somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কুয়াকাটা ভ্রমণ এবং ম্যাজিষ্ট্রেট সাহেব

০৫ ই মার্চ, ২০১৫ রাত ৯:৩০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

অনেক দিন হলো দুরে কোথাও ভ্রমণ করা হয় না। হঠাৎ কুয়াকাটা দেখার সাধ জাগলো। অফিস থেকে তিনদিনের ছুটি পেয়েছি। ভ্রমণ করার একটা মক্ষোম সুযোগ মনে হলো। একা একা বাসায় মনও টিকছিল না। কুয়াকাটার কথা মনে হতেই মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিয়ে নিলাম। বিকালের দিকে ট্রাভেল ব্যাগে কাপড়-চোপড় এবং প্রয়োজনীয় জিনিষ-পত্র নিয়ে একাই বের হলাম।
সন্ধ্যা সাতটার সময় সদর ঘাট পৌঁছে লঞ্চের কেবিন খুঁজতে গিয়ে নাকাল হলাম। পটুয়াখালীর কোন লঞ্চেই সিঙ্গেল কেবিন খালি নেই। সব ভাড়া হয়ে গেছে। অবশেষে ’নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভাল’ এই কথা মনে করে ডবল সীটের কেবিনের একটি সীট ভাড়া করে উঠে পড়লাম। কেবিনে গিয়ে দেখি আগে থেকেই এক ভদ্রলোক কেবিনের দেয়ালে হেলান দিয়ে বেডের উপর বসে আছেন। বয়স খুব বেশি নয়। ত্রিশ পঁয়ত্রিশ হবে। কেরানী আমাকে রুমে ঢুকিয়ে দিয়ে হাতে একটি চাবি ধরিয়ে দিল। কেবিনে বসে থাকা ভদ্রলোক আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন কোন কথা বললেন না। ভদ্রলোকের চাহনীতে আমি কিছুটা ইতস্তত করতে লাগলাম। একে তো লঞ্চ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা কম, তারোপর অচেনা-অজানা লোকের সাথে একই কেবিনে। এ লোক যদি চোর-বাটপার বা ছিনতাইকারী হয় তাহলে একা পেয়ে আমার বারোটা বাজিয়ে দিবে। এমনও হতে পারে আমার ব্যাগ টাকা-পয়সা রেখে চলন্ত লঞ্চ থেকে ধাক্কা দিয়ে নদীতে ফেলেও দিতে পারে। আমার এ ভ্রমণের কথা কউকে বলেও আসিনি। মনের ভিতর অজানা আশঙ্কায় দ্বিধাদ্বন্দ শুরু হলো। কুয়াকাটা যাবো না লঞ্চ থেকে নেমে বাসায় ফিরে যাবো-- ভাবছি। এমন সময় লঞ্চটি ধাক্কা খেল। কেবিনের জানালা খুলে বাইরে তাকালাম। লঞ্চ ছেড়ে দিয়েছে। লঞ্চ ছেড়ে দেয়ায় অজানা আশঙ্কা সত্বেও আর লঞ্চ থেকে নামা হলো না।
ব্যাগটি বিছানার কোনায় বালিশের পাশে রেখে ভদ্রলোকের মত দেয়ালে হেলান দিয়ে বসলাম। ভদ্রলোকের দিকে দু’ তিনবার তাকালাম। ভদ্রলোক জানালা খুলে বাইরে তাকিয়ে আছে। আমিও চাঁদনি রাতে বুড়িগঙ্গা নদীর দৃশ্য দেখতে লাগলাম। প্রায় আধ ঘন্টা পরে ভদ্রলোকের দিকে তাকালাম। চোখাচোখি হলো। ভদ্রলোক মুখ ঘুরিয়ে নিল। আমিও কিছু বললাম না। কিছুক্ষণ পর আবার তাকালাম। দেখি ভদ্রলোক আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি কিছু বলবো মনে করে ভাবছি, এমন সময় তিনি বলে উঠলেনÑÑ
-- আপনি কোথায় যাবেন?
-- পটুয়াখলী।
-- আপনার বাড়ি কি পটুয়াখালী?
-- না।
-- ওখানে কি চাকরী করেন?
-- না।
-- আত্মীয়ের বাসায় বেড়াতে যাবেন?
-- না।
-- তাহলে কি আপনি ব্যাবসা করেন?
-- না।
আমার না না উত্তর শুনে ভদ্রলোক কিছুটা অবাক হওয়ার মত অবন্থা হলো। আমি যাতে আর না না উত্তর না বলি সেই জন্য কথার প্রসঙ্গ একটু ঘুরিযে প্রশ্ন করলেন।
-- আপনি কোথায় থাকেন?
এ কথার উত্তর হা বা না দিয়ে দেয়া যায় না। তাই বাধ্য হয়েই কথা বলতে হলো। বললাম-- ঢাকা।
-- আপনি কি করেন?
-- চাকরী করি।
-- কোথায় চাকরী করেন?
-- সংবাদ পত্রে?
