somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

উপন্যাস– আঁধারে শশী (পর্ব-৪)

২৪ শে মার্চ, ২০১৫ বিকাল ৫:১৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


এ্যাড ইসাহক আলী প্রামানিক

=== (এই উপন্যাসটি আমার বড় ভাই এ্যাডভোকেট ইসাহক আলী প্রামানিক-এর লেখা) ===

(সাত)
সানোয়ার হাউজিং কমপ্লেক্স লিঃ নির্বাহী কমিটির মিটিংয়ে নুতন পরিকল্পনা নিয়ে কথা হচ্ছিল। এখন থেকে শহর ও নগরে যে সব হাউজিং কমপ্লেক্স গড়ে তোলা হবে সেখানে নাগরিকের মৌলিক চাহিদা পুরণের ব্যবস্থা রাখা সম্বন্ধে। কামাল কথা উঠালেন। অর্থাৎ আবাসিক সুবিধার সাথে শিক্ষার ব্যবস্থা চিকিৎসা ও আধুনিক মার্কেট ব্যবস্থা রাখলে যা দাঁড়ায় আর কি। তার সাথে থাকবে কমিউনিটি ও খেলার মাঠ যাতে আবাসিক এলাকাটি একটা আধুনিক রিক্রিয়েশনাল এরিয়া হিসাবে গড়ে উঠবে।
প্রস্তাবটি শুনে পরিষদের সকলেই প্রথমে থ বনে গেলেও পরে পর্যালোচনা করে সবাই এক বাক্যে মারহাবা মারহাবা বলে কামালকে ধন্যবাদ জানাল। কারণ এধরনের আইডিয়া কোন অফিসারের মাথায় আসেনি। এধরনের প্লান নিয়ে কোন আবাসিক এলাকা গড়ে উঠলে নিশ্চয় আবাসিক প্লট বরাদ্দের কোন সমস্যা হবে না। সকলেই লুফে নিবে পজেশন।
প্রস্তাবটি পরিষদে এক বাক্যে পাশ হল এবং এখন থেকে যে সব আবাসিক এলাকা তৈয়ারী করা হবে সেখানেই প্লানটি থাকতে হবে। তাই তার জন্য সুন্দর ও বিরাট স্পেস দেখে সাইড নির্ধারণ করার জন্য প্রস্তাব গৃহীত হল। এলাকা নির্ধারনের উপরে বাজেট প্রনয়নের ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হল।
সকলেই একটা ধারনা দিলেন যে আগামীতে যদি এই প্লান আমরা কাজ করতে পারি, তবে এতে একটা কমিউনিটি ফিলিংস গড়ে উঠবে। এমনিতে আমরা ঢাকার মানুষেরা বড় স্বার্থপর হয়ে গেছি। অতএব এ ধরণের প্লান আমাদের অন্যদের পূর্ব থেকে থাকা উচিৎ ছিল।
প্রজেক্ট ডাইরেক্টর সানোয়ার হোসেন বললেন আমি বা তোমরা বলছো সুস্থ্য সুন্দর জীবনের কথা। আমরা কি নিজেরাই সুস্থ্য আছি। আমরা কি করো জন্য মায়া মমতা করে থাকি। এই দেখনা কিছু দিন পূর্বে আমার গ্রামের বাড়ির কিছু আত্মীয় স্বজন এসে আশ্রয় নিয়েছিল আমাদের বাসায়। ঝড় বৃষ্টিতে তাদের ঘর বাড়ি নষ্ট হয়ে গিয়েছে, অপর দিকে নদীতে জমাজমি ভেঙ্গে গেছে। স্বামী অনাহারে অর্ধাহারে বিনা চিকিৎসায় মারা গেছে। দুটো এতিম বাচ্চা নিয়ে সে মহিলাটির কি অসহায় অবস্থা? অথচ দ’ুদিন যেতে না যেতেই পরিবারের অনেকেই তাদেরকে সহ্য করতে পারল না। তার অপরাধ সে দরিদ্র অশিক্ষিত এবং অল্প বয়সী সুন্দরী। তোমরা যে যাই বলনা কেন কামাল শরাফত আমরা মানবতা কে হারিয়ে ফেলেছি। আমরা নিজের বিবেককে অন্ধ করেছি। আমরা মানবাধিকার লংঘন করছি। তাই আমরা কি সমাজের নিকট অপরাধী নই। তাহলে কি ভাবে আমরা সুস্থ্য ও সুন্দর জীবন ও সমাজ কামনা করতে পারি।
