somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্প ঃ রোস্তম ফকিরের দেমাগ (পর্ব-০৫)

২৪ শে আগস্ট, ২০১৬ রাত ১০:১০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

এর কিছুদিন পরের ঘটনা, তখন অগ্রহায়ণ মাসের প্রথম দিকে ধান কাটা শুরু হয় নাই, তবে হবে হবে ভাব। রোস্তম ফকির পূর্ব দিকের একটি গ্রামে ভিক্ষা করতে গিয়েছিল। রাস্তা চলতে চলতে হঠাৎ মাথা ঘুরে মুখ থুবরে পড়ে গেল। রাস্তার লোকেরা তাকে পাঁজা করে ধরে এনে বাড়ি পৌছে দিল। রাতে গায়ে জ্বর এলো। সারা রাত অসুস্থ্য অবস্থায় ছটফট করলেও দেখাশুনা করার মতো কোন লোক নেই। সকাল বেলা পাশের বাড়ির আছিয়ার মা কি কারণে যেন রোস্তম ফকিরের ঘরের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। যাওয়ার সময় ঘরের ভিতর থেকে কাতর কণ্ঠে কোকানোর আওয়াজ শুনতে পেল। অবস্থা অবলোকন করার জন্য ঘরে ঢুকে দেখে রোস্তম ফকির প্রচন্ড জ্বরে অস্থির ভাবে ছটফট করছে। তাড়াতাড়ি আছিয়ার মা টিউবওয়েল থেকে এক বালতি পানি এনে মাথা ধুয়ে দিল। এতে সে কিছুটা আরাম বোধ করল। পরে আছিয়ার মা তার ছোট ছেলে কালুকে দিয়ে মজিবর ডাক্তারকে ডেকে এনে ঔষধ পানির ব্যবস্থা করল।
মজিবর ডাক্তার রোস্তম ফকিরের কাছ থেকে কোন ডাক্তারী ফী নিলেন না, শুধু ঔষধের দাম নিয়ে চলে গেলেন। নিয়মিত ঔষধ খাওয়ানোর পরও তার জ্বর কমলো না। তার অবস্থা আস্তে আস্তে খারাপের দিকে গেল। রাতে আছিয়ার মা এসে ঔষধ পানি খাইয়ে গেল। সারা রাত আর কেউ তার খোঁজ খবর নিল না।
সকাল বেলা আছিয়ার মা তার খোঁজ খবর নিতে এসে দেখে সে আর নড়াচড়া করছে না। কপালে হাত দিয়ে দেখে কপাল ঠান্ডা। বুকে হাত দিয়ে দেখে শরীর ঠান্ডা হিম হয়ে আছে। নাকে কোন নিঃশ্বাস নেই। এই অবস্থা দেখে আছিয়ার মা ঘরের বাইরে এসে চিৎকার করে কেঁদে উঠল, কে কোথায় আছো গো তাড়াতাড়ি আসো, রোস্তম ফকির যেন কেমন হয়ে গেছে।
তার ডাক চিৎকারে আশেপাশের লোকজন জড়ো হতে লাগল। অনেকেই ঘরে গিয়ে রোস্তম ফকিরের গা ছুয়ে দেখল, শরীর ঠান্ডা হয়ে আছে, নাকের নিঃশ্বাস পরীক্ষা করল নিশ্বাঃস পেল না, কেউ কেউ নাড়ি ধরে পরখ করে দেখল, নাড়ি চলে না। অবশেষে তারা নিশ্চিত হয়ে বলল, রোস্তম ফকির আর নেই, মারা গেছে।
তিন দিন জ্বরে ভুগে ভোরে ফজরের আজান দেয়ার সাথে সাথে মারা গেছে। মরার সময় তার কাছে কেউ ছিল না। মৃত্যুর সময় কিছু বলার থাকলেও রোস্তম ফকির কাউকে কিছুই বলে যেতে পারে নাই।
