somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোড়াবাড়ির চমচম ও ভাসানীর বেগুন টালের কাহিনী (পর্ব-১)

৩০ শে ডিসেম্বর, ২০১৪ রাত ৩:০৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ির চমচম অনেক খেয়েছি। কিন্তু পোড়াবড়ি টাঙ্গাইলের কোথায় অবস্থিত তা জানা ছিল না। সেই সুযোগটা হটাৎ করেই পেয়ে গেলাম।
আমি তখন আরমবাগের একটি মেসে থাকি। আমার রুমমেট চাকরিজীবী উপেন দা। ঢাকা ট্রেজারীতে চাকরি করেন। পাশের রুমে আলমগীর ও রিপন নামে দু’জন ছাত্র থাকে। একজন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে আরেকজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। দুইজনের বাড়িই টাঙ্গাইল জেলায়, তবে সদর থানায় নয়। ১৯৮৫ সালের ষোলই নভেম্বর রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়–য়া রিপন এসে বলল, ভাই আমরা আগামী কাল ১৭ই নভেম্বর ভাসানীর মৃত্যু দিবসে টাঙ্গাইল যাচ্ছি, আপনারা ইচ্ছা করলে আমাদের সাথে যেতে পারেন। আমরা ৫০ সিটের বাস রিজার্ভ ভাড়া করেছি। এখনও আমাদের ৫০জন হয়নাই।
রিপনের কথা শুনে সুবর্ন সুযোগ মনে হলো। এরকম সুযোগ পেলে আর কেউ না গেলেও আমি তো ছেড়ে দেয়ার পাত্র নই। সাথে সাথেই রাজি হয়ে গেলাম।
উপেন দা মানিক গঞ্জের লোক। বাংলায় মাস্টার্স--তবে খুব রসিক। তিনি মানিকগঞ্জের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলতে স্বাচ্ছন্দবোধ করেন। আমার যাওয়ার আগ্রহ দেখে হাসতে হাসতে বললেন, রিপন, ভালো মাইনষের কাছেই কইচাও, একে তো নাচুনী বুড়ি, তারোপর ঢোলের বাড়ি, এহন তোমরা না গেলেও পরামানিক একলা হইলেও যাইবো, বলেই হো হো করে হাসতে লাগলেন।
আমি উপেন দা’র হাসির সাথে যোগ দিয়ে হাসতে হাসতে বললাম, দাদা, ঘুরে বেড়ানের সুযোগ তো সব সময় পাই না। এবার সেই সুযোগ যখন পেয়েছি তখন একটু না হয় ঘুরে আসি। আমি তার দিকে আগ্রহ নিয়ে বললাম, দাদা, আপনেও চলেন আমাদের সাথে?
দাদা হাত কচলাতে কচলাতে বললেন, নারে ভাই, চাকরির ডিউটি বাদ দিয়া ঘুইরা বেড়ান যাইবো না। তাইলে চাকরি থাকবো না। আপনারা বেকার মানুষ যত পারেন ঘুইরা বেড়ান। এহনই আপনাগো ঘুইরা বেড়ানের সময়।
আমাদের আগামীকালের প্রগ্রাম নিয়ে দাদা অনেক রসিকতা করলেন। আমরাও তার সাথে যোগ দিয়ে অনেক হাসাহাসি করে মজা পেলাম। অনেক কথা বলার পর রিপন তার রুমে চলে গেল। যাওয়ার সময় বলে গেল, প্রামানিক ভাই, বাস কিন্তু সকাল ছয়টায়। তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠবেন।
আমি ‘ঠিক আছে’ বলে সায় দিয়ে দিলাম।