মিটিং শেষ করে অফিসের গাড়ীতে বাসায় ফিরছিল ওরা। এখন ওদের কারো ব্যাক্তিগত গাড়ি কেনা হয়নি। পান্নাকে এজন্য শত শত কৈফিয়ত দিতে হয়েছে কামালের।
হোন্ডার পিছনে চড়ে বেড়াতে পান্নার নাকি খুব খারাপ লাগে। চার বছর হলো কামাল চাকরি করে কিন্তু স্ত্রীর মনমত কিছু করতে পারেনি। তাই পান্না একদিন বলে, তুমি অতবড় একটা ফার্মে চাকরী করো অথচ একটা কার কিনতে পারলেনা ওদিকে আমার বান্ধবী ও বড় আপারা প্রতি বছর নুতন মডেলের গাড়ি কিনছে। মার্কেটিং করতে আসছে নিজের গাড়িতে আর আমি কিনা মোটর সাইকেলে এবং রিকসায়। আমার পেস্টিস বলতে আর কিছু রইল না।
কামাল শত চেষ্টা করেও তাকে বুঝাতে পারেনি যে সকলের জীবনে সমান সুযোগ আসেনা। তাছাড়া অসৎ পথের আয় কোন ক্রমেই মানব জীবনের কল্যান কর নয়। তাই অন্যের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললে নিজের ঘরের সুখ টুকু বিলীন হয়ে যায়। সত্যিকরেই কামালের ঘর সুখ বিলীন হয়ে যাচ্ছিল পান্নার আচরণে। চার বছরের বিবাহিত জীবনে যেন তার চারটি বিষাক্ত স্মৃতি হয়ে আছে।
কারণ পান্নার কথায় সে চলতে পারে নাই বলে কামালকে কাপুরুষ, ভিরু, স্বার্থপর বিভিন্ন ধরনের গাল মন্দ শুনতে হয়েছে। প্রায়শঃই স্বামী স্ত্রী ঝগড়া হয়েছে পান্নার স্ট্যাটাচ অভিজাত্য ও স্বাধীনভাবে চলা ফেরার বিষয় নিয়ে। সে আরো বলেছে, ‘আই ওয়ান্ট মাই ফ্রিডম। মাই বয় ফ্রেন্ড হ্যাজ গান টু স্কার্শন, ওকে আই উইল গো উইথ হিম’। আরো অনেক অনেক কথা আজ তার মনে পড়ছে। কামাল বিগত দিনের চিন্তায় বিভোর সে টেরই পায়নি গাড়ীটি কখন তার বাসার গেটে এসে দাঁড়িয়েছে। শরাফত তার গায়ে হাত বুলাল কিরে নামবি না? কথা শুনে সে চমকে উঠল।
শরাফত বলে উঠল চল আমিও নামব অনেকদিন হ্েচছ খালাম্মাার সাথে দেখা হয় না। একটু দেখা করে যাই।
বাসায় ফিরে ঘরে তাকাতেই সে অবাক। বসার ঘরের দরজা থেকে সে শুনতে পেল ভরাট গলার আওয়াজ ভেসে আসছে। সারাবাড়ি যেন গমগম করছে। কারণ গ্রাম থেকে এসেছে মারুফ চাচা। তার বিশাল ভুড়িটার উপর বসে আছে তার মেয়ে শিউলী।
কামাল তার গলা শুনেই ছোট ছেলের মত চেচিয়ে একটা দৌড় দিল। চাচা চাচা আপনি কখন এসেছেন। ইস্ আপনাকে অনেক দিন হলো দেখিনা। বড়ই খারাপ লাগছে চাচা ইদানিং। তাই আপনাকে মনে মনে কামনা করছিলাম।