-- আপনি তাহলে পত্রিকার কাজে এসেছেন?
-- না।
এবারো আমার না জবাব পেয়ে ভদ্রলোক কিছুটা চোখ বড় করে আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন--
আপনি তাহলে কি কাজে এসেছেন?
-- বেড়াতে।
বেড়াতে এসেছি শুনে ভদ্রলোক চোখ কপালে তুলে আশ্চার্য হয়ে জিজ্ঞেস করলেন -- শুধু বেড়াতে?
-- জ্বি।
-- কোথায় বেড়াবেন?
-- কুয়াকাটায়।
কুয়াকাটার কথা শুনে ভদ্রলোকের চোখ সড়াৎ করে কপাল থেকে নেমে স্বাভাবিক জায়গায় স্থাপিত হলো। কিছুটা মৃদু হেসে বললেন-- আপনি কুয়াকাটা বেড়াতে এসেছেন?
-- জ্বি।
আমার ‘জ্বি’ বলার পরে আর কিছু না বলে শুধু তাকিয়ে আছেন। ভদ্রলোকের এত প্রশ্নের পরও আমি তাকে একটি প্রশ্নও করিনি। একই কেবিনে দুইজন মানুষ। একই দিকে যাচ্ছি, তার সম্বন্ধেও কিছু জানা দরকার। তার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম-- আপনার বাড়ি কি পটুয়াখালী?
-- না।
-- তাহলে কি ঢাকায়?
-- না।
-- আপনি কি ব্যাবসা করেন?
-- না।
-- আপনিও কি বেড়াতে যাচ্ছেন?
-- না।
আমার মত তিনিও প্রশ্নের উত্তর না না দেয়ায় কিছুটা বিব্রত বোধ করে প্রশ্নের ধরন পরিবর্তন করে বললাম--
আপনি কোথায় যাবেন?
এ প্রশ্ন করায় তিনিও আর হা বা না দিয়ে উত্তর দিতে পারলেন না। মুখের জবান খুলে উত্তর দিলেন-- পটুয়াখালী।
-- পটুয়াখালী যাচ্ছেন কেন?
-- আমি ওখানে চাকরী করি।
-- কিসে আছেন?
-- এই কোর্ট কাচারীতে।
-- কত দিন হলো আছেন?
-- প্রায় দুই বৎসর।
কোর্ট কাচারীতে চাকরী করে শুনে মনে হলো হয়তো নাজির, পেশকার একটা কিছু হবে। যে পদেই চাকরী করুক না কেন, লোকটি যে ধান্দাবাজ নয় এব্যাপারে কিছুটা নিশ্চিত হলাম। বাকীটা হয়তো সারা রাতে বোঝা যাবে। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললাম-- আপনার বাড়ি কোথায়?
আমার প্রশ্ন শুনে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে বললেন-- যশোরে।
-- আপনার বাড়ি?
-- রংপুরে।
-- আপনি তাহলে পত্রিকায় চাকরী করেন?
-- জি, পত্রিকায় আছি।
আমার বাড়ি রংপুর এবং পত্রিকায় চাকরী করি শুনে লোকটি মনে হলো কিছুটা স্বাভাবিক হলো। তার ভিতরে ভীতি বা ইতস্ততভাব যতটুকু ছিল তা কিছুটা কেটে গেল। আমিও তার যশোর বাড়ি এবং কোর্ট কাচারীতে চাকরী করে শুনে কিছুটা আশ্বস্ত হলাম। পরবর্তীতে তার সাথে অনেক কথা হলো, কথা বলার এক ফাঁকে তিনি তার আসল পরিচয় দিলেন। তিনি পটুয়াখালী কোর্টের একজন ম্যাজিস্ট্রেট। নতুন চাকরী পেয়ে সর্ব প্রথম পটুয়াখালী জয়েন করেছেন। জয়েন করার পর থেকে দুই বছর হলো এখানেই আছেন। অফিসিয়াল কাজে ঢাকা গিয়েছিলেন। তিনিও আমার মত সিঙ্গেল কেবিন পাননি। আগামী কাল চাকরীতে জয়েন করতে হবে। বাধ্য হয়েই ডবল কেবিনে সীট নিয়েছেন। তার পরিচয় এবং আলাপচারিতায় একটা পর্যায়ে এমন সখ্যতা গড়ে উঠল, কিছুক্ষণ আগে যে তার প্রতি আমার ভীতিভাব ছিল সেটা ভুলেই গেলাম। প্রথমে কেবিনে ঢুকে যাকে চোর বাটপার মনে করেছিলাম তিনি চোর নন চোরের বিচারক। একথা মনে হতেই মনের ভিতর যেমন সাহস এলো তেমনি তার প্রতি শ্রদ্ধাও এলো। পরিচয় হওয়ার পর থেকে গল্পে গল্পে রাত প্রায় একটা বেজে গেল। দুইজনেই লাইট জ্বালানো অবস্থায় কখনও বালিশে হেলান দিয়ে আবার কখনও বসে বসে গল্প করছি। মাঝে মাঝে ঘুমানোর চেষ্টা করেও ঘুমাতে পারছিলাম না। লঞ্চের ইঞ্জিনের ঘর ঘর শব্দ এবং বিছানাসহ দেয়ালের থরথর কাঁপুনিতে নিজেও অনবরত থরথর করে কাঁপতে ছিলাম। এরকম ঘরঘর শব্দ এবং ঝাকুনি পরিবেশে কখনও ঘুমাইনি, তাই ঘুম তো দুরের কথা মাথা ভার হয়ে অস্বস্থিবোধ করতে ছিলাম। আমার মত হয়তো তিনিও একই অবস্থা বোধ করতেছিলেন। কারণ তিনিও ঘুমানোর চেষ্টা না করে সারাক্ষণ আমার সাথে নানা প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলেছিলেন।