রোস্তম ফকিরের মারা যাওয়ার খবর এলাকায় প্রচার হয়ে গেল। একজন দুইজন করতে করতে অনেক মানুষ রোস্তম ফকিরের ঘরের সামনে রাস্তায় জড় হলো। এলাকার লোকজন একত্রিত হয়ে আলোচনা করছে, কিভাবে কাফন-দাফনের ব্যবস্থা করা যায়? তার আত্মীয় স্বজন এখানে কেউ নেই। যাও আছে তা যমুনা নদীর ঐ পাড়ে। তাদের খোঁজ-খবর এপারের লোকজন জানে না। আশেপাশের যারা মাতব্বর শ্রেণীর লোক ছিল তারা সিদ্ধান্ত নিল, সবাই মিলে সামর্থ্য অনুযায়ী সাহায্য সহযোগীতা করে, টাকা-পয়সা, বাঁশ-চাটাই দিয়ে তাড়াতাড়ি রোস্তম ফকিরের লাশ সৎকারের ব্যবস্থা করা দরকার। এর মধ্যে একজন বলে উঠল, যেহেতু ফকির মানুষ, তার কোন টাকা পয়সা নাই, জায়গা জমি আত্মীয় স্বজন কিছুই নাই, কাজেই এলাকার চেয়ারম্যান সাবকে খবর দিলে কেমন হয়? ইউনিয়ন কাউন্সিলের ফান্ড থেকে যদি কিছু টাকা পয়সা বা দাফন-কাপনের ব্যাবস্থা করে, তাহলে তো আমাদের তেমন কোন কষ্ট করতে হয় না। এ কথা শোনার পরে অনেকেই কথাটি গ্রহণ করল। দু’তিন জন চেয়ারম্যানের কাছে যাওয়ার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করল। এলাকার মাতব্বর যারা ছিলেন তারা তাদের সাথে পানাউল্লাহ নামের আরেকজন লোককে সাথে যেতে বলল। পানাউল্লাহর সাথে চেয়ারম্যানের খুব সখ্যতা। তাদের কথায় কাজ না হলেও পানাউল্লার কথা চেয়ারম্যান ফেলতে পারবে না।
সবার কথা মত পানাউল্লাহসহ চারজন লোক চেয়ারম্যানের কাছে চলে গেল। চেয়ারম্যান তাদের আসার কারণ জিজ্ঞাসা করতেই রহীমুদ্দি বলল, চেয়ার ম্যান সাব, রোস্তম ফকির তো মারা গ্যাছে।
চেয়ারম্যান বলল, কখন মারা গ্যাছে?
--- মরার সময় ঘরে তো কেউ ছিল না, মনে হয় ফজরের আজানের পর পরেই মারা গ্যাছে।
--- কি হয়া মরল?
--- জ্বর হইছিল।
--- শালা মরছে না ভাল হইছে। শালা ফকিরের বাচ্চা ফকির খায় ভিক্ষা কইরা, আমার সাথে আবার দেমাগ দ্যাখায়? শালা ফকিরের দেমাগ এহন গেল কই?
চেয়ারম্যানের সাথে সায় দিয়ে আলাল মিয়া বলল, হ-- চেয়ারম্যান সাব, ফকিরের খুব দেমাগ আছিল। ভিক্ষা কইরা খাইছে তয় দেমাগ ছাড়ে নাই।
চেয়ারম্যান সাথে সাথেই উত্তর দিল, হ তুই ঠিকই কইছোস, শালার দারুণ দেমাগ আছিল, এহন শালার দেমাগ গেল কই? যাক গা -- তোমরা রোস্তম ফকিরের কথা বাদ দাও, বলেই রহীমুদ্দির দিকে তাকিয়ে বলল, এই রহীমুদ্দি--- তোমরা এত সকালে কি জন্য আইছো?
রহীমুদ্দি চেয়াম্যানের প্রশ্নে কথার সুযোগ পেয়ে তাড়াতাড়ি বলল, চেয়াম্যান সাব, আইছিলাম রোস্তম ফকিরের ব্যাপারে। ফকির মইরা গেছে তার তো সৎকার করা দরকার?
--- সৎকার করা দরকার করবা। তা আমার কাছে ক্যান আইছো?
--- আইছি ফকিরের ঘরে তো কোন ট্যাকা পয়সা নাই। তার কাফনের কাপড় কেনা লাগবো, লাশ নিয়া তো বইসা থাকা যায় না।
--- ফকিরের ট্যাকা নাই তো লাশ কলাগাছে তুইলা নদীতে ভাসায়া দেও।
--- চেয়ারম্যান সাব, লাশ ভাসায়া দিলে তো আমাগো মাইনষে মানুষ কইরা কইবো না। গ্রামে এতোগুলো মানুষ থাকতে একটা ফকিরের লাশ কাফন-দাফন না কইরা ভাসায়া দেয়া কি ঠিক হইবো?
--- লাশ নদীতে ভাসায়া না দিলে আতর-গোলাপ ফুল-চন্দন দিয়া সৎকারের ব্যবস্থা কইরা ফালাও।
