somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কুয়াকাটা ভ্রমণ এবং বাটপার হোটেলওয়ালা (২য় পর্ব)

১১ ই মার্চ, ২০১৫ বিকাল ৩:২৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


(ছবি ইন্টারনেট)
শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

বাস থেকে নেমেই দক্ষিণ দিকে হাঁটতে লাগলাম। বেড়ি বাঁধ পার হয়ে ছোট একটি বাজার। বজারের পরেই সমুদ্র সৈকত। কাঁধে ব্যাগ নিয়েই সমুদ্র সৈকতে গিয়ে সমুদ্রের তর্জন গর্জন দেখতে লাগলাম। দক্ষিণে বিস্তৃতজোরা পানি আর পানি। পানি ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ে না। কিছুক্ষণ সমুদ্রের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকে বাজারের দিকে ফিরলাম। সমুদ্রের কাছেই বাজারের ভিতরে রাস্তার পাশেই দোতালা একটি থাকার হোটেল পেলাম। ভাড়া খুব বেশি নয়। এক সিটের রুম দোতালায় এক শত টাকা ভাড়া। তখন কুয়াকাটায় পর্যটকদের এত রমরমা অবস্থা ছিল না। ২০০১ সালের সেপ্টেম্বর মাস। পর্যটকের মৌসুম না হওয়ায় হোটেলওয়ালারা বোর্ডার পাচ্ছে না। তাই এত কম ভাড়া। পর্যটক মৌসুমে এই রুমটিই হাজার টাকা ভাড়া হয়।
ম্যানেজারের কাছে খাতায় নাম ঠিকানা লিখে রুমের চাবি নিয়ে রুমে গিয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে মিঠা পানিতে গোসল করে নিলাম। বেলা দেড়টার দিকে আবার সমুদ্রের পাড়ে গিয়ে কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করায় ক্ষুধার উদ্রেক হলো। পূর্ব পার্শ্বের বাজারে গিয়ে দেখি তিনটি খাবার হোটেল আছে। একটি হোটেলের ক্যাশে হাঁটুর নিচ পর্যন্ত লম্বা পাঞ্জাবী পরা, মাথায় গোল টুপি, স্বাভাবিকের চেয়ে লম্বা মুখ ভর্তি দাড়ি, কপালে নামাযের কোলো দাগওয়ালা মাঝারি বয়সের মওলানার মত চেহারার এক লোক বসে আছে। তার সামনে টেবিলের উপরে ভাত তরকারী সুন্দর করে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। ইলিশ মাছের ঝোলের গামলার পাশে আরেকটি গামলায় ইলিশ মাছ ভাজা রাখা আছে। দেখে খুব লোভ লাগল। ক্যাশে বসা মওলানা সাহেবকে জিজ্ঞেস করলাম, চাচা ইলিস মাছ কত?
উনি বিনয়ের সাথে বললেন, খুব বেশি না বাবা, দুই পিস ত্রিশ টাকা।
দুই পিস ত্রিশ টাকা দাম বলায় আমার কাছে খুব সস্তা মনে হলো। কারণ ঢাকায় আগের দিন মতিঝিলের একটি হোটেলে এক পিস পঁয়ত্রিশ টাকায় খেয়ে এসেছি। তারপরেও বাঙ্গালীর স্বভাব অনুযায়ী বললাম, চাচা একটু কম রাখা যায় না?
আমার কথা শুনে মওলানা হাসি দিয়ে বললেন, দুই পিস ত্রিশ টাকা দেয়ার পরেও কম রাখতে বলতেছেন। এর চেয়ে কম রাখলে তো আমার চালান থাকবে না। ঘরবাড়ি বিক্রি করে এনে আপনাদেরকে খাওয়ানো লাগবে।
মওলানার কথা শুনে নিজেই লজ্জিত হলাম। এরপর আর কোন কথা না বাড়িয়ে বললাম, চাচা ভাত দেন।