ভোর থাকতেই রিপন আমাকে ঘুম থেকে ডেকে উঠালো। হাত মুখ ধুয়ে কাপড় পরে সকাল পৌনে ছয়টায় দু’জনে পল্টন মোড়ে এসে দাঁড়ালাম। যথা সময়ে বাস চলে এলো। আমরা বাসে উঠলাম। পিছনের কিছু সিট ফাঁকাই থাকল। আমাকেসহ সর্বমোট ৪২জন। সকাল আটটার আগেই টাঙ্গাইল পৌছে গেলাম। সন্তোষের জমিদার বাড়ির সামনের রাস্তায় নেমে সবার সাথে আমিও স্লোগান ধরলাম। আমরা পৌছানোর আগেই অনেক লোক এসেছে। বিশ্ব বিদ্যালয়ের মাঠ ভরে গেছে। এরা সবাই যে ভাসানী ন্যাপ পার্টি করে তা নয়। আওয়ামীলীগ, বিএনপি, ন্যাপ, কমিউনিষ্টসহ অনেক পার্টির লোক এসেছে। ঐদিন লোকজনের ভাব দেখে মনে হলো, মওলানা ভাসানী মজলুম জননেতা হিসেবে আসলেই একজন জনপ্রিয় নেতা ছিলেন। দলমত নির্বিশেষে তার প্রতি সকলেরই শ্রোদ্ধাবোধ আছে। স্লোগান দিয়ে সবাই মঞ্চের দিকে চলে গেলে আমি রিপনের কাছে গিয়ে আস্তে আস্তে বললাম, রিপন, আমি একটু এই এলাকাটা ঘুরে দেখবো।
রিপন বলল, বেশি দুরে যাবেন না। আমরা কিন্তু দেরি করবো না।
আমি যেতে যেতে বললাম, ঠিক আছে, তাড়াতাড়িই ফিরবো।
আমি মাঠের পূর্ব পার্শ্বে সন্তোষের রাজবাড়ির ভিতরে ঢুকে পুরানো বিল্ডিংগুলো দেখে দক্ষিণ পার্শ্বে চলে এলাম। সামনে ঘাট বাঁধানো বিশাল পুকুর। পানি টলটল করছে। পুকুরের পূর্ব পাড় দিয়ে দক্ষিণে রাস্তাায় এসে দাঁড়ালাম। একজন রিক্সাওয়ালা ‘চাড়াবাড়ি চাড়াবাড়ি’ করে যাত্রী ডাকছে। ‘চাড়াবাড়ির’ নাম শুনে মওলানা ভাসানীর সেই ঘটনা মনে পড়ে গেল।
ইংরেজ বেনিয়াদের শাসন আমল। সারা বাংলায় বন্যার প্রকোপে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। বন্যা পরবর্তি প্রচন্ড অভাব। বিশেষ করে পূর্ববাংলায় অভাবের পরিমাণ বেশি। মানুষ না খেয়ে অর্ধাহারে অনাহারে দিন কাটাচ্ছে। এমতোবস্থায় মওলানা ভাসানী অনেকগুলো মহাজনী বড় বড় নৌকা বোঝাই ত্রাণ সামগ্রী নিয়ে এসে হাজির। নৌকার বহর চাপিয়েছেন সন্তোষ জমিদার বাড়ি থেকে দুইমাইল পশ্চিমে ‘চাড়াবাড়ি’ ঘাটে। একটি নৌকায় ভাসান চর থেকে নিয়ে এসেছেন সাদা ভুটিয়া তেজী ঘোড়া। নৌকা থেকে ঘোড়া নামিয়ে ঘোড়ায় চরে সন্তোষের রাজার বাড়ির দক্ষিণ পার্শ্বের রাস্তা দিয়ে রওনা হয়েছেন। যাবেন করটিয়ার জমিদার ওয়াজেদ আলী খান পন্নীর বাড়িতে। রাজার বাড়ির সামনে পৌঁছতেই হইহই রইরই করে পাইক, বরকন্দাজ, লাঠিয়ালরা এসে ভাসানীর ঘোড়ার লাগম টেনে ধরল। তার কারণ, রাজার বাড়ির সামনে দিয়ে প্রজাদের ঘোড়ায় চরে যাওয়া নিষেধ। লাঠিয়ালরা তাকে ঘোড়া থেকে নেমে হেঁটে যেতে বলল। মওলানা ভাসানী বললেন, এটা কার নির্দেশ?
লাঠিয়াল সর্দার বলল, এটা রাজার নির্দেশ।
ভাসানী মুচকী হেসে বললেন, তোমার রাজাকে যায়া কও ভাসান চরের মওলানা ঘোড়ায় চইরাই যাইবো।
একজন লাঠিয়াল দৌড়ালো রাজার কাছে, রাজা রাজপ্রাসাদের দোতালার বারান্দায় বসা ছিলেন। রাস্তার দিকে তাকিয়ে দেখেন একে তো যবন, তার উপর লুঙ্গি ফতুয়া পড়া দাড়ি পাগরীওয়ালা মুসলমান মোল্লা। রাজা সাথে সাথেই চোখ রাঙিয়ে লাঠিয়ালকে বলে দিলেন, যে হুকুম তাই পালন করা হোক।