--- ফুল-চন্দন না দিলেও মার্কিন কাপড় দিয়া কোন রকমে কাফনের ব্যবস্থাডা করা দরকার।
চেয়ারম্যান কিছুটা রাগ হয়েই বলল, তা বেশ ভাল কথা, ব্যবস্থা কইরা ফালাও, তা আমার কাছে আইছো ক্যান?
--- আপনার কাছে আইছিলাম চেয়ারম্যান সাব, যদি ইউনিয়ন কাউন্সিল থাইকা কিছু সাহায্য সহযোগীতা করেন, তাইলে ফকিরের লাশ সৎকারের জন্য আমাগোর জন্য সহজ হয়, নইলে গ্রামে গ্রামে হাইটা হাইটা টাকা পয়সা তুইলা, সৎকার করতে অনেক সময়ের ব্যাপার। এতো সময় তো লাশ রাখা ঠিক হইবো না। তাইলে লাশ ফুইলা যাইবো। যতো তাড়াতাড়ি দরকার লাশ দাফন করা ভাল।
--- তা ভাল কথা, তাড়াতাড়ি দাফন করবা না দেরি কইরা করবা তা তোমাগো ব্যাপার। আমি এই ফকিরের আগেও নাই পিছেও নাই। ও আমার অনেক মানসম্মান নষ্ট করছে। অন্য কোন কথা থাকলে হেইডা কও?
এতক্ষণ পানাউল্লাহ চুপচাপ বসে ছিল কোন কথাই বলে নাই। সে ধীর স্থিরভাবে ঠান্ডা মস্তিষ্কে সবসময় কথা বলে এবং অবাঞ্চিত কথা কম বলে। এবার সে আস্তে আস্তে চেয়ারম্যানকে বলল, চেয়ারম্যান সাব, মরা মাইনষের লাশের সাথে রাগ করতে নাই। আপনি যতই রাগারাগি করেন আর মারামারি করেন এসব কথা রোস্তমের লাশ হুনবও না, দেখবও না, রাগও করব না, লজ্জাও পাইবো না। আপনার মন্দ কথায় তার কোন লাভও হইবো না, ক্ষতিও হইবো না। লাশ তো লাশ। বরঞ্চ লাশেরে নিয়া যত গালাগালি করবেন আপনার তত ক্ষতি হইবো। লাশেরে যত লানৎ দিবেন আপনার ঘাড়ে সেই লানৎ উইল্টা চাপব।
চেয়ারম্যান চোখ কপালে তুলে বললেন, আমার আবার কি ক্ষতি হইবো রে, ও বাইচা থাকতে যা ক্ষতি করার কইরা গ্যাছে, এখন মইরা গ্যাছে তারপরেও ক্ষতি করবো? এ শালা মানুষ না আর কিছু আছিল রে? বাইচা থাইকাও ক্ষতি করছে আবার মইরা যায়াও ক্ষতি করবো? মরা লাশ আমার কি ক্ষতি করবো রে? কেমনে করবো রে? ভাল কইরা বুঝায়া ক--?
(--- চলবে ---)

গল্প ঃ রোস্তম ফকিরের দেমাগ (পর্ব-০৪)
গল্প ঃ রোস্তম ফকিরের দেমাগ (পর্ব -০৩)
গল্প ঃ রোস্তম ফকিরের দেমাগ (পর্ব -০২)
গল্প ঃ রোস্তম ফকিরের দেমাগ (পর্ব -০১)
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে আগস্ট, ২০১৬ রাত ১২:৫৫
১০টি মন্তব্য ১০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় পণ্য বয়কটের কেন এই ডাক। একটি সমীক্ষা-অভিমত।।

লিখেছেন সাইয়িদ রফিকুল হক, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৩:১৫



ভারতীয় পণ্য বয়কটের কেন এই ডাক। একটি সমীক্ষা-অভিমত।।
সাইয়িদ রফিকুল হক

বিএনপি ২০২৪ খ্রিস্টাব্দে দেশে অনুষ্ঠিত “দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে”-এ অংশগ্রহণ করেনি। তারা এই নির্বাচনের বহু আগে থেকেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×