদ্ধের ইতিহাস’ নিষিদ্ধ করা হয়। মনীন্দ্রনাথ বসু ১৯০৯ প্রকাশ করেন ‘সোফিয়া বেগম’ নামের একটি উপন্যাস। উপন্যাসটিতে ইংরেজবিরোধী রাজনীতির কথা থাকার কারণে ১৯১০ সালে উপন্যাসটি নিষিদ্ধ করা হয়। ঐ একই সময়ে নিষিদ্ধ করা হয় সখারাম গণেশ দেউড়ীর রচিত ‘দেশের কথা’ ও ‘তিলকের মোকদ্দমা’ গ্রন্থ দুটি।
তথ্যানুসন্ধানে দেখা যায়, সব থেকে বেশি গ্রন্থ নিষিদ্ধ করা হয় ১৯২০ থেকে ১৯৩৪ সালের মধ্যে। এ সময় দুই হাজার ৩১৯টি গ্রন্থ নিষিদ্ধ করা হয়। যার মধ্যে বাংলা গ্রন্থ ছিল ১৭৮টি।
আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামকেও হতে হয়েছে নিষিদ্ধকরণের শিকার। ব্রিটিশ আমলে যেসব লেখকের গ্রন্থ নিষিদ্ধ করা হয় তাদের মধ্যে কাজী নজরুল ইসলাম অন্যতম। ব্রিটিশ সরকার তার পাঁচটি গ্রন্থ নিষিদ্ধ করে। গ্রন্থগুলো হলো- ‘বিষের বাঁশী’, ‘ভাঙার গান’, ‘যুগবাণী’, ‘চন্দ্রবিন্দু’ ও ‘প্রলয় শিখা’। কাজী নজরুল ইসলামের সম্পাদকীয় নিবন্ধনগুলো নিয়ে লেখা বই ‘যুগবাণী’কে নিষিদ্ধ করা হয় ১৯২২ সালে। ১৯২৪ সালে নিষিদ্ধ করা হয় নজরুল ইসলামের ‘বিষের বাঁশী’।
‘ভাঙার গান’ বইটি প্রথমে দুই হাজার ১০০ কপি ছাপা হয়েছিল। বইটির অধিকাংশ কবিতাই ব্রিটিশ সরকারের আপত্তিকর বলে মনে হয়। সরকারের নির্দেশে পুলিশ দোকান থেকে বইটির অবিক্রীত কপিগুলো নিয়ে যায়। এবং গ্রন্থটিকে বাজেয়াপ্ত ঘোষণা করে ১৯৩০ সালে।
১৯৩০ সালে প্রকাশিত হয় কাজী নজরুল ইসলামের কাব্যগ্রন্থ ‘প্রলয় শিখা’। পরবর্তীতে কাব্যগ্রন্থটি নিষিদ্ধ করা হয়। বিধিমতে, প্রতিষ্ঠিত শাসনতন্ত্রের বিরুদ্ধে অসন্তোষ উৎপাদন করা হয়েছে এই অভিযোগে বইটি নিষিদ্ধ করা হয়। কবি নজরুল ইসলামকে ছয় মাসের সশ্রম কারাদণ্ড দেয়া হয়। ১৯৩১ সালে বাজেয়াপ্ত করা হয় নজরুল রচিত ‘চন্দ্রবিন্দু’র প্রথম সংস্করণটি।
অগ্নি যুগের বিপ্লবীদের কাছে যে বইটি বীজমন্ত্রের মতো ছিল তা বঙ্কিমের ‘আনন্দমঠ’। এই বইটি পড়ে অবিভক্ত বাংলায় গড়ে উঠেছিল অনুশীলন সমিতি। এই উপন্যাসের একটি গান ‘বন্দে মা তরম’ যুবশক্তিকে সশস্ত্র আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্বুদ্ধ করেছিল, যা দেখে ব্রিটিশ সরকার বইটি নিষিদ্ধ করেছিল।

স্বাধীন ভারতবর্ষে পরাধীন মুক্তচিন্তা
১৯৪৭ সালে ব্রিটিশরা ভারতবর্ষ ছেড়ে চলে যায়। কিন্তু স্বাধীন ভারতবর্ষেও বই নিষিদ্ধকরণের ধারা অব্যাহত থেকেছে। অব্যাহত থেকেছে ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতা আঁকড়ে রাখার প্রবণতা। আর সে কারণেই পরবর্তী সময়গুলোতেও আঘাত এসেছে মুক্তচিন্তা চর্চার ওপর, লেখক সাহিত্যিকদের রচনার ওপর। তবে তখন গ্রন্থ নিষিদ্ধ করার কারণ হিসেবে বেশি প্রধান্য পেয়েছে লেখায় ধর্ম ও শ্লীলতা-অশ্লীলতার বিষয়।