মওলানা তের চৌদ্দ বছর বয়েসি একটি ছেলেকে ভাত দিতে বলে নিজে ঝোল সহ দুই পিস মাছের তরকারী দিয়ে গেলেন। আমি মাছ পাতে ঢেলে নিয়ে অর্ধেক ভাত খেতে না খেতেই ঢাকা থেকে একটি পরিবার এসে হোটেলে ঢুকলো। তারা সংখ্যায় সাত জন। সবাই চাপ কলের পানিতে হাত মুখ ধুয়ে চেয়ারে বসার পরে সম্ভাবত পরিবারের কর্তা হবেন তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ইলিশ মাছ কত?
লেবাস ধারী মওলানা সাহেবের আসল চরিত্র যেন বের হলো। মুখে মৃদু হাসি দিয়ে বললেন, প্রতি পিস ত্রিশ টাকা।
লোকটি বললেন, কম হবে না।
মওলানা বললেন, না, কম হবে না। এখন মাছের দাম বেশি। তাছাড়া এই দামে পাশের টেবিলেই তো একজন খাচ্ছে। আপনাকে কম দিব কিভাবে?
আমার দিকে ইংগীত দিয়ে কথা বললেও আমি ধরেই নিয়েছি আমাকে উদাহারণ দেখিয়ে ঢাকাইয়া পাবলিকের কাছ থেকে দু’পয়সা বেশী রোজগার করে নিচ্ছে। তাছাড়া এই এলাকায় নতুন এসেছি। কাউকে চিনি না জানি না। এই মুহুর্তে ঢাকার ভদ্রলোককে মাছের দাম দুই পিস ত্রিশ টাকা যদি বলে দেই, কি জানি আবার ব্যাবসা কম হওয়ায় হোটেলওয়ালার আমার উপর ক্ষেপে যায়। সেই দিকে চিন্তাভাবনা করে আমি কোন কথা না বলে চুপচাপ খেতে লাগলাম। খাওয়া শেষে হাত ধুয়ে উঠে এসে ক্যাশে গিয়ে মওলানা সাহেবকে জিজ্ঞেস করলাম, আমার বিল কত?
মওলানা আমার মুখের দিকে না তাকিয়েই বললেন, পঁচাত্তর টাকা।
আমি তার দাম চাওয়া দেখে আকাশ থেকে পড়লাম, বললাম, এত টাকা কিভাবে হলো?
মওলানা হাসি হাসি মুখে সুন্দর করে হিসাব বুঝিয়ে দিলেন, মাছ দুই পিস ষাট টাকা, ভাত দুই প্লেট বারো টাকা, ডাল তিন টাকা, এই পঁচাত্তর টাকা।
আমি বললাম, হুজুর বলেন কি? মাছ দুই পিস ত্রিশ টাকা না বললেন?
মওলানা মুখ বাঁকা করে দাঁত বের করে বললেন, আপনার কি মাথা খারাপ? দুই পিস ইলিশ মাছ ত্রিশ টাকা? বাংলাদেশের কোথাও আছে?
আমি বললাম, আপনিই তো ত্রিশ টাকার কথা বললেন?
মওলানা এমন ভাব নিয়ে আমার কথার জবাব দিল যেন তিনি আমার কথায় আকাশ থেকে পড়লেন। চোখ কপালে তুলে আশ্চার্য হওয়ার ভাব ধরে বললেন, আমি দুই পিস ত্রিশ টাকার কথা বললাম! কখন বললাম! আপনি তাহলে ভুল শুনছেন, এক পিস ত্রিশ টাকা বলেছি।
আমি তার মিথ্যা কথার প্রতিবাদ করে বললাম, হুজুর আমি ভুল শুনি নাই, দুই পিস ত্রিশ টাকার কথা বলেছেন। একবার না কয়েক বার বলেছেন।
মওলানা হাত নেড়ে নেড়ে তার মিথ্যা কথা সত্যে পরিণত করার জন্য জোর গলায় বললেন, আমি কখনই বলি নাই, আপনি আমাকে মিথ্যাবাদী বানানোর চেষ্টা করতেছেন। আমি মিথ্যা কথা বলার লোক না। আপনি আমাকে মিথ্যাবাদী বানানোর আগে আমার চেহারাটা ভাল করে দেখা উচিৎ ছিল? আমার লেবাস দেখেও তো আপনার হুস হওয়া উচিৎ। এই লেবাসে কেউ মিথ্যা কথা বলে?
দামের জন্য নয়, মওলানার লেবাসে মিথ্যা কথা বলাটা সহ্য হচ্ছিল না, তাই নিজেকে সামলাতে না পেরে ফস্ করে মাথাটা সামনে ঝাকি দিয়ে বললাম, আপনি তো বললেন?
