somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

রম্য রচনা ০ ট্রেনের কামরায় এক রহস্যময় ব্যাগ

১২ ই অক্টোবর, ২০১৫ রাত ৯:৩০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

ঊনিশ শ' আশি সালের ঘটনা। রাত দুইটার দিকে বাহাদুরাবাদ ঘাট থেকে ট্রেন ঢাকার উদ্দেশ্যে ছেড়ে দিল। গভীর রাত হওয়ায় ট্রেনের দুলুনিতে চোখে ঘুমের ভাব চলে আসে। সিটে বসা অবস্থায় কতক্ষণ ঘুমিয়ে ছিলাম বলতে পারবো না। হঠাৎ ঝাকুনি খেয়ে ঘুম ভেঙ্গে গেল। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখি ট্রেন জামাল পুর স্টেশনে এসে থেমেছে। জামাল পুর স্টেশন থেকে ট্রেন ছাড়ার পূর্ব মুহুর্তে দু’জন রেলওয়ে পুলিশ আমাদের কামরায় উঠল। ট্রেন ছাড়ার কিছুক্ষণ পরেই তারা যাত্রীর ব্যাগ তল্লাশি করে অবৈধ জিনিষ পত্র খুঁজতে লাগল। কারো ব্যাগেই কিছু পেল না। আমার সামনের সিটের যাত্রী স্যুট কোট পরা বিশিষ্ট ভদ্রলোক। মনে হয় কোন অফিসের কর্মকর্তা হবেন। তিনি একটা বড় ধরণের দামি ব্যাগ সিটের নিচে ঢুকিয়ে বসে আছেন। পুলিশ সবশেষে সিটের নিচ থেকে সেই ব্যাগটি টেনে বের করল। ব্যাগটি কার? জিজ্ঞেস করতেই সিটে বসে থাকা ভদ্রলোক বলল, ব্যাগ আমার।
-- ব্যাগের ভিতর কি আছে?
-- খারাপ কিছু নাই, তবে ব্যাগ খোলা যাবে না।
-- কেন?
-- সমস্যা আছে
-- কি সমস্যা?
-- সমস্যাটা বলতে পারছি না, যে কারণে খুলতেও পারছি না।
ভদ্রলোক এ কথা বলায় পুলিশের ব্যাগ তল্লাশির আগ্রহ বেড়ে গেল। ব্যাগে ছোট একটি তালা ঝুলানো ছিল। পুলিশ ব্যাগের তালা খোলার জন্য ভদ্রলোককে নির্দেশ দিল। ভদ্রলোক কোন মতেই ব্যাগের তালা খুলতে রাজি হলো না। অবশেষে পুলিশ ব্যাগ তল্লাশী করতে না পেরে ময়মনসিংহ স্টেশনে গাড়ি থামার সাথে সাথে একজন পাহারায় থেকে অন্যজন নেমে গেল। কিছুক্ষণ পর রেলওয়ে পুলিশের হাবিলদারসহ আরো তিনজন পুলিশ এসে হাজির হলো। মোট পাঁচজন পুলিশ দেখে ভদ্রলোকের মুখ শুকিয়ে গেল। ব্যাগের ভিতর কি আছে সেটা দেখার জন্য আমাদেরও আগ্রহ বেড়ে গেল। কিন্তু আমাদের আগ্রহ থাকলেও আমরা কেউ পুলিশের সামনে কোন কথা বললাম না।
স্টেশনে গাড়ি দাঁড়ানো অবস্থায় হাবিলদার কিছুই বলল না। গাড়ি ছেড়ে দেয়ার পর পরই কামরার দুই দরজায় তিনজন পুলিশকে পাহারা দিতে বলে হাবিলদার একজন কনস্টেবল সাথে নিয়ে ভদ্রলোকের কাছে এসে বলল, আপনার ব্যাগটা খোলেন।
-- ভাই ব্যাগটা না খুললে হয় না?
-- কেন, ব্যাগে কি আছে? সবাই ব্যাগ খুলে দেখালো আপনি দেখাবেন না কেন?
ভদ্রলোক মুখটা কাচুমাচু করে বলল, ভাই ব্যাগটায় সমস্যা আছে।