ব্রিটিশ শাসন-পরবর্তীকালে নিষিদ্ধ হওয়া গ্রন্থগুলোর মধ্যে সব থেকে আলোচিত সমরেশ বসুর ‘প্রজাপতি’ উপন্যাসটি। ১৯৬৮ সালে বইটি নিষিদ্ধ করা হয়। নিষিদ্ধ করার আগে আদালত থেকে বিশেষজ্ঞ মতামত দেয়ার জন্য বুদ্ধদেব বসু ও কবি নরেশ গুহকে ডাকা হয়েছিল। ‘প্রজাপতি’ বইটি সম্পর্কে আদালতে বুদ্ধদেব বসু বলেছিলেন, ‘এই বইয়ের নায়ক বা অনায়ক সমসাময়িক পশ্চিমবঙ্গের রকবাজ ছেলেদের টাইপ। এই যুবকেরা সাধারণত যে ভাষায় কথা বলে সে ভাষাতেই উপন্যাস লেখা। এই বইতে এত বেশি স্ল্যাং ব্যবহারের এটাই যৌক্তিকতা। এই স্টাইল জীবন্ত ও জীবনের অবিকল প্রতিচ্ছবি। এখানেই এই উপন্যাসের প্রধান সাফল্য।’ ‘প্রজাপতি’র বিরুদ্ধে অশ্লীলতার অভিযোগ খণ্ডন করে বুদ্ধদেব বলেন, ‘কোনো গ্রন্থের অংশবিশেষ পাঠকের কামোদ্রেক করে এই অভিযোগে সেই বই যদি দূষণীয় হয় তবে তো সর্বাগ্রে বাইবেল ও মহাভারতের প্রচার বন্ধ করে দিতে হয়।’ কিন্তু মাননীয় চিফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট সম্পূর্ণ ভিন্নমত পোষণ করেছিলেন। তার বিচারে, ভারতীয় দণ্ডবিধির ২৯২ ধারায় লেখক দোষী সাব্যস্ত হন। ২৯২/১০৯ ধারায় দোষী সাব্যস্ত হন প্রকাশক। লেখক ও প্রকাশক প্রত্যেকের ২০১ টাকা করে জরিমানা, অনাদায়ে দুই মাসের বিনাশ্রম কারাবাস শাস্তি হিসেবে ধার্য হয়। সেই সঙ্গে ফৌজদারি কার্যবিধির ৫২১ ধারায় শারদীয় ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘প্রজাপতি’ উপন্যাস থেকে মোট ৫৩ পৃষ্ঠা বর্জনের আদেশও দেন বিচারক।
এই আদেশের বিরুদ্ধে অভিযোগকারী ও আসামি উভয়পক্ষই দ্বারস্থ হন মহামান্য হাইকোর্টের। অভিযোগকারীর দাবি ছিল কঠিনতম শাস্তি প্রদান। নিম্ন আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে ছিল আসামিপক্ষেরআপিল। হাইকোর্টেও পুরোপুরি বহাল রইল নিম্ন আদালতের রায়। সেই সঙ্গে নির্দেশ দেয়া হলো শারদীয় ‘দেশ’ পত্রিকা ও গ্রন্থাকারে প্রকাশিত ‘প্রজাপতি’ বাজেয়াপ্ত করে আপত্তিকর পৃষ্ঠাগুলো বাদ দেয়া হোক।
লেখক ও প্রকাশক মহামান্য হাইকোর্টের এই রায় মেনে নিতে পারেননি। এরপর তারা গেলেন সুপ্রিম কোর্টে। ১৯৮৫ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর সুপ্রিম কোর্টের চূড়ান্ত রায়ে ‘প্রজাপতি’র ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হয়। ১৮ বছর ধরে অশ্লীলতার দায়ে নিষিদ্ধ গ্রন্থ সমরেশ বসুর ‘প্রজাপতি’ পায় সম্মানে পুনর্বাসন।