ভোর সাড়ে পাঁচটার সময় লঞ্চের ঘর ঘর শব্দ থেমে গেল। আমি দরজা খুলে বাইরে বের হলাম। চেয়ে দেখি লঞ্চ ঘাটে ভিড়েছে। পুনরায় রুমে এসে কাপড়-চোপড় পরে ব্যাগ গুছিয়ে নিতে দেখে ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব আমাকে এই সময়ে লঞ্চ থেকে নামতে নিষেধ করলেন। কারণ তখনও পুরোপুরি বাইরে ফর্সা হয়নি। এই সময় ছিনতাই হওয়ার সম্ভাবনা আছে। ভদ্রলোকের কথা শুনে উৎসাহে ভাটা পড়ে গেল। আবার বিছানার উপর বসে কালক্ষেপণ করতে লাগলাম। সাড়ে ছয়টার সময় ভদ্রলোক টয়লেট থেকে এসে কাপড়-চোপড় পরে রেডি হলেন। লঞ্চের লোক বাইরে অপেক্ষায় ছিল, তার কাছে চাবি দিয়ে দুইজনেই লঞ্চ থেকে নেমে এলাম।
ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব আমাকে তার ভাড়া করা রিক্সায় তুলে এনে বাস স্টেশনের কাছে নামিয়ে দিলেন। শুধু আমাকে নামিয়েই দিলেন না, তিনি নিজেও রিক্সা থেকে নেমে এসে কুয়াকাটার বাসে তুলে দিলেন। আমাকে বাসে তুলে দিয়ে আবার রিক্সা ঘুরিয়ে শহরের দিকে চলে গেলেন। পটুয়াখালিতে নতুন এসেছি। আমি যাতে পথ ভুলে বা ঠক, বাটপার, ছিনতাইকারীর পাল্লায় না পড়ি, সেইজন্য আমাকে বাস স্ট্যান্ড পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে গেলেন। এই কাজটি করতে গিয়ে তাকে নিজের রাস্তা ফেলে উল্টো পথে আসতে হয়েছিল। ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের এই সহযোগীতা ও সহানুভুতির কথা আজীবন ভুলতে পারবো না।
বাসে উঠে সিট নিয়ে বসে রইলাম। সকাল সাতটার সময় বাস কুয়াকাটার উদ্দেশ্যে ছেড়ে দিল। খেপুপাড়া সহ কয়েকটি ফেরীঘাট পার হয়ে বাস যখন কুয়াকাটা পৌছল তখন সময় সকাল সাড়ে এগারোটা।

(চলবে)
১৮টি মন্তব্য ১৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছবির গল্প, গল্পের ছবি

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৩:১৫



সজিনা বিক্রি করছে ছোট্ট বিক্রেতা। এতো ছোট বিক্রেতা ও আমাদের ক্যামেরা দেখে যখন আশেপাশের মানুষ জমা হয়েছিল তখন বাচ্চাটি খুবই লজ্জায় পড়ে যায়। পরে আমরা তাকে আর বিরক্ত না করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে লীগ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে জামাত

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৪৬


বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪৩

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

চা বাগানের ছবি কৃতজ্ঞতা: http://www.peakpx.com এর প্রতি।

আমাদের সময় একাডেমিক পড়াশোনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চয়নিকা বইয়ের গল্পগুলো বেশ আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, চাষীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×