somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বড়ই গাছের ভুত (অবাস্তব ভুতের বাস্তব কাহিনী)

১৭ ই আগস্ট, ২০১৫ রাত ৮:৫০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

১৯৬৯ সালের অগ্রাহায়ন মাস। ধান কাটা শুরু হয়েছে। বাড়ি বাড়ি নতুন ধানের মাড়াই চলছে। আমাদের বাড়িতেও দুই দাউন* গরু দিয়ে ধানের মলোন* দেয়া হয়েছে। আমার বড় মামা বেড়াতে এসেছেন। আমরা তিন ভাইবোন কাচারী ঘরে পড়তে বসেছি। সন্ধ্যা অনেকক্ষণ হয় পার হয়েছে। চাঁদনী রাত। হঠাৎ আমাদের বাড়ির দক্ষিণ পার্শ্বে চিৎকার চেচামেচির শব্দ-- কে আছো গো, তাড়াতাড়ি আগাও গো, বড়ই গাছের তলে নতুন বউ মরে গেল গো - -- -।

বড় মামা উঠানে বসে বড় ভাইয়ের সাথে গল্প করছিলেন। চিৎকার শুনে মামা আমাদের পড়ার টেবিল থেকে হ্যারিকেন নিয়ে দৌড়ে গেলেন। পিছনে পিছনে আমরাও দৌড়ে গেলাম। গিয়ে দেখি রাস্তায় একটি গরুর গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। রাস্তার পঞ্চাশ হাত পশ্চিম পার্শ্বে ক্ষেতের আইলে বড়ই গাছ। গাছের নিচে নতুন শাড়ি পরিহিতা অল্প বয়স্কা তরুণী চিত হয়ে শুয়ে আছে। হুশ নেই, অচেতন। গাড়োয়ানের সাথে নয়/দশ বছরের একটি মেয়ে আছে। মামা অজ্ঞান মহিলাকে ধরার জন্য বার বার গাড়োয়ানকে অনুরোধ করলেন কিন্তু গাড়োয়ান ধরতে রাজি হলো না। গাড়োয়ান বার বার বলছে আমি তার ভাসুর, আমার ধরা যাবে না।

ভাসুরেরা শত বিপদেও ছোট ভাইয়ের বউয়ের গায়ে হাত দিতে পারবে না এমন নিয়ম অত্র এলাকায় চালু থাকায় লোকটি চিৎকার চেচামেচি করলেও মরানাপন্ন ছোট ভাইয়ের বউয়ের গায়ে হাত দেয়নি। বর্তমান ভাসুরেরা কি করবে জানিনা? তবে এলাকার আঞ্চলিক নিয়ম মেনে গাড়োয়ানের দাঁড়িয়ে থাকাটা সামাজিক নিয়মের প্রতি শ্রদ্ধাবোধই বলা চলে। মামা ভাসুরের বিষয়টি বুঝতে পেরে বাধ্য হয়ে মেয়েটির মাথা ধরে ঝাঁকি দিয়ে জ্ঞান ফিরানোর চেষ্টা করলেন। কিন্তু চেষ্টা করেও জ্ঞান ফিরাতে পারলেন না। মহিলাকে মাঠের মাঝে বড়ই গাছের নিচে রাখাও ঠিন নয়। অগত্যা ভাই এবং মামা মহিলাকে অজ্ঞান অবস্থায় ধরাধরি করে আমাদের বাড়িতে নিয়ে এলেন। বাড়ির ভিতর জল চৌকির উপর শোয়ায়ে মা মাথায় পানি ঢাললেন। কয়েক কলসি পানি ঢাললেও জ্ঞান ফিরে এলো না। মেয়েটির বাপের বাড়ি খুব বেশি দূরে নয়। আমাদের বাড়ি থেকে আধা মাইলের রাস্তা। মেয়ের বাড়িতে খবর পাঠানো হলো। মেয়ের বাবা খবর পেয়ে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলেন। মেয়ের বাবা আসার আগ মূহুর্ত পর্যন্ত উপস্থিত যারা ছিলেন তারা যে যতটুকু টোটকা চিকিৎসা জানে তা প্রয়োগ করেও মেয়ের জ্ঞান ফিরাতে পারল না। মেয়ের বাবা মেয়েকে অজ্ঞান অবস্থায় গরুর গাড়িতে করে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে গেলেন। রাতেই কবিরাজ ডেকে এনে ভুতের চিকিৎসা করালেন। ভুতের নাম আয়তন্নেছা। সহজে ভুত ছাড়তে চায় না। অনেক চেষ্টা তদবীর করার পর ভুত ছাড়তে বাধ্য হলো। ভুত যাতে আর না আসে তার জন্য কবিরাজ সাহেব পানি পড়া, তেল পড়া, তাবিজ-কবজ অনেক কিছু দিলেন। কবিরাজের চিকিৎসায় মেয়েটি এযাত্রা সুস্থ্য হলো।