অশ্লীলতার দায়ে ১৯৭০ সালে নিষিদ্ধ হয় বুদ্ধদেব বসুর ‘রাত ভর বৃষ্টি’ উপন্যাসটি। তিন বছর পর অর্থাৎ ১৯৭৩ সালে এ নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হয়।

বাংলাদেশ : দীর্ঘ হচ্ছে নিষিদ্ধ তালিকা
১৯৪৮ সালে নিষিদ্ধ হয় সুরেশ চক্রবর্তীর বই তরবারী/শৃঙ্খল। একই সময়ে অজ্ঞাতনামা এক লেখকের ‘দ্য হিন্দুজ অফ বেঙ্গল’ নামে একটি গ্রন্থ নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। তবে এ অঞ্চলে স্বাধীনতা পূর্ববর্তীকালে যেসব গ্রন্থ নিষিদ্ধ হয়েছে সেগুলোর মধ্যে হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত ‘একুশের সংকলন’ অন্যতম। সংকলন গ্রন্থটি নিষিদ্ধ করা হয় ১৯৫৩ সালে। ষাটের দশকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয় বদরুদ্দীন উমরের ‘সাম্প্রদায়িকতা’ বইটি। জ্যোতি সেনগুপ্তের ‘এক্লিপস অফ দ্য ইস্ট পাকিস্তান’ গ্রন্থটি নিষিদ্ধ করা হয় ১৯৬৩ সালে। ১৯৬৯ সালে নিষিদ্ধ হয় আবদুল মান্নান সৈয়দ-এর ‘সত্যের মত বদমাশ’। সে সময় বইটি ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। একই সময়ে নিষিদ্ধ হয় শেখ আবদুল হাকিমের ‘অপরিণত পাপ’ বইটি।
স্বাধীন বাংলাদেশে নিষিদ্ধ বইয়ের সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া মুশকিল। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে নিষিদ্ধ হওয়া প্রথমদিককার কয়েকটি গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে বায়েজিদ খান পন্নীর ‘এই ইসলাম ইসলাম না’। কিছুদিন আগে নিষিদ্ধ করা হয় মতিয়ার রহমান রেন্টুর বই ‘আমার ফাঁসি চাই’।
তবে স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের যে দুটি নিষিদ্ধ বই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে আলোড়ন তুলেছে সেগুলো হচ্ছে- হুমায়ুন আজাদের ‘নারী’ ও তসলিমা নাসরিনের ‘লজ্জা’।
তসলিমা নাসরিন রচিত গ্রন্থ ‘লজ্জা’ নিষিদ্ধ করা হয় ১৯৯৩ সালে। অভিযোগ তোলা হয় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাকে উসকে দিয়েছে এ বই। মৌলবাদীরা তসলিমাকে দেশ ত্যাগেও বাধ্য করে। বাংলাদেশে নিষিদ্ধ হলেও বিশ্বের অনেক ভাষায় ‘লজ্জা’ বইটি অনূদিত হয়েছে।