এ কথা বলার সাথে সাথে মওলানা চোখ গরম করে লাফিয়ে উঠলেন, এই আপনার বাড়ি কোথায়? আপনি তো আচ্ছা লোক। কুয়াকাটায় এসে খাওয়ার দাম নিয়ে উল্টাপাল্টা কথা শুরু করে দিয়েছেন। আপনি আমাকে মিথ্যাবাদী বানানোর চেষ্টা করতেছেন। আপনার চোখের সামনে ত্রিশ টাকা পিস মাছের দাম দিয়ে ভাত খাচ্ছে, আর আপনে দুই পিস ত্রিশ টাকা দিতে চান। যারা ত্রিশ টাকা পিস মাছ খাচ্ছে, তারা কি আমার শত্রু নাকি?
আমি বললাম, তারাও আপনার শত্রু না, আমিও আপনার শত্রু না, তারাও আপনার কাস্টমার, আমিও আপনার কাস্টমার। তারা যেমন খাওয়ার আগে মাছের দাম মিটিয়েছে, আমিও খাওয়ার আগে দাম মিটিয়ে নিয়েছি।
মওলানা এবার ভাল মানুষ হওয়ার চেষ্টা করে আমাকে বলল, আরে বাবা কথা তো ঠিকই আছে, তারা প্রতি পিস ত্রিশ টাকা দাম মিটিয়ে খাচ্ছে, সেখানে আপনি দুই পিস ত্রিশ টাকা দিতে চাচ্ছেন। এইটা কি হয়? কোনো পাগলেও তো এমন কম বেশি মেনে নিবে না। একই টেবিলে বসে একজন পনর টাকা দিবে আরেকজন ত্রিশ টাকা দিবে, এইটা বিবেকবান মানুষ হয়ে আমি নিতে পারি?
বাটপারের কথা শুনে বুঝলাম এই হোটেলে খেয়ে আমি এখন অবিবেকবান হয়েছি। তার এই যুক্তি যে কোন লোককে বললেও মেনে নেবে। একা একা এই অচেনা অজানা জায়গায় বাটপারের সাথে তর্ক করা উচিৎ হবে না। যে লোক মওলানার লেবাস পরে বাটপারি করতে পারে সে আমার ক্ষতিও করতে পারে। কাজেই তর্ক করা সমীচীন নয় মনে করে কথা না বাড়িয়ে পকেট থেকে একশত টাকার একটি নোট বের করে দিয়ে বললাম, নেন আপনার মনে যা চায় তাই নেন।
মওলানা টাকা হাতে নিয়ে হাত নেড়ে নেড়ে বললেন, জি না বাবা, আপনি বেশি দিলেও আমি বেশি নিব না। আমি বেঈমান নই। আমি হালাল ব্যবসা করে খাই। পঁচাত্তর টাকা দাম হয়েছে পঁচাত্তর টাকাই নিব। এক পয়সাও বেশি নিব না।
তার কথা শুনে মনে হলো সে অত্যাধিক সৎ লোক আমিই ঠক বাটপার। ঢাকা থেকে কুয়াকাটায় এসে উনার মত ভাল সাধু লোকের সাথে বাটপারি করার চেষ্টা করতেছি। ভন্ড নিজের পক্ষে সততার যুক্তি দিয়ে কথা বললেও আমি আর কথা বললাম না।
মওলানা একশত টাকা থেকে আমাকে পঁচিশ টাকা ফেরত দিলে তাই নিয়ে মনের দুখে হোটেলে চলে গেলাম। টাকা বেশি নেয়ায় আমার কোন দুঃখ ছিল না। যদি আমাকেও প্রথমেই ত্রিশ টাকা পিস দাম বলে দিত, তাহলে আমি আমার মনকে বুঝাতে পারতাম, দাম ঠিক করেই তো খেয়েছি। কথা যখন দিয়েছি তখন বেশি দিতেই হবে। খাওয়ার আগে বলল কম দাম, খাওয়ার পরে নিল বেশি, এইখানেই আমার খারাপ লাগতেছিল। এর চেয়ও অনেক দাম দিয়ে মাছ খেয়েছি। এই তো গত সপ্তাহে (২০০১ সালে) কাওরান বাজারের মেরিন হোটেলে একশত বিশ টাকা পিস আইড় মাছ দিয়ে ভাত খেয়েছি। খাওয়ার পরে তৃপ্তিসহকারে ঢেকুর তুলে দেড় শত টাকা বিল দিয়েছি। তার আগের মাসে সোনার গাঁ হোটেলে বুফেতে খেয়ে দুই জনে তের শত টাকা বিল দিয়েছি। এত টাকা বিল দিলেও মোটেও খারাপ লাগে নাই। কারণ আমাদের জানা আছে ওইসব হোটেলের খাবার মূল্য সাধারণ হোটেলের চেয়ে সবসময় বেশি থাকে।