Ñ তা কই বাপ একটা চিঠিওতো দিলে না।
-- দিব দিব করছি চাচা। তা এসেই যদি গেছেন অতো সহজে আপনাকে ছাড়ছিনা এবার।
-- ঠিক আছে আমিও তোমার মেয়েকে ছেড়ে সহজে যাচ্ছি না। না দিদিমনি। কামাল তোমার সাথে শরাফত না।
-- জী চাচা। আয় আয় তোরা বস আমার কাছে। মারুফ চাচাকে পেয়ে কামালের যেন মনটা অনেক হালকা হয়ে গেছে। মারুফ চাচা আব্বার ছোট বেলার বন্ধু। ছোট বেলা থেকেই উভয়ে এক সাথে কাটিয়েছে। মারুফ চাচা একজন একনিষ্ঠ দয়ালু ও কৃতজ্ঞ বন্ধু ছিলেন আব্বার। সে একজন জেলা পুলিশ কর্মকর্তা ছিলেন। ইদানিং সে অবসর নিয়েছেন।
পিতার মৃত্যুতে তার এই চাচাকে দিয়েই তার অভাব টুকু পুরণ করে কামাল। একটু অসুবিধা হলেই সে এই চাচাকে স্মরণ করে বসত।
-- তা চাচা আপনার কেমন যাচ্ছে দিন?
-- আরে, আমি একটা অয়েল মিল করেছি। বুঝলেÑ? গ্রামের বেকার লোকদের এনে চাকরি দিয়েছি। আবার একটা জমি রাস্তার ধারে নিয়েছি, সেখানে স্কুল করব। তার পাশেই একটা দাতব্য চিকিৎসালয় করেছি। সেখানে শুধু ভর্তি ফি দু’টাকা নিয়ে বিনে পয়সায় চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছি। কয়েকটি ঔষধ কোম্পানীর সাথে আলোচনা করেছি তারা আমার এই চিকিৎসালয়ে সাহায্য করতে চেয়েছে। এভাবেই এখন দিন যাচেছ আর কি?
তা স্কুলের কাজেই এসেছি ঢাকায়, তাই ভাবলাম কামালদেরকে সাক্ষাত দিয়ে যাই। তা তোর এই পুচকি দারোগাটার হাতে বন্দী হয়েছি। বলতো এখন যাই কি করে? শিউলীর দিকে লক্ষ্য করে উনি হো হো করে হেসে উঠলেন।
-- ও দাদু তোমাকে যেত দিব না।
-- আচ্ছা তুমি যেতে দেবে না।
-- না তুমি আমাদের ঘরে থাকবে গল্প বলবে। তাই না আব্বু?
-- জী মা তোমার দাদুকে যেতে দিও না।
-- আচ্ছা দেব না। ও দাদু তুমি একটা গল্প বলনা। এই বলে দাদুর কোলে আরো ভাল করে বসল।
-- আম্মু তুমি দুষ্টুমী করনা তোমার দাদু ব্যাথা পাবে।
-- কামাল তোমরা হাত ধুয়ে আস। এক সঙ্গে আমরা আহার করি আজ।
-- শরাফতকে দেখে কামালের মা রান্না ঘর থেকে বেরিয়ে এল। শরাফত তোমরা কিন্তু আজ অবশ্য এক সঙ্গে খাবে। বাসায় ফোন করে দাও যেন তোমার জন্য ওরা অপেক্ষা না করে। আর তোমার আম্মা ভাল তো?
-- জী খালাম্মা। আপনার শরীর এখন কেমন?
-- আছি এক রকম দয়াময়ের ইচ্ছায়। যাও বাবা হাত মুখ ধুয়ে এসো।
কামালের বিয়ের পর অনেক কিছুই বদলে গিয়েছিল তার জীবনে। শরাফতের কিছুই করার ছিল না। অসহায় ভাবে তাদের দাম্পত্য জীবনের নাটকটি শুধু দেখে গেছে। কিন্তু যখন থেকে পান্না চলে গেছে এ সংসার থেকে তখন থেকেই কামাল বেশি কথা বলেনা। একটু নিরবে থাকার চেষ্টা করে। তার জীবনটা বড়ই এলো মেলো হয়ে গেছে যেন।