পরবর্তীকালেও তসলিমার আত্মজীবনী ‘আমার মেয়েবেলা, ‘উত্তল হাওয়া’, ‘ক’, ‘সেই সব অন্ধকার’ নিষিদ্ধ করা হয়। তসলিমা নারীবাদিতার সামনে এসে দাঁড়ায় রাষ্ট্র, ধর্ম, সমাজ, পুরুষতন্ত্র। তার আত্মজীবনী তৃতীয় খণ্ড ‘দ্বিখণ্ডিত’ পশ্চিমবঙ্গে ১ বছর ৯ মাস ২৬ দিন বন্দি থাকার পর হাইকোর্টের রায়ে মুক্তি পায়। সেখানে সচেতন লেখক ও বুদ্ধিজীবীরা তার বইয়ের পাশে, লেখকেরা মত প্রকাশের স্বাধীনতার পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন।
বহুমাত্রিক লেখক হুমায়ুন আজাদ রচিত ‘নারী’ বইটি নিষিদ্ধ করা হয় ১৯৯৫ সালের ১৯ নবেম্বর। ‘বইটির আগাগোড়ায় অশ্লীল... ইসলাম ও ধর্মবিদ্বেষী’ নারী গ্রন্থটি সম্পর্কে এ ধরনের অভিযোগ তোলেন ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের পরিচালক ও ইমাম প্রশিক্ষণ একাডেমির এক পরিচালক। একই সঙ্গে তারা গ্রন্থটি বাজেয়াপ্ত ঘোষণা করার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে আবেদন করেন। দীর্ঘদিন আইনি লড়াই শেষে ২০০০ সালের মার্চ মাসে ‘নারী’ বইটির ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হয়। ‘নারী’ মূলত একটি গবেষণা গ্রন্থ।
বই সংগ্রহ এবং পাঠের মাধ্যমে জ্ঞানার্জন মানুষকে সমাজে সম্মানিত করে। বিশ্ববিখ্যাত নাট্যকার উইলিয়াম শেক্সপিয়র একং ইনকা গার্সিলাসোর মৃত্যুদিবসকে শ্রদ্ধা, সম্মান জানাতে জাতিসংঘ বিশ্বব্যাপী ২৩ এপ্রিল বিশ্বগ্রন্থ ও গ্রন্থস্বত্ব দিবস পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। বাংলাদেশে বিশ্বগ্রন্থ ও গ্রন্থস্বত্ব দিবস প্রথম বারের মতো পালিত হয় ২০০০ সালে।
বই মানুষের মনের জানালা খুলে দেয়। মানুষ ভাবতে শেখে, শেখে প্রশ্ন করতে। এই ‘জিজ্ঞাসা’ ‘প্রশ্ন’ই তো মানুষকে আগামী দিনে পৌঁছে দেয়। সে কারণেই হয়ত মানুষের প্রশ্নের শক্তিতে এত ভয়। লেখকের মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় এত ভীতি, আতঙ্ক রাষ্ট্রযন্ত্রের।
প্রযুক্তির উৎকর্ষতায় জীবন-যাপন সহজ হয়েছে। কিন্তু মানসিকতার উৎকর্ষ, শ্রেণী উত্তরণ কে ঘটাবে। এখনো বই নিষিদ্ধ হয়। লেখক নির্বাসিত হন। আজকে এই সময়ে এসেও। কিন্তু মুক্তচিন্তা ও গণতন্ত্রের স্বার্থে তা তিরোহিত হওয়া উচিত।
তবেই মুক্তি, নয়ত নয়।
৩টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ডালাসবাসীর নিউ ইয়র্ক ভ্রমণ

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ২:৪৪

গত পাঁচ ছয় বছর ধরেই নানান কারণে প্রতিবছর আমার নিউইয়র্ক যাওয়া হয়। বিশ্ব অর্থনীতির রাজধানী, ব্রডওয়ে থিয়েটারের রাজধানী ইত্যাদি নানান পরিচয় থাকলেও আমার কাছে নিউইয়র্ককে আমার মত করেই ভাল ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×