বিছনায় শুয়ে শুয়ে মওলানার মত লেবাস পরা চেহারায় মানুষকে ধোঁকা দেয়ার কৌশল দেখে নিজের মনকে বুঝ দিতে পারছিলাম না। এরকম লেবাসী চেহারায় এরকম জঘন্য মিথ্যা কথা বলতে আর কখনও কাউকে দেখি নাই। মনের মধ্যে বার বার মওলানার ছদ্মবেশী খোলস চোখে ভাসতে লাগল। ইচ্ছা হলো মওলানাকে ধরে সমুদ্রের পানিতে চুবিয়ে আনি। কারণ ইসলামের সব চেয়ে পবিত্র পোষাক হলো এটি। এই পোষাকটি ইসলামের সুন্নতি পোষাক। এই পোষাক যার গায়ে থাকে সে সবসময় সত্যবাদী হয়। মানুষের সাথে কখনও প্রতারনা করে না বা করার চেষ্টা করে না। সেই পোষাক পরে বাটপার বেটার প্রতারনা করাটা আমার সহ্য হচ্ছিল না। এইসব মওলানা লেবাসধারী বদ লোকের কারণে বর্তমানে ইসলাম এবং মুসলমানের দুর্দশা। এদের মত দু’একজন ভন্ড লোকের প্রতারণার জন্য মানুষ ইসলাম তথা পুরো মুসলমান জাতিকে ভন্ড মনে করে। এদেরকে ধরে কঠিন শাস্তি দেয়া দরকার, যাতে এই লেবাসে আর কেউ কখনও ভন্ডামী না করে। সেই জন্যই প্রতিবাদ করতে ছিলাম টাকার জন্য নয়। কিন্তু এই মুহুর্তে এই জায়গায় এর চেয়ে বেশি প্রতিবাদ করা ঠিক হবে না। অচেনা অজানা জায়গায় একা একা যতটুকু প্রতিবাদ করেছি তা যথেষ্ট। এর চেয়ে বেশি কিছু করতে গেলে ক্ষতি গ্রস্থ হওয়ার সম্ভাবনা আছে। যে বাটপারি করতে পারে সে ক্ষতিও করতে পারে। বাটপারের কথা ভুলে যাওয়ার জন্য ঘুমানোর খুব চেষ্টা করেও ঘুমাতে পারছিলাম না। বিছানায় অনেক গড়াগড়ি করে অবশেষে উঠে বসলাম।