এমন সময় কামাল শরাফতের গায়ে হাত দিল, চলরেÑ আমার বড্ড ক্ষিদে পেয়েছে।
-- হা তুই গিয়ে বস আমি এখনই আসছি, বলে শরাফত তার মাকে ফোন করে জানিয়ে দিল। পরে বাথরুমে গেল হাত মুখ ধুতে।
খাওয়া শেষে শরাফত অনেকক্ষণ গল্প করে চলে গেল। কামাল ও মারুফ চাচা তারপরেও অনেক কথা বললো। যে মেয়েটি কামালের সাথে রংপুর থেকে এসেছে তার সমস্ত ঘটনা তাঁকে বলল।
-- ওকি সত্যিই কোন কিছু বলতে পারে না, মারুফ সাহেব জিজ্ঞেস করল? নাকি ওর এটা অভিনয়।
-- আমরা তো বুঝতে পারছি না চাচা। আর ওর অভিনয় করেই বা কি লাভ।
-- ভাইজান আপনি পুলিশে ছিলেন শুনে ও কেমন যেন জড়সড় হয়েগেছে। যে শিউলীকে এত ভালবাসে সে কথা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। আর শিউলী ওকে ছাড়া আর কিছুই বোঝেনা। অথচ আপনাকে দেখে সে শিউলীর জন্য একবারও বের হয়নি।
-- ঠিক আছে। তোমরা তো প্রায় একমাস রাখলে। এর ভিতর ওর কোন খোঁজ খবর নেই। খবরের কাগজেও কোন খবর নেই। তোমরা পুলিশকেও জানাওনি। এটা কিন্তু বিরাট ভুল করে ফেলেছো। শেষে তোমাদের বিপদ হয়ে যেতে পারে।
-- তাহলে কি করবো চাচা এখন? ওদিকে আবার এমন ভাবে গেড়ে বসেছে যেন বাড়ির মেয়ে। আম্মা তো এসবে কিছুই করতে দিচ্ছে না।
-- ওর চেহারাটা দেখে খুব মায়া লাগে মারুফ ভাই। যদি আমার মেয়ে হতো তাহলে কি করতাম। তাই কি করে ওকে আমি পুলিশের হাতে তুলে দেই বলুন।
-- আমি মাঝে মাঝে অনুধাবন করি, মেয়েটির বড়ই কষ্ঠ হয়। মনে হয় সে মাঝে মঝে স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করে কিন্তু সে কেন যেন মুষড়ে যায়।
-- আচ্ছা ঠিক আছেÑ বিষয়টি আমি ভেবে দেখব।
-- কথা শেষে সকলেই উঠে গেল। মারুফ চাচাও ঘুমাতে গেল। কামাল বিছানায় গিয়ে হাত দিতেই শিউলী উঠে বসলো। তার গলাটা জড়িয়ে ধরল।
-- কি আম্মু তুমি এখনও ঘুমাওনি কেন?
-- কেমন করে ঘুমাবো আব্বু। আন্টি যে পুলিশ দাদাকে ভয় করে। সে যে আমার কাছে আসে না। গান গায় না। জানো আব্বু আন্টি না খুব ভাল, আমাকে খাইয়ে দেয়, কোলে নেয়, চুমু দেয়, ফুলের মালা দেয়, বাগানে নিয়ে খেলা করে। আব্বু আজকে কথা বলে না কেন?
-- হায়রে অবোধ শিশু, তুই এই পৃথিবীকে চিনিস না। এ পৃথিবী বড়ই নিষ্ঠুর। পৃথিবীর মানুষগুলি বড়ই নির্মম। জগদ্দল পাথর। শুধু শুধু ভালোবাসার কোন কিছুই ধরে রাখা যায় না। নিষ্ঠুর নিষ্ঠুর এ পৃথিবী মাÑ কামাল গভীর দুঃখের সাথে কথাগুলো মনে মনে ভাবল।