লাঠিয়াল দৌড়ে এসে বলল, রাজার হুকুম ঘোড়া থেকে নেমে যেতে হবে।
লাঠিয়ালের কথা শুনে মুহুর্তেই মওলানা অগ্নিমুর্তী ধারণ করে গর্জে উঠলেন। বজ্রকণ্ঠে ধমক দিয়ে বললেন, তোর রাজারে যায়া কইস, মওলানা ভাসানী পায়ে হাইটা সেইদিন যাইবো যেইদিন এই রাজবাড়িতে বেগুনের টাল (সবজি বাগান) করবার পারবো। বলেই ঝটকা টান মেরে লাঠিয়ালের হাত থেকে লাগাম খুলে নিয়ে দ্রুত বেগে ঘোড়ায় চড়েই চলে গেলেন। মওলানার কান্ড দেখে সারা রাজবাড়ি হইচই শুরু হয়ে গেল। রাজার মাথায় যেন বজ্রাঘাত হলো। রাজা মওলানাকে ধরার জন্য হুলিয়া জারী করে দিলেন। কিন্তু ধরতে পারলেন না।
মওলানা ভাসানী তার বজ্রকণ্ঠের ঘোষিত সেই কথা ঠিকই বাস্তবায়ন করলেন। রাজার সমস্ত সম্পত্তি ছিল সম্রাট কর্তৃক ইসলাম প্রচারের জন্য ওয়াক্ফ সম্পত্তি। একসময় মওলানা ভাসানীর হাতে চলে আসে সম্রাট আওরঙ্গজেবের সইমোহরাংকিত তাম্রপাত্রে লিখিত সেই দলিল। ময়মনসিংহ আদালতে রাজার বিরুদ্ধে মামলা করলেন। মামলায় রাজা পরাজিত হয়ে রাতের অন্ধকারে পালিয়ে গেলেন। মওলানা ভাসানী রাজবাড়ি দখল করেই বেগুনের টাল করলেন। তারপর পুরো রাজবাড়ি পায়ে হেঁটে বেড়ালেন।
সন্তোষের সেই রাজবাড়িটিই বর্তমানে মওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।
মওলানা ভাসানীর সেই কাহিনী মনে পড়তেই চাড়াবাড়ি ঘাট দেখার জন্য মনটা ছটফট করতে লাগল। জিজ্ঞেস করলাম, চাড়াবাড়ি কতদুর?
রিক্সাওয়ালা বলল, দুই মাইল।
আমি বললাম, ভাড়া কত?
রিক্সাওয়ালা কি মনে করে যেন আমাকে আবার প্রশ্ন করল, আপনি কি চাড়াবাড়ি যাইবেন, না পোড়াবাড়ি যাইবেন?
রিক্সাওয়ালার প্রশ্ন শুনে আমিও পাল্টা প্রশ্ন করলাম, কোন পোড়াবাড়ি?
কিছুটা আশ্চার্য হয়ে রিক্সাওয়ালা বলল, আপনি পোড়াবাড়ি চেনেন না? পোড়াবাড়ির হাট চেনেন?
আমি আমতা আমতা করে বললাম, এটা কি চমচমের পোড়াবাড়ি?
রিক্সাওয়ালা এবার মাথা ঝাঁকিয়ে খুশি খুশি ভাব নিয়ে বলল, হ হ, এইটাই তো আসল চমচমের পোড়াবাড়ির হাট।
চমচমের পোড়াবাড়ির হাটের নাম শুনে মনটা আনন্দে নেচে উঠল। এতদুর এসে যদি পোড়াবাড়ি না যাই তা হলে মনের মধ্যে একটা আফসোস তো থাকবেই তারোপর আসল পোড়াবাড়ির চমচম না খেলে জীবনটাই অতৃপ্তির মধ্যে থেকে যাবে। তাই রিক্সাওয়ালাকে বললাম, পোড়াবাড়ি হাটের ভাড়া কত?
রিক্সাওয়ালা বলল, আপনি কি একলাই যাইবেন না আমি একজন পেসান্দার নিমু?
আমি বললাম, একাই যাবো?
রিক্সাওয়ালা মাথাটা বাম দিকে কাত করে বলল, তাইলে দশ ট্যাকা নিমু।
জিজ্ঞেস করলাম, এখান থেকে কতদুর।
দুরুত্ব নিয়ে আমার ভীতিভাব যাতে না আসে সেই চিন্তা করে দুরুত্বটাকে সহজভাবে বুঝানোর জন্য মুখটা বিকৃত করে ডানবাম ঝাঁকি দিয়ে বলল, বেশি দুর না, মাত্র তিন মাইল।
আমি আর কোন প্রশ্ন না করে রিক্সাওয়ালাকে বললাম, ঠিক আছে চলেন, বলেই রিক্সায় উঠে বসলাম।