বিকাল বেলা আবার সমুদ্র সৈকতে গেলাম। সমুদ্রের জোয়ারে তখন ভাটা। সমুদ্রের তর্জন গর্জন অনেক কমেছে। সমুদ্রের সৈকত ধরে পশ্চিম দিকে হাঁটতে লাগলাম। বেলা পশ্চিম দিকে লাল হয়ে আস্তে আস্তে পানির ভিতর ডুবে যাচ্ছে। সমুদ্রে ডুবে যাওয়া সূর্য দেখে খুব অভিভুত হলাম। এক পর্যায়ে সুর্য পানির নিচে চলে গেল। সূর্যের ডুবে যাওয়া দৃশ্য দেখতে দেখতে প্রায় আধাকিলোমিটারের মত চলে গিয়েছি। হঠাৎ হুশ হলো, যদি এখন না ফিরি তাহলে অন্ধকার হয়ে গেলে বিপদে পড়তে পারি। তৎক্ষনাৎ উল্টা দিকে ঘুরে আবার ফিরে এলাম। সূর্য ডুবলেও অন্ধকার শুরু হয় নাই। তখনও পর্যাপ্ত আলো আছে। আসার সময় লক্ষ্য করে দেখি সৈকতের বালুর উপর অসংখ্য লাল লাল ইটের টুকরা দেখা যায়। কাছে আসতেই সব ইটের টুকরা কোথায় যেন লুকিয়ে যায়। এসব ইটের টুকরা না অন্য কিছু বুঝতে পারছি না। সারা বালুকা বেলায় লক্ষ লক্ষ ইটের টুকরা দুরে থেকে দেখলেও কাছে এসে কিছুই চোখে পড়ছে না। বিষয়টি ভাল ভাবে পরখ করার জন্য নিচু হয়ে বালুর উপর তাকালাম, খেয়াল করে দেখি এগুলো ইটের টুকরা নয়, সমুদ্র সৈকতে বসবাস করা ছোট ছোট লাল কাঁকড়া। এরা মানুষের উপস্থিতি টের পেলেই বালুর ভিতর ঢুকে যায়। সমুদ্রের গর্জন আর লাল লাল কাকড়ার লুকোচুরি খেলা দেখতে দেখতে কুয়াকাটা বাজারে চলে এলাম। কুয়াকাটা বাজারে যখন এলাম তখন সন্ধ্যা হয়েছে। হোটেলের রুমে গিয়ে কিছুক্ষণ রেস্ট নিয়ে আবার নিচে নেমে এলাম। একা একা ভাল লাগছিল না। হাঁটতে হাঁটতে বেড়ি বাঁধ পার হয়ে উত্তরের বাজারে চলে এলাম। এখনে এসে পাকা রাস্তার পূর্ব পার্শ্বে দুটি খাওয়ার হোটেল পেলাম।
একটিতে হুজুর ক্যাশে বসা দেখে সেখানে দুপুরের কথা মনে হতেই আর ঢুকলাম না। পাশের হোটেলে ঢুকে পোয়া মাছ দিয়ে ভাত খেয়ে চল্লিশ টাকা বিল দিয়ে বেরিয়ে এলাম। রাতে আবার সমুদ্র সৈকতে গেলাম। রাতে আমিসহ মাত্র তিনজন মানুষ। কেউ কাউকে চিনি না দেখে, দেও দুস্যুর ভয়ে নয়, মানুষ ছিনতাইকারীর ভয়ে সৈকত থেকে চলে এলাম। হোটেলে এসে হাত মুখ ধুয়ে শুয়ে পড়লাম।
সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠেই সমুদ্র সৈকতে চলে গেলাম। বেলা আটটা পর্যন্ত সমুদ্র সৈকতে হাঁটাহাটি করে বেড়ি বাঁধের উত্তর পার্শ্বে নাস্তা করতে গেলাম। রাতে যে হোটেলে খেয়েছিলাম সে হোটেলের নাস্তা পছন্দ হলো না। পাশের হোটেলে গেলাম। হোটেলের ম্যানেজার হুজুর। হুজুর দেখেই পিলে চমকে উঠল। আবার বুঝি ঠকের পাল্লায় পড়ি। তবে এ হুজুর অত হুজুর নয়। কিছুটা গ্রাম্য কাঠ মোল্লার মত। মুখে এক মুষ্ঠি ছাগল দাড়ি। গায়ে হাতাওয়ালা কোড়া গেঞ্জি। পরনে কচুপাতা রঙের লুঙি। ডান হাতে কালো সুতা দিয়ে বাঁধা তাবিজ।
হোটেলে ঢুকে খাবারের দিকে চেয়ে দেখি গরম গরম ভাত তরকারী সাজানো আছে। রুটি পরাটাও আছে। ভাপ উঠা ভাত তরকারী দেখে ভাত খেতে ইচ্ছা হলো। কিন্তু ক্যাশের হুজুরকে দেখে মনে মনে ভাবলাম অত বড় হুজুরই যখন এত বড় ঠকামী করল, এই কাঠ মোল্লা হুজুরের তো সেই সুন্নতী লেবাস নেই, এ যে আবার কতবড় ঠকামী করে বসে। মনে মনে চিন্তা করলাম ঢাকার ভাষায় কথা বলায় হয়তো ঢাকা থেকে বেড়াতে এসেছি মনে করে আমাদের ঠকিয়ে থাকে, বরিশালের ভাষায় কথা বললে নাও ঠকাতে পারে। কিন্তু বরিশালের ভাষা খুব একটা জানি না। সেই দিক দিয়ে ইতস্তত করতে লাগলাম। কিছুক্ষণ চেয়ারে বসে বসে বরিশালের ভাষা প্রাকটিস করে নিলাম। কাঠ মোল্লা হুজুরের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললাম, বাইডি, মোরে দুগ্গা বাত দ্যান দেহি।
ক্যাশে বসে থাকা কাঠ মোল্লা হুজুর বলল, হাত মুখ ধুইয়া বন, মুই দেতাছি।