(আট)
হঠাৎ একদিন কামালের দেশের বাড়ি থেকে তার মামাতো বোন নাজমা এল বেড়াতে। সেদিন ছিল ঝলমলে সকাল। কোলে তার ফুটফুটে একটা মেয়ে। নাম মুনমুন। সে দেখতে বড়ই ফুটফুটে। সকালে এসেই রাজ্যের কথা বলে ফেলল। তার মেয়ের প্রশাংসা করতে লাগল। তার মেয়ের জন্ম দিন উপলক্ষে অনুষ্ঠান করবে। অনুষ্ঠানের জন্য সকলের দাওয়াত দিতে এসেছে। অনুষ্ঠানে বিশাল আয়োজন করবে। স্বামী একজন বিরাট ব্যাসায়ী। অতএব টাকার অভাব নেই। অনুষ্ঠান জাকজমকের ব্যবস্থা অবশ্যই হবে। নিজের মনের খেয়ালে একটানা কত সে কথা বলে চলেছে।
কিছুক্ষণ পর সে রান্না ঘরের দিকে চলে গেল। রান্না ঘরে গিয়ে সে চেচিয়ে উঠল, এই তুমি রুবিনা না?
ওমা এখানে তুমি লুকিয়ে আছো কেন? কি ফুফু আম্মা, রুবিনা আমার সাথে কথা বলছে না কেন? নিশ্চয় আমাকে দেখে অহংকার করছে। বাব্বা, তাহলে আমি আর এখানে থাকব না। আমাকে দেখে এরা হিংসা করছে।
মাহমুদা দৌড়ে এসে বললেন, আরে না ও রুবিনা হতে যাবে কেন? ওযে আমাদের আত্মীয়, একটা কাজে এসেছে এখানে। কয়দিন এখানেই থাকবে। ওর নাম বেনু।
-- ও তাই বুঝি। কিন্তু রুবিনার মতই যে চেহারা। তাই না ফুফু আম্মা।
-- হা তা যা বলেছ। একেবারে বদল করা যায়।
-- তা আসো না ভাই একটু গল্প করি। তুমি থাকতে কথা বলার লোক পাচ্ছি না যে। তোমার সাথে কথা না বললে এখানে যে সমজুটি আর কেউ নেই। তা ওখানে রুমে গিয়ে বসি।
বেনু পড়ে গেল বিপদে। এখন তার সাথে কি গল্প করবে। আর কি বা পরিচয় দিবে। তার কপালে ঘামের দানা ফুটে উঠল।
তার হাতে আলুর চপ। সে চপ ভাঁজছিল। তাই আমতা আমতা করে বলে উঠল আমি আমি একটু পরে।
-- আরে রাখো ওসব কাজের অজুহাত। কোথা থেকে এসেছো তুমি? ঝাউ তলা না জাম তলা, না বড় মামাদের কেউ?
বেনুর মাথা ঘুরছে। একি জ্বালা এখন কি বলি? কঠিন সমস্যায় ফেলল দেখি। আর কিইবা উত্তর দিব এই রসিক মানুষ টিকে। ঠিক এই সময় ঘর থেকে বেড়িয়ে এল কামাল। বেনুর অবস্থা দেখে সে আঁতকে উঠল। বেনুর চোখে চোখ পড়তেই বুঝতে পারল তার বোনটি বেনুকে নাজেহাল করে ছাড়ছে। সে যেন বাঁচার জন্য সাহায্য খুঁজছে। তাই কামাল একটা অজুহাতে বলে ফেলল, বেনু তুমি আমার ব্যাগটা একটু গুছিয়ে দাওতো। আর শিউলী কোথায় ওকে একটু ডাকো ও যেন ধুলোবালি গায়ে না জড়ায়।
বেনু যেন স্বস্তি ফিরে পেল। তাই যাচ্ছি বলে দে দৌড়।
তখন কামাল সুযোগ বুঝে নাজমাকে বলল কিরে তা তুই একাই যে এলি। তোর স্বামীকে আনতে পারিসনি। অনেক দিন হলো তো দেখা হয় না। দু’জনে একসাথে আসতিস। শোন তুই কিন্তু আজ থাকছিস।
-- না ভাইজান আমি বিকেলেই চলে যাবো।
-- তুমি তো একদিনও যাওনা। আমি ফুফুকে অনেক দিন হল দেখিনা তাই চলে এলাম। অপর দিকে আগামীতে জন্ম দিনের কথাটা ফুফুকে বলতে এলাম। ভাই ঐদিন কিন্তু সকলে যাবেন। না গেলে কিন্তু আমি গলায় দড়ি দিব।
-- ধ্যাত পাগলি গলায় দড়ি দিবি কেন?
-- তোমরা না গেলে তা হলে আমার কে আছে যে যাবে?
-- আচ্ছা আচ্ছা ঠিক আছে। যাওয়া যাবে সেদিন আসুক তো আগে।
দুপুরে গাড়ি এলো নাজমার। সে ফুফুকে বলল আপনারা কেউ যেতে ভূলবেন না।আমি এখন যাই। বাসায় অনেক কাজ আছে। ফুফু আম্মা ঐ বেনুকে অবশ্যই সাথেই নিয়ে যাবে কিন্তু।