নববধুর এই অবস্থা দেখে ভাসুর গাড়োয়ান নাইওরী না নিয়েই খালি গাড়ি নিয়ে ফিরে গেল। যাওয়ার সময় আমরা চাঁদনী রাতে সামনের উঠানে বসে গল্প করছিলাম। আমাদের চাকর দুইজন আর কাজের মহিলারা মাড়াই ধান পরিস্কার করছিল। এমন সময় সেই গরুর গাড়ি আর গাড়োয়ানকে দেখে মামা গাড়ি থামিয়ে দিলেন। জিজ্ঞাস করলেন মেয়েটি কেমন করে বড়ই গাছের নিচে পড়ে গেল। ঘটনা সম্পর্কে মেয়ের ভাসুর যা বললেন তা হলো এই, এক মাস হলো মেয়েটির বিয়ে হয়েছে। বিয়ের পর আচার অনুষ্ঠান সব পার হয়েছে। বিয়ের পরে মেয়ে বাপের বাড়ি বেড়াতে এসেছে। নতুন বউ নেয়ার জন্য তার ছোট বোনকে সাথে নিয়ে এসেছে। নিজেদের গরুর গাড়ির নিজেই গাড়োয়ান। বিকাল বেলা নাইওরী নিয়ে যাওয়ার কথা, কিন্তু খাওয়া দাওয়া করে বিদায় নিতে নিতে রাত হয়ে যায়। ছৈয়ের পিছনে ফাঁকা জায়গা শাড়ী কাপড় দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়েছে। ছৈয়ের সামনে ছোট বোন এবং পিছনে নতুন বউ। ছৈয়ের বাইরে ভাসুর গাড়োয়ান হয়ে গরু তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। বড়ই গাছের কাছে আসতেই হঠাৎ গাড়ি ঝাঁকি দিয়ে উঠে। ভাসুর তার ছোট বোনকে গাড়ি ঝাঁকি দেয়ার কারণ জিজ্ঞেস করতেই বলে, ভাবী গাড়ি থেকে লাফ দিয়েছে। বাম দিকে তাকিয়ে দেখে শাড়ীর আঁচল ছড়ানো অবস্থায় নতুন বউ বড়ই গাছের দিকে দৌড়ে যাচ্ছে। গাছের তলে গিয়েই অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায়। এই অবস্থা দেখে সে চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করে।

এই ঘঠনার ঠিক সাতদিন পড়ে আমরা সন্ধ্যার সময় পড়ার ঘরে পড়তে বসেছি। মামাও আমাদের সাথে বসে আছে। এমন সময় বাড়ির দক্ষিণ পার্শ্বে তিন চারটি কণ্ঠে চিৎকার দিয়ে উঠল। কিছু বুঝে উঠতে না পেরে মামা এবং আমাদের বাড়ির দুই চাকর দৌড়ে গেল। গিয়ে দেখে বড়ই গাছের নিচে আবার সেই মহিলা পড়ে আছে। গাড়োয়ান সেই মহিলার ভাসুর। সাথে আরো দুটি মেয়ে। মামা এবং আমাদের বাড়ির চাকর এন্তাজ ভাই ধরাধরি করে মহিলাকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে এলো। জলচৌকির উপর শোয়ায়ে কেউ মাথায় পানি ঢালে, কেউ তেল পড়া দেয়, কেউ নাকে মরা গরুর হাড্ডি আগুনে পুরে ধরে। ইত্যাদি করতে করতে একসময় মেয়ের হুশ হলো। হুশ হওয়ার পরপরই মেয়ের বাড়ি থেকে মেয়ের বাপ মাসহ কয়েকজন চলে এলো। মেয়ের বাপ রাজী হলেও মেয়ের মা মেয়েকে এ অবস্থায় স্বামীর বাড়ি পাঠাতে রাজী হলো না। অগত্যা গরুর গাড়ি আমাদের বাড়ি থেকে নাইওরী ছাড়াই ফেরত গেল।