কাঠ মোল্লা হুজুর ক্যাশ থেকে উঠে এসে নিজেই ভাত দিলেন। লম্বা টানে জিজ্ঞেস করলেন কি খাইবে--ন? মুরগী, ইলি--শ, না লাউ চিংড়ি-- ?
বরিশালের কথা বলতে অভ্যস্ত না হওয়ায় সংক্ষেপে বললাম, লাউ চিংড়ি।
গরম গরম ভাত আর লাউ চিংড়ি খেতে খুব ভাল লাগল। লাউ চিংড়ি অনেক স্বাদ হয়েছে। খাওয়া শেষে চিন্তা করলাম, মওলানার মত সুন্নতী লেবাসধারী হুজুরের সাথে মাছের দাম করার পরও ডবল দাম নিয়েছে, এই কাঠ মোল্লা হুজুরকে তো কোন কিছু জিজ্ঞেস করা হয় নাই, না জানি কত দাম নেয়। ভীতিভাব নিয়ে দাম দিতে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, বাইডি, কত অইছে---?
হুজুর পান চিবাতে চিবাতে মাথা নাড়িয়ে বললেন, খুব বেশি না, বিশ টাহা।
কথা শুনে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। তিনি বিশ টাকা বললেন না বিয়াল্লিশ টাকা বললেন। হুজুরের মুখ থেকে বিলের টাকার হিসাব আবার জানার জন্য বললাম, বাইডি, অ কন কি, এত অইলে ক্যামবে?
হুজুর আমার মুখের দিকে তাকিয়ে হাসি হাসি মুখে বললেন, খুব বেশি অইলে কই? বাত দুই প্লেট দশ টাহা, লাউ চিংড়ি দশ টাহা, ডাল তো ফ্রি দেলাম।
মাত্র বিশ টাকা বিল শুনে নিজের কানকেই নিজে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। এত ভাল খাবার মাত্র বিশ টাকা। মনে মনে খুব খুশি হয়ে পঞ্চাশ টাকার নোট বের করে দিয়ে বললাম, লন বাই লন, মুই আবার দুপুরে খামু, দুপুরে একটু কমায়ে রাইহেন।
এ কথা শুনে হুজুর বলল, মুই তো কামায়াই রাহি, বেড়ি বাঁধের ওই পারে যাইবেন, গলা কাইটে রাখবে। তহন বুঝবেন, মুই বেশি নেই না হেরা বেশি নেয়।
বেড়ি বাঁধের ওই পারে যে দাম বেশি নেয় এ কথা কাঠ মোল্লা হুজুরের কাছে শুনে খুব ভাল লাগল। খুশিতে হুজুরকে ধন্যবাদ দিয়ে মনে মনে বললাম, ওই পারের হুজুর গলা কাইটে রাইহে দিবে কতক্ষণে, গত কাল দুপুরে তো মোর গলা কাইট্টেই দেছে। মুই তো হেইয়া আপনারে কইতে হারতেছি না।
কাঠ মোল্লা হুজুরের কথা শুনে ইচ্ছা হলো গতকালকের ওই হুজুরের কাহিনী বলি, কিন্তু পরক্ষণেই চিন্তা করলাম যদি আবার এ হুজুর আমার সেই ঘটনার সুযোগ নেয়, তাই ইচ্ছা থাকা সত্বেও ঘটনাটি বললাম না।
দুই হুজুরের মধ্যে অনেক পার্থক্য মনে হলো। এত বড় হুজুরের লেবাসধারী লোক যে এত বড় ঠক হতে পারে তা আগে কল্পনা করি নাই অথচ এই কাঠ মোল্লা হুজুরের চারিত্রিক গুন এবং ব্যাবসায়িক সততা দেখে মুগ্ধ হলাম। এর পরে যে কয়দিন ছিলাম ওই কাঠ মোল্লা হুজুরের হোটেলেই সব সময় খেয়েছি। অন্য কোন হোটেলে আর যাইনি। এতে তার কাছ থেকে কিছু সুবিধাও পেয়েছি। মাত্র পনর টাকা পিস ইলিশ মাছের দাম নিত। তিন চার পিস খেলে মাঝে মাঝে দশ টাকা পিসও দাম ধরতো। সব সময় খেতাম দেখে হুজুর আমাকে বেশি বেশি করে তরকারী দিত বিনিময়ে কোন টাকা পয়সা বেশি নিত না।
উব্বিজুব্বি পরা মওলানার মতো লেবাস হলেই যে সে সৎ লোক হয় না এটা কুয়াকাটা এসে হাড়ে হাড়ে টের পেলাম। অথচ এই কাঠ মোল্লা হুজুর হয়তো অত লেখাপড়া জানে না। ধর্মের প্রতি দুর্বলতা এবং পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের কারণে দাড়ি রেখেছে। কুয়াকাটায় যে কয়দিন ছিলাম তার ভিতরে ঠকানোর চিন্তা কখনই চোখে পড়ে নাই। তার সাথে প্রথমেই যা বরিশালের ভাষা ব্যবহার করেছি এর পর আর বরিশালের ভাষায় কথা বলি নাই। আমি ঢাকা থেকে বেড়াতে এসেছি জেনে আমার সাথে সবসময় ভাল ব্যাবহার করেছেন। আসার সময় তার কাছ থেকে বিদায় নিতে গেলে হুজুর খুশি হয়ে আমাকে চা খাওয়ালেন। আমি দাম দিতে চাইলেও কোন ভাবেই তিনি চায়ের দাম গ্রহন করলেন না। মনে হলো এই তিন দিনেই তিনি আমাকে আপন করে নিয়েছেন।