-- কামাল ভাই তুমিও কিন্তু অবশ্যই যাবে। ভাই ওই মেয়েটি যা সুন্দর আমার কি হিংসে হচ্ছে। আমি কেন আতো সুন্দর হলাম না। ইসঃ কি চুল! কি চোখের চাহনি! ঠোটে যেন মিষ্টি ভরা! তাই না ভাই?
কামাল নাজমার কথায় হতবাক বনে গেল, সে তো বেনুর দিকে কোন দিন তাকিয়ে দেখেনি। আর এই টুকু সময়ের মধ্যে নাজমা এতসব অবলোকন করেছে। সাংঘাতিক পাকা মেয়ে দেখি।
-- তা হলে তো শিউলী মা মনির কথাই ঠিক।
-- আন্টি খুব ভালো। খুব সুন্দর আব্বু।
-- সত্যি কি তাই!
-- কই এসব কথা তো কখনো অন্তরে নাড়া দেয়নি।
-- সে যেন চমকে উঠল। একটু আগেই কামাল বেনুর দিকে এক পলক তাকিয়ে দেখেছে। কি স্নিগ্ধ নির্মল ঐ চোখ দুটো। তাকে দেখে বুকের মধ্যে যেন কি একটা হঠাৎ ওলটপালট হয়েগেছে তার। কথা তো করোই মিথ্যে নয়।
না না সে হয় না। মনের ভিতর এমন কিছু দানা বাঁধতে দেয়া যায় না। পুরো ব্যাপারটাই একটা ভুল মাত্র। যেদিন এই মেয়েটি তার সব কিছু স্মৃতিচারণ করতে পারবে, সেদিন হয়ত এই গল্পের যবানিকা ঘটবে।
বেনুর স্বপ্ন ছিল নিজকে ভালভাবে গড়িয়ে নিবে, কিন্তু সে স্বপ্ন তার ভেঙ্গে গেছে। তার জীবনের কোন রহস্যময় ছবি নয় যে সে কল্পনা করে অনেক কিছু, কিন্তু কিছুই বুঝতে পারে না। শুধু অনুভব করে তার জীবনের চারদিকে আঁধারে ঘেরা। তার উপরে মেঘের ছায়া। ছোট বেলায় তার মা মারা গেছে। তারপর আব্বা সংসারে নিয়ে এলেন ছোট মাকে। আব্বার মুখের হাসি যেন তার চোখে ভেসে উঠছে। কিন্তু তার মাঝে ভেসে আসে দুটো হিংস্রদানবের চোখ। তাদের ভাষ্য তোমার আব্বা মারা গেছেন। তাই তোমার সব সম্পত্তির দেখাশুনার ভার এখন আমাদের। তারপর সে ঘুমের মধ্যে হঠাৎ ছটফট করে উঠে। হা সে চেষ্টা অনেক করেছে লোকগুলোকে চিনতে। ওরা বলেছিল ঐ যে কালো লোকটা তোমার স্বামী। ওকে তুমি স্বামী হিসেবে গ্রহণ করো। নইলে নইলে---
হা তারা ঘরে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল বেনুর শোবার ঘরে। কিন্তু বেনু মারা যায়নি। প্রতিবেশীরা জানালা ভেঙ্গে তাকে উদ্দার করেছে। তখন সেই শয়তানেরা বলেছিল, কই অন্য ঘরে তো আগুন ধরে নি। আর ওর ঘরে কেনই বা আগুন ধরবে। আসলে ওর মাথায় দোষ আছে। নিজেই আগুন ধরিয়ে দিয়েছে ঘরে।
বেনু ঘুমের ঘোরে স্বপ্ন দেখছে। তার বিপদ আর কাটছেনা। সে নদীর পার দিয়ে হাঁটছে পা পিছলে যেন সেই নদীতে পরে যাচ্ছে। কুলে আবার এক লোক তাকে যেন খপ করে ধরে বাঁচানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু তাকে উপরে উঠাতে পারছেনা। সে যেন চিৎকার করে ডাকছে আমাকে একটু ভাল করে ধরে তুলুন, আমি যে মরে যাচ্ছি। আচমকা সে চেতন হয়ে যায়। তার শরীরটা যেন হাপাচ্ছে এবং অস্থিরতায় ঘেমে গেছে শরীর।
তাড়াতাড়ি উঠে ঘরের বাহিরে এসে দেখে রোদ উঠেছে। রহিমা কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে দাড়িয়ে শিউলীকে দেখছে। কি ব্যাপার চোখ মুখ বস্যা গেছে ক্যান? দেহি দেহি, আরে গায়ে যে ভীষণ জ্বর গো। আম্মারে ডাক দেই।
Ñ না না বুয়া আম্মাকে ডেকো না। আমার কিছু হয়নি। এমনিতেই ঠিক হয়ে যাবে আমার।