হাবিলদার রাগত স্বরে বলল, এই সব সমস্যা দেখার জন্যই সরকার আমাদের নিয়োগ দিয়েছে। আপনি যদি স্বেচ্ছায় ব্যাগ না খোলেন তবে বাধ্য হবো ব্যাগসহ আপনাকে থানায় নিয়ে যেতে। আমি এই লাইনে দীর্ঘদিন হলো আছি। প্রতি মাসেই অবৈধ অস্ত্রসস্ত্রসহ স্ম্যাগলিং অনেক কিছু ধরে থাকি। কাজেই আপনাকে আমরা সহজেই ছাড়ছি না। আপনার ব্যাগে যদি অবৈধ কিছু না থাকে তবে এতো পীড়াপীড়ি করা সত্বেও আপনি ব্যাগ খুলছেন না কেন? আমাদের আর বুঝতে বাকি নাই, আপনার ব্যাগে কি আছে। এ কথা বলেই হাবিলদার কনস্ট্যাবলদের আদেশ দিল, এই সব দরজা-জানালা বন্ধ করে দাও।
কনস্টেবলরা সাথে সাথে কামরার দরজা-জানালা বন্ধ করে দিল। হাবিলদার মেজাজ গরম করে ধমক দিয়ে বলল, এবার ব্যাগ খোলেন, নইলে অসুবিধায় পড়বেন।
হবিলদারের গরম মেজাজ হুমকি-ধমকি আর থানার কথা বলায় ভদ্রলোক কিছুটা ভরকে গিয়ে অনিচ্ছা সত্বেও পকেট থেকে চাবি বের করে হাবিলদারের হাতে দিল। হাবিলদার চাবি নিয়ে বলল, এবার আপনি ব্যাগটা খোলেন।
ভদ্রলোক বলল, আপনার যখন দেখার এতো আগ্রহ তখন আপনিই খোলেন। আমার পক্ষ থেকে কোন আপত্তি নাই।
হাবিলদার চাবি দিয়ে তালা খুলে চেইন টান দিয়ে ব্যাগের মুখ হা করাতেই ব্যাগের ভিতর আরেকটি কাপরের ব্যাগ চোখে পড়ল। ভিতরের ব্যাগটির মুখ রসি দিয়ে ভালো করে বাঁধা।
হাবিলদার ব্যাগের ভিতরে ব্যাগ দেখে অবৈধ কোন জিনিষ পত্র আছে মনে করে খুব খুশি হলো। মনে মনে ভাবল, এবার হয়তো একজন ক্যুখ্যাত আসামী পাওয়া গেছে। একে ধরিয়ে দিতে পারলে উপরওয়ালার কাছে সুনাম পাওয়া যাবে। পুলিশী কায়দায় ধমকের সুরে ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করল, ভিতরের ব্যাগে কি আছে?
ভদ্রলোক বলল, ভাই আপনি নিজ হাতে খুলে চেক করে দেখেন কি আছে?
হাবিলদার তাড়াতাড়ি খুব আগ্রহ নিয়ে ব্যাগের মুখ খুলে ভিতরে হাত দিয়ে মুখটা মলিন করে বলল, এগুলো কি নিয়েছেন?
ভদ্রলোক বলল, আপনি তো নিজেই হাত দিয়ে দেখতে পাচ্ছেন, আমাকে আর মুখে বলতে বলছেন কেন?
হাবিলদার রাগত স্বরে বলল, এটা আমাদের আগে বললেই তো হতো।
ভদ্রলোক বলল, আপনি যে ভাবে ভয়ভীতি দেখালেন তাতে তো বলার সুযোগই পেলাম না।
হাবিলদার সুর কিছুটা নরম করে বলল, এগুলো কেন নিয়েছেন?
ভদ্রলোক জবাবে বলল, আমার ছোট বোন ঢাকায় নতুন বাসা নিয়েছে, সে মায়ের কাছে চিঠি লিখেছে ঢাকা শহরে সব পাওয়া যায় শুধু এটাই নাকি খুব অভাব। তাই অন্য কিছু বাদ দিয়ে ব্যাগ ভর্তি করে এগুলো নিতে বলেছে। তাই নিয়ে যাচ্ছি।
এবার হাবিলদার মুখটা কালো করে ব্যাগের ভিতরেই হাত পরিস্কার করতে লাগল। হাবিলদারের এ অবস্থা দেখে আমি একটু আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ভাই ব্যাগের ভিতর কি জিনিষ?
হাবিলদার বিরক্ত ভাবেই জবাব দিল, অবৈধ কিছু নয়, তবে বলা যাবে না। বলেই সে ব্যাগ থেকে হাত বের করে কিছুটা লজ্জা কিছুটা বিরক্ত হয়ে যে পুলিশটা ডেকে এনেছিল তাকে বকাবকি করতে করতে দরজার দিকে চলে গেল। তার হাতের দিকে লক্ষ্য করে দেখলাম কালো কালো পাউডারের মত কি যেন পাঁচ আঙুলে লেগে আছে।
একটু পরেই গাড়ি গফরগাঁও স্টেশনে থামলে সব পুলিশ নেমে গেল।