আজকেও নাইওর নিতে এসেছে ভাসুর এবং সাথে দুইজন মেয়ে। সেদিনের সেই দশ বছরের মেয়েটির সাথে আরও একটি তের চৌদ্দ বছর বয়সের মেয়ে এসেছে। ছৈয়ের ভিতর নতুন বউকে মাঝখানে বসিয়ে সামনে দশ বছরের মেয়ে এবং পিছনে তের চৌদ্দ বছর বয়সের মেয়েটি নতুন বউয়ের চুল ধরে আছে। দুইজনেই সতর্ক যাতে নতুন বউ লাফ দিয়ে গাড়ি থেকে নেমে না যেতে পারে। ঠিক বড়ই গাছের কাছে আসার সাথে সাথে চুল ধরা অবস্থায় নতুন বউ কিভাবে যে লাফ দিয়ে নেমে গেছে মেয়েটি বলতেই পারে না। নামতে গিয়ে যখন গরুর গাড়ি ঝাঁকি খেয়েছে তখন মেয়েরা চিৎকার দিয়ে উঠে, ভাই, বউ গেল, বউ গেল। নতুন বউ এক দৌড়ে বড়ই গাছের নিচে যেতেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায়। পরপর দুইদিন এই ঘটনা ঘটায় বড়ই গাছটি ভুতুরে গাছ হিসাবে পরিচিতি পায়। পরবর্তীতে আয়তন্নেছা ভুতের বড়ই গাছ নাম হয়।

এই ঘটনার পরে ক্ষেতওয়ালা ভয় পেয়ে যায়। গাছ কাটার ইচ্ছা থাকলেও ভুতের ভয়ে আর গাছ কাটেনি। গাছ কাটলে কি জানি যদি ভুতে আবার ক্ষতি করে ফেলে! গাছওয়ালা গাছ না কাটলেও দেশ স্বাধীনের কয়েক বছর পরে বড়ই গাছটি এমনি এমনি মরে যায়।

এই ভুতের আছড়ওয়ালা বউকে শ্বশুর বাড়ির লোকজন আর নিতে আসেনি। কয়েক মাস পরে ডিভোর্স দিয়ে দেয়। ডিভোর্স হওয়ার পর মেয়ের বাবা মেয়েকে অনেক দিন আর বিয়ে দেয়নি। সুস্থ্য হওয়ার পর অন্য জায়গায় বিয়ে দিয়েছে।

ঘটনাটি আমার জীবনের বাস্তব ঘটনা। কয়েক মাস আগে ঘটনাটি মনে পড়তেই গাঁয়ে গিয়ে সেই মহিলার খোঁজখবর নেই। মহিলা এখনও বেঁচে আছেন। সন্তানাদি বড় হয়ে নাতিপুতি হয়েছে। তবে এখন আর সেই ভুতের আঁছড় নেই।

* দাউন = ধান মাড়াই করার জন্য বিশেষ কায়দায় তৈরী যে রশিতে গরুগুলোকে আটকানো হয় সেই রশির নাম দাউন। দুই দাউন অর্থ হলো দুই সারিতে গরু দিয়ে ধান মাড়াই করা। এক সারি গরু সামনে আরেক সারি গরু পিছনে থাকে।
* মলোন = গরু দিয়ে ধান মাড়াই করা।
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই আগস্ট, ২০১৫ রাত ৯:১৪
২৩টি মন্তব্য ২১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতকে জানতে হবে কোথায় তার থামতে হবে

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৪৫


ইন্ডিয়াকে স্বপ্ন দেখানো ব্যাক্তিটি একজন মুসলমান এবং উদার চিন্তার ব্যাক্তি তিনি হলেন এপিজে আবুল কালাম। সেই স্বপ্নের উপর ভর করে দেশটি এত বেপরোয়া হবে কেউ চিন্তা করেনি। উনি দেখিয়েছেন ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×