কামাল তার মেয়েকে নিয়ে রাস্তায় বেরিয়েছিল। সে প্রায়ই সকালে রাস্তায় যায়। মাহমুদা বেগমকেও নিয়ে যান সঙ্গে। শিউলী রাস্তায় দৌড়াতে ছিল। হঠাৎ পড়ে গিয়ে পা কেটে ফেলল।
পা দিয়ে রক্ত ঝরতে লাগল। শিউলী ব্যাথায় ককিয়ে উঠল। সে রক্ত দেখে ভয় পেয়ে গেল। তাড়াতাড়ি কামাল তাঁকে নিয়ে বাড়ি এল। বেনুর চোখে পড়ে গেল ওদের দৌড়াদৌড়ি। কামাল ডাক্তারের নিকট যাওয়ার জন্য তৈরী হলো।
কিন্তু বেনু দৌড়ে এসে শিউলীকে কোলে তুলে নিল। কি ভাবে কাটল, কোথায় কাটল? স্যাভলন নিয়ে আসো। বুয়া গরম পানি নিয়ে আসো। সে স্যাভলন ও পানি দিয়ে ধুয়ে দিল। মলম দিয়ে পট্টি বেঁধে দিল রক্ত বন্ধ হয়ে গেল। শিউলী যেন স্বাভাবিক হয়ে গেল। বেনু বলতে লাগল ডাক্তারকে বলে ইনজেকশনের একটা ব্যাবস্থা নিতে।
কামাল বেনুর এতগুলো কথা শুনে এবং তার দায়িত্ব বোধ দেখে চমকে গেল। একি মাতৃত্বের বন্ধন না নারীর দায়িত্ব না নিছক একটি অভিনয়। সে যেন অংক মিলাতে পারছিল না।
বিকালে শিউলী স্বাভাবিক ভাবে চলাফেরা করছে। কিন্তু বেনু তাকে ছেড়ে দিচ্ছে না। সর্বক্ষণ আগলিয়ে রাখছে। সন্ধ্যায় শিউলীকে ঘুমিয়ে দিয়ে কামালের কক্ষ হতে বেনু চলে যাচ্ছিল।
এমন সময় কামাল ঘরে প্রবেশ করল। কামাল বেনুকে বলল, বেনু তুমি লেখাপড়া কোন পর্যন্ত করেছো।
-- করেছি এই আর কি।
-- মনে করতে পারছো না।
-- মনে পরছে না। শুধু আব্বার চাকরী করার কথাটাই মনে পড়ে। আর কিছু বলতে পারে না। কিন্তু বলার জন্য কামালের দিকে চেয়ে থাকে। কিন্তু শরীরটা তার কাঁপতে থাকে।
কামাল তাকে শিউলীর সেবা করার জন্য একটু কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে চেয়েছিল। কিন্তু বেনুর কষ্ট হোক তাই তাকে চলে যেতে বলে। কামাল বেনুকে নিয়ে একটু ভাবতে থাকে।
-- কামাল, বাবা কামাল, তুই ঘুমিয়েছিস?
-- না আম্মা বসে আছি। কেন কিছু বলবে?
-- হ্যা, তোর খালা আম্মাকে কোন পত্র লিখেছিস কি?
-- না আম্মা লিখব লিখব করছি। তা ঝামেলা তো শেষ হচ্ছে না।
-- এই তোর মারুফ চাচার পত্র। দেখি কি লিখেছে।
“বাবা কামাল তোমার সমস্যার সামাধান পেয়েছি। তোমার কোন ভয় নেই। মেয়েটি একটি বুনিয়াদ বংশের মেয়ে। সে একটা চক্রান্তের শিকার। তার বিশাল সম্পত্তির মালিক সে। সম্পত্তি আত্মসাৎ করার জন্য তাকে একটা চক্রান্তের জালে ফেলেছে। তাই মেয়েটি আত্মরক্ষার জন্য গৃহ হারা হয়েছে। ওকে হেফাজতে রেখ। আমি অচিরেই এর সব তথ্যাদি নিয়ে আসছি। পুলিশকে রিপোর্ট করেছি। অচিরেই ক্রিমানালদের একটা উচিৎ সাজার ব্যবস্থা করে ফেলবো। তুমি এ্যাডভোকেট জমিরুল ইসলামকে এবিষয়ে একটু বলে রাখবে। মেয়েটিকে বিপদ থেকে উদ্ধার করতে হবে। বিষয়টি তোমার মাকেও বলিও।
-- আম্মা চিঠিটা পড়েছো।
-- না কেন রে?
-- চাচা আসছে। এবার বুঝি সমস্যার সমাধান হবে।
-- কেন কি লিখেছে? দেখি দেখি।
-- কামাল পত্রটি মায়ের হাতে তুলে দিল।
-- পত্রটি পড়া হয়ে গেলে মাহমুদা বলল, ভালই হলো বাবা। সমস্যা সমাধান হলেই ভাল।
-- কিন্তু মা ভেবে দেখেছো বেনুর ভাগ্যটা কত ঘটনা বহুল। মা বেনু চলে গেলে শিউলীর কি হবে?
-- হা তাইতো ভাবছি। আচ্ছা দেখা যাক কোন দিকের পানি কোন দিকে যায়। মাহমুদা যেন কামালের ভিতর কিসের আভাস পেলেন।
(চলবে)