কামরার যাত্রীরা পুলিশ এবং ভদ্রলোকের এসব ঘটনা আগ্রহসহ দেখতে ছিল। কিন্তু কেউ কোন কথা বলার সাহস পেল না। পুরো কামরা নিরব নিস্তব্ধ হয়ে আছে। আমি নিরবতা ভঙ্গ করে ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করলাম, ভাই, মনে কিছু করবেন না, সত্যি করে বলেন তো, ব্যাগের ভিতর কি নিয়েছেন?
ভদ্রলোক বিরক্ত হয়ে বলল, আরে ভাই আপনিও তো দেখি পুলিশের মত পাগোল হলেন। কি নিয়েছি পুলিশ যখন বলল না তখন আপনার শোনার এতো আগ্রহ কেন? বলেই ব্যাগের উপর খুলে রাখা রসি হাতে নিয়ে ভিতরের ব্যাগের মুখ দুই হাতে চেপে ধরতেই ভক্ করে কিছু ছাই উড়ে এসে আমার এবং আমার পাশের যাত্রীর চোখে মুখে ঢুকে গেলো।
চোখ কচলাতে কচলাতে বললাম, আরে ভাই করেন কি, ছাই উড়াচ্ছেন কেন?
ভদ্রলোক মুখটা বাঁকা করে বলল, আরে ভাই ব্যাগের ভিতর আছে ছাই, ছাই উড়াবো না তো টেলকম পাউডার উড়াবো!
আমি ভদ্রলোকের কথা শুনে হাসি হাসি মুখে জিজ্ঞেস করলাম, ভাই মনে কিছু করবেন না, এতো সুন্দর ব্যাগের মধ্যে ছাই ঢুকালেন কি করতে?
ভদ্রলোক ব্যাগের মুখ বাঁধতে বাঁধতে বিরক্ত ভাবে বলল, আরে ভাই বললাম তো, ছোট বোনটা চিঠি লিখেছে ঢাকা শহরে সব পাওয়া যায় কিন্তু থালা বাসন মাজার জন্য নাকি ছাই পাওয়া যায় না, তাই সব বাদ দিয়ে ব্যাগ ভর্তি ছাই নিতে বলেছে। সেই জন্য ব্যাগ ভর্তি ছাই নিয়েছি। শ্যালার পুলিশ এইটা দেখার জন্য পাগোল হয়ে গেলো। দেখে তো নিজেও আহম্মক হলো আমাকেও আহাম্মক বানালো।
ভদ্রলোকের কথা শুনে কামরার সব যাত্রী হো হো করে হেসে উঠল। হাসির ফোয়ারা দেখে ভদ্রলোক লজ্জায় মাথা নিচু করল। ঢাকা স্টেশনে পৌছার পূর্ব মহূর্ত পর্যন্ত তিনি কারো সাথে কোনো কথা বলল না।

০০০ সমাপ্ত ০০০
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই অক্টোবর, ২০১৫ রাত ৮:১০
২৮টি মন্তব্য ২৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছবির গল্প, গল্পের ছবি

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৩:১৫



সজিনা বিক্রি করছে ছোট্ট বিক্রেতা। এতো ছোট বিক্রেতা ও আমাদের ক্যামেরা দেখে যখন আশেপাশের মানুষ জমা হয়েছিল তখন বাচ্চাটি খুবই লজ্জায় পড়ে যায়। পরে আমরা তাকে আর বিরক্ত না করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে লীগ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে জামাত

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৪৬


বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪৩

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

চা বাগানের ছবি কৃতজ্ঞতা: http://www.peakpx.com এর প্রতি।

আমাদের সময় একাডেমিক পড়াশোনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চয়নিকা বইয়ের গল্পগুলো বেশ আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, চাষীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×