(চলবে)
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে ডিসেম্বর, ২০১৪ রাত ৩:১১
১৪টি মন্তব্য ১১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। কালবৈশাখী

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:২৪



গত পরশু এমনটি ঘটেছিল , আজও ঘটলো । ৩৮ / ৩৯ সে, গরমে পুড়ে বিকেলে হটাৎ কালবৈশাখী রুদ্র বেশে হানা দিল । খুশি হলাম বেদম । রূপনগর... ...বাকিটুকু পড়ুন

একজন খাঁটি ব্যবসায়ী ও তার গ্রাহক ভিক্ষুকের গল্প!

লিখেছেন শেরজা তপন, ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:০৪


ভারতের রাজস্থানী ও মাড়ওয়ার সম্প্রদায়ের লোকজনকে মূলত মাড়ওয়ারি বলে আমরা জানি। এরা মূলত ভারতবর্ষের সবচাইতে সফল ব্যবসায়িক সম্প্রদায়- মাড়ওয়ারি ব্যবসায়ীরা ঐতিহাসিকভাবে অভ্যাসগতভাবে পরিযায়ী। বাংলাদেশ-ভারত নেপাল পাকিস্তান থেকে শুরু করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরান-ইজরায়েল যুদ্ধ

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:০৮

আমরা সবাই জানি, ইরানের সাথে ইজরায়েলের সম্পর্ক সাপে নেউলে বললেও কম বলা হবে। ইরান ইজরায়েলকে দুচোখে দেখতে পারেনা, এবং ওর ক্ষমতা থাকলে সে আজই এর অস্তিত্ব বিলীন করে দেয়।
ইজরায়েল ভাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

নগ্ন রাজা কর্তৃক LGBTQ নামক লজ্জা নিবারনকারী গাছের পাতা আবিষ্কার

লিখেছেন মুহাম্মদ মামুনূর রশীদ, ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৪০

LGBTQ কমিউনিটি নিয়ে বা এর নরমালাইজেশনের বিরুদ্ধে শোরগোল যারা তুলছেন, তারা যে হিপোক্রেট নন, তার কি নিশ্চয়তা? কয়েক দশক ধরে গোটা সমাজটাই তো অধঃপতনে। পরিস্থিতি এখন এরকম যে "সর্বাঙ্গে ব্যথা... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে...

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে,
পড়তো তারা প্লে গ্রুপে এক প্রিপারেটরি স্কুলে।
রোজ সকালে মা তাদের বিছানা থেকে তুলে,
টেনে টুনে রেডি করাতেন মহা হুলস্থূলে।

মেয়ের মুখে থাকতো হাসি, ছেলের চোখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×