( আগের পর্ব দেখার জন্য নিচের লিঙ্কে ক্লিক করুন )
উপন্যাস– আঁধারে শশী (পর্ব-৩)
৪টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

নারী একা কেন হবে চরিত্রহীন।পুরুষ তুমি কেন নিবি না এই বোজার ঋন।

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ রাত ১২:৫৪



আমাদের সমাজে সারাজীবন ধরে মেয়েদেরকেই কেনও ভালো মেয়ে হিসাবে প্রমান করতে হবে! মেয়ে বোলে কি ? নাকি মেয়েরা এই সমাজে অন্য কোন গ্রহ থেকে ভাড়া এসেছে । সব... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুসলিম কি সাহাবায়ে কেরামের (রা.) অনুরূপ মতভেদে লিপ্ত হয়ে পরস্পর যুদ্ধ করবে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪৯




সূরাঃ ৩ আলে-ইমরান, ১০৫ নং আয়াতের অনুবাদ-
১০৫। তোমরা তাদের মত হবে না যারা তাদের নিকট সুস্পষ্ট প্রমাণ আসার পর বিচ্ছিন্ন হয়েছে ও নিজেদের মাঝে মতভেদ সৃষ্টি করেছে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

মসজিদে মসজিদে মোল্লা,ও কমিটি নতুন আইনে চালাচ্ছে সমাজ.

লিখেছেন এম ডি মুসা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সকাল ১০:২৩

গত সপ্তাহে ভোলার জাহানপুর ইউনিয়নের চরফ্যাশন ওমরাবাজ গ্রামের এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। লোকটি নিয়মিত মসজিদে যেত না, মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়েনি, জানা গেল সে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসী ছিল, স্বীকারোক্তিতে সে... ...বাকিটুকু পড়ুন

=সকল বিষাদ পিছনে রেখে হাঁটো পথ=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সকাল ১১:৩৮



©কাজী ফাতেমা ছবি

বিতৃষ্ণায় যদি মন ছেয়ে যায় তোমার কখনো
অথবা রোদ্দুর পুড়া সময়ের আক্রমণে তুমি নাজেহাল
বিষাদ মনে পুষো কখনো অথবা,
বাস্তবতার পেরেশানী মাথায় নিয়ে কখনো পথ চলো,
কিংবা বিরহ ব্যথায় কাতর তুমি, চুপসে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগে বিরোধী মতের কাউকে নীতি মালায় নিলে কি সত্যি আনন্দ পাওয়া যায়।

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:১৮

ব্লগ এমন এক স্থান, যেখানে মতের অমিলের কারণে, চকলেটের কারণে, ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে অনেক তর্কাতর্কি বিতর্ক কাটা কাটি মারামারি মন্তব্যে প্রতিমন্তব্যে আঘাত এগুলো যেনো নিত্য নৈমিত্তিক বিষয়। ব্লগটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×