(চলবে)

(প্রথম পর্ব পড়ার জন্য ‍‍"কুয়াকাটা ভ্রমণ এবং ম্যাজিষ্ট্রেট সাহেব" নিচের লিংকটি ক্লিক করুন)
কুয়াকাটা ভ্রমণ এবং ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই মার্চ, ২০১৫ রাত ১:০২
২১টি মন্তব্য ২১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা ও পদ্মশ্রী পুরস্কার

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৫৬



এ বছরের পদ্মশ্রী (ভারতের চতুর্থ সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মাননা) পদকে ভূষিত করা হয়েছে, বাংলাদেশের রবীন্দ্র সংগীত এর কিংবদন্তি শিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যাকে।

আমরা গর্বিত বন্যাকে নিয়ে । ...বাকিটুকু পড়ুন

কষ্ট থেকে আত্মরক্ষা করতে চাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৯



দেহটা মনের সাথে দৌড়ে পারে না
মন উড়ে চলে যায় বহু দূর স্থানে
ক্লান্ত দেহ পড়ে থাকে বিশ্রামে
একরাশ হতাশায় মন দেহে ফিরে।

সময়ের চাকা ঘুরতে থাকে অবিরত
কি অর্জন হলো হিসাব... ...বাকিটুকু পড়ুন

রম্য : মদ্যপান !

লিখেছেন গেছো দাদা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫৩

প্রখ্যাত শায়র মীর্জা গালিব একদিন তাঁর বোতল নিয়ে মসজিদে বসে মদ্যপান করছিলেন। বেশ মৌতাতে রয়েছেন তিনি। এদিকে মুসল্লিদের নজরে পড়েছে এই ঘটনা। তখন মুসল্লীরা রে রে করে এসে তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

= নিরস জীবনের প্রতিচ্ছবি=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৪১



এখন সময় নেই আর ভালোবাসার
ব্যস্ততার ঘাড়ে পা ঝুলিয়ে নিথর বসেছি,
চাইলেও ফেরত আসা যাবে না এখানে
সময় অল্প, গুছাতে হবে জমে যাওয়া কাজ।

বাতাসে সময় কুঁড়িয়েছি মুঠো ভরে
অবসরের বুকে শুয়ে বসে... ...বাকিটুকু পড়ুন

Instrumentation & Control (INC) সাবজেক্ট বাংলাদেশে নেই

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৫




শিক্ষা ব্যবস্থার মান যে বাংলাদেশে এক্কেবারেই খারাপ তা বলার কোনো সুযোগ নেই। সারাদিন শিক্ষার মান নিয়ে চেঁচামেচি করলেও বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরাই বিশ্বের অনেক উন্নত দেশে সার্ভিস দিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×